আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস
#পর্ব – ৭
লাবণ্যকে কাঁপছে ঠিক মৃগীরোগীর মতো। কোনভাবেই তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না৷ মনে হচ্ছে যেন শরীরে ভর করেছে অন্য কিছু। এ ঠিক চেনা লাবণ্য নয়। এলোমেলো পিঠ ছড়ানো চুলের বেহাল দশা। চোখ টকটকে রক্ত জবা। গলা দিয়ে অদ্ভুত এক আওয়াজ বের হচ্ছে। দুজন নার্স শক্ত করে ধরে আছে তাকে। ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়ার প্রায় মিনিট দশেক পর আলগা হতে শুরু করলো তার হাতের কাঠিন্য। নার্স দুজন ছেড়ে দিতেই এলিয়ে পড়লো বিছানায়৷ এই দিনে গত দুই দিনে তিনবার এমন হলো। লাবণ্যর মা মেয়ের অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন। তার বাবা স্তম্ভিত। চয়ন বাইরে বসে আছে। লাবণ্যর এমন অবস্থা সহ্য হচ্ছে না তার। সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। কেন যে নিয়ে গেল তাকে ওই বাড়িতে! ওখানে না নিয়ে গেলে কিচ্ছু হতো না। কি যে এক ভয়ঙ্কর বিপদে ফেসে গেল! নিজের হাত দুটো দিয়ে চোখ চাপা দিয়ে হাসপাতালের চেয়ারে হেলান দিলো সে৷ মল্লিকার লাশটা প্রথম লাবন্যই দেখেছিলো। চয়ন তখন ছাদে। ঘুমন্ত লাবণ্যকে ঘরে রেখে একটু সময় সময় কাটাতে এসেছিলো। অনিন্দিতার মৃত্যুর যক্কি সামলে রূপম তখন মৃত প্রায়। আর লাবণ্যকে ছেড়ে একা কোথাও যেতে পারছে না বলে থানা পুলিশ সব সামলাচ্ছে প্রত্যয়। মল্লিকা ব্যস্ত ভাইকে নিয়ে। ও বাড়ির বদ্ধ গুমোট আবহাওয়ায় হাপিয়ে উঠেছিলো চয়ন নিজেও। ছাদে ভরা দুপুরের রোদ্দুর সেদিন। তবুও ফাল্গুনী হাওয়া ছিলো। অজানা কিছু ফুলের ঘ্রাণ মাখানো সে বাতাসে কিছুক্ষণের জন্য যেন বুক ভরে শ্বাস নিতে পেরেছিলো সে। তখনই লাবণ্যর কানফাটানো চিৎকার। প্রথমে চয়ন বুঝে উঠতে পারেনি৷ তারপরই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করেছে। ছাদ থেকে নেমে তিনতলায় পা দিতেই আরো অবাক৷ লাবণ্য পড়ে আছে একটা খোলা দরজার সামনে। তখনও চয়ন জানতো না তার জন্য কি অপেক্ষা করছে ওই ঘরের ভেতর। লাবণ্যকে ডাকাডাকি করতে করতেই চোখ গিয়েছিলো ঘরের ভেতর। সেই এক দৃশ্য, অনিন্দিতার মতো। মল্লিকা ঝুলছে কড়িকাঠ থেকে। পরনে বেনারসি। সেই শাড়িটাই কি, যেটা অনিন্দিতা পরেছিলো? চয়নের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানো শুরু করেছিলো। তারই ডাকাডাকিতে রান্নার লোক দুটি ছুটে আসে। খানিক পরে প্রত্যয়। উফ! কি একটা দিন গিয়েছিলো সেদিন। মল্লিকার লাশ দেখে প্রত্যয় সব ভুলে চড়াও হয়েছিলো লাবণ্যর উপর। তার এক কথা, মল্লিকা আত্মহত্যা করেনি৷ তাকে মেরেছে লাবণ্য৷ এখন লোকজন দেখে নিজেকে আড়াল করার জন্য অজ্ঞান হবার ভাব করছে! ভাগ্যিস চয়ন ছিলো, তা না হলে কি যে হত! নিজের বন্ধু এক নিমিষেই অচেনা হয়ে উঠেছিলো তার কাছে। থানার দারোগা যে এসেছিলো, তারও এক কথা! বারবার লাশ গুলো কেন শুধু লাবণ্যই আবিষ্কার করে? নাকি সে নিজেই কোন ভাবে এর থাকে জড়িত? কপাল ভালো যে মল্লিকার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে সুইসাইড এসেছে৷ তা না হলে লাবণ্যকে হয়ত বাঁচানো যেত না পুলিশের হাত থেকে৷ চিন্তাগুলো আসার পর নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো সে। খুব বেশি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন! অনিন্দিতা আর মল্লিকা, জলজ্যান্ত দুটি মেয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে হারিয়ে গেছে চোখের সামনে থেকে, আর সে কিনা শুধু নিজেদের কথা ভাবছে!!
– চয়ন ভাই
ডাক শুনে চয়ন চোখ থেকে হাত সরালো। তাকালো সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। লম্বা, পাতলা, ছিপছিপে শ্যাম বর্ণের মেয়েটির নাম তনিমা। লাবণ্যর বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই স্কুল থেকে দুজনের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। আজ এত বছর পরে এসেও অটুট বন্ধন তাদের। তনিমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো চয়ন৷ এগিয়ে এলো তার দিকে৷ মেয়েটির চোখ ভর্তি জিজ্ঞাসা। চয়নই প্রথম কথা বললো,
– দেখলে ওকে? কি থেকে কি যে হয়ে গেল! কিছুই বুঝতে পারলাম না।
তনিমা শুনলো। কথা বললো না কোন। সে এখনো তাকিয়েই আছে চয়নের দিকে। এক দৃষ্টিতে। কি যে দেখছে! ভিষণ অস্বস্তি লাগছিলো তার। ঠিক এমন অবস্থায় এই ধরনের পুরোনো স্মৃতি আওড়ানো উচিৎ নয় জেনেও চয়নের একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ তখন প্রথম প্রথম লাবন্যর সাথে চয়নের পরিচয় হয়েছে। প্রেমের সবে দু মাস। একদিন বৈকালিক আড্ডায় বসেছিলো লাবণ্য, চয়ন আর তনিমা। এমনই কোন বসন্ত বিকেল ছিলো সেদিন। ক্যাম্পাসের চায়ের দোকান ছিলো তাদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল। কথার ফাঁকে চায়ের অর্ডার দিতে লাবণ্য উঠে যেতেই হঠাৎ তনিমা প্রশ্ন করে বসল,
– আচ্ছা চয়ন ভাই, প্রেম করছেন ঠিক আছে, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন না?
চয়ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ভাবছি তো অনেক কিছুই৷ কিন্তু লাবণ্যর বাবা মা রাজি না হলে?
সাথে সাথে তনিমা চপল কণ্ঠে উত্তর দিলো,
– না হলে আর কি, লাবণ্যর বদলে আমি আপনার গলায় মালা দিয়ে দিব। এমন হ্যান্ডসাম ছেলেকে আমার ফ্যামিলি অন্তত রিজেক্ট করবে না!
চয়ন চকিতে বিমূঢ়। খানিকটা যেন হকচকিয়েও গিয়েছিলো। লাবণ্য আসার সাথে সাথে তনিমা প্রসঙ্গ পাল্টেছে। কথা বলছে অন্য বিষয় নিয়ে। কিন্তু তার এই একটা বাক্য অনেকদিন পর্যন্ত কানে বাজতো চয়নের। লাবণ্য কিছু না বুঝলেও পরে অনেক কাজে, কথায় তনিমা চয়নের প্রতি তার দূর্বলতা দেখিয়েছিলো। সে অবশ্য পাত্তা দেয়নি কখনো। আজ হঠাৎ তনিমার চাহনি দেখে পুরোনো অনুভূতিটি আবার জেগে উঠছিলো তার। তনিমা তার হাত দিয়ে চয়নের হাত ছুঁয়ে দিলো,
– এত চিন্তার কিছু নেই চয়ন ভাই! নিশ্চয় লাবণ্য সুস্থ হয়ে যাবে! ভেতরে আন্টি আংকেল আছেন। আসুন, একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।
চয়ন মাথা ঝাঁকালো। তার নিজেও ভালো লাগছে না হাসপাতালের এই অবস্থা। বড়সড় আধুনিক হাসপাতালের পাঁচতলায় বিশাল খোলা বারান্দা। পুরোটা জুড়ে ফুলের বাগান। দূরে দেখা যাচ্ছে হাইওয়ে। ফাঁকা রাস্তা। মহামারীর ভয়ে লোকজন বাইরে বের হওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সব সময় রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ আর সেনাবাহিনীর লোকজন। দূরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চয়ন বললো,
– সবটা আমার দোষ। আমার কারণেই এমন হলো৷ আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না তনিমা।
– চয়ন ভাই, সামলান নিজেকে৷ ঘটনাটা কি ঘটেছে আমাকে বলুন তো৷ আর আপনি কেন নিজেকে দায়ী ভাবছেন? এখানে আপনার কি করার আছে?
– কারণ ওই বাড়িতে আমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম! ওখানে না গেলে কিচ্ছু হতো না।
– চয়ন ভাই, আমি জানি আপনি ওখানে যেতে চাননি৷ পুরোনো বাড়ির প্রতি লাবন্যর সময়ই একটা ফ্যাসিনেশন কাজ করে। ও যে জোর করে আপনাকে নিয়ে ওই বাড়িতে গিয়েছিলো তা আমার জানা। ওই বাড়িতে আপনারা যেদিন গেলেন, তার আগের রাতে লাবণ্যর সাথে কথা হয়েছিলো আমার। সে যাই হোক, আরেকটা বিষয় হলো, বাড়ির কখনো কোন দোষ থাকে না।
– থাকে তনিমা! তুমি জানো, লাবণ্য আমাকে বলেছিলো, অনিন্দিতা মারা যাবার দিন ও কোন একজনকে দেখেছিলো ওই বাড়িতে৷ একটা মেয়েকে দেখেছিলো।
– এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কোন কথা?
– হয়ত নয়৷ কিন্তু বিশ্বাস না করেও আমি কোন উপায় দেখছি না আর।
– দুটো মৃত্যুই কিন্তু আত্মহত্যা ছিলো, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নাকি তাই বলছে!
– এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য? দুটো হাসিখুশি উচ্ছল মেয়ে বেড়াতে গিয়ে আত্মহত্যা করে বসলো?
একথা বলে নিজেই নিজের মুখ ঢাকলো চয়ন। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। সে গলা নামিয়ে বললো,
– আমি এ কথা জোর দিয়ে কিছু বলতেও চায় না। ব্যাপার যাই হোক না কেন, খুন নিয়ে প্রশ্ন উঠলে লাবন্য ফেসে যাবে। আমি কখনো চাই না তা হোক! তার থেকে বরং যা হয়েছে, হয়তো ভালোই হয়েছে। আমি শুধু চাই, লাবণ্য সুস্থ হয়ে উঠুক। স্বাভাবিক থাকুক।
——————————————————
তিন মাস পর
গত তিনধরে বর্ষা নেমেছে প্রকৃতিতে। দিন নেই, রাত নেই টাপুরটুপুর বর্ষাসংগীত বেজে চলেছে। এর মধ্যেই বিশাল এক আয়োজন। প্রতি বছরের মতো এবারও সেরার সেরা পুরস্কার নিয়ে চলে এসেছে দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন বইয়ের বাজার। গত দুবছর ধরে সেরার সেরা পুরস্কারে ছিলো একটিই নাম। আর তা হলো লাবণ্য রহমান। দুই বছরের চব্বিশ মাস, সবগুলো অনলাইন বুকশপে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই ছিলো তারই। গতবছর গননা শুরুর পরও সে ছিলো সেরা অবস্থানে। তবে গত তিনমাসে সব উল্টেপাল্টে গেছে। সোস্যাল মিডিয়াতে হঠাৎ চাউর হয়েছে, লাবণ্য রহমানের বইয়ের পাঠকদের সাথে নাকি অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। তার বইয়ের লেখা মৃত্যু গুলো নাকি কাকতালীয় ভাবে পাঠকদের জীবনে প্রবেশ করছে। অনেক পাঠক তার বই পড়ে, ঠিক বইয়ের চরিত্রের মতো ভাবে মারা যাচ্ছে। এই দেশে এইধরনের খবরের পাঠকের অভাব নেই। বাতাসের বেগে কথাটি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ জুড়ে৷ অনেকেই জীবন বাঁচাতে বর্জন করছে তার বই। অবশ্য অদ্ভুত অলৌকিক এই খবরের নিন্দা জানিয়েছেন অনেকেই। যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে উড়িয়ে দিচ্ছে শিক্ষিত সমাজ। কিন্তু তারপরও লাবণ্য রহমানের বইয়ের বাজার হঠাৎ করেই পড়ে গেছে। অনেকেই বিক্রি করে দিচ্ছেন পছন্দের এই লেখকের বই। কেউ কেউ তো নিজের জীবন বাঁচাতে আগুনে ফেলে পুড়িয়ে ফেলেছে বইগুলো। বাধ্য হয়েই প্রকাশকরা তার বই বিক্রি একরকম গুটিয়েই ফেলেছে। তার ফেসবুক পেজটিতে রিপোর্ট করে বন্ধ করে দিয়েছে একদল উগ্রবাদী পাঠক। এই ঘটনাগুলোর পর লাবণ্য রহমানও অন্তরালে চলে গেছেন। জানা গেছে তিনি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই সেরার সেরা পুরস্কারের তালিকায় এবার তার নাম নেই। তাকে টপকে সেরার সেরা অবস্থানে এবার পাঠকের আরেক প্রিয় লেখকের নাম এসেছে। তিনি আগন্তুক।
( চলবে)