আগন্তুক পর্ব-০৩

0
1080

আগন্তুক
#পর্ব : ৩

পর পর দুটো দিন দারুণ আনন্দে কাটলো লাবণ্যর। রূপমরা বেশ ব্যবস্থা করেছে। খাওয়া দাওয়া থেকে কোন কিছুরই কমতি নেই। শুধু বাড়িটা অদ্ভুত রকমের নিশ্চুপ। আশেপাশে অন্যকোন বাড়ি নেই বলে, লোকজনও তেমন চোখে পড়ে না। গতকাল বিকেলে মল্লিকার সাথে ছাদে গিয়েছিলো সে। ছাদ থেকে দূরের শিরিষ গাছগুলো কেমন ঢেউখেলানো জলাভূমির মতো মনে হলো। সন্ধ্যে হতে না হতেই অজস্র পাখির কুহুতানে কানে তালা লাগার জোগাড় হয়। তারপর রাত ঘন হতে হতে, আবার সব নীরব! আজ বিকেলে কিছুক্ষণ মা বাবার সাথে ফোনে গল্প করলো লাবণ্য৷ চয়ন, রূপম আর প্রত্যয় উত্তরের দীঘিতে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসেছে। অনিন্দিতা আর মল্লিকা নিজেদের ঘরে আছে। লাবণ্যরও কোন কাজ নেই৷ ফেসবুক খুলে বসতেই সে তার নতুন বইয়ের রিভিউ এসেছে দেখলো। বইমেলার পরে তার বইয়ের চতুর্থ মুদ্রণ এসেছে। চারিদিকে লাবণ্য রহমানের জয়জয়কার। থ্রিলার পাঠকদের মধ্যে তার বই নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে। বেশ কয়েকজন পাঠক তাকে নিয়ে চমৎকার পোস্ট দিয়েছে৷ স্তুতি গুলো মনে মেখে নিয়ে টপ চার্টে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। দেশের সবচেয়ে সম্মানের পুরস্কারের মধ্যে একটি সেরার সেরা পুরস্কার। যেটি দেশের সবগুলো অনলাইন বুক শপ মিলে একত্রে দেয়। পুরস্কারটি দেওয়া হবে জুনমাসের মাঝামাঝিতে। ততদিন পর্যন্ত সবগুলো বুকশপ মিলে যে সেরার অবস্থানটা ধরে রাখতে পারবে, সেই পাবে সেরার সেরা এওয়ার্ড। এখন পর্যন্ত সেরার তালিকার শীর্ষে লাবণ্য। তিন মাস ধরে এই পজিশনে সে প্রায় অনড়৷ তার ঠিক ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে আগন্তুক নামক একজন। ইনিও থ্রিলার জগতে বিখ্যাত লেখক। তবে তার সাথে কখনো লাবণ্যর দেখা হয়নি৷ ভদ্রলোকের বইতে কোন ছবি থাকে না৷ থাকে না কোন লেখক পরিচিতি৷ বইমেলার সারামাসে একদিনও তিনি মেলায় যান না। তবুও তার দারুণ লেখায় বুদ হয়ে থাকে পাঠকেরা৷ হাতে গোনা কিছু সংখ্যার হিসেবে উনি লাবণ্যর পেছনে, অর্থাৎ ২য় র‍্যাঙ্কিং এ অবস্থান করছেন। লাবণ্য নিজেও এই ভদ্রলোকের বই পড়ে৷ সাইকোলজিক্যাল পটভূমিতে বেশ সিদ্ধহস্ত তার। অবশ্য লাবণ্য বিনোদনের উপকরণ হিসেবে তার বই পড়েনা, সে পড়ে তাকে ছাড়িয়ে কিভাবে অন্য কিছু লেখা যায় সে জন্য। একটা প্রতিযোগিতাও বলা যেতে পারে৷ অদেখা প্রতিযোগিতা আর কি! লাবণ্য খেয়াল করলো, কেন যেন আগন্তুক নামটা শুনলেই লেখককে ভদ্রলোক বলে মনে হয়। আচ্ছা, তার সাথে তো লাবণ্যর কখনো দেখা হয়নি, হতে পারে সে একজন ভদ্রমহিলা? হতেই পারে!

অনলাইন থেকে বেরিয়ে লাবণ্য লেখায় মন দিল৷ প্রথমদিন এখানে এসে রূপমের মুখে নয়নতারার গল্পটা শোনার পর থেকে গল্পের প্লট তার মাথায় ঘুরছে। নতুন লেখার জন্য পাঠকের আবদারও বাড়ছে। এই প্লটের কয়েকটা পর্ব পাঠকের জন্য ছেড়ে দেওয়া যায়! দেখা যাক, কোন দিকে মোড় নেয় পাঠকের চিন্তা। কী- বোর্ডের উপর দ্রুত আঙ্গুল ঘুরতে থাকে লাবণ্যর। লেখায় ভরে ওঠে পাতা। গল্পের নাম দেয় নয়নতারা। নয়নতারার চরিত্রটা একটু নিজের মতো করে রাঙিয়ে নেয় সে। মেয়েটা দেখতে অপূর্ব সুন্দরী। বিশাল এক রাজবাড়ির একমাত্র মালকিন সে৷ রাজবাড়িটা জীর্ণ-শীর্ণ৷ অনেকদিন যেখানে কারো পা পড়ে না। এই রাজবাড়িতে নয়নতারা থাকে কিভাবে? আহা! থাকতে পারবে না কেন? সে যে শরীরী কোন অবয়ব নয়। একদম অশরীরী৷ ঘটনা চক্রে সে বাড়িতে বেড়াতে আসে তিন জোড়া দম্পতি। রাতের মধ্য সময়। চৈত্রের পূর্ণিমায় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে আলোয়। সেই তিন দম্পতির একজন শুনতে পেল কে যেন ডাকছে তাকে। কি এক অপার্থিব মোহ-মায়ায় সে পাশের সঙ্গিনীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। দেখল, রাজকীয় সাজ পোশাকে এক অনিন্দ্য সুন্দরী নারী এগিয়ে চলেছে। ছেলেটাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো পিছু নিলো তার। বেশ খানিকটা পথ যাবার পর হঠাৎ তীক্ষ্ণ চিৎকার। ছেলেটা পেছনে ফিরলো। নাহ! কেউ নেই। সাথে সাথে সামনে ফিরে দেখলো সে পথও ফাঁকা। ছেলেটির ভ্রম ভাঙলো। মনে পড়লো ঘরে তার সঙ্গিনীকে একা রেখে এসেছে। দ্রুত পায়ে ছুটলো ঘরের দিকে! তারপরই গলা ফাটানো চিৎকার দিলো সে। ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর কড়িকাঠে ঝুলছে তার সঙ্গিনীর দেহ! ঘরময় ছড়ানো অজস্র গন্ধহীন বেগুনী আর সাদা ফুল। নয়নতারা।

– সুযোগ পাওয়া মাত্র ল্যাপটপ হাতে বসে গেছ?

চয়নের কথায় ঘোর ভাঙলো লাবণ্যর। লেখাটি টুক করে তার ফেসবুক পেজে পোস্ট করে দিয়ে কোলের উপর থেকে ল্যাপটপটি নামিয়ে রাখলো।

– কি করব? তোমরা তো আমাদের না নিয়েই লাপাত্তা! মল্লিকা আর অনিন্দিতা ভাবীও যে যার ঘরে। আমার একা একা কি করার থাকতে পারে?

– বুঝলাম! এবার নিচে এসো। দেখো, কি বিশাল দুটো মাছ ধরেছি।

লাবণ্য চয়নের সাথে নিচে নেমে এলো। আসলেই তারা বেশ বড়সড় দুটো মাছ ধরেছে। মল্লিকা, অনিন্দিতা, প্রত্যয়, রূপম প্রত্যেকে নিচে আছে৷ গ্রাম থেকে রান্নার নতুন দুজন লোকও নিয়ে এসেছে। এত বড় মাছ, একা একা কেটে রান্না করা চাট্টিখানি কথা নয়। মল্লিকা জিজ্ঞাসা করলো,

– লাবণ্য মাছ রাঁধতে জানো?

– মাছের ঝোল পারি। ওই চলার মতো আর কি!

– ঝোল বাদে অন্য কিছু?

প্রত্যয় সাথে সাথে বলে উঠেছে,

– অনিন্দিতা ভাবীর রান্নার হাত চমৎকার। আজ বরং ভাবীর হাতের রান্না খাই আমরা। আর তোমরা তো আছই হেল্প করার জন্য।

– তাই হবে। আমিই আজ খাওয়াবো। রুইমাছের কালিয়া, আর মুগ ডাল দিয়ে মুরিঘণ্ট চলবে?

– চলবে মানে? বেশ চলবে! তোমরা তাহলে শুরু করো। আমরা বরং একটু আড্ডা দিই ঘরে বসে।

চয়ন, রূপম, আর প্রত্যয় চলে যেতেই ওখান থেকে সরে এলো লাবণ্য। বিশাল ডাইনিং স্পেসের শেষ মাথায় রান্নাঘর। রান্নার জন্য বড় বড় মাটির চুলার জায়গা করা আছে। নতুন দুজন রান্নার লোক মাছ কাটতে বসে পড়েছে৷ লাবণ্যরা আসার পর যিনি কাজ কর্ম তদারকির দায়িত্বে আছেন, তিনিও এসে পড়েছেন। কিছু পেয়াজ, রসুন নিয়ে খোসা ছাড়াতে তার পাশে বসলো তারা তিনজন। মহিলাটি বেশ বয়স্ক। কম করে হলেও ৬৮-৬৯ এর কম নয়। মল্লিকা বললো,

– লাবণ্য, আমাদের জন্ম থেকেই উনাকে দেখছি৷ যখনই এ বাসায় বেড়াতে এসেছি, উনি চলে এসেছেন তখনই। উনার বাসা এই গ্রামেই৷ আগে উনার শাশুড়ি এই বাসায় কাজ করতেন।

লাবণ্য মাথা নাড়লো।

– তাই নাকি? তাহলে তো এই বাড়ি আপনারা অনেকদিন থেকে দেখছেন। এই বাড়ির গল্প বলুন শুনি। এই যে এত বড় বাড়ি খালি পড়ে থাকে সারাবছর? চোর ডাকাতের উপদ্রব হয়না?

– চোর ডাকাত!

হাসলো বৃদ্ধা।

– কই থেকা আসবো চোর? জানের ভয় আছে না? তামাম দিকে সবলাই যখন ঘুমায় যায়, তখন সে আসে। এই বাড়ির চারিদিকে ঘুরঘুর করে, গান গাহে। আর তার চোখে যদি কেউ পইড়া যায়, তার তো জীবনডা ওইখানেই শেষ!

লাবণ্য অবাক চোখে তাকালো মল্লিকা আর অনিন্দিতার দিকে। কি বলছেন উনি! কার কথা বলছেন। অনিন্দিতা অবশ্য লাবণ্যর চোখে চোখ।পড়তেই উঠে পড়লো। বলল,

– তোমরা গল্প শোনো, আমি চুলা রেডি করি।

লাবণ্য দ্বিধা নিয়ে তাকালো বৃদ্ধার দিকে। চোখ কুচকে বললো,

– ঠিক বুঝলাম না! কার কথা বলছেন আপনি?
বৃদ্ধা মাথা ঝাকালো। তারপর বললো,

– নয়নতারা গো! নয়নতারার কথা বলি। ওই যে সেই জনম দুখী মাইয়া। বিয়া হইলো, কিন্তুক ঘর করবার পারলো না৷ তার আগেই গলায় দড়ি দিয়া মরলো। সে ঘুরে এখানে। সারা রাত বেবাক সময় ঘুইরা বেড়ায়।

লাবণ্য অবিশ্বাস নিয়ে বললো,

– আপনি দেখেছেন কখনো তাকে?

বৃদ্ধা হাসলো।

– সে সবালাইকে দেখা দেয়না। কাউরে কাউরে দেয়। যারে তার পছন্দ অয়।

লাবণ্য এবার মল্লিকার দিকে ফিরে বললো,

– তুমি কখনো এই ধরনের কিছু দেখেছো?

– আরেহ, পাগল নাকি? আমি দেখলে কি আর এখানে আসি! আর আমরা আগে যতবার এসেছি, বিকেল নাগাদ আবার ফিরে গেছি। থাকিনি কখনো। যাক গে, বাদ দাও তো৷ সব বুজরুকি! এইসব আবার সত্যি হয় নাকি?

লাবণ্য সরে আসার সময় শুনতে পেল বৃদ্ধা বিড়বিড় করে বলল,

– থাইকো ক’টা দিন! নিজেরাই হেরে ঠিক দেখবার পাবা!

রাতের খাওয়াটা জম্পেশ হলো তাদের। সত্যিই অনিন্দিতার হাতের রান্না চমৎকার। প্লেট চেটেপুটে খেয়েও যেন স্বাদ মেটেনা। খাওয়া দাওয়া শেষে দোতলার বেলকনিতে বসলো গানের আসর৷ প্রত্যয় আর মল্লিকা দুজনই দারুণ সুন্দর নজরুলগীতি গায়। তাদের গান শুনতে শুনতে রাত গড়ালো অনেক৷ ঘড়ির কাটা বারোটা জানান দেওয়ার কিছু আগে আসর ভাঙলো তাদের। বিছানো মাদুর গুছিয়ে তুলতে তুলতে অনিন্দিতা বললো,

– এই লাবণ্য, ফেসবুকে নতুন গল্প দিয়েছো, তাইনা? এই বাড়ি নিয়ে? খুব সুন্দর হয়েছে। ওয়েটিং ফর নেক্সট পার্ট।

চয়ন বললো,

– ও আচ্ছা, লেখা পোস্ট করাও সারা! বলেছিলাম না, ওখানে এসেছে শুধু নিভৃতে নতুন উপন্যাসের প্লট নিয়ে ভাববে বলে!

মল্লিকা সাথে সাথে উত্তর দিলো,

– আচ্ছা, চয়ন ভাই লাবণ্যর লেখার উপরে আপনার এত কিসের রাগ বলুন তো? ও ভালো লেখে। লিখতে দেন! ও না লিখলে আমরা দারুণ গল্প গুলো পাবো কোথায়?

চয়ন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল। সকলকে বিদায় জানিয়ে লাবণ্যও এসে ঢুকলো ঘরে। সে ততক্ষণে বিছনায় চিৎপাট। লাবণ্য এসে বিছানার এক পাশে হেলান দিয়ে বসলো। তার মনটা ভালো নেই। ইদানীং সে খেয়াল করে, চয়ন তার লেখালেখিটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে চায় না। সবসময় তাকে লেখা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু লেখা ছাড়া সে বাঁচবে কিভাবে? আর কেনই বা চয়ন এমন করছে? সে কি গত দুবছর থেকে লাবন্যকে দেখছে না? সব কিছু জেনে শুনেই তো প্রেমে পড়েছিলো তার। এইসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গিয়েছিলো তার। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন রাত ক’টা বাজে জানে না লাবণ্য। দক্ষিণের বড় জানালা হাট করে খোলা৷ পাশে চয়ন এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে৷ চারিদিক অদ্ভুত নিঝুম। লাবণ্য নেমে এলো। জানালাটা বন্ধ করা দরকার। এদিকে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আকাশে গোল চাঁদটা নিশ্চুপ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। লাবণ্য জানালাটা বন্ধ করে দিলো৷ সরে আলো আবার বিছানার কাছে। তখনই প্রথম শব্দটা কানে এলো। কেউ যেন গোঙ্গাচ্ছে, নাকি গুনগুন করছে ধীর সরে। সাথে সরসর আওয়াজ। ঠিক পাথরের কাজ করা শাড়ি মেঝে ফেলে টেনে নিয়ে গেলে যেমন হয়। লাবণ্যর হাত পা শিরশির করে উঠলো। কিসের আওয়াজ ওটা? এত রাতে কে ঘুরছে বাইরে?
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে