#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতেঃ- অনামিকা ভট্টাচার্য্য
আংটি পর্ব ৩
ক্লাস শেষে কোয়ার্টারে ফিরে আসে উপমা।কলেজ বিল্ডিং এর পাশেই টিচার্স কোয়ার্টার।কলেজের পিছন দিকে ছোট্ট একটা রাস্তা। রাস্তা মানে সরু গলি।দু পাশে শিমুল,কদম,মেহগনি,কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো।এই এক ফালি পথটুকু হেঁটে আসতেই ভালো লাগে উপমার।
তারপরই ওর কোয়ার্টার।
উপমার ছেলেবেলা কেটেছে ছোট্ট এক মফস্বল শহরে।ক্লাস এইটে উঠার পর তারা ঢাকায় চলে আসে।তারপর থেকে ঢাকারই স্থায়ী বাসিন্দা তারা।বাবা-মাকে ছেড়ে এই প্রথমই একা একা থাকছে।কোয়ার্টারে উপমা একটা সিঙ্গেল রুমে থাকে,এটাচড ওয়াশরুম।রুমের সাথে ছোট্ট একটা ব্যালকনি।কমন কিচেন।মাজেদা খালা এই কোয়ার্টারের রাঁধুনী।রান্নার পর উপমার ঘরে এনে খাবারটা দিয়ে যায়।যদিও ডাইনিং রুমে অনেকগুলো চেয়ার পাতা আছে।তবু ঘরে বসেই খাবার খেতে পছন্দ করে উপমা।এই মাজেদা খালা মহিলাটাকে ভালোই লাগে উপমার।এই ধরণের মহিলা সাধারণত পান খেয়ে রসিয়ে রসিয়ে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে মজা পায়।ওদের পছন্দের টপিক হলো কোন অবিবাহিত মেয়ে দেখলে তার বিয়ে না হওয়ার কারণ নিয়ে গবেষণা করা।কবে বিয়ে খাবো বলতে বলতে কাউকে বিরক্ত করা কিংবা বিবাহিত হলে বাচ্চা আছে কি-না,কবে হবে,কেন হচ্ছে না আবার বাচ্চাকাচ্চা থাকলে স্বামী-সংসার ফেলে এতোদূরে চাকরি করতে আসছেন কেন এইসব বিষয়ে বার বার বলে বলে মুখে ফেনা তোলা।কিন্তু উপমা দেখলো মাজেদা খালা পানও খান না।আবার ওসব বিষয়ে কখনো কিছু জিজ্ঞেসও করেন নি।নিজের কাজটুকু নিষ্ঠা সহকারে করে যান।বাড়তি কথা খুব একটা বলেন না।রান্নাটাও বেশ ভালোই করেন।সাধারণত এরকম ছুটা বুয়ারা খুব বেশী তেল আর হালকা মসলা দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব রেসিপি রান্না করে।সেই সাথে প্রায় সবাই ম্যাজিক ডাল রান্না করতে বিশেষ পারদর্শী হয়।এই ডালটা এতোটাই পাতলা হয় যে সেটাকে একইসাথে ডাল এবং হাত ধুয়ার জল দুটোই বলা চলে।তাই এই ধরনের ডালকে উপমা মনে মনে নাম দিয়েছে ম্যাজিক ডাল।উপমা নিজে কখনোই বাসার বাইরে না থাকলেও কাজিন এবং বান্ধবীদের হোস্টেলে,মেসে অনেকবার গিয়েছে।তাই উপমা এসকল রান্নার সাথে খুব পরিচিত।তবে মাজেদা খালার রান্না এরকম না।মোটামুটি ভালোই রান্না করেন।সব থেকে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে কোন রান্নাতেই অতিরিক্ত তেল লাগান না।ডালটাও ঠিকঠাক মতোই রাঁধেন।সেজন্য ঘরোয়া একটা আমেজ পাওয়া যায় খাবারে।এছাড়া এই মহিলা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।তাই তৃপ্তির সহিত খাওয়া যায়।সব মিলিয়ে মাজেদা খালাকে ভালোই লাগে উপমার।
উপমা নিজের রুমে রাইস কুকার,ইলেকট্রিক কেটলি,ব্লেন্ডার এগুলো রেখেছে।চা,কফি কিংবা গরম জলের জন্য যাতে কিচেনে যেতে না হয়।কিচেন শেয়ার করতে ভালো লাগে না উপমার।তাই রুমের ভেতরই ব্যবস্থা করে নিয়েছে।রুমের ভেতর আসবাবপত্র বলতে একখানা চৌকি ও একটা সস্তা চেয়ার-টেবিল ছিলো।উপমা নিজে একটা বুকশেলফ আর কাপড় রাখার জন্য একটা প্লাস্টিকের ওয়ারড্রব কিনে এনে রেখেছে।বুকশেলফ ছাড়াও ওয়ারড্রবের একটা ড্রয়ারে বই রাখা আছে।যেহেতু উপমার বই পড়ার খুব নেশা।
ব্যালকনিটা নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছে উপমা।একপাশে টবে কয়েকজাতের ফুল লাগিয়েছে।একপাশটা খালি রেখেছে।খালি পাশটায় ইচ্ছে হলেই ছোট্ট শীতলপাটি বিছিয়ে বই নিয়ে বসে যায় উপমা।সাথে থাকে চা কিংবা কফি।দেয়ালের সাথে বালিশ লাগিয়ে রাখে।বালিশে পিঠ দিয়ে পড়তে ভালো লাগে উপমার।
আজ শুক্রবার।ছুটির দিন।সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।উপমা রাইস কুকারে চাল-ডাল বসিয়েছে।খিচুড়ি আর ডিমভাজি দিয়ে লাঞ্চ করবে আজ।খিচুড়ি বসিয়ে হাতে এক কাপ চা নিয়ে ব্যালকনিতে আসে উপমা।বৃষ্টি ভেজা সবুজ প্রকৃতি দেখতে ভালোই লাগছে উপমার।গাছগুলো যেন একসাথে স্নান করছে সব।কানে হেডফোন গুঁজে দিয়েছে উপমা।রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছে।
“এসো নীপবনে,ছায়াবিথী তলে এসো
করো স্নান নবধারা জলে এসো,নীপবনে”।
হঠাৎ ঐ সরু গলিটার দিকে চোখ পড়ে উপমার।দেখে অরণ্য বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কদম ফুল কুড়াচ্ছে।সাথে কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে।সবুজ টি-শার্ট আর সাদা-কালো ট্রাউজারে অরণ্য কে দেখতে কলেজ স্টুডেন্টদের মতোই লাগছে।কে বলবে অরণ্য এই কলেজের সিনিয়র লেকচারার।মনে মনে ভাবে উপমা।কলেজ ক্যাম্পাসের কথা মনে পড়ে উপমার।বৃষ্টি ভেজা ক্যাম্পাসটা নিশ্চয়ই সবুজ কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে।শুক্রবার থাকায় কলেজের এই স্নিগ্ধ রূপটা দেখতে পারলো না উপমা।ছাতা মাথায় দিয়ে মাজেদা খালা হেঁটে আসছেন।খালাকে জানাতে হবে আজ দুপুরে ওর জন্য খাবার না দিতে।
নতুন চাকরি,নতুন কর্মস্থল,নতুন বাসস্থান,কিছু অপরিচিত নতুন মানুষ।সব মিলিয়ে এই নতুন জীবনটাকে উপভোগ করছে উপমা।
****************
সন্ধ্যাবেলা নিজ রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো অরণ্য।এমন সময় ওর মা ফোন করলেনঃ-
-হ্যাঁ মা বলো।
-আমি আর কি বলবো বাবা।বলবি তো তুই। তোর নীলিমা আন্টি একটু আগে কল করেছে।গতকাল জানানোর কথা ছিলো।অথচ আজো আমরা জানাতে পারলাম না।তুই তো এখনো কিছু বললি না।
-পছন্দ হলে নিশ্চয়ই বলতাম মা।কিছু যখন জানাই নি তার মানে তো তোমরা বুঝে নিতে এখানে আমার মত নেই।
-তোর অমতের কারণটা বল।
-ওসব বড়লোকের ন্যাকা ন্যাকা মেয়ে আমার একদম পছন্দ না মা।দেখার দিন দেখলে না কেমন ন্যাকামো করলো।রান্নার কথা জিজ্ঞেস করতেই কেমন উত্তর দিলো!ও নাকি পড়াশুনা নিয়েই বিজি ছিলো।তাই রান্নাঘরের ধারে কাছেও যায় নি।এটা কোন কথা হলো!যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না।
-দেখ বাবা,আজকালকার মেয়েরা এমন একটু হয়েই থাকে।এসব কোন ব্যাপার না।তাছাড়া আমার একমাত্র ছেলের বৌ।আমি ওকে রান্না করতে দেবোই বা কেন?আমি এটা বলছি না ঐ মেয়েকেই তোর বিয়ে করতে হবে।কিন্তু কাউকেই তো তোর পছন্দ হয় না।আমার কি ইচ্ছে করে না ঘরে বৌমা আনতে।তোর বাবার কতো শখ বৌমাকে নিয়ে।আর কতো অপেক্ষা করবো বল তো।
-অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় মা।আর বোধহয় বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না।এখন রাখছি।আগামীকাল আমাদের কলেজে নবীনবরণ অনুষ্টান আছে।এখন এটা নিয়ে একটু কাজ করছি।পরে কথা হবে।
ফোন রেখে আবার কাজে লেগে যায় অরণ্য।হঠাৎ করে কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব আসে।তখনি সেই স্বপ্নটা আবার দেখে।একটা ছেলে একটা মেয়েকে আংটি পরিয়ে দিচ্ছে।তারপর ঐ মেয়েটার সীঁথি তে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে।যদিও কারোরই চেহারা দেখা যায় নি।শুধু হাত আর কপাল দেখেছে।তখনই স্বপ্নটা ভেঙে যায়।ধড়ফড়িয়ে উঠে অরণ্য।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।তারপর একগ্লাস পানি খেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ভাবতে থাকে এ স্বপ্নের মানে কি!এতো বছর তো শুধু আংটি পরানোই দেখতো।আজকে সিঁদুর দান দেখলো।আংটি টা তো একই আছে।উপমার হাতে যেটা থাকে।তবে কি ক্রমশই খুলবে এই রহস্যের জট।অপেক্ষায় থাকে অরণ্য।
#চলবে
#পরবর্তী_পর্ব
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/962773780820008/