আংটি – সপ্তম পর্ব
প্রতিটা দিন খুব দ্রুত এগোচ্ছে। হাতে থাকা সময়টা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মাঝ রাতে আনিকার নাম্বার থেকে আসা ফোনে ঘুম ভাঙ্গলো। ফোনটা রিসিভ করতেই আনিকা হাসিমুখে বললো,
– রাকিব জানিস আজকের দিনটা আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের দিন। বাবা অভিমান ভেঙ্গে তার রাজকন্যাটার সাথে কথা বলেছে। মেনে নিয়েছে আমার সকল চাওয়া।
আমি সহজ গলায় বললাম,
– কি এমন চেয়েছিলি তোর বাবার কাছে ? মেনে নিতে এতটা দিন লেগেছে।
আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বললো,
– আমি সারা জীবনের জন্য তোর হতে চেয়েছি। বাবাকে বলেছি আমার ভালবাসার কথা। সেদিন হসপিটালে যাওয়ার পর তোর মায়ের চোখে তানিয়ার প্রতি যে ভালবাসা দেখেছি সে ভালবাসার সামান্য টুকু পেতে তোর মাকে আমি মা ডাকতে চাই।
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
– বলছিস কি এসব ? সারা জীবনের জন্য আমার হতে চাস মানে ? হঠাৎ করে আসা আবেগ নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিস কিভাবে ?
– যা বলছি ভেবেচিন্তে বলছি। আমার এই বয়সটা আবেগের নয়, আবেগ মাখানো বয়সটা পেছনে ফেলে এসেছি।
– তুই তো জানিস আমাদের সম্পর্কটা শুধু মাত্র বন্ধুত্বের।
আনিকা আত্মবিশ্বাসী গলায় বললো,
– যেদিন তোর মাকে দেখতে হসপিটালে গিয়েছি, সেদিনই আমি তোরে ভালবেসে ফেলি। জানিস খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি, সন্তানের প্রতি একজন মায়ের কতটুকু ভালবাসা থাকে সেদিন হসপিটালে না গেলে বুঝতে পারতাম না। আমি মমতাময়ী সেই মায়ের ভালবাসা নিয়ে বাকিটা জীবন বাঁচতে চাই। পরদিনই রাতেই আমার ভালবাসার কথাটা তোরে জানিয়ে দিতাম, বাবা যদি রাজি না হয় তাই জানাইনি। আজকে বাবাকে রাজি করিয়েছি, এখন তুই ফিরিয়ে দিবি আমায় ?
আনিকার কথা শুনে পুরোপুরি থমকে গেলাম। পৃথিবীতে এতো শব্দ থেকে ও আনিকাকে বলার মতো কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
– আনিকা তোরে হয়তো বলা হয়নি, আগামী শনিবার আমার ফ্লাইট। আমি এই জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাচ্ছি অনেক দূরে, বহুদূর।
আনিকা জবাব দিলো না। আমি ফোনটা কানে লাগিয়ে বসে আছি, একটু পরেই অপর প্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। আনিকা কাঁদছে, হাউমাউ করে কাঁদছে।
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ঘুম আসতে অনেক দেরি হয়। আমি আনিকার ফোনটা কেটে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আনিকার কান্নার শব্দটা বার বার কানে বাজছে, আমি তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ঘুমিয়ে গেলাম।
একটু পরেই আবারো ঘুম ভাঙ্গলো, ঘুম ভেঙ্গেছে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। আমি ভয় পেয়ে খাটের উপরে উঠে বসলাম। রুমের লাইট জ্বাললাম। তানিয়ার মৃত্যুর পর এই প্রথম বার তানিয়াকে স্বপ্নে দেখলাম। স্বপ্নের ভেতর তানিয়া আমার কাছে আংটিটা চাইলো, ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরো রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। ঠিক যখনি মনে হলো আংটিটা আমার আঙ্গুলে লাগানো, তাকিয়ে দেখি তানিয়া নেই।
ছোট এই স্বপ্নটা দেখে গলা শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে পানির তৃষ্ণায় মারা যাবো। পাশে থাকা জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে ভাবলাম, খুব সকালেই তানিয়ার কবরটা দেখতে যাবো।
ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করেই বাইরে বের হলাম। বাসে করে ফয়সালের বাড়িতে আসতে অনেকক্ষণ লাগলো।
তানিয়ার কবরটার কাছে আসার আগে ফয়সালের বাড়ির সামনে আসলাম। বাড়ির সামনে অনেক মানুষজন দেখে আগ্রহ নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম,
– এই বাড়িতে আজ এতো মানুষজন কেন ?
– বিয়েতে তো মানুষজন থাকবেই, ফয়সাল গতকাল বিয়ে করেছে।
কঠিন গলায় বললাম,
– হঠাৎ করে বিয়ে ?
মেয়েটা সহজ গলায় বললো,
– অফিসের কলিগ তিশা আপুকে আরো আগেই বিয়ে করার কথা ছিল, মাঝখানে অনেক ঝামেলার কারণে দেরি হয়ে গেছে।
কথাটা শুনে মেয়েটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এখানে দাঁড়াতে এক মুহূর্ত ও ইচ্ছে করছে না। আমি পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম তানিয়ার কবরটার দিকে।
তানিয়ার কবরটার উপরে দেওয়া মাটিগুলো শুকিয়ে গেছে। ছোট ছোট ঘাস উঠতে শুরু করছে। আমি কবরের পাশে বসে ভাবছি, ঘাসগুলো একদিন আরো বড় হবে, পরিবর্তন হয়ে যাবে সবকিছু। পাল্টে যাওয়া সময়ের সাথে সাথে এক সময় মানুষ সবকিছু ভুলে যাবে।
বাড়িতে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়েছে। ঘরে ঢুকে আঙ্গুলে লাগানো আংটিটার দিকে হতাশ চোখে তাকালাম। তিশার সাথে ফয়সালের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর একটা মেয়ের সবচেয়ে আপনজন হয়ে যায় তার স্বামী। এমন অবস্থায় তিশার কাছ থেকে ফয়সাল সম্পর্কে কিভাবে জানবো ?
সকাল থেকেই বার বার আনিকার কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। ভুলে থাকতে পারছি না। আনিকাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি, রাতে শুনতে পাওয়া কান্নার শব্দগুলো হৃদয়টা এলোমেলো করে দিচ্ছে। হৃদয়ে জমে থাকা অনুভূতিটা বার বার আনিকার কাছে ছুটে যেতে চাচ্ছে।
আমি ছুটে গেলাম মায়ের শোবার রুমে। মা শোবার রুমে সাথে লাগানো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে এগিয়ে আসলো। আমি বললাম,
– আমার বিয়ের ব্যাপারে তোমাকে কথা বলার জন্য আগামীকাল আনিকার বাড়িতে যেতে হবে।
আমার কথা শুনে মা কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। আমি মাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
– ভালবেসে প্রিয় মানুষটার জন্য যদি কেউ চোখের জল ফেলে সেই জল কখনোই মিথ্যা হতে পারে না।
মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। অনেকদিন পর মায়ের মুখে মমতা মাখানো হাসিটা দেখলাম।
আজকে রাতেই আনিকার সাথে মা ফোনে কথা বললো। আনিকার বাড়িতে আমরা আগামীকাল আসবো শুনে সে আবারো কাঁদলো। এবারের এই কান্নায় আনন্দ মেশানো, আত্মতৃপ্তি মেশানো আনন্দ।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করলাম। মা আমার আগেই তৈরি হয়ে আছে। মাকে সাথে নিয়ে রুম থেকে বের হলাম। গেইটের কাছে আসতেই দারোয়ান বললো,
– একটা আপা এসেছিল, এসে তোমার ফোন নাম্বার নিয়ে গেছে।
আমি মায়ের সাথে আনিকার বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছি, এখন তো আনিকা আমাদের বাড়িতে আসার কথা নয়। আনিকার কাছে আমার ফোন নাম্বার রয়েছে, তাহলে কে এসেছে ?
দারোয়ানকে কঠিন গলায় বললাম,
– আপা মানে ? যে মেয়েটা এসেছিল মেয়েটাকে চিনেন না ?
– জ্বে না, আগে কখনো দেখিনি।
– অপরিচিত হলে ফোন নাম্বার দিয়েছেন কেন ?
– মেয়েটা এসেই বললো সে তানিয়ার পরিচিত।
মা নরম গলায় বললো,
– হয়েছে তো রাকিব, একটা শুভ কাজে যাচ্ছি। শুধু শুধু এতো কথা বাড়ানোর কি দরকার ?
আমি বললাম,
– মা শুনো, তানিয়ার পরিচিত কেউ হলে আমাদের বাসার ভেতরে আসবে। দারোয়ানের কাছ থেকে আমার নাম্বার নিবে কেন ?
মা চুপ করে আছে। আমি দারোয়ানকে বললাম,
– শুধুই কি নাম্বার চেয়েছে ? আর কিছু বলেনি ?
দারোয়ান মাথা নিচু করে বললো,
– না। আর কিছুই বলেনি।
আমি গেইট থেকে বাইরে বের হলাম। যাওয়ার সময় দারোয়ানকে বললাম,
– যদি অপরিচিত কেউ আসে, বলবেন বাড়ির ভেতরে যেতে। নাম্বারের প্রয়োজন কিংবা যে কোন প্রয়োজনে যেন ভেতরে এসে কথা বলে।
দারোয়ান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
মাকে সাথে নিয়ে আনিকার বাড়িতে আসলাম। বাড়িটার ঠিক সামনে একটা বাগান বিলাস গাছ লাগানো। পুরো গাছে এমন ভাবে ফুল ফুটেছে মনে হচ্ছে নীল আকাশের নিচে আগুন ধরে গেছে।
বাগান বিলাস গাছটার কারণে বাড়ির রঙ টা অসম্ভব সুন্দর রূপে ফুটে উঠেছে। লাল রঙের পেছনেই পুরো দেওয়ালটা কালো রঙে সাজানো হয়েছে।
আনিকার ঘরে ঢুকতেই তার বাবা এগিয়ে আসলেন। আজ আমরা আসবে বলে তিনি অফিসে যান নি।
মা সোফায় বসেছে। আমি মায়ের পাশে বসলাম। আনিকার বাবাকে অতি ব্যস্ত দেখাচ্ছে, তিনি একবার দু’তালায় যাচ্ছেন আরেক বার ড্রয়িং রুমে আমাদের সাথে একটু একটু কথা বলে উপরে চলে যাচ্ছেন।
আনিকাকে আসতে দেখা গেলো। আনিকা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে, সে আজ শাড়ি পড়েছে। কালো রংয়ের সুন্দর একটি শাড়ি। আনিকাকে শাড়ি পড়া অবস্থায় আগে কখনো দেখিনি। কালো রংয়ের এই শাড়িটাতে তাকে অসম্ভব সুন্দর মানিয়েছে।
আনিকা মায়ের কাছে এসে বললো,
– আপনারা একটু বসুন, আমি রান্না ঘরে যাবো আর চলে আসবো।
মা হাসিমুখে বললো,
– আরে আরে তুমি এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন ? খাবার তৈরি করায় এতো ব্যস্ত হতে হবে না।
– আব্বু তো সকাল থেকেই রান্নাঘরে ব্যস্ততায় কাটাচ্ছে, একটার পর একটা আইটেম বানাচ্ছে।
মা হেসে ফেললো। হাসিমুখে বললো,
– তোমার বাবাকে বলো চলে আসতে।
আনিকা তার বাবাকে ডাকতে সিঁড়ি বেয়ে দু’তালায় দৌড়ে উঠে গেল।
একটু পরেই আনিকা তার বাবাকে সাথে নিয়ে আমাদের পাশের সোফায় বসলো। আমি একবার আনিকার দিকে তাকাচ্ছি আরেক বার মাথা নিচু করে ফেলছি। আনিকার বাবার সাথে মা আমাদের ব্যাপারে কথা বলছেন। আমার পুরো মনযোগ আনিকার দিকে থাকায় মায়ের কথায় মনযোগ দিতে পারছি না। এর মাঝেই হঠাৎ করে পকেটে আমার মোবাইলটা কেঁপে উঠলো।
মোবাইলে ফোন এসেছে ভেবে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। না, কেউ ফোন দেয় নি। হোয়াটসঅ্যাপে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। মেসেজটা সীন করতেই সাথে সাথে পুরোপুরি চমকে উঠলাম। মেসেজে লিখা,
– সকালে দারোয়ান থেকে নাম্বারটা আমিই এনেছিলাম। দেখুন একটা ভিডিও পাঠিয়েছি। ভিডিও টা দেখুন, এই ছোট ভিডিও টাই তানিয়ার মৃত্যুর আসল কারণ।
( চলবে … )
লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী