#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৯
নিশুতি রাতের কান্নাগুলো আটকে আছে।মাঝেরাতের নিস্তব্ধতা চিঁড়ে আরিয়ানের বুকের ভেতর চলছে বিধ্বংসী ঝড়।শ্বাস নেয়ার সাহসটুকো পাচ্ছেনা সে।বদ্ধ বদ্ধ লাগছে।নিজের সাথে নিজেকে সামলে নেয়ার নিরন্তর যুদ্ধ করছে।রাতের আঁধার কেটে ধীরে ধীরে দিনের আলো উঁকি দিচ্ছে গহীন আকাশে।
এই ভোরবেলাই ড.মিতালী কে ফোন করায় ছুটে এসেছেন তিনি।হসপিটালে এখন কোন ডাক্তার নেই বিধায় সেখানে নিয়ে যাওয়াটা বোকামি ছাড়া কিছুইনা।ইতি আর ডক্টর মিতালী প্রায় একঘন্টা যাবত রুমের ভেতর আছে।রুমের বাইরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান।তার পাশেই তন্ময়।
বেশ অনেকক্ষনের নিরবতা ভেঙে তন্ময়ই বললো,
—“ভাবির ব্লিডিং তো থেমে গেছে ভাই।টেনশন নিয়েন না।ভাবি আর বাচ্চারা তিনজনই সুস্থ থাকবে, দেখেন।”
আরিয়ান অসচ্ছ চোখে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
—“মেয়েটা আমার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল অথচ ওর ব্লিডিং হচ্ছে আমি খেয়ালই করলাম না তন্ময়।দোষটা তো আমারই।”
তন্ময় দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে।আরিয়ানকে বোঝানো তার পক্ষে অসম্ভব।যদিও তার নিজেরও মাথা ঘুরছে।আরিয়ান ডাকার পর মায়ার রক্ত দেখে নিজেও প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়েছিলো।সম্পর্কে মায়া তার ভাবি হলেও বয়সে তার থেকে খুব ছোট।ভাবি হিসেবে যেমন সম্মান করে তেমনই ছোটবোনর মতোই তাকে খুব স্নেহ করে তন্ময়।
তার ভাবনার মাঝেই গেট খুলে বেরিয়ে আসে ড.মিতালী।তার ক্লান্ত চেহারাতে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে আরিয়ানকে বলে,
—“আপনার স্ত্রী সুস্থ আছেন।বাচ্চাদের হার্টবিট ও ঠিক আছে।মূলত যতটা দেখা গেছে ততটা রক্ত বের হয়নি।সুতি কাপড়ে রক্ত ভিজে ছড়িয়ে পরেছিলো তারউপর উনি সাদা জামা পরে ছিলেন তাই মনে হচ্ছিল অনেক ব্লাড।কিন্তু আসলে অতটা ব্লিডিং হয়নি।আর এটা স্বাভাবিক।আপনাকে বললাম না ব্লিডিং হওয়া মানেই মিসক্যারেজ না।আপনার স্ত্রীর বয়সটা একটু কম,ফার্স্ট টাইম প্রেগন্যান্সিতেই টুইন বেবি হবে আর এমনেই উনি একটু নাজুক,আদুরে প্রকৃতির।ইমিউনিটি সিস্টেম একটু লো।একটু ব্লিডিং হয়েছে যদিও আমার ধারণা এটা ব্যাথাহীন ব্লিডিং তবুও দেখেন উনি ঘুমের মধ্যই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন।”
আরিয়ান স্বস্তির হাসি হাসে।এতক্ষন বুকের উপর চেপে থাকা পাথরটা নেমে যায়।
—“রক্তটা কেন বের হলো ডক্টর?ওর কিছু হবোনাতো?”
—“আশা করছি কিছু হবেনা।সাতমাসে যদিও ব্লিডিং হয়না।তবুও উনার হয়েছে।সমস্যা নেই।”এভরি প্রেগন্যান্সি ইজ্ ডিফারেন্ট”।উনি সুস্থ আছেন এটাই খুশির।আমি মেডিসিন লিখে দিয়েছি।কাল থেকে টাইমলি খাওয়াবেন।এখন স্যালাইন চলছে,দূর্বলতা কেটে যাবে।
আর আগামী তিনমাসে উনাকে বেশি লাফালাফি করতে দিবেন না।বেড রেস্টে থাকবে এটাই বেটার হবে।”
—“আচ্ছা ডক্টর।আমি খেয়াল রাখবো।আপনি আজকের রাতটা গেস্টরুমে থেকে যান।সকাল হলে বাসায় পৌছে দিবোনে।”
ড.মিতালী হাসেন।আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলেন,
—“সরি বাট আমি থাকতে পারবোনা।আমার মেয়েটা বাসায় একা।আমার ফিরতে হবে।আই হোপ ইউ ক্যান আন্ডারস্টেন্ড।
আরিয়ান আর জোর করে করেনা।ড.মিতালীর স্বামী নেই সে জানে।পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে যার সাথে আরিয়ানের দু চারবার দেখা হয়েছে।বেশ মিষ্টি মেয়েটা।তার কারণে বাচ্চা মেয়েটাকে বাসায় মাঝরাতে একা রেখেই চলে এলো ড.মিতালী ভাবতেই মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো।
_______________
ধীরপায়ে রুমে প্রবেশ করলো আরিয়ান।খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে মায়া।কেউ আসার শব্দে চোখ মেলে তাকালো সে।আরিয়ানকে দেখে সে দূর্বল গলায় বললো,
—“আপনি এতক্ষন কোথায় ছিলেন?সবসময় আমার কাছে কাছে থাকবেন।আপনাকে ছাড়া আমার ভয় করে।”
আরিয়ান দরজা আটকিয়ে মায়ার কাছে এসে বসে।
মায়া ক্ষীণ হেসে ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হাতটা আরিয়ানের হাতের উপর রাখে।
আরিয়ান হুট করে ঝুকে মায়াকে নিজের সাথে লেপ্টে নেয়।তার একহাত মায়ার কোমড় আরেকহাত মায়ার ঘাড়ের পিছে।কয়েক মূহূর্তের মাথায় মায়াকে অসংখ্য চুমু তে ভরিয়ে দিতে থাকে সে।
মায়ার গাল,কপাল,গলা ছেঁয়ে যায় আরিয়ানের তীব্র ভালবাসার স্পর্শে।ভালবাসার ঝড় থেমে যেতেই তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে রাখে আরিয়ান।দ্বিতীয়বারের মতোন মায়া তার ঘাড়ে চোখের জলের অস্তিত্ব টের পায়।আলতো করে আরিয়ানের পিঠে হাত রেখে সে বলে,
—“কাঁদছেন কেনো?”
উওরে আরিয়ান আরো বার দুয়েক তার ঘাড়ে ঠোঁট ছুইয়ে ভেঁজা কন্ঠে বলে,
—“মায়াবতী তুমি…।”
—“আমি ঠি ক আছি।বাচ্চারাও সুস্থ আছে।আপনি শান্ত হন।”
আরিয়ান আরো বেশ কিছুক্ষন মায়াকে জড়িয়ে রেখে ছেড়ে দেয়।চোখ লাল হয়ে আছে তার।ঠোঁটগুলো রক্তিম।
স্যালাইন শেষ হলে মায়ার ক্যানেলাটা খুলে দিয়ে তাকে শুইয়ে দেয় আরিয়ান।ঘরের লাইট নিভিয়ে নিজেও তার পাশে শুয়ে মাথায় হাত রাখে।
মায়া তখনো সজাগ।ঘরের হাল্কা আলোয় আরিয়ানকে দেখা যাচ্ছে।মায়া তার মাথায় রাখা হাতটা নিজের দুহাতে চেঁপে ধরে বুকের মাঝখানটায় নিয়ে বলে,
—“জানেন,বাবাও না আমাকে খুব ভালোবাসতো।আপনার মতোই পাগলামি করতো।আমার কিছু হলে অস্থির হয়ে উঠতো।আমি শান্ত হতে বললেও শান্ত হতোনা।এতো কঠিন মানুষটাও কেঁদে দিত।ঠিক আপনার মতোই।কিন্তু দেখেন সে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।আচ্ছা আপনিও কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”
—“আজেবাজে কথা না বলে ঘুমাও মায়া।তুমি না ঘুমালেতো বাচ্চারাও ঘুমাতে পারেনা।”
বিষন্নতার মাঝেও ফিক করে হেসে দেয় মায়া।হাসিমাখা কন্ঠে বলে,
—“এটা কে বললো আপনাকে?”
—“আমার মনে হয়।”
—“ওদেরতো এখনও চোখও ফুটেনি।আপনি যে কিসব বলেন।”
—“ওইদিন ডক্টর বললোনা,তুমি যা খাও ওরাও তাই খায়।তাই ভাবলাম তুমি ঘুমালে ওরাও ঘুমায়,তুমি কাঁদলে ওরাও কাঁদে,তুমি ব্যাথা পেলে ওরাও ব্যাথা পায়,তুমি হাসলে ওরাও হাসে।”
—“হয়েছে চুপ করেন।এখন আপনি আর কথা বললে আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো।”
আরিয়ান বোকা হাসে।দুটো বাচ্চার বাবা হবে তাই হয়তো দিন দিন এতো বোকা হয়ে যাচ্ছে সে।
______________
বাগানের নরম ঘাসের উপর হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে মায়া।মুখে নজরকাড়া হাসি নিয়ে খেলে চলেছে জ্যাক আর জেনির সাথে।
ঘাসের মাঝখানেই বসার জায়গা আছে আরিয়ান সেখানেই বসে আছে কিন্তু মায়া বসেনি।তার ওরকম পা ঝুলিয়ে বসতে তার কষ্ট হয়।অনেক বাঁকবিতন্ডতার পর আরিয়ান তাকে বাগানে এনেছে।নয়তো এই তিনমাস যাবত তাকে একদম ঘোরাফিরা করতে দেয়না আরিয়ান।দিলেও সবসময় নিজে সাথে থাকে।
আরিয়ান ফোন চালাচ্ছে।সেসময়ই তন্ময় আসে।মায়াকে বাগানে বসে খেলতে দেখে মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠে তার।দ্রুতপায়ে এগিয়ে যেয়ে পকেট হাতরিয়ে একটা বড় চকলেটের প্যাকেট মায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“ভাবি নেন,চকলেট খান।”
মায়া মিষ্টি করে হেসে তন্ময়ের হাত থেকে চকলেটটা নিতেই আরিয়ান গম্ভীর গলায় বলে,
—“তুই ওকে এত চকলেট কেন দেস তন্ময়?সারাদিন খালি খাবারের বদলে চকলেট চকলেট করে।আর তুই ওকে এনেও দেস”।
আরিয়ানের কথায় চোখ রাঙিয়ে তাকায় মায়া।ততক্ষনে ঠোঁটের চারপাশে ভরিয়ে চকলেট খেতে শুরু করেছে সে।খেতে খেতেই সে বলে,
—“আপনার কি সমস্যা?”
মায়ার এমন বাচ্চা বাচ্চা চাহনী দেখে না চাইতেও হেসে দেয় আরিয়ান।বলে,
—“আচ্ছা খাও।”
তন্ময় পকেট থেকে আরেকটা চকলেট বের করে দিয়ে মায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
—“ওটা শেষ হলে এটা খেয়েন,আপনারা তিনজন মানুষ একটা চকলেটে হয় নাকি!।”
আরিয়ান ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।দুই বাচ্চার মা হবে এই মেয়ে তবুও তরা বাচ্চামো স্বভাব যায়না।বকা দিলে এখনো বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়।
ডেলিভারির ডেটের আর এক সপ্তাহ বাকি আছে।তিনদিন পর মায়াকে হসপিটালে এডমিট করা হবে।এবার সব ভালোয় ভালোয় হলেই হয়।
~চলবে~
#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৪০
সূর্য ডুবে যাচ্ছে।সারাদিনের ছন্নছাড়া পাখিগুলো নিজ নিজ বাসস্থান ফিরে যাচ্ছে তাদের ক্লান্ত ডানাগুলো ঝাপটে।
বিকেলের মিষ্টি রোদের কিছুটা এখনও চারদিকে আলো ছড়াচ্ছে।সেই ক্ষীণ আলোই তীর্যক আকারে মায়ার উপর আছড়ে পরেছে।।ঘন কালো চুলগুলোয় সোনালি আভা।ঠোঁটের চারপাশে ভরিয়ে চকলেটের দ্বিতীয় প্যাকেটটা শেষ করছে সে।আরিয়ান তাকে রুমে যেতে বললেও সে জেদ করেই যায়নি।এতদিন পর বাগানে এসেছে,এত তাড়াতাড়ি নাকি সে যাবেনা।জ্যাক আর জেনিও অলস ভঙ্গিতে মায়ার পাশে বসে রয়েছে।এতক্ষণ অবিশ্রামভাবে মায়ার সাথে খেলা করছিলো তারা।
একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো আরিয়ান।ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে মায়ার সামনে একহাঁটু গেড়ে বসলো।মায়ার চকলেট খাওয়া শেষ।হাতে খালি প্যাকেট হাতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আরিয়ানের দিকে চেয়ে আছে সে।আরিয়ান মায়ার গায়ের ওড়না ঠি ক করে দিয়ে হাতের ইশারায় একজন বডিগার্ডকে ডাকলো।লোকটা মাথা নুইয়ে সামনে এসে দাড়াতেই সে মায়ার হাত থেকে চকলেটের প্যাকেটগুলো নিয়ে লোকটার হাতে দিয়ে বললো,
—“এগুলা ফেলে দাও।আর জ্যাক-জেনিকে ওদের ঘরে নিয়ে খাবার দাও।দেখে ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে”
লোকটা ওদের নিয়ে চলে যেতেই আরিয়ান পকেট থেকে রুমাল বের করলো।পাশের পানির বোতল থেকে রুমালটা ভিজিয়ে আলতো করে মায়ার ঠোঁটের চারিপাশ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“অনেকক্ষন থেকেছো বাগানে।এখন রুমে যেয়ে চুপ করে ঘুমাবা।ঠিকাছে?”
মায়া দুষ্ট হাসলো।আরিয়ান ঠোঁট ক্লিন করে রুমালটা সরাতেই সে হাতে লাগা চকলেট গুলো আবারো চারপাশে লাগিয়ে দিল।
আরিয়ান রাগী দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করতেই সে মিষ্টি হেসে মুখ বাড়িয়ে বললো,
—“মুছিয়ে দিন।তারপর তাড়াতাড়ি রুমে চলেন।প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।”
আরিয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো।পুনরায় তার হাত,মুখ মুছে দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে উঠালো মায়াকে।
ধীরে ধীরে রুমে নিয়ে বিছানায় বসাতে নিলেই “আহ্”বলে মাঝারি আকারে চিৎকার করে উঠলো মায়া।আরিয়ান তাকে বসিয়ে দিয়ে দ্রুত গলায় বললো,
—“কি হলো?পেইন উঠেছে?”
মায়া পেটে হাত দিয়ে পরপরই আবারো চিৎকার করে উঠলো।দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
—“আপনার বাচ্চারা আমাকে লাথি দিচ্ছে।দুইজন একসাথে শুরু করেছে বোধহয়।”
ঠোঁটের কোঁণে স্বস্তির আভাস দেখা গেলো আরিয়ানের।এটা স্বাভাবিক সে জানে তাই ভয় পেলো না
।ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে জামা উঠিয়ে মায়ার পেটে আলতো চুমু খেয়ে কান লাগিয়ে সে বললো,
—“আপনারা এত ব্যাথা কেন দেন মাকে?বুঝেননা আপনাদের মা যে আপনাদের মতোই বাচ্চা।এত ব্যাথা সে নিতে পারেনা।”
মায়া নিরলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো,
—“ওরা কি এসব শুনতে পারছে?”
—“অবশ্যই শুনতে পারছে।তুমি শুনতে পারছে মানে ওরাও শুনতে পারছে।”
মায়া মৃদু হাসে।বলে,
—“আপনার এই যুক্তিটা….আআহ্।”
মূহুর্তেই চোখমুখ চকচক করে উঠলো আরিয়ানের।স্পষ্ট পায়ের ছাঁপ দেখেছে সে মায়ার পেটে।একেবারে ছোট্ট একটা পায়ের স্পষ্ট ছাঁপ।উজ্জল হেসে সে বলে,
—“মায়াবতী,ওর পায়ের ছাপ দেখেছি আমি।একেবারে স্পষ্ট।ছোট্ট একটা পা।”
উওরে একটা চওড়া হাসি দিলো মায়া।এতক্ষনের ব্যাথাটা যেনো নিমিষেই মিলিয়ে গেলো।
মায়ার পেটে আবারো চুমু খেয়ে আরিয়ান বলে,
—“তাকিয়ে থাকো।আবার লাথি দিলে দেখতে পারবা।”
কিছুক্ষন অতিবাহিত হয়ে গেলেও কিছু দেখতে পাওয়া গেলো না।আরিয়ান মুখ এগিয়ে বললো,
—“লাথি দিচ্ছোনা কেন তোমরা?মা অপেক্ষা করছে তো।…আস্তে দিও নয়তো মা ব্যাথা পাবে”।
সাথেসাথেই লাথি দিলো একজন।মায়া মুখ দিয়ে আর্তনাদ করতে গিয়েও থেমে গেল।কারণ এবারে সেও পায়ের ছাপ দেখেছে।এবারের টা আরো স্পষ্ট।খুশিতে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরলো মায়ার।আরিয়ান মুচকি হেসে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।দুগালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে বললো,
—“এখনই কাঁদছো!আর কদিন পর যখন ওরা তোমার কোলে থাকবে,একসময় আধো আধো স্বরে মা বলে ডাকবে।তখন কি করবে?”
মায়া আবারো কেঁদে দেয়।আরিয়ানের বুকে মাথা গুঁজে বলে,
—“জানিনা।”
আরিয়ান স্বস্নেহে তার চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দেয়।এই স্বৃতিময় প্রহরগুলো খুব সুন্দর।খুব বেশিই সুন্দর।
_________________
ব্যাগ গুছিয়ে নেয়া হয়েছে।মায়ার কিছু জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।যদিও ডেলিভারির ডেট আরো তিনদিন পরে।তবুও যাতে কোনরকম সমস্যা না হয় তাই আগে আগেই মায়াকে হসপিটালে এডমিট করে দিতে বলেছে ড.মিতালী।
মায়াকে নিয়ে নিচে নেমে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান।জ্যাক আর জেনি অনবরত চেটে দিচ্ছে মায়াকে।তারাও হয়তো বুঝতে পারছে মায়া কয়েকদিনের জন্য কোথাও যাচ্ছে।তাদের সাথে দেখা হবেনা।
মায়া হাত উঠতেই তারা আরিয়ানের শরীরে সামনের পা ঠেকিয়ে দুইপায়ে দাড়িয়ে গেলো।মায়ার যেনো তাদের ঝুঁকে আদর না করতে হয় সেজন্য।দুজনের মাথায়ই হাত বুলিয়ে দিলো মায়া।আরিয়ান বললো,
—“এবার যাই?ওদেরকে নিয়ে যাক?”
মায়ার একটু মন খারাপ হলেও সে মুচকি হেসে বললো,
—“আচ্ছা নিয়ে যান।”
তন্ময় বসলো ড্রাইভিং সিটে।ইতি বসেছে পিছনে মায়া আরিয়ানের সাথে।আরিয়ানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছে মায়া।আধো ঘুম আধো জাগা সে।কয়েকবারই সে বলেছে তার হাল্কা পেট ব্যাথা করছে।হসপিটালেই যাচ্ছে তাই আর আরিয়ান ড.মিতালী কে ফোন দেয়নি।তন্ময় ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছে।কোনরকম ঝাঁকুনিতে যেন মায়ার কোনো সমস্যা না হয়।গাড়ি চুপচাপ।মাঝেমধ্য টুকটাক কথা বলছে তারা।
হঠাৎই হুট করে মাথা উঠিয়ে আরিয়নের বাহু খামছে ধরলো মায়া।চোখগুলো বড় বড় করে আরিয়ানের তাকালো সে।আরিয়ান সোজা হয়ে মায়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
—“মায়া?কি হলো?”
সাথে সাথে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো মায়া।লেবার পেইন উঠেছে তার।ব্যাথায় চোখ মুখ লাল হয়ে এলো।চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কোনরকমে সে বললো,
—“ব্যা..থা…হচ্ছে..খু..ব।”
ঘাবড়ে গেলো আরিয়ান।ডেলিভারির ডেট তো চারদিন পর তবে হঠাৎ করে পেইন উঠলে কেনো?তন্ময় এবার দ্রুত ড্রাইভ করছে।একটু পর পর জোরে চিৎকার করে উঠছে মায়া।পেইনটা ছড়িয়ে পরছে তার।কাঁপছে সে।আরিয়ানের শার্ট ভিজে যাচ্ছে চোখের পানিতে।মায়ার কষ্ট দেখে নিজেকে আটকে রাখতে পারছেনা আরিয়ান।এলোমেলো লাগছে তার।অনবরত মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলছে,
—“একটু সহ্য করো মায়া।একটু সহ্য করো।এইতো পৌছে গেছি।”
মায়া আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো।ঠোঁট কামড়ে বললো,
—“খুব….ক…কষ্ট হচ্ছে আমি…”
—“কথা বলোনা।জান আমার..এসে পরেছিতো।কিছু হবেনা তোমার।আমি আছিতো।”
গাড়ি থামলো।আরিয়ান নেমে গেলো।মায়া উঠতে পারছেনা।ইতি বেরিয়ে বললো,
—“আপু,উঠতে পারবেননা ভাইয়া।”
আরিয়ান আর কিছু ভাবলোনা গাড়ির ভেতর ঝুঁকে গিয়ে মায়াকে পাঁজাকোলা করে ধরে বলে,
—“মায়া,কষ্ট করে গলাটা ধরো।নয়তো ব্যালেন্স রাখতে পারবোনা।”
মায়া কাতরাতে কাতরাতে বলে,
—“আপনি আমাকে কোলে নিতে পারবেননা।আপনার কষ্ট হবে।”
আরিয়ান এবার জোরে ধমকে উঠে।বলে,
—“ধরো বলছি।”
মায়া সিক্ত নয়নে তাকিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
মায়ার এতো ভারি শরীর নিয়েও তাকে কোলে তুলে নিলো আরিয়ান।কোনরকমে দৌড়ে ভিতরে নিয়ে যেতেই স্ট্রেচার নিয়ে এলো ওয়ার্ডবয়।ড.মিতালী দৌড়ে এলেন।উনি মায়ার কেবিন ঠি কঠাক করে তাদেরই অপেক্ষা করছিলো।
মায়াক দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে বললো,
—“উনারতো ওয়াটার ব্রেক করছে।ডেলিভারি হবে।দ্রুত ওটিতে শিফ্ট করো।ফাস্ট”
তারপর আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“চিন্তা করবেননা।আপনার স্ত্রীর কিছু হবেনা।”
মায়াকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে।আরিয়ান তার সাথেই আছে।একমূহুর্ত একা ছাড়েনি।মায়া শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে।জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে সে।হসপিটালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে।
ড.মিতালী চলে এসেছেন।ওটিতে ঢুকানোর ঠি ক আগমূহুর্তে মায়া আধোআধে কন্ঠে বললো,
—“আপনাকে ছাড়া আমি ভেতরে যাবেনা।আমার ভয় লাগে।”
—“মায়া আমি…”।
আরিয়ানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মায়া বললো,
—“আমি কিছু জানিনা।আপনি আমার সাথেই থাকবেন।বললামতো আমার ভয় লাগছে।”
ড.মিতালী একমূহুর্ত তাকালেন।আরিয়ানের সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি বললেন,
—“আসুন।আপনিও ভেতরে আসুন।উনি পারবেননা আপনাকে ছাড়া”
আরিয়ান মায়ার হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেলো।এত ব্যাথা সহ্য করছে এই মেয়ে অথচ তার নাকি আরিয়ানকে ছাড়া ভয় করছে।ও
টিতে ঢুকানো হলো মায়াকে।নরমাল ডেলিভারিই হবে তার।ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছে।আরিয়ান শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে।তার চোখদুটো দিয়ে কখন যেন ভিজে গেছে নিজেও টের পায়নি সে।
মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বারবার সে বলছে,
—“আমি আছি মায়া।ভয় পেয়োনা।আমি আছি।”
হাঁড়ভাঙা তুমুল ব্যাথার মাঝেও এই একটা কন্ঠস্বর ক্রমাগত সাহস দিয়ে যাচ্ছে মায়াকে।এই মানুষটা না থাকলে হয়তো এই ব্যাথাতেই মারা যেত সে।জীবনে এরকম একটা মানুষের খুব দরকার।খুব!
~চলবে~