#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৫
গাড়ি একটা জায়গায় থেমে গেছে ব্যাপারটা বুঝতেই চোখ খুলে মায়া।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাসায় এসে পৌঁছেছে তারা।আরিয়ান নেমে গিয়ে তার পাশের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দেয়।
মায়া এক পা বাড়িয়ে মুচকি হেসে তার হাত ধরার আগেই তাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খায়।
আরিয়ান দ্রুতহাতে তার কোমড় পেচিয়ে ধরে বলে,
—“হোয়াট হেপেন্ড?খারাপ লাগছে?”
মায়া দুবার পিটপিট করে পলক ফেলে।নিজেকে সামলে নিয়ে মিহি স্বরে বলে,
—“নাহ্,ঠিক আছি।মিসব্যালেন্সড্ হয়ে গিয়েছিলাম।”
আরিয়ানের কুঁচকানো কপালটা স্বাভাবিক হয়।ভ্রু জোড়া স্হির করে সে মায়াকে সোজা করে দাড় করায়।গাড়ির দরজা আটকে দিয়ে একবার নিজের ফোনে চোখ বুলিয়ে মায়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে।ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজাচ্ছে কয়েকজন।
মায়া সেদিকে একবার তাকায়।অত:পর দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে।যত তারাতারি সম্ভব শাওয়ার নিয়ে নিচে নামবে সে।যদিও সন্ধ্যার দিকেও অফিসে খাবার আনিয়ে দিয়েছিলো আরিয়ান।তবুও প্রচন্ড খুদা পেয়েছে।একদম সহ্য হচ্ছে না।
।।
পাশের রুমের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে আসে আরিয়ান।মায়াও শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে তখন।তার পরণে হাঁটু অবধি সাদা রংয়ের ফ্রক,সাদা পায়জামা,সাদা ওড়না।পরিপূর্ণ সাদা শুভ্রময়ী রুপ।আধভেজা চুলগুলো থেকে ঝড়ঝড় করে পানি পরছে।
চুলে তোয়ালে পেচিয়ে সে আরিয়ানকে দ্রুত বলে,
—“চলুন,খেতে চলুন।”
আরিয়ান শপিং ব্যাগগুলো কাবার্ডে রাখতে রাখতে একবার তাকিয়ে বলে,
—“চুলটা মুছে নাও।তারপর যাই।”
—“চুল মোছা লাগবেনা।আমার ক্ষুদা লেগেছে।আপনি আসেনতো।”বলে দরজার দিকে যেতে উদ্যত হয় সে।
আরিয়ান ভ্রু কুচকে তাকায়।মেয়েটার হঠাৎ এতো ক্ষুধা কেন লাগলো।এভাবে ভেজা চুলে থাকলে নির্ঘাত ঠান্ডা জ্বর হয়ে অসুস্থ হবে।
আরিয়ান ঘুরে গিয়ে তার হাত টেনে বিছানায় বসায়।পেঁচানো তোয়ালেটা খুলে নিয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে বলে,
—“আরে বাবা,ঠান্ডা লেগে যাবেতো।পাঁচটা মিনিট দাও,মুছে দেই।তারপর যাচ্ছি”
মায়া বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।পাঁচমিনিট শেষ হলেই আরিয়ান তোয়ালে পাশে রেখে দেয়।চুলগুলো হাত দিয়ে সারা পিঠে সুন্দরমতো ছড়িয়ে দিয়ে বলে,
—“চলো,বাকিটা এমনিই শুকিয়ে যাবে।’
খাবার টেবিলে বসে আছে ইতি,তন্ময়।আরিয়ান,মায়া নিচে নেমে তাদের সাথে বসলে খেতে শুরু করলো তারা।মায়া মাঝেমধ্য এটা ওটা বলছে।তন্ময়কে কোথায় গিয়েছিলো কি করেছে এসব জিজ্ঞেস করছে।তন্ময়ও বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে সুন্দরভাবে সবকিছুর উওর দিচ্ছে।
।
।
খাওয়া দাওয়া শেষ।তন্ময়,ইতি যার যার রুমে চলে গিয়েছে।মায়া আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আচরাচ্ছে।ঘড়িতে বারোটা বেজে যাচ্ছে।ঘুমানোর জন্য আগেই বিছানা গুছিয়ে রেখেছে সে।কানে ফোন নিয়ে একটু আগে ব্যালকনিতে গিয়েছে আরিয়ান।হয়তো জরুরি কোনো ফোন!
হঠাৎই রুমে এসে মায়াকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নেয় আরিয়ান।হাতের চিরুনিটা ফ্লোরে পরে যায়।
মায়া তার গলা জড়িয়ে ধরে আৎকে উঠে বলে,
—“কি করছেন?”
আরিয়ান উওরে স্মিত হাসে।মায়াকে কোলে নিয়েই দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।সিড়িঘর অনেকটাই অন্ধকার।মায়াকে কোলে করে ছাদের দিকে উঠতে নিলেই মায়া বিস্মিত কন্ঠে বলে,
—“এতরাতে ছাদে কি করবেন?অন্ধকারে পড়ে যাবোতো।”
আরিয়ান উঠতে উঠতেই বলে,
—“আমার কোল থেকে পড়ে যাবে তুমি?আর আমি তোমাকে পড়ে যেতে দিব?”
বলতে বলতেই ছাদে এসে দাড়ায় তারা।ছাদ অন্ধকার।সুনসান নিরবতা।
মায়াকে কোল থেকে নামাতেই চারিদিকে সোনালী রংয়ের লাইট জ্বলে উঠে।মায়ার উপর আছড়ে পরে কতগুলো গোলাপের পাপড়ি।বিস্ময়ে থমকে যায় মায়া।দুহাতে মুখ চেপে জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।পুরো ছাদ লালগোলাপ দিয়ে সাজানো।একটা কর্নার বেলুন দিয়ে ঘেরা।
আরিযান তাকে বাহু ধরে কাছে টেনে চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুইয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
—“হ্যাপি বার্থডে মায়াবতী”।
মায়া ছলছল দৃষ্টিতে তাকায়।ইতি,তন্ময় বেরিয়ে আসছে।দুজনের মুখেই তৃপ্তির হাসি।তারা দুজনই হাসিমুখে বলে,
—“হ্যাপি বার্থডে ম্যাম।”
মায়া মিষ্টি করে হাসে।তার মনেই ছিলোনা তার জন্মদিনের কথা।মূলত নিজের জন্মদিনটা তার কাছে খুব বেশি অপ্রিয়।কোনোকালেই জন্মদিন পালন করেনি সে।তাই এই দিনটা বিশেষভাবে কখনোই মনে থাকেনা তার।
কারণ এতদিন সে জানতো তার জন্মদিনের দিনই তার মা মারা গিয়েছে।তার বাবাতো তাকে এটাই বলেছিলো যে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে।তাই এ দিনটা তার মায়ের মৃত্যুদিনও বটে।সেজন্যই এ দিনটার উপর বিতৃষ্ণা ছিল তার।বরং জন্মদিনটা অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের চেয়ে একটু মন খারাপেই কাটতো তার।
তবে এখন সে জানে তার মা কে তার বাবা মেরেছে।সে তার জন্মদিনের দিন মারা যায়নি।তার মায়ের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী না।
এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে জল এসে পরে মায়ার।আরিয়ান খুব সন্তর্পনে তার চোখের জলটা মুছিয়ে দিতে বলে,
—“আমি জানি তুমি কখনো এ দিনটা কখনো সেলিব্রেট করোনি।আর তার পিছে ছিলো একটা মিথ্যে কারণ।
যেটা তুমি জানো।তাই,এখন আর মন খারাপ করোনা।বারোটা বেঁজে গেছে।চলো কেক কাটি।”
মায়া নিজেই চোখদুটো ভালো করে মুছে নেয়।হেসে বলে,
—“আপনি এমন কেন?সবসময় মন ভালো করে দেন।”
বেলুন ঘেরা জায়গাটায় কেক কাটার টেবিল রাখা।টেবিলের চারপাশে বেলুন দেয়া।পিছে ফোলা ফোলা বেলুনে ইংলিশ অক্ষরে “Happy Birthday Maya” লেখা।কেকের উপরেও একই লেখা।আরিয়ান তাকে কারো সামনে”মায়াবতী”ডাকেনা।যখন তারা একান্তে থাকে তখনই মায়াবতী ডাকে।তাই হয়তো এখানে “মায়াবতী” লেখেনি।তার কন্ঠ থেকে “মায়াবতী” ডাকটা একমাত্র মায়াই শুনেছে।
মায়া কেক কাটে।সর্বপ্রথম আরিয়ানকে খাইয়ে দেয়।আরিয়ান তখন একহাতে মায়ার এলো চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিচ্ছিলো।মায়ার মুখে উজ্জল হাসি।সে অবস্থাতেই ছবি তুলে তন্ময়।ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যায় একটা স্বৃতি।আশেপাশে সবকিছু লাল রং দিয়ে সাজানো।তার মাঝে সাদা জামা পরিহিত মায়াকে যেন একটা শুভ্রপরী লাগছে।
ইতিকে খাইয়ে তন্ময়কে ডাকে মায়া,
—“তন্ময় ভাইয়া,আসেন।ইতি যাওতো তুমি ছবি তুলে দাও।”
তন্ময় ইতস্তত কন্ঠে বলে,
—” না না ম্যাম।আমাকে খাইয়ে দেয়া লাগবেনা।”
আরিয়ান ধমকে উঠে বলে,
—“কেন?তুই কি পর কেও?আয় জলদি।”
তন্ময় ইতির দিকে ক্যামেরা এগিয়ে দেয়।মায়া মুচকি হেসে এক টুকরো কেক তুলে দেয় তার মুখে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার,জ্যাক আর জেনিও বসে আছে মায়ার পায়ের কাছে।আফটার অল,তারাও পরিবারের একটা অংশ।কিন্তু তাদের কেক খাওয়ানো যাবেনা।কেকের ক্রিমে পেট খারাপ করবে।নয়তো তাদেরও কেক দিতো মায়া।আরিয়ান বারণ করায় আর দেয়নি।
______________
রাত প্রায় ১টা বাজে নিচে নেমেছে তারা।মায়ার চোখেমুখে খুশি ঝিলিক দিচ্ছে।হাত ধুয়ে মাত্র বিছানায় বসেছে।তখনই আরিয়ান কাবার্ড থেকে কিছু বের করে নিয়ে আসে।তার সামনে একহাঁটু গেড়ে বসে মায়ার পায়েল পরানো পা টা টেনে নিজের পায়ের উপর রাখতেই মায়া ভ্রু কুচকে বলে,
—“কি হয়েছে?পায়ে তো কিছু হয়নি।”
আরিয়ান হাতের মুঠো থেকে সেই লাল রুবি পাথরের পায়েলটা বের করে বলে,
—“তোমার জন্মদিনের উপহার।আমি জানি এটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছিল।”
মায়া মূহূর্তেই চুপ হয়ে যায়।এতক্ষনের উজ্জল চেহারাটা নিমিষেই কালো মেঘে ছেঁয়ে যায়।দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে কাতরকন্ঠে সে বলে,
-–-“আমার পায়েলটা খুলবেননা প্লিজ।ওটা বাবা দিয়েছিলো।”
আরিয়ান ঠোঁট এলিয়ে হাসে।মায়ার পায়জামাটা একটু তুলে পায়েলটার দিকে তাকায়।সাথে পাথরের সুন্দর একটা পায়েল।যেদিন এটা মায়াকে পরিয়ে দিয়েছিলো তখন থেকে আজ অবধি মায়াকে একবারের জন্যও এটা খুলতে দেখেনি সে।এমনকি শাওয়ার শেষে মেয়েটা কাপড় দিয়ে রোজ পায়েলটা মুছে।যেন সেটা ভিজে না থাকে।পায়েলটা যে মায়ার জন্য খুব স্পেশাল সেটাও আরিয়ান জানে।রাশেদ চৌধুরি দিয়েছিলো বলেই হয়তো এটাকে এতো ভালোবাসে মায়া।
দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে আরিয়ান।মায়ার কাতর চেহারার দিকে তাকিয়ে বলে,
—“এটা আমি কখনোই খুলবোনা মায়াবতী।তোমার বাবার স্বৃতি তোমার থেকে নিয়ে নেয়ার অধিকার আমার নেই।আর থাকলেও আমি সেই অধিকার ফলাবো না।আমি জানি তোমার বাবাকে তুমি কতটা ভালোবাসো।শত হলেও তোমার বাবা।তোমার বাবার প্রতি তোমার ভালোবাসা নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই।তাই এই পায়েলটা খোলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।আমি শুধু এই ভালোবাসাটার সাথেই তোমাকে আমার ভালবাসাটাও পরিয়ে দিতে চাই।মে আই?”
মায়া ছলছল নয়নে তাকায়।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই আরিয়ান ওই পায়েলটার সাথেই লাল পায়েলটা পরিয়ে দেয়।সাদা পাথর আর লাল পাথরটা মিলে অদ্ভুত সুন্দর লাগে পা টা।
আরিয়ান তার পা টা নামিয়ে উঠে গিয়ে মায়ার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
—“তুমি কি ভেবেছিলে?তোমার বাবার কথা শুনলে আমি রাগ করবো?”
মায়া উপর নিচে মাথা নাড়ায়।আরিয়ান বলে,
—“তোমাকে কখনো শত্রুতার মাঝে টেনে এনেছি আমি?”
মায়া ছোট্ট করে জবাব দেয়,
—“না”।
আরিয়ান হেসে বলে,
—“আমাদের সম্পর্টার মাঝে যাতে কখনো তোমার বাবা আর আমার সম্পর্কটা না আসে।তোমার সাথে আমার ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন।সবকিছু থেকে আলাদা।বুঝেছো?”
—“হু”।
মায়া আর কিছু বলেনা।আরিয়ান তার বাবার মৃত্যুর কারণ এটা সে কখনোই ভাবেনা।সে মানে তার বাবা তার কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে এবং সেটা আরিয়ানের দ্বারা।কিন্তু এসবকিছুর উর্ধে তার ভালবাসা।তার জীবনে সে দুজন মানুষকেই প্রচন্ড ভালোবাসে তারা হলো তার বাবা আর আরিয়ান।কোন কারণে কখনোই এদের ঘৃণা করেনি সে।আর না কখনো করবে।
_______________
গভীর রাত…
ঘুম ভেঙে যায় মায়ার।আরিয়ান তাকে বুকে জাপটে নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।মায়া জড়ানো কন্ঠেই তাকে ডাকে,
—“একটু উঠবেন?”
মায়ার প্রথম ডাকেই ঘুম ভেঙে যায় আরিয়ানের।মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ভ্রু কুচকে সে বলে,
—“কি হয়েছে?খারাপ সপ্ন দেখেছো?”
—“উহু”।
—“তবে?ঘুম ভেঙেছে কেন?”
মায়া এবার আরিয়ানের হাত সরিয়ে উঠে বসে।ঘাড় ঘুড়িয়ে আরিয়ানের দিকে চেয়ে বলে,
—“আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
~চলবে~
#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৬
নিস্তব্ধ রজনী।পুরো বাড়ি অন্ধকার।শুধু আরিয়ানের রুমে লাইট জ্বলছে।
মায়া বসে আছে বিছানার মাঝখানটায়।তার সামনে দুটো প্লেট রাখা।একটায় পাস্তা,আরেকটায় নুডলস্।
পাস্তার প্লেটটা ইতিমধ্যেই খালি।আর নুডুলস এর টায় একটু আছে।সেটাই খাচ্ছে মায়া।
আরিয়ান বসে আছে তার মুখোমুখি সোফায়।তার একহাতে ফোন।তবে তার দৃষ্টি সেদিকে নয় সে চেয়ে আছে মায়ার দিকে।মেয়েটার এতো ক্ষুধা পেয়েছে!রাতেও বলছিলো ক্ষুধা লেগেছে।হঠাৎ এতো ক্ষুধা লাগছে কেনো?আগে তো দু’চামচ খেয়েই বলতো “পেট ভরে গেছে”,”আর খাবোনা”আরো কতোরকম বাহানা।
নাহ,মেয়েটার খাওয়া দাওয়ার দিকে আরো যত্নশীল হতে হবে তাকে।নয়তো কি শুধু শুধুই মাঝরাতে এতো ক্ষুধা থাকে পেটে!
নুডুলসের শেষ চামচটা মুখে দেয়ার আগে মায়া বললো,
—“শেষ কিন্তু।খাবেন একবার?”এর মধ্যে আরো পাঁচ ছয়বার মায়া জিজ্ঞেস করে ফেলেছে তাকে খাওয়ার কথা।প্রতিবারই আরিয়ান মানা করেছে।এবারো মানা করার পর মায়া তেঁতে উঠলো।নুডুলসটা মুখে তুলে চিবাতে চিবাতে বললো,
—“তা খাবেন কেন?এটা খেলেতো আপনার পেট খারাপ হবে!!আপনি একমাস অসুস্থ থাকবেন!।
আরিয়ান চোখ কুচকায়।মায়ার আজকাল ঘন ঘন মুড সুইং হয়।শুধু শুধুই চিল্লিয়ে উঠে আবার পরক্ষনেই শান্ত হয়ে যায়।
চুপচাপ ফোনটা রেখে উঠে যায় সে।প্লেট দুটো একসাথে করে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিয়ে মায়াকে পানির গ্লাস দেয়।পানি খাওয়া শেষে হাত দিয়ে ঠোঁট মুছিয়ে দিয়ে বলে,
—“শোও তুমি।আমি আসছি।”
আরিয়ানের পরণে শুধু ধুসর রংয়ের ট্রাওজার।উপরে টি-শার্ট পরেনি সে।গরম পরেছে বেশ।রুমে এসি ছাড়া বিধায় বোঝা যায় না।কিন্তু একটু বাইরে বের হলেই জীবন শেষ।রাতের বেলা হলরুমের এসি বন্ধ ছিলো।একজন সার্ভেন্ট কে মায়ার জন্য খাবার বানাতে বলে একটু বসেছিলো সেখানে।ব্যস!সেখানেই দরদর করে ঘাম ছুটে গেলো।ছোট থেকেই গরম সহ্য হয়না তার!।
ওয়াশরুমে যেয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিতেই দরজায় জোরে জোরে বাড়ি দেয়ার শব্দ হলো।মায়া চাপা স্বরে ডাকছে,”দরজা খুলেন,জলদি।”
আরিয়ান দ্রুত দরজা খুলে দিতেই তাকে সরিয়ে বেসিনের উপর হরহর করে বমি করে দিলো মায়া।
মায়ার হঠাৎ এমন করায় বিচলিত হয়ে পরে আরিয়ান।মুখ উপর করে বমি করছে মায়া।আরিয়ান তার থুবড়ে পরা চুলগুলো একহাতে মুঠ করে ধরে।পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।মেয়েটার এতো শরীর খারাপ সে বুঝতেই পারলোনা!।ততক্ষনে বমি থেমেছে মায়ার।দুহাতের আজলায় পানি নিয়ে কুলি করে মুখে পানি দিয়ে চোখ বন্ধ করে আরিয়ানের বুকে সাইড করে মাথা ঠেকায় সে।আরিয়ান পাশে ঝোলানো টাওয়ালটা হাতে নেয়।সারামুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“বেশি খারাপ লাগছে মায়া?”
মায়া উওর দেয়না।আবারো গা গোলাচ্ছে তার।আরিয়ান টাওয়ালটা জায়গামতো ঝুলিয়ে রাখতেই আবারো বমি করে মায়া।এতক্ষন যা খেয়েছিলো কিছুই হজম হয়নি তার।আরিয়ান এবার নিজেই ট্যাপ ছেড়ে দেয়।চিন্তায় অস্থির লাগছে।মেয়েটা এতো অসুস্থ কখন হলো?ফুড পয়েজন হলো নাকি?নতুবা এতো বমি হচ্ছে কেন?এই ভোরবেলা ডাক্তারইবা পাবে কোথায়?
মায়া তার বুকে মাথা এলিয়ে রেখেছে।আরিয়ান নরম শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
—“রুমে নিয়ে যাবো?নাকি আরো বমি হবে?”
মায়া অস্পষ্ট স্বরে বলে,
—“বমি হবে।কিন্তু আসছেনা।”
আরিয়ান ফাঁকা একটা ঢোক গিলে।বমি আসলেও বমি না করতে পারা যে কতটা কষ্টের তার জ্বর হলে বুঝতে পারে।মায়ার থেকে বেশি অস্থির লাগছে তার।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সে বলে,
—“আচ্ছা,একটু ওয়েট্ করি।হয়ে যাবে।”
পাঁচমিনিট পার হয়ে গেলে দুবার জোরে জোরে কাশি দেয় মায়া।সাথে সাথে মুখভর্তি বমি হয় তার।তৃতীয়বারের মতো মুখ মুছিয়ে দিয়ে আরিয়ান নিরস কন্ঠে বলে,
—“আরো বমি করবে মায়াবতী?”
মায়া দু’পাশে মাথা নাড়ায়।আর বমি হবেনা তার।পেটে যা ছিলো সব বের করে দিয়েছে।তিনবার বমি করে প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।আরিয়ান তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়।পরণের জামা গলার দিকে ভিজে গেছে।লাইট নিভিয়ে মায়ার জামা চেন্জ করে দেয়।ততক্ষনে ঘুমিয়ে পরেছে মায়া।আরিয়ান তার পাশে সুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ক্রমাগত।সারারাতেও একবারও তার মাথা থেকে হাত সরায়না।
আজকাল নিজের কাজে নিজেই অবাক হয় আরিয়ান।আগে নিজে বমি করলেও ঘেন্না হতো।বমির দিকে তাকাতে পারতনা পর্যন্ত।রাস্তাঘাটে কাউকে বমি করতে দেখলেও গা গোলাতো।অথচ আজ মায়ার প্রতি ঘেন্না তো দূর একফোঁটা বিরক্তিও আসেনি তার।বরং মেয়েটার অসুস্থতায় অজানা একটা ভয় কাজ করছিলো।
__________
সকাল সকাল মায়াকে দ্রুত রেডি হতে বলেছে আরিয়ান।তাকে নিয়ে হসপিটালে যাবে।যদিও ঘুম থেকে উঠার পর দূর্বলতার ছিঁটে ফোঁটাও ছিলোনা তার মধ্য।আরামে নাস্তা খেয়ে বাগানে বসে জ্যাক আর জেনির সাথে খেলা করছিলো।তখনই আরিয়ানের কড়া আদেশ।”দ্রুত তৈরি হও,হসপিটালে যাবো”।মায়া মানা করলেও শুনেনি সে।অগত্যা রেডি হতে হচ্ছে।
ক্রিম কালারের থ্রিপিস পরে চুলগুলো হাল্কা করে ঝুটি করে নিলো মায়া।
আরিয়ান বসে বসে কফি খাচ্ছে আর মনোযোগ দিয়ে মোবাইল স্ক্রল করছে।মায়া ওড়নাটা দু’কাধে দিয়ে হাতে সেফটিপিন নিয়ে আরিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“আটকে দিন।”
আরিয়ান পিন হাতে নিয়ে মায়ার দিকে তাকায়।মায়াকে একদম স্বাভাবিক লাগছে এখন।বোঝাই যাচ্ছেনা কাল রাতে এত অসুস্থ ছিল মেয়েটা।
ওড়না আটকে দিতে দিতে সে স্বাভাবিকভাবেই বলে,
—“তোমার পিরিয়ড মিস হয়েছিলোনা লাস্ট মান্থে?”
মায়া চমকে তাকায়।লজ্জা লাগে তার।কোনরকম উপরনিচে মাথা দোলায় সে।আরিয়ান এককাঁধের পিন আটকে আরেক কাঁধেরটা আটকে দিতে দিতে তীযর্ক কন্ঠে বলে,
—“এই মাসে?”
মায়া দৃষ্টি নিচের দিকে নিয়ে মিহি স্বরে বলে,
—“ডেট আসেনি এখনো।”
আরিয়ান ওড়নাটা ঠিক করে দিয়ে উঠে দাড়ায়।সে যা ধারণা করছে তাই যদি ঠিক হয়?হাহ্!হসপিটালে গেলেই বোঝা যাবে।
আজকে আবার তন্ময়ের বাবা,মা আসবে।তারা গ্রামে থাকেন।তন্ময়রে বিয়ে এখানেই হবে তাই আসবেন।
যদিও একয়বছরে হাজারবার আরিয়ান তাদের এখানে থাকার কথা বলেছে।কিন্তু তারা থাকবেনা।গ্রাম ছাড়া নাকি তাদের ভালো লাগেনা।তন্ময় প্রতিমাসে যেয়ে দেখে আসে।তন্ময় শহরে এসেছিলো পড়াশোনার সুবাদে।তারপর এখানেই আরিয়ানের সাথে দেখা সাক্ষাত।কাজকর্মের ভীড়ে আর গ্রামে ফিরেনি সে।
_______________
মায়ার অসুস্থতার লক্ষন গুলা শুনেই ড.মিতালী সর্বপ্রথম মায়াকে যেই কথাটা বলেন তা হলো,
—“আপনি কি প্রেগন্যান্ট?টেস্ট করিয়েছেন?”
মায়া থতমত খেয়ে যায়।তার পাশে বসেছিলো আরিয়ান।সেই উওর দেয়,
—“নাহ্,টেস্ট করেনি।”
ড.মিতালী মুচকি হেসে তার ড্রয়ার থেকে একটা প্রেগন্যান্সি কিট বের করে দেয়।মায়ার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে দিকে ইঙ্গিত করে বলে,
—“আপনি টেস্ট করে আসেন।আমার ধারণা ভুল নাহলে খুব সম্ভবত আপনি কনসিভ করেছেন।”
মায়া আমতা আমতা করে আরিয়ানের দিকে তাকায়।তার মেজাজের গতিবিধি লক্ষ্য করার চেষ্টা করে।ড.মিতালী বলার এক মাইক্রোসেকেন্ড আগেও তার মাথায় প্রেগন্যান্সির বিষয়টা আসেনি।সে আসলেই খুব বোকা।এজন্যইতো আরিয়ান সকালে ওসব বলছিলো।তখনো বিষয়টা মাথায় আসেনি তার।
।
।
স্পষ্ট দুটো লাল দাগ।মায়া কয়েকবার ঢোক গিলে।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।
খুশিতে চোখ টলমল করছে তার।ঠোঁট কাঁপছে।চোখের জলটা মুছে সে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বের হলো।
ড.মিতালীর দিকে সেটা এগিয়ে দিতেই উনি উজ্জল হেসে বললেন,
—“কংগ্রেচুলেশন!সি ইজ্ প্রেগন্যান্ট।”
আরিয়ানের মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা যায়।জোড়ে একটা শ্বাস ছেড়ে সে বলে,
—“থ্যাংকস ডক্টর।কিন্তু ওর প্রেগন্যান্সিতে কি কোনো কমপ্লিকেশন আছে?আই মিন,ও তো ছোট এখনো।
রিস্কি হবেনা ব্যাপারটা?”
ড.মিতালী স্মিত হাসে।সাধারণত কাউকে এখবরটা দেয়ার পর প্রথমে সে নিজের সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করে।বলে”আমার বেবি ঠি ক আছেতো?”তারপর আসে স্ত্রীর কথায়।তবে আরিয়ানের ভালবাসা দেখে সে সত্যিই মুগ্ধ।
আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল রেখে হাত মুষ্ঠি বদ্ধ করে টেবিলের উপর রেখে সে বলে,
—“দেখুন মি.আরিয়ান।”মা হওয়া” এই বিষয়টাই খুব সেনসিটিভ।খুব সহজ ব্যাপার এটা নয়।আপনি রেগুলার চেকআপ করাবেন।স্ত্রীর যত্ন নিবেন।বাকিটা আল্লাহর হাতে।
আমি বুঝতে পারছি আপনার কনসার্নটা।আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে আপনি খুবই সিরিয়াস।নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,সাধারণত এমনটা দেখা যায়না।এদিক দিয়ে আপনার স্ত্রী খুব লাকি।”
যাইহোক,আপনার স্ত্রী মেইবি দেড়মাসের অন্ত:সত্তা।তবুও আপনারা টেস্ট করিয়ে নেন।শিওর হওয়ার জন্য।রিপোর্ট আমি দেখে দিবোনে।নো প্রবলেম।”
|
|
গাড়ি চলছে।আরিয়ান ধীরগতিতে ড্রাইভ করছে।কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
মায়া চুপচাপ বসে আড়চোখে আরিয়ানকে পর্যবেক্ষন করছে।আরিয়ানের মেজাজটা ঠি ক বুঝে উঠতে পারছেনা সে।লোকটা কি রেগে আছে?নাকি খুশি হয়েছে?নাকি অন্যকিছু?কিছুই বুঝতে পারছেনা।
সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত,সাবলীল দৃষ্টিতে ড্রাইভ করছে সে।চোখে মুখে কোনো অনুভূতি নেই।
বেশ খানিকক্ষন পর গাড়ি জ্যামে আটকায়।গাড়ির জানালা আটকানো।ভিতরে এসি ছাড়া।তাই আজ আর গরম লাগছেনা দুজনের।
ধৈর্যহারা হয়ে মায়াই জিজ্ঞেস করে,
—“আপনি কি খুশি হননি?”
আরিয়ান শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।ঠোঁটের কোঁণে হাসি ফুটিয়ে একেবারে মায়ার দিকে ঝুকে যায়।বলিষ্ঠ হাতজোড়া মায়ার দু’গালে রেখে কপালে গভীর থেকে গভীরতম উষ্ম ঠোঁটের স্পর্শ দেয়।কয়েকমিনিট কেটে গেলেও ঠোঁট সরায়না সে।মায়া চোখ বন্ধ করে রেখেছে।কপালে চুমু দিলে এতো শান্তি লাগে কেনো?স্নিগ্ধ পবিত্র স্পর্শ।
মায়া অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলতে নিলেই আরিয়ান ঠোঁট সরায়।তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
—“মায়াবতী,আমার এই গোটা জীবনে হাতে গোনা দু’বার শুধু আমি বাস্তবিকভাবে খুশি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।এক যেদিন আমি আমার মা বাবার খুনিকে শাস্তি দিতে পেরেছি।আর দ্বিতীয়ত যেদিন তোমাকে আমি সম্পূর্ণ রুপে নিজের করে পেয়েছি।তাছাড়া খুশি শব্দটা আমার উপভোগ করার সুযোগ হয়নি।আজ তৃতীয়বারের মতো আমি খুশি।একেবারে বাঁধভাঙা খুশি।আমার থেকে খুশি এই পৃথিবীতে কেউ আছে নাকি সন্দেহ আছে।
তবে অতিরিক্ত খুশিতে আমি অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছি।নিজেকে প্রকাশ করতে পারছিনা।
কেমন যেন লাগছে!আমি বাবা হবো ভাবতেও শ্বাস আটকে আসছে।
এটুকু বলতেই থামে আরিয়ান।কাঁধে একফোঁটা পানির অস্তিত্ব অনুভব করে মায়া।থমকে গেছে সে।
বেশি খুশি হলে কি মানুষ কাঁদে?অনুভূতি গুলো কি জলরূপে বেরিয়ে যায়?হয়তো যায়।
আরিয়ান নিজেকে সামলায়।একহাতে মায়ার গলা জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে বলে,
—“আপনার সকল সুখ,ভালবাসা,আবেগ,অনুভূতি শুধু এবং শুধু তোমাকে ঘিরেই হোক মায়াবতী।”
~চলবে~
বি:দ্র-রি-চেক হয়নি।বানান ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।”