আঁধার
৩৯.
রাকা বলল, ” কী করবি তুই? কয়টা টাকা হয়ে গেছে তো আসমানে উঠে গেছস তাই না? ”
মাহমুদ ভাই কিছু বলার আগেই কলিংবেলের শব্দে রাকা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দেখি দুজন সুঠাম দেহি পুরুষ। হাতে খাবারের ব্যাগ একজনের, অন্যজনের হাতে ফাইল আর সিডি। মাহমুদ ভাই তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ” একদম ভালো সময়ে এসেছ তোমরা। ”
দুজনের মধ্যে একজন বললেন, ” ভাবলাম দেরি হয়ে গেছে। ”
” আরেনা মামুন একদম ঠিক সময়ে। ” মামুন তার হাতের ফাইল মাহমুদ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন। মাহমুদ ভাই হাত বাড়িয়ে নিলেন। তারপর ফাইল খুলে কাগজপত্র ভালো করে দেখে নিলেন।
” মেইন কাগজগুলো তো সেফ জাগায় আছে? ”
” হ্যাঁ, সবকিছু রেডি। ” মামুন বললেন। আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” ইনিই কি রাসেল সাহেব? ”
মামুনের সাথে অন্য যেজন এসেছেন তিনি বললেন, ” হ্যাঁ, উনিই।”
মাহমুদ ভাই বললেন, ” মাসুদ তুমি কীভাবে জানলে? ”
” কয়েক সপ্তাহ আগে আপনাদের বিল্ডিংয়ের সিসিটিভি ফুটেজে উনাকে দেখেছিলাম। সব সিডিতে সুন্দর করে ডেট টাইম সহ সাজিয়ে রাখা আছে। ” মাসুদের মুখে বিজয়ের হাসি।
” এটাই তো চাচ্ছিলাম। ” মাহমুদ ভাই বললেন। আমাকে যে মাহমুদ ভাই অল্পতে ছাড়বেন না। সেটা বোঝাই যাচ্ছে । রাকাকে উদ্দেশ্য করে মাহমুদ ভাই বললেন, ” যাও তো তিনটা প্লেট নিয়ে আসো। আর খাবার পানি, গ্লাস। ” রাকা রান্নাঘরে চলে যাওয়ার পরে মামুন বললেন, ” একটা কপি কিন্তু আপনার শ্বশুড়বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ”
রাকা প্লেট নিয়ে আসার পরে আমরা খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। পেটে যে এতো খুদা ছিলো বুঝতেই পারেনি। ভয়াবহ রকমের একটা দিন যাচ্ছে আমার। কীভাবে এখান থেকে বের হবো ভাবতেই পারছি না। মাহমুদ ভাই সিডি ছাড়লেন। রাকাকে জোর করে মাহমুদ ভাই ধরে রাখলেন। সবার সামনে নিজের অকাম কুকামের ভিডিও দেখার মতো সাহস মনে হয় নাই। ভিডিও শুরু হওয়ার পরে আমার অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
” ভাই আমার দ্বারা এসব দেখা সম্ভব না। ”
মাসুদ বললেন, ” আপনার প্রেয়সীর আসল রূপ না দেখে কেনো যাবেন?”
” যা দেখেছি যথেষ্ট। আমি এতেই সব বুঝতে পারছি। ”
” নাটক আর কতো করবে মাহমুদ? ” রাকা চিৎকার করে বলল।
” হোটেলে গিয়ে অন্যান্য পুরুষদের সামনে জামাকাপড় খুলতে তো লজ্জা করে না। তাহলে এখন কেনো লজ্জা পাচ্ছ?” মাহমুদ ভাই বললেন।
” আমি তোমার নামে মানহানীর কেস করবো। ”
রাকা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল।
মাহমুদ ভাই রাকার মান ইজ্জত সব সুন্দর করে খুলে দিয়েছেন।
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” যা ইচ্ছা কর তুই আর তোর বাপ। আমি আমার দিক থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছি। তোর গায়ে আমি এখনো পর্যন্ত হাত তুলিনি। এর কারণ আমি হাত তুললেই তুই একটা কারণ পাইয়া যাবি কেস করার। তা নাহলে তোরে চিপা মাইর দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিতাম। তারপর রাসেলের সাথে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবি। তোর মতো হোরকে আমি আমার সংসারে রাখবো না। আমার রুচি এতো খারাপ না। ” মাহমুদ ভাই থামার সাথে সাথে আমি বললাম, ” আমি রাকাকে নিতে পারবো না। ”
রাকা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, ” তুই নিবি না তোর বাপে নিবে। ”
” সরি রাকা। আমার জীবন অলরেডি তুমি জাহান্নাম বানায় দিছ। এখন তোমাকে নিলে তো আমি পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবো। তার উপর তোমার এক পুরুষে হয়না। তোমার রেগুলার একজন করে নতুন পুরুষের প্রয়োজন হয়। তোমার জায়গা আমার কাছে না। তোমার জায়গা নিষিদ্ধপল্লীতে। ” কথাগুলো বলতেও আমার বাঁধেনি। আমার খালাতো বোন যে এতো খারাপ হতে পারে ভাবতেও পারেনি।
মাহমুদ ভাই বললেন, ” রাসেল তুমি তো জোশ একটা কথা বলেছ। আসলেই ওখানে রাকা গেলে একসাথে টাকা আর নিজের তৃপ্তি মেটাতে পারে। ”
রাকার হাতে কাঁচের গ্লাস ছিল। ফ্লোরের উপর আছড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ” আমি তোমাদের সবাইকে দেখে নিব। ”
মাসুদ বললেন, ” এতো সোজা না বুঝছেন। আপনার নিজের তো টাকাপয়সা, যোগ্যতা নাই। যা আছে বাবা আর স্বামীর। তারমধ্যে স্বামী তো একটু পরই বাসা থেকে এক কাপড়ে আপনাকে বের করে দিবে। আর আপনার বাবা কতটুকু করবেন সেটা তো এখনো জানেন না। ”
” তোমার আশিকদের মধ্যে একজন অলরেডি পিছিয়ে গেছে। বাকিগুলোর খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। ”
আমার এখানে থাকাটা আর সম্ভব না। অনেক বেশি লোড নেয়া হয়ে গেছে আমার। এই রাকার হাত প্রথম যখন ধরেছিলাম তখন কি ভেবেছিলাম যে, ও আমার জীবনটাকে এইভাবে নরক বানায় দিবে?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ” ভাই আমি তাহলে যাই। ”
” রাসেল একটা কথা বলি মনে রেখো। জীবন ছেলেখেলা না যে যাকে তাকে যখন ইচ্ছা বিশ্বাস করে বসে থাকলাম। আর তার কথা চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিলাম। বিশ্বাস করার আগে ভেবেচিন্তে করতে হয়। তোমার যে ভুল সেই ভুলের জন্য কিন্তু অন্য কেউই পস্তাবে না। নিজেকেই পস্তাতে হবে। রাকার এই ঘটনা কিন্তু আজ কালের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাবে। আর এতে তুমি জড়িত থাকায় তোমার উপরও ঝামেলা আসবে। এই ঝামেলার জন্য তোমার অবস্থা কী হবে বুঝতে পারতেছ? ”
” আমার পাপের শাস্তি তো আমাকেই পেতে হবে। ”
” শুধু তোমার একা কিন্তু না। তোমার স্ত্রী’র অবস্থা কেমন হবে ভাবতে পারো? যদিও ওকে আমি বলেছি রাকাকে তোমার সাথে পাঠিয়ে দিব। ”
” কী? ” তাই তো বলি মাহমুদ ভাই আমাকে এখনো কিছু কেনো বলেননি।
” এটা তোমার শাস্তি। তোমাকে এতো সহজে আমি কেনো ছাড়বো?”
” ওশান কি সেইফ জায়গায় আছে? ”
” হ্যাঁ, আল্লাহর রহমতে। ”
” আমি যাই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাই। আপনি না হলে আজকে একটা অভিশপ্ত জীবন শুরু করে বসতাম। ”
” এখনো কি অভিশপ্ত না? ”
” হ্যাঁ, অনেক বেশি। ”
” তাও তোমার হাতে অপশন আছে রাসেল। তোমার একটা ভালো বউ আছে। আমার তো কেউই নেই। প্রচণ্ড ভালোবাসছি এই রাকাকে। এতটা যে ওর আসল রূপ জানার পর থেকে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ”
মাহমুদ ভাইয়ের চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। আমি দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। সন্ধ্যা হবে হবে এমন একটা সময়ে। কখন যে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না৷ রাকা অগ্নিমূর্তির মতো বসে ছিল। ওর ওই চেহারা দেখারও ইচ্ছা নাই আমার। সে আমার সুন্দর সংসারটা ভেঙে দিল এভাবে! মা – বাবার কথা আমার শোনা উচিৎ ছিল।
( মিলা )
” আপা কিছু খাবেন না? ” আট দশ বছরের বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করলো। আমি বাচ্চাটার দিকে না তাকিয়ে বললাম, ” এক কাপ চা দিতে পারবা? ”
” আপা আমরা তো চা বেঁচি না। চটপটি আর ফুসকা বেঁচি। ”
” আমাকে এক কাপ লাল চা এনে দাও। আমি তোমাকে বখশিশ দিব। ”
” পাশেই তো চায়ের দোকান৷ আপনি নিজে গেলেই তো পারেন। ”
” তুমি একটু এনে দাও। ” বাচ্চাটা আমার অনুরোধ ফেলতে পারলো না। অনেক সময় যাবত এভাবে একা বসে থাকতে দেখে হয়তোবা ওর করুণা হয়েছে। বাসায় যেতে ইচ্ছা করছেনা। বাসায় তো কেউ আমার অপেক্ষায় নেই। কেউ তো নিজের ভালোবাসার কাছে চলে গেছে।
” আপা আপনার চা। ” বাচ্চাটা হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি নিয়ে নিলাম। তারপর ব্যাগ থেকে বিশ টাকার নোট ওর হাতে দিলাম। ছেলেটা চলে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। সাথে সাথে এখানে প্রথম রাসেলের সাথে আসার কথা মনে পড়ে গেল। এই স্মৃতিগুলোও বেহায়া। মানুষটার সাথে চলে যায় না কেনো? বেহায়ার মতো চিপকে থাকে। সবকিছু চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। চায়ের কাপে আধা খাওয়া চা ফেলেই বাসার দিকে পা বাড়ালাম। অল্পবয়সী, আমার বয়সী, মধ্যবয়সী অনেক ছেলে মেয়ে এখানে আড্ডা দিচ্ছে। পাঁচ ছয়জনের একটা দল গোল হয়ে পুকুরের পাশের যে সরু রাস্তা সেখানে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এই দলে একজন গিটারিস্ট আছে আর একজন গায়ক। গিটারিস্ট গিটারে ডুব দিয়ে তার মনের সুর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করছে। আর গায়ক গলা ছেড়ে এই রাতের কৃত্রিম আলোতে নিজের সব দুঃখ, কষ্ট, সুখ উগড়ে দিচ্ছে। আর বাকিরা মন দিয়ে শুনছে। আমার জীবন কেনো এদের মতো হলো না? আমি কেনো আজীবন অন্যের পাপের শাস্তি পেয়ে গেলাম? আমি কেনো আজীবন আঁধারেই থেকে যাবো? চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনতা পানি। এতদিন অনেক কষ্টে আটকে রেখেছিলাম। রাসেলকে বুঝতে দেয়া যাবেনা যে, আমি তাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। জানতে দিলেই সে আমাকে নিয়ে নতুন খেলা শুরু করবে। আমি না পারবো সেই খেলা থেকে বের হয়ে আসতে। না পারবো সহ্য করতে। সে তো ঠিকই তার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে নতুন জীবনে পা দিয়ে দিয়েছে। আর আমি? সিড়ি ধরে নেমে গেলাম পুকুরের দিকে। বাসায় যাওয়া অর্থ কয়েকশ বেহায়া স্মৃতির আনাগোনা সহ্য করা! এতটা সহ্যশক্তি আমার নেই।
*****
রাসেল নতুন বাসস্ট্যান্ডের কাউন্টারের বারান্দায় বসার জায়গায় চুপচাপ বসে আছে। রাত দশটার বেশি বাজে। আস্তে আস্তে মানুষের আনাগোনা কমে যাচ্ছে। রাসেল ভাবছে, আমি এখন কী করবো? মিলার কাছে ফিরে যাবো? কিন্তু ও তো বিশ্বাসই করবেনা আমি তার কাছেই ফিরে আসার চিন্তায় বিভোর ছিলাম। সে আমাকে একটা বারও আটকায়নি। আর আটকাবেই বা কেনো? আমি তো তাকে বুঝাতেই পারিনি যে যা ঘটেছিল রাকার সাথে সবকিছুই তার আমার জীবনে আসার আগে। তার আসার পরে আমি তার মাঝেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। কোন মুখ নিয়ে যাবো? মাহমুদ ভাই আমাকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছেন।
আসলেই উপযুক্ত শাস্তি। একেতে এতদিন যে বিশ্বাসের উপর সে ছিলো সবই আজকে ভুলে রূপ নিয়েছে। তার উপর যার প্রতি আসলে ভালোবাসা ছিল। তার কাছে যাওয়ার সব পথ বন্ধ। সে নিজের মতো জীবন গড়ে তুলতে ব্যস্ত!
মিলা জুবিলী ট্যাংকের পুকুরে পা ডুবিয়ে দিয়ে বসে আছে। আশেপাশের খোঁজ তার নেই। সে আনমনে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক সময় যাবত চোখ দিয়ে আর পানি বের হচ্ছে না। মানুষ কাঁদতে কাঁদতে একসময় নাকি কাঁদতে ভুলে যায়। হয়তোবা তার এই সময় খুব দ্রুত এসেছে। না, সে আর আঁধারে নিশ্বব্দ সরীসৃপের মতো থাকবেনা। সে মানুষের মতো মেরুদণ্ড সোজা করে এই আঁধার থেকে বের হয়ে আসবে আলোর দিকে। হয়তোবা সময় লাগবে কিন্তু একদিন তো আলোর পথে এসে ঠেকবেই সে। মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করছে সে। ভালোবাসছে তো কী হয়েছে? তাই বলে কি সে ভালোবাসার মানুষের দেয়া অন্ধকারেই ডুবে নিজেকে শেষ করে দিবে নাকি?
সমাপ্ত।
~ Maria Kabir