আঁধার
৩০.
ভয়ে ভয়ে বাসার দিকে এগিয়ে গেলাম। কেনো যেন মনে হচ্ছে খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে ঝড়! কোনোকিছু করতে মন চাচ্ছে না। শুধু দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম যদি। কিন্তু সেটা সম্ভব না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। মিলা অপেক্ষায় আছে। খালি হাতে যেতে মন চাচ্ছে না। শিশু হাসপাতালের সামনে থেকে পেয়ারা আর ভেলপুরি কিনে বাসায় ফিরলাম। এখানে আসলে বাচ্চাদের কান্নার শব্দ কানে আসবেই। প্রতিদিন কত কত শিশু জন্ম নিচ্ছে এখানে। ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরলাম। কলিং বাজাতেই মিলা দরজা খুলে দিল। আমার হাতে খাবার দেখে মুখ ভার করে বলল, ” এগুলো আনার প্রয়োজন ছিলো না। বাসায় এমনিতেই আজকে অনেক কিছু আছে। ”
” খেতে ইচ্ছে করল তাই আনলাম। ” ভেতরে ঢুকে খাবারের প্যাকেট টি-টেবিলের ওপর রেখে বললাম।
” আপনি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। তারপর কথা বলা যাবে। ”
” খুব ক্লান্ত লাগছে আমার। মন চাচ্ছে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় পড়ে থাকি। ”
” তারজন্য আপনাকে ফ্রেশ হতে হবে। বিছানার চাদর আর ঘর ময়লা হলে আমার কষ্ট হয়ে যাবে। ”
” কাপড় চোপড় না হয় এখন থেকে আমি ধুয়ে দিব। ” শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললাম।
” আপনার গুলো ধুলেই হবে। আর আপনি আরেকটু পরিষ্কার হলেই আর কিছু করার প্রয়োজন হবেনা আপনার। ” মিলা ভেলপুরির প্যাকেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে কথাগুলো বলল। রাকার নাম্বার থেকে আর ফোন আসেনি। যদি এতো সহজে পিছু ছাড়ে তো আলহামদুলিল্লাহ!
” চা না কফি খাবেন? ” মিলা রান্নাঘর থেকে প্রশ্ন করলো।
” চা দিও। ” বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধোয়ার সময় বিনে ব্যবহৃত প্যাড চোখে পড়লো। তার অর্থ মিলার প্রেগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই। মন খারাপ করবো নাকি ভালো করবো বুঝতে পারছি না। বাথরুম থেকে বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ, হাত মুছে ড্রয়িংরুমের দিকে গেলাম৷ টি – টেবিলের উপর মাঝারি আকারের ওয়েসিসের কেকের প্যাকেট। মনে হয় মিলার বান্ধবীরা এনেছিল। মেয়েদের যে কতরকমের শখ থাকে আল্লাহ ভালো জানেন। কেকের প্যাকেটের পাশে বেলপুরি আর নুডুলস রাখা। ঘড়িতে কাটায় কাটায় আটটা বাজে। মিলা ছোট্ট ট্রে-তে করে দুই মগ চা নিয়ে টি – টেবিলে রেখে আমার গা ঘেঁষে বসলো। মনে হলো ও কিছু বলতে চায়।
” কিছু বলবে? ” কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার। গলা দিয়ে খুব কষ্টে দু’টো শব্দ বের হয়েছে।
মিলা আমার কানের কাছে ঠোঁট এনে স্বাভাবিক স্বরেই বলল, ” শুভ জন্মদিন প্রিয় । ”
” জন্মদিন? কার? ”
” আপনার আর কার হবে? ” মিলা মুচকি হেসে বলল।
আমি আমার জন্মদিন অব্দি ভুলে গেছি। আসলে মনে করিয়ে দেয়ার মতোও তো কেউ নেই। মা বাবা জন্মদিন পালন, উইশ পছন্দ করেন না৷ বড় আপা ও ছোট আপা রাকার ব্যপার নিয়ে আমার সাথে কথা বলেন না। একজনই বেস্টফ্রেন্ড ছিলো। তাকেও আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছি। কারণ সে আমাকে এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার জন্য বলতো। তার মুখের বুলিই হয়ে গিয়েছিল, ” এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আয় দোস্ত। ওই মেয়ের এখন বিয়ে হয়ে গেছে। এখন নিজেকে শক্ত করে সবকিছু শেষ করে দে। ”
শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম।
” তুমি জানলে কী করে? ” আমার ওর সাথে কথা বলতে হবে। চুপচাপ বসে থাকলে, কথাবার্তা কম বললে মিলা সন্দেহ করে বসতে পারে।
” আপনার বড় আপা ফোন দিয়ে আমাকে বলল। ”
” বড় আপা তোমাকে ফোন দেয়? ” মিলার সাথে আমার ফ্যামিলির সবারই মোটামুটি যোগাযোগ হয়। কিন্তু এরা আমাকে ফোন দেয়না। কারণ জানে যে আমি শুধরানোর না। আচ্ছা তাদের কেউ কি আমার আর রাকার ব্যাপারটা ওকে বলে দিয়েছে কিনা? দিলে তো মিলা এতো স্বাভাবিক ব্যবহার করতো না। এভাবে হেসে কথা বলত না।
” হ্যাঁ, ছোট আপাও ফোন দেন। ”
” আমি আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজকে আমার জন্মদিন। এই বয়সে আবার জন্মদিন! ”
” এজন্যই তো আমি মনে করিয়ে দিলাম৷ আমি ভাবলাম আমি আপনাকে উইশ করিনি বলে মন খারাপ করে অম্বিকায় বসে আছেন। ”
” আরেনা। তোমার জানার কথাই না। আমিই ভুলে গেছি! ” হাসার চেষ্টা করলাম। মিলাকে বুঝতে দেয়া যাবে না। শেষে দেখা যাবে আমাকে জিজ্ঞেস করে উত্তর না পেয়ে। আমার বোনদের জিজ্ঞেস করে বসতে পারে।
” তাহলে এখন কেক কাটবেন। তারপর আমাকে কেক খাইয়ে দিবেন। চকলেট ফ্লেভার কেক আমার খুব পছন্দের। ” মিলার আর আমার মধ্যের পার্থক্য মাত্র কয়েক ইঞ্চি।
” আর আমাকে? ” আমার প্রশ্নে মিলা চোখ নামিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো।
” কী যে জিজ্ঞেস করেন আপনি! খাবারের সাথে আপনার তুলনা হয় নাকি? ”
” না, হয়না। ” মিলা কেক কাটার জন্য প্রস্তুত করে দিল। পাশে কেক কাটার ছুড়ি ছিল। দুই পাউন্ডের চকলেট কেক। খুবই সিম্পল একটা কেক। উপরে ইংরেজিতে হ্যাপি বার্থডে রাসেল লেখা। লাস্ট বার কেক কেটেছিলাম কবে মনেও নেই। রাকার সাথে রিলেশনের পরে দেখা গেছে প্রতিবার জন্মদিনের আগে আমাদের ঝগড়া হতো। আর ও রাগ করে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিত। অতীত থেকে নিজেকে টেনে বর্তমানে নিয়ে আসলাম। ছোট্ট একটা মোমবাতি কেকের উপর দিয়ে গ্যাস লাইট দিয়ে জ্বালিয়ে দিলো মিলা।
” এখন ফু দিয়ে নিভান। আমি হ্যাপি বার্থডে গানটা গাইবো। ”
মিসেসের হুকুম পালন করলাম। মিসেস গুনগুনিয়ে হ্যাপি বার্থডে গানটা গাইলো। কেক খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে মিলা ভেলপুরির বাটি নিয়ে বসল।
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” আমাকে দিবা না? ”
” ভেলপুরি একা আমার। এই জিনিসে কোনো ভাগ হবেনা। ”
” আরে এক পিস তো দাও। ”
” না ”
” ওকে যাও লাগবেনা। কিন্তু আমার চা যে ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেটার কী হবে? ”
” আজকে ঠান্ডা চা’ই খেতে হবে। ”
ভেলপুরির বাটি আমার হাতে দিয়ে বলল, ” এক পিস খেতে পারেন। আপনার মন খারাপ হয়ে গেছে। ” মিলা জানেনা আমার মন খারাপের মূল কারণ কী! জানলে আমার চেহারাও দেখতেও চাইবে না। আমার এখন কী করা উচিৎ? হামজার সাথে কথা বলতে হবে। একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড আমার!
( রাকা )
রেড ওয়াইন গ্লাসে ঢেলে দিল টিউলিপ। মুচকি মুচকি হাসছে। আমার হেরে যাওয়ার কারণে তার মুখে এই হাসি। ম্যান্ডি তার গ্লাসের লাস্ট ওয়াইন টুকু গলায় ঢেলে আমার উদ্দেশ্যে বলল, ” ওইরকম হাজারটা তোমার লাইফে যাবে আসবে। রাসেলের আছে কি যোগ্যতা? না আছে টাকা না আছে সম্পদ। ”
গ্লাসটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি। কত সুন্দর রঙ। ঠিক রক্তের মতো! এক ঢোক নিতেই মনে হলো মিলার রক্ত গলা দিয়ে নেমে গেল। আহ! কি শান্তি!
টিউলিপ আমার হাত থেকে গ্লাসটা নেয়ার মেকি চেষ্টা করল। নিতে না পেরে মেকি রাগ দেখিয়ে বলল, ” আপু, এটা ঠিক হচ্ছে না। এটা দিয়ে আপনার ছয় পেগ হয়ে গেল। বাসায় কীভাবে ফিরবেন? ”
” বাসায় এভাবেই ফিরবো। ”
” ভাইয়ার কানে গেলে আপনার তো ঝামেলা হবে। ” টিউলিপ বলল।
” ফাক ইওর ভাইয়া। ওরে আমি গুণি নাকি? কী করবে ও আমাকে? ওর চৌদ্দগুষ্টিরে জেলের ভাত খাওয়াবো আমি। আমার বাপির যে ক্ষমতা ওর ধারে কাছে আসার ক্ষমতাও হবেনা। ”
” কিন্তু ওশান তো বাসায় একা তাই না রাকা? তোমার নিজের সন্তানের দিকে তো তাকাতে হবে। এভাবে নেশা করে যদি বাসায় যাও। তাহলে তো ওর উপর একটা প্রেশার দেয়া হয়ে যাবে। ”
” ম্যান্ডি স্টপ ইওর ফাকিং লজিক। ” ম্যান্ডি আমার কথায় হাসলো।
” রাসেলকে মনে হয় খুব ভালোবাসো? ওর মধ্যে আছে টা কী? একদিন দেখতে হয়। ” ম্যান্ডি শয়তানের মতো হেসে বলল।
” হ্যাঁ, খুব ভালোবাসি। আর ওর দিকে তাকানোর সাহসও করবে না। ও শুধু আমার। হি ইজ মাইন। ”
” তাই নাকি? কিন্তু সে তো বউ নিয়ে ভালোই ফূর্তিবাজিতে মত্ত আছে। তার বউ তো তাকে রেগুলার বেডে পাচ্ছে। পারলে তার বউকে গিয়ে কিছু বলো। এখানে বসে ওয়াইন গিললে তো কাজ হবেনা। ” ম্যান্ডি দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
” অবশ্যই করবো। কেনো করবো না? সে আমার কলিজায় হাত দিয়েছে। এতো সহজে ব্লাডি হোরটাকে আমি ছাড়বো? ” ঘড়ির কাটা নয়টা ছুই ছুই! বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না। আমার এখন রাসেলকে লাগবে বেডে। তাকে ছাড়া আমার তৃপ্তি আসেনা।
চলবে…
~ Maria Kabir