আঁধার পর্ব-২৯

0
1248

আঁধার

২৯.

বাসায় যেতে মন সায় দিল না। অম্বিকা ময়দানের বসার জন্য বেশ কয়েকটা সিট বানানো আছে। ইন্টারে পড়া অবস্থায় এখানে প্রায়ই চুপচাপ বসে থাকতাম৷ রাকার জন্য অপেক্ষা করতাম। সেখানের একটায় গিয়ে বসলাম। আমার মতো অনেকেই এখানে বসে আছে। একা মনে হয় আমিই। অম্বিকার বাউন্ডারির সাথে চারজন খাবার বিক্রি করেন৷ একজন চা, বিস্কুট বিক্রি করেন। আর বাকি সবাই ভাজাপোড়া আর শীতের দিনে পিঠা। অন্যদিন হলে কিছু না কিছু কিনে খেতাম। কিন্তু আজ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। রাকার সাথে সম্পর্ক শুরুর সময় কি ভেবেছিলাম যে এভাবে শেষ হবে সবকিছু? তাকে আমি কখনোই ভালোবাসিনি। কিন্তু এই চরম সত্যটা কীভাবে আমি বুঝতে পারলাম না! ভেবে পাচ্ছি না। মানুষ কেনো ভালোবাসে? অনেকেই বলে কারণ নেই ভালোবাসায়। কিন্তু আমি তো দেখি কারণ আছে। মানুষ ভালোবাসে তার শূন্যতা পূরণ করার জন্য। মানুষের মধ্যে শূন্যতা থাকে। যখন সে কাউকে ভালোবাসে তখন সেই শূন্যতা পূরন হয়। সবারই এমন একজন প্রয়োজন যার আগমনে পূর্ণতা আসবে। যার আগমনে স্থিরতা আসবে। যার আসার পরে অন্য কাউকে দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করা যাবেনা। সে চলে গেলেও সেই শূন্যতা জুড়ে থাকবে। কিন্তু রাকা কখনোই আমার সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি। নিজেকে বুঝ দিতাম যে, কাছে নেই তাই হয়তোবা এমন শূন্য শূন্য লাগে নিজেকে।
কিন্তু না, আসলে তাকে ভালোই বাসতে পারিনি। পরমাণু গুলো কেনো যৌগ তৈরি করে? এর উত্তর হচ্ছে – স্থিরতা পাওয়ার জন্য। নিষ্ক্রিয় পরমাণুর ন্যায় ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জনের জন্য। এখন কথা হচ্ছে, নিষ্ক্রিয় পরমাণুরই ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করতে হবে? কারণ, তাদের এই ইলেকট্রন বিন্যাসের জন্যই তারা অন্য কোনো পরমাণুর সাথে বন্ধনে যায়না। অর্থাৎ তাদের অন্য কাউকে প্রয়োজন নেই। ঠিক এই কারণে অন্যান্য পরমাণুও সেই কাজ করে। নিজেকে স্থির আর তাদের অরবিটাল ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ করতে চায়। মানুষও তেমন। তারাও এমন কাউকে চায় যে, তাদের মধ্যে স্থিরতা, পূর্ণতা নিয়ে আসবে। রাকা পারেনি করতে। মরিচীকার পেছনে বারো তেরোটা বছর কীভাবে ব্যয় করে দিলাম। ভাবতেই খারাপ লাগছে। বাবা কতবার বলেছেন,” এটা ভালোবাসা না। এটা তোর মোহ৷ ওই মেয়ে তোকে একটা ঘোরের মধ্যে ডুবিয়ে রাখছে। যখন ঘোর কাটবে তখন দিশা খুঁজে পাবিনা। ”

আমি উল্টো রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার দরকার ছিলো। তখন আমি রাস্তায়, মসজিদে, মাজারে রাত কাটায় দিছি। মা বলেছিলেন, ” রাকা তো বিয়েতে রাজি। ও তো না করেনি। তুই তাহলে কার জন্য এভাবে নিজেকে কষ্ট দিতেছিস? ”

তখনও যদি বুঝতাম, ভালোলাগাকে ভালোবাসা ভেবে বসে আছি। তাহলেও সবকিছু এতো ঘোলাটে হতো না৷ মিলাকে না হয় এখন কিছু জানালাম না। কিন্তু একটা সময় তো সে জানবে। তখন আমি তাকে কী বলবো? সে তো মানতেই চাইবে না। তাকে আমি হারানোর ক্ষমতা রাখি না। মিলাকে বাসর রাতে প্রথম যখন ঘোমটাপরা অবস্থায় দেখলাম। তখন অন্যরকম কিছু একটা অনুভূতি কাজ করছিল। আমি বুঝিনি। ভেবেছি বিয়েতে রাজি ছিলাম না তাই মনে হয় এমন লাগছে। নিয়ম মানার জন্য ওর ঘোমটা খুলে যখন শান্তশিষ্ট মুখটা দেখলাম। ভেতরে যে অস্থিরতা ছিলো সেটা একটু একটু করে কমে যাচ্ছিল। চোখ তুলে যখন তাকালো। তখন মনে হলো কেউ একজন আমাকে ধাক্কা দিল জোরে সোরে। পণ করেছিলাম, রাকা ছাড়া অন্য কোনো নারীর কাছেই যাবো না। কিন্তু মিলার চাহনি আর তার সাথে টুকটাক কথাবার্তায় নিজেকে আর আটকে রাখতে পারিনি। মেয়েটাও আমাকে কোনো ব্যাপারে না বলেনি। যা বলতাম তাই মেনে নিত। এটা করিনা কেনো? ওটা করিনা কেনো? এমন কোনো প্রশ্নই তার নেই। কমদামী শাড়ী দিয়ে তার লাগেজ ভরে দিয়েছিলাম। ওইসব শাড়ী ওদের বাড়ির কাজের মেয়েরা পরে। কিন্তু এই মেয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত বলেনি। এই শাড়ী গুলো পরবো না। কেনো দিয়েছেন? কিচ্ছু না। আমি চাইতাম তার থেকে দূরে থাকতে আর ঘটতো উল্টোটা। তাকে কাছে পাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করতে পারতাম না। আসলে আদম সন্তানের বড্ড তাড়াহুড়া! যদি তখন ফ্রেন্ডরা তো প্রেম করছে তাহলে আমি একা থাকবো কেনো? এটা না ভেবে ভাবতাম, সঠিক মানুষটা একসময় আসবেই। তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। আল্লাহ তাকে একদম ঠিক সময়ে আমার জীবনে নিয়ে আসবেন। তাহলে আজকে আমাকে এতো বিশ্রী একটা চক্রে জড়াতে হতো না। রাকা এভাবে আমাকে ছাড়বে না। এই মেয়ে বিয়ের পরেও আমাকে ছাড়েনি। আর এতো সহজে আমাকে মুক্তি দিবে? আর সে কি আমাকে ভালোবাসছে? বাসেনি, বাসলে সে অনেক আগেই আমার সাথে চলে আসতো। সে আমাকেও কাছে চাইবে আবার সংসারও করবে মাহমুদ ভাইয়ের! এটা কীভাবে সম্ভব? এখন সে পুরোপুরি আসতে চাচ্ছে কারণ আমি মিলাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি। আমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছি। এখন সে অস্থির হয়ে উঠেছে। আমি বিয়ে করতে চাইনি। সেই জোর করে বিয়ে করিয়েছে। এখন সে আসতে চাচ্ছে। মাঝখান দিয়ে মিলা কি ফাউ? সে কি দোষ করেছে যে তাকে সংসার ছাড়া হতে হবে? তার তো কোনো দোষ নেই এখানে? সে কেনো আজীবন অন্যের পাপের শাস্তি পাবে? আমি আর রাকা পাপ করেছি। শাস্তি আমরা দু’জন পাবো। এখন আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। রাকা কিছু একটা তো করবেই।
মোবাইলের রিংটোনে ভাবনা থেকে বের হয়ে আসলাম। মিলার নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রিসিভ করলাম।

মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।

বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি

https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham

” আপনি কোথায়? ”

” এইতো অম্বিকায় বসে আছি। ”

” ফ্রেন্ডদের সাথে? ”

” না ”

” বাসায় আসুন। মন ভালো হয়ে যাবে। ”

” তুমি কীভাবে বুঝলে মন খারাপ? ”

” একা একা বসে আছেন। মন খারাপ থাকলে অনেকেই একা একা থাকতে পছন্দ করে। ”

” আর কিছুক্ষণ থাকি। তুমি বোর হচ্ছ না তো? ”

” না, তবে তাড়াতাড়ি আসলে ভালো হয়। আপনার অনেক পরিশ্রম হয়ে যাচ্ছে। রেস্টের প্রয়োজন আছে। ”

” আমি নিবন্ধন পরীক্ষা দিব না। ”

” ঠিকাছে দেয়া লাগবেনা। আপনি আগে বাসায় আসুন। ”

” তুমি রাগ করবা না, পরীক্ষা না দিলে? ”

” না তো। রাগ করবো কেনো? ”

” নিবন্ধনে টিকে গেলে বেতন তো বাড়তো। অল্প বেতনে তোমার সমস্যা হয়। সারাদিন একাই সব কাজ করতে হয়। কাজের লোক রাখার মতো সামর্থ্য আমার হয়না। দাম দিয়ে ভালো কিছু কিনেও দিতে পারিনা। ”

” আমার সমস্যা হয়না। আমি এভাবে আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। একটা থাকার জায়গা আছে, তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারছি। রাতে বিশ্বস্ত মানুষের পাশে শান্তিতে ঘুমুতে পারছি। এতেই আলহামদুলিল্লাহ। যদি অভাব চলেই আসে তাহলে আমি নাহয় কিছু একটা করবো। ”

” ইন্টার পাশে জব হয়? ”

” হয় তবে অনেক খাটুনির কাজ হয়। সরকারি চাকরিও আছে। তবে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকতে হবে। এমন ধরনের। ”

” ঘরের কাজও করবা আবার চাকরিও করবা। মানে মাথা ঠিক আছে? ”

” এখন আছে। আপনি দ্রুত বাসায় আসুন। কতক্ষণ ঠিক থাকে তার ঠিক নেই। ” মিলা মনে হয় হাসছে।

” ঠিকাছে আসছি। তোমার বান্ধবীরা চলে গেছে? ”

” হ্যাঁ ”

” ভাজাপোড়া কিছু খাবে? ”

” না, তাহলে রাতের খাওয়ায় অনিয়ম হয়ে যাবে। ”

চলবে…

~ Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে