আঁধার
২৫.
” আমি কী এমন করলাম যে আপনার মন ছুঁয়ে দিলাম? ”
” জানিনা ” সত্যিই আমি জানিনা।
” একইভাবে আমি পথের খোঁজ জানিনা। ”
” কথা জানো তো তুমি। ”
” ছোট বেলা থেকে তো কথা শুনেই আসছি। এখন একটু বলার সুযোগ পেয়েছি। সেই সুযোগ কি হাত ছাড়া করা যায়? ”
” না যায়না। ”
মিলা কিছু একটা বলতে যাবে তখন ওর মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। আমাকে ছেড়ে দিয়ে মোবাইলের কাছে এগিয়ে গেল। রুমে এসেই মোবাইল ওয়ারড্রবের উপরে রেখেছিল। ফোন রিসিভ করলো৷ আমি কথোপকথন মনযোগ দিয়ে শোনার জন্য প্রস্তুত হলাম।
” আসসালামু অলাইকুম আম্মা । ”
…
” জ্বী, আল্লাহর রহমতে ভালো। আপনি কেমন আছেন? ”
…
” আব্বা ভালো আছেন? বড় আপা ও মেজ আপা? ”
…
” হ্যাঁ, উনি পাশেই আছেন৷ দিব উনাকে? ”
…
মিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে মোবাইল হাতে নিতে বলল ইশারায়। চোখের ইশারায় কত সুন্দর করে কথা বলে! আমি যন্ত্রের মতো মোবাইল হাতে নিলাম।
” হ্যালো আম্মা ”
” কীরে খবর টবর কী? আসবি কবে আমাদের এখানে? ”
” নেক্সট ছুটিতে আসবো। তুমিই তো পারো ফরিদপুরে আসতে। ”
” হ, তোগো একটা মাত্র মুরগির খুপরির মতো ঘরে থাকতে আসবো? তোরা শুবি কোথায়? ”
” আম্মা, আমাকে এইভাবে অপমান করতে পারলা? ”
” হ পারলাম। কতবার কইলাম আরো চাকরির পরীক্ষা দে। না, সে আর দিবে না। এখন খুপরিতেই থাক। ” মিলা বাথরুমে গেল বাসার থ্রিপিস নিয়ে।
” আচ্ছা দেবোনে আম্মা। ”
” সত্যিই নাকি আমাকে ডস দিচ্ছোস? ”
” সত্যিই আম্মা। ওর অনেক কষ্ট হয়ে যায় সাবলেটে থাকতে। মুখে কিছু বলে না। কিন্তু বুঝি। ”
” আল্লাহর রহমত রে। বউয়ের জন্য যাক তোর মায়া হইছে। এজন্যই তোরে জোর করে বিয়া করাইছি। আর ওই শাকচুন্নির পিছন তো ছাড়বি। ” মা এইসময়ও রাকাকে টানলেন।
” মা রাখছি। ”
” তারমানে তুই এখনো চুন্নির লগে যোগাযোগ রাখছিস? ”
” আম্মা, আমি এই বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না। ”
” বাজান, এখন তো ছাড়। বিয়ে করছিস, সংসার হইছে। বউডাও লক্ষ্মী। ”
যত নিষিধ করবো তত সে কথা বাড়াবে। ভাগ্য ভালো মিলা পাশে নেই। ওর কানে গেলে ঝামেলা বেঁধে যাবে। যা করতে হবে গোপনে।
মোবাইল হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করলাম। আননাউন নাম্বার থাকলে সেটা টুকে রাখতে হবে। এক্সদের সাথে যোগাযোগ আছে কিনা জানা দরকার। কিন্তু কোনো আননাউন নাম্বার পেলাম না। সব সেভ করা নাম্বার। আর সব ওর আত্মীয় স্বজন, বান্ধুবী। সবচেয়ে অবাক হলাম আমার নাম্বার ‘ টুসকু ‘ নামে সেভ করেছে। এটা আবার কী নাম?
মিলা কখন যেন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে৷ খেয়ালই করিনি৷ আমার ঘাড়ে এক হাত রাখার পরে বুঝলাম। প্রায় লাফিয়ে উঠলাম৷
” আমার এক্সদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। ”
” না। আমি দেখছিলাম আমার নাম্বার কী নামে সেভ করেছ সেটা। ”
” টুসকু ”
” এই নাম কেনো? ”
” প্রতিটা মানুষ তার প্রিয়জনকে এক বা একাধিক নাম দেয়। আমি আপনার জন্য এটা রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম কোনোদিন যদি এমন কাউকে পাই তাহলে এই নামে ডাকবো তাকে। ”
” আমাকে তো একবার এই নামে ডাকোনি। ”
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” নামটা ফিক্সড করলাম আজকেই। ”
” আমি তো কোনো নাম দেইনি তোমাকে। ”
” যখন মনে হবে তখন দিবেন। জরুরী না যে আমি যাকে প্রিয়জন ভাবি তাকেও আমাকে প্রিয়জন ভাবতে হবে। ”
মিলা কথাটা শেষ করেই রুম থেকে বের হয়ে গেল৷ আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর মোবাইল রেখে আমিও বের হয়ে গেলাম। বড় দুলাভাইকে খুব মনে পড়তেছে।
*****
” উঠুন ”
” উঁহু ”
” উঠুন ” মিলা কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলছে।
” কিন্তু কেনো? ”
” আগে উঠুন। তারপর বলবো। ”
” ক’টা বাজে, মিলা? ”
” রাত তিনটা ”
” এখনো সকাল হয়নি মিলা। ” অনেক রাতে ঘুমিয়েছি। সবার সাথে গল্পগুজব করতে করতে রাত বারোটা বেজে গেল। তারপর রুমে এসে ঘুমাতে ঘুমাতে সাড়ে বারোটা। কাঁচা ঘুম ভাঙলে মাথাব্যথা শুরু হবে।
” আমি জানি৷ আপনি উঠুন৷ তা নাহলে কিন্তু আমি একাই যাবো। ”
লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। মিলা আমার এভাবে উঠে বসা দেখে শব্দ করে হাসলো। হাসির শব্দ শুনে চোখ খুললাম। ড্রিম লাইট জ্বালানো।
” এই রাতে কোথায় যাবা? ” বিরক্তিকর পরিস্থিতি।
” আমি একা না, আপনিও যাবেন৷ ”
” সকালে যাবো। আসো ঘুমাই। ”
” আপনি ঘুমান৷ আমি গেলাম। ” মিলা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ছিলো। বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে পা বাড়ালো।
” এই দাঁড়াও। আমিও যাবো। ” ঘুম ঘুম চোখে কোনোমতে হাফহাতা গেঞ্জিটা পরে নিলাম। ভাগ্যিস ট্রাউজার পরে ঘুমায় ছিলাম৷ তা নাহলে এই কানা রাতে লুঙ্গী খুলে ট্রাউজার পরতে গেলে আরেক ঝামেলায় পড়তে হতো।
মিলা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। এখনো চোখ মুখে ঘুম লেগে আছে। বাড়ির উঠান থেকে নেমে জঙ্গলের দিকে নিয়ে গেল। মোবাইলটা আনা প্রয়োজন ছিলো। আল্লাহ জানেন, এই মেয়ে আমাকে মেরে ফেলবে না তো? প্রায় তো খবরের কাগজে নিউজ হয়। প্রেমিকের সাথে মিলে স্ত্রী স্বামীকে খুন করেছে। এই মেয়ের মাথা ঠিক নেই৷ মিলা গুনগুন করে গান গাইছে। খুব সম্ভব এরকম একটা লাইন বারবার গাইছে, ” কে যায় আসে রে.. ওই ভাটিয়ালির দেশে.. ”
এই ছমছমে জঙ্গলে আমাকে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে! জোছনার আলোয় মিলার কোমড় সমান চুলে চোখ গেল। এই মেয়ে কি আসলে মিলা? নাকি ওর রূপ নিয়ে এসে,আমাকে জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছে। পরে ঘাড় মটকে মাটিতে পুতে রাখবে। আল্লাহর রহমতে আজকে পূর্ণিমা! তখনই মনে পড়লো। ডাইনিরা পূর্ণিমা রাতে তার স্বীকার খুঁজতে বের হয়। দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করলাম। ছয় – সাত বার পড়ার পরে বুঝতে পারলাম আমি আসলে কালেমা শাহাদাৎ পড়তেছি।
” মিলা, আর কতক্ষণ? ” ভয়ে ভয়ে বললাম। দেখা গেলো প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য ঘাড় না ঘুরিয়ে মাথাটাই ঘুরিয়ে বসলো। ঠাকুমার ঝুলিতে শাক চুন্নি যেভাবে মাথা ঘোরায়, সেভাবে।
” এইতো এসেই গেছি। ”
” মিলা ”
” হু ”
” আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ”
” পৌঁছে গেলেই বুঝতে পারবেন৷ ” মিলা আমার দিকে ঘুরলো। ঠোঁটের কিনারে হাসি লেগে আছে। আরেক হাত দিয়ে আমার আরেকটা হাত ধরলো। তারপর দুই হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছি। পরনে সাদা জর্জেটের শাড়ী, ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক, চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় খেয়াল করিনি আর তখন ঘুমও ছিলো চোখে। এখন ঘুম নাই। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার থেকে কয়েক কদম পরে বিশাল পুকুর। পুকুরের চারপাশ দিয়ে গাছ পালা৷ পুকুরে লাল শাপলা ফুটে আছে। ভরা পূর্ণিমায় অপরূপ লাগছে এই পরিবেশ।
মিলার চোখে অদ্ভুত রহস্যের খেলা শুরু হয়েছে। আমাকে টেনে পুকুরের সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ না বলা দূরে থাক, আমি আরো এগিয়ে যাচ্ছি। মিলা উল্টো দিকে ভালো হাঁটতে জানে৷ একটা কদম উল্টো পাল্টা ফেলছে না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। তৃতীয় ধাপে এসে মিলা কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলল, ” আপনাকে আমি ভালোবাসি। ”
কানের কাছে মিলার নিঃশ্বাস আছড়ে পড়েছে। এতো ঠান্ডা যে আমি কেঁপে উঠলাম। মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। মিলা আবার নামতে শুরু করলো। এবার আমাকে টেনে নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। আমিই মিলাকে অনুসরণ করে নামতে লাগলাম।
আমি শুধু এই রমণীকে চাই! একমাত্র সঙ্গী হতে চাই তার। তার সকল সৌন্দর্য্য শুধু আমার। এবং আমি সেই সৌন্দর্য্য এই পূর্ণিমার রাতে…
চলবে…
~ Maria Kabir