আঁধার
২.
” তোমার কি পদ্মফুল ভালো লাগে? ” রাসেলের কথায় আমার খানিকটা বিরক্ত লাগলো। চুপচাপ বসে নিজের চিন্তায় ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু না তার আমাকে বিরক্ত করতেই হবে। পরে আবার মনে পড়লো তার বিরক্ত করার মানুষ নাই। আমি একাই তার জীবনের।
মা – বাবা, পরিবার পরিজন আছে কিন্তু স্ত্রী তো আমি একাই।
” হ্যাঁ, লাগে ” আসলে আমার ভালো লাগেনা৷ কিন্তু ওকে না বললে আরো কয়েকটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার থেকে একটা প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যা বলাই ভালো।
” আমারও ভালো লাগে। আমাদের কত মিল। তাই না মিলা? ” রাসেলকে অনেক আনন্দিত মনে হলো।
” হ্যাঁ, স্বামী- স্ত্রী বলে কথা! ” আমিও তার আনন্দে একটু মশলা দিয়ে দিলাম। আমার সামান্য মশলাতেই কাজ হবে।
” তোমার খারাপ লাগেনা? ” রাসেল ইতস্তত ভাবে প্রশ্নটা করল।
” কী নিয়ে খারাপ লাগবে? ” অবাক হওয়ার ভান করে পাল্টা প্রশ্ন করলাম। সে জানেনা আমার কোনো কিছুই ভালো লাগেনা। সবকিছুতেই খারাপ লাগে।
” এইযে সামান্য একটা টং দোকানে বসিয়ে তোমাকে শুধু চা খাওয়াচ্ছি। সাথে না বিস্কুট না কেক। ” গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাসেল। সে এসবও ভাবে? আমার জন্যও তার ভাবনা আসে?
” সামান্য হওয়াতে তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না কারো। কেউ তো এসে আমাকে প্রশ্ন করছে না যে, মিলা তুই এখানে চা খাচ্ছিস? কেউ অপমান, অপদস্ত করছে না। আমার টং দোকানে চা খাওয়া নিয়ে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে তো চারকোণা টেবিলের বৈঠক বসেনি। আমার শুধু চা খাওয়া নিয়ে ইরাক ও আমেরিকার মধ্যে মিসাইল ছুড়াছুঁড়ি শুরু হয়নি। এগুলো কোনোটা কি হয়েছে? ” একটু মজার ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করলাম। রাসেল আমার বলার ভঙ্গিতে হাসতে শুরু করলো। খিলখিলিয়ে হাসছে, আশেপাশের মানুষ অনেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
‘ মানুষের চোখে পড়া ‘ আমার ভালো লাগেনা। কেনো যেন এখন ভালো লাগছে। হাসতে হাসতে কিছু একটা বলল।
” আরেকটা ব্যাপার ভুলে গেছ বলতে। বিএনপি তীব্র আন্দোলনের ডাক দেয়নি। ” বলেই আবার হাসতে শুরু করলো। কাউকে হাসতে দেখার মধ্যে শান্তি আছে। শুধু শান্তি না, প্রশান্তি আছে। নিজের কারণে হাসতে দেখার মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রশান্তি আছে।
” আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু পাইনি! ” চায়ের কাপ নড়াচড়া করলাম। এতো অল্প পরিমাণে এরা চা দেয় যে দুই তিন চুমুকেই উধাও হয়ে যায়।
” আরেক কাপ চা খাবে?”
” না, বাসায় যাবো। ” এখানে বসে থাকার মানে হয়না। রোমান্টিকতা আমার পছন্দ না।
” ঠিকাছে চলো ”
হঠাৎ করে আবহাওয়া বদলে গেলো। দমকা বাতাস শুরু হলো। রাসেল চায়ের বিল দিয়ে আমাকে নিয়ে রাস্তায় নামার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি। যেই সেই বৃষ্টি না। অঝোর ধারার বৃষ্টি সাথে দমকা হাওয়া। একটা রিক্সা যাবেনা, অটো যাবেনা। কী করবো ভেবে না পেয়ে আমিই রাসেলকে বললাম, ” গলির সাইডের পুরান বিল্ডিংয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। ”
” এভাবে ভিজে যাওয়ার কোনো মানে হয়না। বাতাসে একটা দুইটা গাছ ভেঙে মাথায় পড়লে খবর হয়ে যাবে। ” রাসেল আমার কথায় সায় দিয়ে বলল।
দুজনে কোনোরকমে রাস্তা পার করে বিল্ডিংয়ের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির পানিতে শাড়ী ভিজে পায়ের সাথে বারবার আটকে আসছিল। রাসেলের সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছিলো। স্কুল জীবনে দৌড়ে কেউ তাকে হারাতে পারেনি। আর এখন সামান্য এক বৃষ্টি কাজটা করে দিল?
” ইশ! তোমার মাতা ভিজে গেছে। ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা আছে। ” রাসেল আমার কাছে এসে কথাটা বলল। রোড লাইন, বাসার লাইন নাই। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে আমার অসহ্যকর এক অনুভূতি হয়। এই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো না। রাসেল আমার মাথা মুছে দিতে লাগলো। ওর পকেটে সবসময় রুমাল থাকে। সেই রুমাল দিয়েই মুছে দিচ্ছে। এই রুমাল দিয়ে সে ঘাম মুছে, নাকও খুব সম্ভব মুছে৷ আমার বমি আসার মতো অবস্থা। এই গাধাটা কীভাবে সরকারি চাকরি পাইলো? কেউ আমাকে এর উত্তর দাও।
” আপনি এগুলা কী করছেন?” বাধ্য হয়ে প্রশ্নটা করলাম।
” তোমার মাথা মুছে দিচ্ছি। ”
” তা তো জানি কিন্তু কী দিয়ে? ” আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমাকে এই কোন ঝামেলায় ফেলে দিলো।
” আমার রুমাল দিয়ে। চিন্তা কইরো না। আমি এটা দিয়ে নাক মুছি না। আর আজকে এটা ব্যবহার করাই হয় নাই। ”
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ ”
বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। নাও ষোলো কলাও পূর্ণ হয়ে গেলো। বিদ্যুৎ চমকানোর কারণে আশেপাশের অন্ধকার কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও ঘুচে যাচ্ছে। সেই আলোতে রাসেলকেও দেখতে পারছি। ভেজা চুল থেকে তার টপটপ করে পানি পড়ছে। চুল কি তার আছে? দুইদিন আগেই সে কদম ছাট দিয়ে এসেছে। এমনিতেই তারে দেখতে লাগে অদ্ভুত। তার উপর এই ছাট! আমি তো দেখেই আকাশ থেকে পড়ছি। সেই চুলের মধ্যে এক ফোঁটা পানি পড়লেও সেই পানি পড়ে যাবে।
” আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো? ”
” কই আমি তো গেটের দিকে তাকিয়ে আছি। ”
” মিথ্যা বলবা না। আমার মিথ্যা বলা পছন্দ না। কথা বলতে ইচ্ছা না করলে বলবা না। কিন্তু কোনো মিথ্যা বলা যাবেনা। ” রাসেলকে বেশ সিরিয়াস মনে হলো।
” হ্যাঁ, আপনাকে দেখছিলাম। ”
” তুমি একসময় আমাকে তুমি বলো। আরেক সময় বলো আপনি। তুমি কি সিদ্ধান্ত নিতে পারছো না? ” অনুজের কণ্ঠ হঠাৎ এত সিরিয়াস হয়ে গেলো কীভাবে? সে তার ব্যাপার। আমার কী? আমার কিছুই না।
” একবার মনে হয় আপনি ‘ তুমি ‘ পছন্দ করছেন না। আরেকবার মনে হয় আপনি ‘ আপনি ‘ অপছন্দ করছেন। ” মিথ্যা বললাম। আমি নিজেও জানিনা কখনো আপনি বলি আর কখন তুমি বলি।
” আমার তুমিই পছন্দ। আপনি বললে মনে হয় তুমি আমার স্টুডেন্ট। নিজের বউকে যদি ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট মনে হয়। তাহলে তো বিপদ। ”
” কিন্তু আপনাকে তো আমার শিক্ষক মনে হয় না। ”
” না মনে হওয়াই ভালো। স্বামী মনে করো তাই ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে তোমার চোখ মুখ কুঁচকে থাকে। শিক্ষক মনে করলে, কাছেই আসতে দিবা না। ” রাসেলের কথায় আমার মাথা হ্যাং হওয়ার অবস্থা। সে এটাও খেয়াল করেছে? খেয়াল করতেই পারে। আমি তো তার দিকে ওই মুহূর্তে ভুলেও তাকাই না। ঘৃণা লাগে তখন তাকে।
” হুম ” কিছু বলার নাই আমার।
” আজকে রাতে রান্না করার প্রয়োজন নাই। ”
বুঝতে পেরেছে বোধহয় আমি আগের টপিকে কথা বলতে ইচ্ছুক নই।
” কেনো? ”
” শাহেদ ভাইদের ওখানে দাওয়াত আছে। ঠিক দাওয়াত না মানে রাতে একসাথে খেতে বলল। ”
” ঠিকাছে ”
” তোমার আপত্তি আছে কোনো?”
” না, আপত্তির কিছু নাই। আমারই ভালো হলো রান্না করতে হবেনা। ”
” তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলি। একটা কাজের লোক রাখার সামর্থ আমার নাই। ”
” তাহলে আমি সারাদিন বসে বসে ডিমে তা দিব? ”
” তুমি পড়াশোনা করতে কেনো চাও না?”
” আমার ভালো লাগেনা। ”
” আমি তোমাকে ডিগ্রিতে ভর্তি করায় দিবো? তাহলে সারাদিন একটু ব্যস্ত থাকতে পারবা। ”
” অনার্স বাদ দিয়ে ডিগ্রি কেনো করবো? আমার ইচ্ছাই নাই পড়াশোনার। থাকলে আমাকে বলতে হতো না। ”
রাসেল আর কিছু বলল না৷ কিছু না বলাই ভালো। এতো কথা বলতে আমার ভালো লাগেনা। কাজের লোক রাখবে? ফাজলামো করে নাকি সে? এক কাপ চায়ের জায়গায় দুই কাপ খেতে গেলে তার পকেটে টান পড়ে। সে আবার কাজের লোক রাখবে।
বৃষ্টি শেষ হওয়ার পরে বাসায় ফিরলাম।
আমিনা ভাবী দরজা খুলে চোখ কপালে তুলে বললেন , ” কী রোমান্টিক আপনি রাসেল ভাই!”
” রোমান্টিকের কিচ্ছু না। আমরা বৃষ্টিতে আটকে গেছিলাম। এই আরকি। ”
” আহা! ভাবী লজ্জা পান কেনো? আমরা আমরাই তো। ” এই কথায় শুনে মনে হলো উনি আমার দুইশ বছর আগের পরিচিত কেউ।
রাসেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” স্বামী – স্ত্রী একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এসেছেন। কী দারুণ মোমেন্ট! ”
আমি রুমের দিকে পা বাড়ালাম৷ রাসেল কী যেন একটা উত্তর দিল। ওর আবার গল্প করার বাতিক আছে। গল্প করুক। কিছু মুহূর্তের জন্যে হলেও আমাকে তো রেহাই দিল৷
রুমে ঢুকে আগে বাথরুমে চলে গেলাম। শাড়ী খুলে বাসার থ্রিপিস পড়লাম। কাঁদা পানিতে শাড়ীটার অবস্থা খারাপ। কম দামী একটা শাড়ী। রাসেলের বাড়ি থেকে বিয়ের লাগেজে করে এসেছিল। আমার বড় খালা দেখে তো ছ্যা ছ্যা করে উঠেছিলেন।
” কী ফকিন্নির সাথে বিয়ে ঠিক করেছিস রে, মিলার বাপ? এই শাড়ী কেউ দেয়? এই শাড়ী তো আমি আমার কাজের বেটিরেও দেইনা। কী ছোট লোক এরা। ”
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল। এত কথা বলার কী আছে? আমার মা বাবা তো কিছু বলেন নাই শাড়ী নিয়ে। তাহলে উনি বলার কে? বিয়েতে তো নিজে খালি হাতে এসেছে। একটা সুতার ত্যানা আনেন নাই। তার উপর বড় বড় বুলি কপচানো হচ্ছে। ভদ্রতার জন্যই কিছু বললাম না।
শাড়ীটা যত্ন করে ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিলাম। আমার অপছন্দ এই শাড়ী। তাই বলে যে শখ করে কিনেছে তাকে তো আর মুখের উপর বলা যায়না, ” আমার পছন্দ হয়নি। ”
চলবে…
~ Maria Kabir