আঁড়ালে কে নাড়ে কলকাঁঠি পর্ব-০২

0
507

#আঁড়ালে_কে_নাড়ে_কলকাঁঠি
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



ফৌজিয়ার কথাটা আমি যেন ঠিক বুঝতে পারিনি।আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম,’ ফৌজিয়া কি বললে যেন তুমি?’
ফৌজিয়া আমার হাতটা ধরলো। তারপর বললো,’ ভেতরে চলো।মাথা কুল রাখো।’
আমি ওর থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,’ ফৌজিয়া, আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুমি কি করে এই সর্বনাশটা করলে আমাদের? ‘
কফিশপের ভেতরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসতে বসতে ফৌজিয়া বললো,’ অ্যাবরোশনের নেগেটিভিটি সম্পর্কে আমি তাকে বলেছি। তার কাছ থেকে কেস শুনতে চেষ্টা করেছি।বলেছি কেন এটা করতে চান তিনি। তিনি বললেন, এখনই তিনি প্রিপেয়ার না মা হতে।আরো নানান ঝামেলা আছে ফ্যামিলিগত।সব বলতে পারবেন না তিনি।’
আমার রাগে শরীর কাঁপছে থরথর করে।আমি বললাম,’ ফৌজিয়া, তুমি বাঁধা দিলে না কেন তাকে? কেন দিলে না বাঁধা?’
ফৌজিয়া এবার রাগ দেখালো। সে বললো,’ যে গর্ভধারণ করেছে সে যদি তার গর্ভ নষ্ট করে ফেলতে চায় তবে আমি কি করবো তপু? আমি একজন ডাক্তার। আর তোমার কাছে এই বিষয়ে কিছু বলাই আমার উচিৎ হয়নি! তোমার কাছে এটা বলাই আমার ভুল হয়েছে। এখন এটা নিয়ে কতো ঝামেলা হয় কে জানে! হয়তো এই ঝামেলায় এখন আমিও জড়িয়ে পড়বো! ‘
আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। ফৌজিয়া তো ভুল কিছু বলেনি।যার সন্তান সে যদি তার সন্তানকে পেটেই মেরে ফেলতে চায়, তার যদি কষ্ট না লাগে।দরদ না লাগে। তবে একজন ডাক্তারের আর কি বা করার আছে এখানে।এরপরেও ফৌজিয়া যে আমার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করেছে এটাই তো অনেক বেশি!
আমি অনুতপ্ত হয়ে বললাম,’ ফৌজিয়া, সরি!’
ফৌজিয়া হাসার চেষ্টা করলো।বললো, ইটস্ ওকে।’
এরপর সে বললো,’ এসব বিষয়ে মাথা গরম করা যাবে না। তুমি জ্ঞানী ছেলে। তোমার সম্পর্কে আমি জানি। এই জন্যই তোমার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করেছি আমি। তোমার ভাবী যে অ্যাবরোশন করিয়েছেন। বাচ্চা নষ্ট করেছেন। এটাকে আমার স্বাভাবিক মনে হয়নি। উনার কেমন যেন তাড়াহুড়ো ছিল! কেমন যেন অস্থির ছিলেন তিনি! তুমি ঠান্ডা মাথায় গোপনে এর কজটা বের করার চেষ্টা করবা।মাথা গরম করলে হিতে বিপরীত হবে পরে।’
আমার মাথা এবার সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। আচ্ছা, ভাবী এমন কাজটা কেন করবে?
আরো একটা সন্দেহের বিষয় আছে এখানে। ভাবীর যে তিন মাসের গর্ভ হয়েছে, এই বিষয়ে বাসার কেউ কিছুই জানে না। ভাবী এই এতো দিন এই বিষয়টা গোপন রাখলো কেন? এটা কি গোপন রাখার মতো বিষয়? মাকে বললো না, আমাকে বললো না। ভাইয়া কি জানে বিষয়টা? জানলে সে গোপন করে রাখলো কেন? আর তাদের মধ্যে ঝামেলাটা আসলে কি নিয়ে? এই যে রাতের কান্না, চোখের উপরের দাগ এরপর আবার গোপনে অ্যাবরোশন করে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলা, এইসব কিছু কেন হচ্ছে? এর মূল কারণটা কি? ভাইয়া এখানে কতোটা দায়ী?
নিশ্চয় এর ভেতর ভয়াবহ রকমের কোন গড়বড় আছে। কিন্তু এটা কি? কি এই ভয়াবহ রকমের রহস্য? আমি কিভাবে এটা খুঁজে পাবো?এর জট খুলবো কিভাবে?
আমি নিজের মাথার চুল ধরে টানতে টানতে বললাম,’ ফৌজিয়া, আমি কিভাবে এসব খুঁজে বের করবো বলো? কিভাবে!’
ততোক্ষণে কফি এসেছে। ফৌজিয়া তার কাপে দু’ চুমুক দিয়েছে। কিন্তু আমার মোটেও কফি খেতে ইচ্ছে করছে না।আমি কাপটা খানিক দূরে সরিয়ে রাখলাম।
ফৌজিয়া আমার দিকে তাকালো। তারপর সময় নিয়ে বললো,’ ভাইয়া ভাবীর মধ্যে কোন রকম ঝগড়া ঝাটি বা ঝামেলা আছে কি? সাংসারিক কোন সমস্যা চোখে পড়েছে তোমার? বন্ডিং কেমন তাদের? স্ট্রং না উইক?’
নিজের ঘরের কথা বাইরে যাবে। কিংবা বাইরের কারোর কাছে ঘরের কথা বলবো আমি।তা কখনোই ভাবতেও পারিনি আমি।
আমি কিছু বলছি না।চুপ করে আছি।
ফৌজিয়া আবার বললো,’ তপু, আমায় কিছু বলতে হবে না।আমি তোমার ঘরের বিষয়ে নাক গলাতে চাই না। আমার কাছে ভাবীর অ্যাবরোশনের বিষয়টা এবং তার অতি গোপনীয়তা খুব দৃষ্টিকটু লেগেছিল।তাই তোমায় ফোন করে বিষয়টা বলা।’
আমি আরেকটু চমকালাম। বললাম,’ গোপনীয়তা মানে? বুঝিয়ে বলো আমায় ফৌজিয়া?’
সে বললো,’ ভাবীর নাম উম্মে নুসরাত অপি না?’
আমি বললাম,’ হুম।’
‘ভাইয়ার নাম অপু। মোহতাসিম বিল্লাহ অপু।তাই তো?’
আমি বললাম,’ হু।’
ফৌজিয়া এবার বললো ,’ ভাবী আমার কাছে তার নিজের নাম বলেছে শুধু অপি। কিন্তু স্বামীর নামের জায়গায় ভাইয়ার নাম বলেইনি।’
এবার আমি আরো বেশি চমকালাম।গা শিউরে উঠলো আমার।আমি বললাম,’ কার নাম বলেছে?’
ফৌজিয়া বললো,’ সে অন্য একটা নাম বলেছে। আমার না নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু চেম্বারের একটা ডায়েরিতে লিখা আছে এটা।পরে দেখে বলবো তোমায়।’
আমি ফৌজিয়ার দিকে তাকালাম। আমার চোখ কেমন জ্বালা করছে। মাথা ঘুরছে। পেটে কেমন পাক দিচ্ছে খানিক পর পর।বমি টমি হবে নাকি?
ফৌজিয়া আমার হাতটা ধরলো খপ করে। তারপর বললো,’ তপু তুমি ঠিক আছো?’
আমি বললাম,’ এখানে দম আটকে আসছে আমার।এখান থেকে বেরুতে হবে। এক্ষুনি।’
ফৌজিয়া আমায় নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কফিশপ থেকে বেরিয়ে এলো।আমরা এসে রাস্তার পাশে খোলা একটা জায়গায় ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলাম। এই জায়গাটা সুন্দর। নিরিবিলি। আমার একটু আরাম লাগছে এখানে।
ফৌজিয়া বললো,’ ভেঙে পড়ো না তো তুমি। শক্ত থাকার চেষ্টা করো। এরচেয়ে বড় সমস্যাও কিন্তু তুমি মোকাবেলা করে এসেছো! তবে এটা নিয়ে এভাবে ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন?’
আমি আওয়াজ করে কিছু বললাম না তাকে। চুপ করে রইলাম। ফৌজিয়া বললো,’ উঠি তাহলে আজ। সাবধানে বাসায় যাও।আর অতো টেনশন করো না। সবকিছু সহজ হবে ইনশাআল্লাহ!’
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
ফৌজিয়াকে একটা রিক্সা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম। তারপর আমি আরো লম্বা সময় ধরে ওখানে বসে রইলাম। এই প্রচন্ড শীতের মধ্যেও আমার শরীর ঘামছে। এখানে হাওয়া আছে। প্রচন্ড শীত আছে। এখানে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর সাংসারিক যে ঝঞ্জাট, এটা থেকে বহু দূরে আছি আমি।আর এই দূরে থাকাতেই যেন জগতের সব প্রশান্তি।

বাসায় ফিরতে আমার অনেক দেরি হয়ে গেল।রাত এগারোটা।মা বললেন,’ কোথায় ছিলি তুই?’
আমি বললাম,’ একটা কাজ ছিল। বাইরে গিয়েছিলাম একটু।’
‘ তোর ফোন রিসিভ করিসনি কেন? ‘
পরে মনে হলো ফোন সাইলেন্ট করা ছিল।এটা আর ঠিক করা হয়নি।
মা বললো,’ তোর ভাইয়া এখনও বাসায় ফিরেনি। সে তো সাধারণত এতো রাত করে না।আজ দেরি হচ্ছে কেন? কল দিলেও রিসিভ করে না।’
আমি বললাম,’ ভাবীকে জিজ্ঞেস করেছো? ভাবী কিছু জানে না?’
মা বললেন,’ তোর ভাবী ঘুমিয়ে গেছে। তার শরীর খারাপ ‌। তাকে আর ডেকে তুলিনি।’
আমি ভীষণ অবাক হচ্ছি।অপি ভাবী বিয়ে হয়ে আসার পর কোনদিন ভাইয়াকে রেখে একা ভাত খায়নি। ভাইয়া অফিস থেকে ফেরার আগে কখনোই ঘুমোতে যায়নি। এমনকি অসুখ থাকলেও না। কিন্তু এখন এসব কি হচ্ছে? এতো পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব? আর ভাইয়া? ভাইয়া কেন এতো লেট করছে আজ? আগে তো মিটিং থাকলেও ফোন করে বলতো মিটিং আছে। একটু দেরি হবে আসতে।আটটা বা নটা বাজবে। কিন্তু এই এগারোটা তো কোনদিন বাজেনি তার!
আমি ফোন বের করে ভাইয়াকে কল করলাম। ভাইয়ার ফোনের সুইচ অফ করা।এর আরো পনেরো মিনিট পর আবার ফোন করলাম। মোবাইলের সুইচ অফ করেই রাখা।কল দিলে বন্ধ বলে। ঘটনা কি!
মা চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন,’ তুই যা। তোর ভাইয়ার অফিসে যা। এক্ষুনি যা।’
আমি যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক তখনই কলিং বেল বাজলো।আমি তাড়াহুড়ো করে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি ভাইয়া। ভাইয়া এসেছে।
আমি বললাম,’ এতো গুলো ফোন করা হলো রিসিভ করলে না কেন তুমি? ‘
ভাইয়া বললো,’ আর বলিস না। ফোন চুরি হয়ে গেছে। আমি থানায় গিয়েছিলাম।জিডি করে এসেছি।’
ততোক্ষণে মা এলেন এখানে। এসে বললেন,’ ফোন চুরি হয়ে গেছে এটা তুই অন্য ফোন দিয়ে কল করে বাড়িতে বলবি না? আমরা চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছি এদিকে!’
মা দেখি কেঁদে ফেলেছেন। তার চোখ ভেজা।গলা ভেজা।
ভাইয়া বললো,’ মা, আমি এটা নিয়ে খুব দৌড়ঝাঁপের মধ্যে ছিলাম। আমার ফোন করা উচিৎ ছিল। করতে পারিনি। সরি মা!’
রাতে ভাইয়া খাওয়া দাওয়া করেনি।মা জোর করেও খাওয়াতে পারেনি তাকে। তার মন ভীষণ খারাপ।মন খারাপ হতেই পারে। মোবাইলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকে। তাছাড়া তার মোবাইলের দামও অনেক বেশি।শখ করে কিনেছিল। খুব বেশিদিন হয়নি কিনেছে।শখের কিছু চুরি হয়ে গেলে ভীষণ খারাপ লাগারই কথা।
ভাইয়া রুমে গিয়ে দরজা আটকে শুয়ে পড়লো।

এরপর পরপর তিনদিন অফিস কামাই করেছে ভাইয়া। অফিসে যায়নি সে। কিন্তু বাসায় থেকেও যেন তারা নাই। ভাইয়া – ভাবীর মধ্যে কোন কথা হয় না। দুজনকে পাশাপাশি একসাথে সময় কাটাতেও দেখা যায় না।এ যেন এক ছাদের নিচে ভিন্ন দুই মানুষ, দুই মন।
তবে ভাবী আগের মতোই ঘরের কাজ করে। রান্নাবান্না করে।ঘর ঝাঁট দেয়।ভাত বেড়ে দেয়।মা কিংবা আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়। কিন্তু নিজ থেকে কিছু বলে না।সব সময় কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে। নিজেকে যেন একটু আড়াল করে রাখতে পারলেই বাঁচে। তার চেহারাও কেমন রোগা রোগা হয়ে এসেছে এই কদিনে। শরীর অনেকটাই শুকিয়েছে। চোখের নিচে কালসিটে দাগ জমেছে।
সবচেয়ে অবাক হবার মতো ঘটনাটা ঘটলো এর আরো সপ্তাহ খানিক পরে। তখন বিকেল। মা ঘরে নাই। পাশের বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন।আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু মশার কামড়ে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তখনই টের পেলাম ভাবী কারোর সঙ্গে কথা বলছে। তার ঘর থেকেই বলছে।ঘরের দরজা ভেজানো।আমি চুপিচুপি তার ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালাম।ভাবী টের পায়নি। সে তখনও কথা বলছে। ফোনে।
আমি এটুকু শুধু শুনতে পেলাম,’ আপনার পায়ে পড়ি, দয়া করে ভিডিও গুলো সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েন না । আপনি যা চান তাই করবো আমি।যা দিতে বলেন এর বিনিময়ে তাই দিবো আমি। তবুও আমার অতো বড় ক্ষতিটা আপনি করবেন না প্লিজ! ‘

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে