ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৮
তরফদার সাহেব কে আইসিইউ থেকে কেবিনে নেয়া হয়েছে। রাত্রি দিনরাত এক করে বাবার জন্য লেগে আছে। ঔষধপত্র আনা, কেবিনে দেয়ার পর সবসময় খেয়াল রাখা সব একা হাতে সামলাচ্ছে। নাজমা কাঁদতে কাঁদতে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দু’জন রোগীকে রাত্রি একা হাতে সামলাচ্ছে। আয়ান আর আরও কয়েকজন কলিগ এসে একদিন দেখে গেছে। আয়ান দেখল রাত্রি একা হাতেই সব সামলাচ্ছে। যাবার সময় আয়ান বলল,
রিলিজের দিন আমি আসব।
রাত্রি বলল,
আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমি পারব।
তবে আয়ান রিলিজের দিন খোঁজ নিয়ে এলো। সবটা আয়ান সামলে নিলো। তবে বাসা পর্যন্ত আর গেলো না। এম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেয়া পর্যন্ত থাকল।
এতদিন রাত্রি কিছু বুঝতে পারেনি। বাসায় এসে বুঝতে পারল কতটা ক্লান্ত ও। দুচোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসছে। পুরো শরীরে ব্যথা । ক্ষুধাও পেল ভীষণ।
এ কয়দিনের টেনশনে গোধূলির বিষয়টা কেউ আর তোলেনি। তবে নাজমার কান্না শুধু স্বামীর অসুস্থতার জন্য না। মেয়েটা কোথায় গেছে,কেমন আছে এই চিন্তা তাকে পাগল করে দিচ্ছিল। তিনি সেই ঘটককে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে সাব্বির ছেলেটাও বাড়িতে নেই সেদিন থেকে যেদিন থেকে গোধূলিকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি। নানা দুঃশ্চিন্তা কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।
রাত্রি খেতে এসে ডাইনিং এ মাকে ডুকরে কাঁদতে দেখল। ও সরে এলো। মনটা খারাপ লাগছে। খেতে ইচ্ছে করছেনা আর। তবে একটু গোসলের দরকার। ওয়াশরুমে গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে নিলো রাত্রি। বাবাকে খাবার ঔষধ খাইয়ে ঘুমালে নিজের ঘরে এলো ও।
ঘরে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ও। আর সাথে সাথেই গোধূলির কথা মনে হলো। গোধূলি যখন হলো তখন রাত্রি ক্লাস ফোরে পড়ে। কাপড়ে মোড়ানো ছোট একটা পুতুলের মতো শিশু ওর মায়ের পাশে শোয়ানো। রাত্রি খুব খুশি হয়েছিল সেদিন। এখন থেকে বোনের সাথে ও খেলবে। সেই থেকে যতটা সময় পেত বোনকে সময় দিত।
বড়বেলায় দু’বোনের কত স্মৃতি। গোধূলিটা একা ঘুমাতে ভয় পায়। ঘুমের ভেতর গায়ের ওপর পা তুলে দেয়। এসব মনে পড়তেই বাঁধ ভেঙে গেল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রাত্রি। কোথায় চলে গেল তার বোনটা।
রাত্রি স্কুলে এসেছে পাঁচ দিন পর। এই কয়দিন হাসপাতালে থাকাতে এসে ছুটি নিতে পারেনি। ফোন করে হেডস্যারকে জানিয়েছিল । আজ আসতেই কলিগরা সবাই বাবার খবর জানতে চাইল। রাত্রি জানালো যে বাবাকে এখন বাড়িতে আনা হয়েছে। মোটামুটি ভালো আছে।
আয়ানকে দেখা গেলো না। রুহিয়া একপাশে বসে কি যেন লিখছিল।
রাত্রি ক্লাসে যাবার সময় করিডোরে দেখা হলো আয়ানের সাথে। আয়ান এগিয়ে এসে বলল,
আপনি এসেছেন,আজকে ছুটিতে থাকতে পারতেন।
না কয়দিন তো ছুটি নিলাম। মাতো আছেন। সমস্যা হবে না।
আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?
এখন ভালো। তবে বাবাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না।
হুম স্বাভাবিক । আপনাকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে ভীষণ। না হয় বাড়ি চলে যান।
না,ঠিক আছে। সমস্যা হচ্ছে না আমার।
আচ্ছা,ঠিক আছে। আমার পরিচিত একজন কার্ডিওলজিস্ট আছেন। আপনি চাইলে দেখাতে পারেন আঙ্কেলকে। আমি এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখব।
দু’দিন যাক। এই ঔষধগুলো শেষ হোক।
হুম,ঠিক বলেছেন। আচ্ছা যান, ক্লাসের দেরী করিয়ে দিলাম। স্টুডেন্টরা তাদের প্রিয় ম্যামকে মিস করেছে একয়দিন।
রাত্রি মুচকি হাসল। এ কয়দিনে এই প্রথম একটু হাসল ও।
লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে রুহিয়া এসে রাত্রির টেবিলে বসল।
রাত্রি খাচ্ছিল। রুহিয়া বলল,
কি অবস্থা?
হুম ভালো।
ভালো যে তাতো জানি। বাসায় বাবা অসুস্থ আর আপনি এখানে কত সুন্দর সময় কাটাচ্ছেন গল্প গুজব করে।
মানে!
আয়ান ছেলেটা ভালো। বড়লোকের ছেলে। কি বলেন? এতো বড় হলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি, অথচ ছেলেদের বশ করতে শিখলাম না। অথচ মানুষ কত সহজেই ছেলে পটাতে পারে।
রাত্রি আর কথা বাড়ালো না। মেয়েটার নোংরা ইঙ্গিত বুঝতে সমস্যা হলো না। খাওয়া রেখেই উঠে পড়ল ও।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে গোধূলি দেখল সাব্বির অঘোরে ঘুমাচ্ছে। গোধূলি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো। বাইরে বেরিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল তনিমা নাশতা তৈরি করছে। শাড়ির আঁচল সরে গিয়েছে বুক থেকে । ওর ঠিক সামনে বসে আছে এই বাসায় থাকা সাব্বির এর আরেক বন্ধু হাসান । ইনি তনিমার বর না। হেসে হেসে কি যেন বলছে লোকটা। গোধূলির কাছে দৃষ্টি কটু লাগল বিষয়টা। গোধূলিকে দেখে একটু যেন চমকে উঠল দুইজন। তনিমা চট করে আঁচল ঠিক করে নিলো। হাসান বলল,
কি ভাবি ঘুম কেমন হলো?
এইতো ভালো।
ভালো হয়েছে? সাব্বির ঘুমাতে দিয়েছে? যা সব বলছিল কাল।
তনিমা অবাক হবার ভান করে বলল,
কি! তোমরা একঘরেই ছিলে!
হাসান বলল,
কি যে বলেন আপনি! সাব্বির তো পাগল হয়ে গেলো বৌয়ের কাছে ঘুমাতে যাবার জন্য। সাব্বির টার কপাল। আগে থেকেই তো ওর মেয়েভাগ্য ভালো। বৌও পাইল একদম খাসা। আর আমাদের দেখেন। প্রেম হলোনা ঠিকঠাক। আবার বৌ বাপ মা পছন্দ করে আনছে। গায়ের মেয়ে। রংঢং কি যদি একটু বুঝত। কামের সময় মনে হয় স্টাচু অব লিবার্টি হয়ে যায়।
আহা! এভাবে বলে নাকি। ভাবিতো খুব সুন্দর।
আর সুন্দর। শুধু সুন্দর দিয়ে কি পুরুষ মানুষের মন ভরে। আরো কিছু জানতে হয়।
তনিমা বলল,
সাব্বির ভাই ওঠেনি? কেনাকাটা করতে হবে তো বিয়ের। অবশ্য বাসর হয়ে গেলে ছেলেদের আর বিয়ে নিয়ে আগ্রহ থাকে না।
উঠে পড়বে ভাবী। আমি কিছু করে দেব?
না থাক, বিয়ের কনে তুমি। এখন কিছু করতে হবে না ভাই।
গোধূলি ওখান থেকে চলে আসল। হাসান আবার আস্তে কি যেন বলল আর তনিমা খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।
সাব্বির উঠল বেলা বারোটায়। নাশতা খেয়ে আবার ঘরে ঢুকে গোধূলিকে ডাকল,
গোধূলি এদিকে একটু আসোতো।
গোধূলি ঘরে ঢুকতেই দরজা লাগিয়ে ওকে জাপটে ধরে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিলো।
এই সবাই কি ভাববে বলেনতো।
কিছু ভাববে না। সবাই বুঝছে আমার কি অবস্থা।
কিন্তু বিয়েটা কখন হবে?
বিয়ে করব তো। এতো অস্থির হচ্ছো কেনো। আমিতো পালিয়ে যাচ্ছিনা। গতকাল জার্নি করে এসেছি। একটু বিশ্রাম নিয়ে বের হব। কেনাকাটা আছে বিয়ের। একটু এনার্জি দরকার।
তো আপনি থাকেন। আমি দেখি ভাবী কি করছে।
আরে তুমি না থাকলে তো হবে না। কাছে আসো।
উঁহু,এখন না।
সাব্বির গোধূলিকে শুনলোইনা। দ্রুত হাতে গোধূলিকে নগ্ন করতে শুরু করল।
দুপুরের পরপর ঘটকের ফোন এলো সাব্বিরের কাছে। গোধূলির বাবার অসুস্থতার খবর জানাল লোকটা।সেইসাথে গোধূলি কোথায় জানতে চাইল সাব্বিরের কাছে। সাব্বির হ্যালো হ্যালো বলে কেটে দিল ফোন। এরপর নাম্বার অফ করে দিলো।
তবে গোধূলিকে কিছুই জানালো না। শুনলে হয়তো কান্না শুরু করবে,এখুনি ফিরতে চাইবে।
ঐদিনও আর কোথাও যাওয়া হলো না। রুমের ভেতরেই সময় কেটে গেলো। সন্ধ্যায় সবাই বসার ঘরে তাস খেলতে বসল। তনিমাও খেলছে। গোধূলি সাব্বিরের পাশে বসল। একটু পর সাব্বির সবার সামনেই গোধূলির কোমড় জড়িয়ে ধরে চিমটি কাটল। গোধূলি ব্যথায় উফ করে উঠল। তনিমা বলল,
কি হলো?
গোধূলি বলল,
না কিছু হয়নি।
সাব্বির খেলা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
মাথাটা ভীষণ ধরেছে। গোধূলী একটু ঘরে এসোতো।
বলেই গোধূলিকে হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল।
বিয়ে নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছিল গোধূলির তবে সাব্বিরের পাগলাটে আদর নিতে খারাপ লাগছিলো না। তাই ও বাঁধা দেবার বদলে সাড়া দিয়ে গেল।
পরদিন সকালে বিয়ের কথা বলতেই সাব্বির হঠাৎ ভীষণ রেগে গেল।
কি শুরু করলা? এমনিতেই এতোটা টেনশনে আছি। তোমার বাবা নাকি অপহরণ মামলা করবে বলেছে। না জানি কি হয়। আর তুমি এদিকে বিয়ে বিয়ে করে মাথাটাই খারাপ করে দিচ্ছে।
গোধূলি সাব্বির এর এমন মূর্তি দেখে কেঁদে ফেলল। এবার সাব্বির একটু নরম হলো। গোধূলিকে কাছে টেনে বলল,
আমি সরি জান। আসলে কেসের কথা শুনে মাথা ঠিক ছিলো না।
গোধূলি ভাবল সত্যিতো,টেনশন হবারই তো কথা। ও আদুরে বেড়ালের মতো সাব্বির এর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল।
সত্যিই তো বাসায় এতোটা বাড়াবাড়ি করছে কেনো। কি এমন হয়েছে। বিয়ে করবে বলেই তো নিয়ে এসেছে সাব্বির ওকে। বাসায় রাজী হলেতো এভাবে পালাতে হতো না। বাবার সবটাতে বাড়াবাড়ি করা স্বভাব। কেস করে কি করতে পারবে। ও কিছুতেই আর ফেরত যাবে না।
বিকেলের দিকে হুজুর ডেকে গোধূলিকে বিয়ে করল সাব্বির। গোধূলির বয়স আঠারোর নীচে। তাই রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে সম্ভব না। আরো ছয়মাস অপেক্ষা করতে হবে তার জন্য।
কেনাকাটা বলতে একটা কাতান শাড়ি আর কিছু কসমেটিকস কেনা হলো গোধূলির জন্য। সাব্ব্বির এর জন্য পাঞ্জাবি কেনা হলো। সাব্বির বিয়ের পর রাতে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়ালো সবাইকে।
বিয়ের পরদিন সাব্বির বলল,
গোধূলি আজ চারটায় ট্রেন। রেডি হয়ে নাও। ঢাকা যাব আমরা।
এমা, কক্সবাজার যাওয়ার কি হবে?
বাসা থেকে কল করেছিল। আমার আব্বা অসুস্থ। কক্সবাজার পরে সময় করে যাব।
ও আচ্ছা।
ঢাকায় ফিরে গোধূলিকে সেই কাজিনের বাসায় নিয়ে গেল সাব্বির।
গোধূলি বলল,
এখানে কেনো, বাসায় যাবো না?
বাবা অসুস্থ হয়ে গেছেন। এমন অবস্থায় তোমাকে নিয়ে বাসায় তুললে খারাপ কিছু হয়ে যাবে। তখন আজীবন দোষী হয়ে থাকতে হবে।
কিন্তু আমি এখানে কতদিন থাকব এভাবে?
দু’তিনদিন থাকো। আমি একটা বাসা ঠিক করে ফেলব এর মধ্যে।
গোধূলি একটু খুশিই হলো, যাক কাউকে আপাতত ফেস করতে হবে না। নিজের মতো সংসার করবে ও। শুধু ওরা দুইজন থাকবে একান্তে।
(চলবে)