গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৪
তরফদার সাহেব হতবাক হয়ে চেয়ে আছেন ছোট মেয়ে গোধূলির দিকে। তার মাথায় আসছেনা গোধূলি কেনো সাব্বিরের বাইকে করে বাসায় এসেছে। আর যেখানে উনি সাব্বিরের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক হবে না বলেই দিয়েছেন তাহলে ঐ ছেলে কি উদ্দেশ্যে গোধূলির সাথে যোগাযোগ করছে।
তিনি থমথমে গলায় জানতে চাইলেন,
সাব্বির ছেলেটাকে কোথায় পেলে?
আমার স্কুলের সামনে এসেছিল।
তুমি ওর সাথে কথা বললে কেনো?
উনি এসে কথা বললেন আমি কি করব। দৌড়ে পালাব?
কেনো, মানা করলে না কেন। তুমি তো জানো ঐ ছেলে কি করেছে। আর তুমি তার বাইকে চেপে বাসা পর্যন্ত চলে এলে একেবারে!
উনি বললেন এদিকে আসবেন তাই বাইকে উঠেছি।
তুমি কি সত্যি বোঝো না নাকি না বোঝার ভান ধরে থাকো গোধূলি। তোমার বড় বোনকে যেই ছেলেটা রিজেক্ট করল তার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করাটা কি উচিত?
আমি বুঝতে পারিনি। আর তাছাড়া উনিতো খারাপ কিছু বলেননি।
নাজমা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এবার আর রাগ সামলে রাখতে পারলেন না। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন মেয়ের গালে।
তুমি আমাকে মারলে কেনো মা। ঐ ছেলে কি এমন করেছে। আমাকে পছন্দ করেছে,এইতো। এতেতো দোষের কিছু নাই।
নাজমা এবার চুলের মুঠি ধরে বললেন,
তোকে চড় মারাটা ঠিক হয়নি। মেরেই ফেলবো আজ। যেখানে আমরা চাইছিনা ঐ ছেলের সাথে কোনোরকম কোনো সম্পর্ক করতে সেখানে তোর সাহস হয় কিভাবে ওর সাথে ঘুরে বেড়াতে। বেহায়া নির্লজ্জ কোথাকার। তোর বোনকে দেখতে এসে তোকে পছন্দ করল। ঐ ছেলের চরিত্র কেমন হবে বোঝাই যায়। তুই কোন সাহসে ঐ ছেলের সাথে কথা বললি। আবার এখানে দাঁড়িয়ে মুখে মুখে তর্ক করা হচ্ছে।
আমাকে মারবে না বলে দিচ্ছি। একদম ভালো হবে না।
কত বড় সাহস দেখছ। কি খারাপ করবি তুই বল।
নাজমা এলোপাথাড়ি মেয়েকে মারতে শুরু করলেন।
রাত্রি এসে নাজমাকে আটকালো।
মা কি করো। ও ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। ছাড়ো ওকে।
না,কারো কোনো কথা শুনবো না। এই মেয়ে এই বয়সে কম কান্ড করেনি। এর ওর মুখে নানা কথা শুনতে হয় এর জন্য। মান সম্মান কিছু রাখবে না এই মেয়ে আমাদের।
নাজমার রাগ আরো বেড়ে গেল কারণ গোধূলি জেদ ধরে রেখেছে। একটাবার বলছে না যে আমার ভুল হয়ে গেছে। বরং চুপ করে থেকে মার খেয়ে যাচ্ছে।
রাত্রি হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিলো নাজমাকে। তরফদার সাহেব বললেন,
এটা নিয়ে চিৎকার করে আর লোক জানিওনা নাজমা। গোধূলি, আমি সাফ বলে দিচ্ছি যেইটা আজ করেছো হয়ত না বুঝে ভুলে করেছ। আর যেন এমন না হয় কখনো।
রাতে খাবার টেবিলে আসেনি গোধূলি। নিজের ঘরে শুয়ে রইল। নাজমা বা তরফদার কেউই মেয়েকে ডাকলেন না।
কিন্তু রাত্রি খেতে বসলো না। ও বোনকে ডাকতে এলো।
গোধূলি খেতে আয় আপুনি।
গোধূলি জবাব দিলো না।
রাত্রি গিয়ে পাশে বসে মাথায় হাত রাখল।
চল মনি, তোকে খাইয়ে দিব।
যাওতো আপা। বিরক্ত করো না।
এমন করিস না। মা বাবার ওপর রাগ করে না খেয়ে থাকবি? তোর ভালোর জন্যই তো শাসন করল।
আমি কি খারাপ করেছি। ঐ ছেলে আমাকে পছন্দ করল এটা কি দোষের কিছু?
তোরতো এখনো বিয়ের বয়স হয়নি এজন্যই বাবা মা রাগ করেছেন।
আসলে সেটা না, তোমাকে পছন্দ না করে আমাকে পছন্দ করেছে এটার জন্যই রাগ ওনাদের। ছোট থেকেই তো দেখছি তোমাকে সবাই সবসময় বেশি আদর করে। আমার জন্য কারো কোনো মায়া নেই। সবাই আমাকে হিংসা করে।
এসব কি বলিস। তুই ছোট, এখনো নিজের ভালোমন্দ বুঝিসনা। তাই সবাই একটু শাসন করে। সব মা বাবাই ছেলেমেয়েদের ভালো চায়। তোর ভালোর জন্যই মা বাবা চিন্তা করছে। আর এজন্য তুই যেন কোনো ভুল না করিস তাই বকা দিয়েছে। তোর এখন লেখাপড়া করার বয়স। বিয়ে-শাদি ,পছন্দ-অপছন্দ এসব নিয়ে এখন ভাবিস না।
শোন আপা, আমি এতোটাও ছোট না যে নিজের ভালো মন্দ বুঝতে পারবো না। আসলে তোর হিংসা হচ্ছে। তোকে পছন্দ না করে আমাকে পছন্দ করেছে এটাই হলো আসল সমস্যা। এতো ভালো একটা ছেলে তোমাকে পছন্দ না করে আমাকে পছন্দ করল খারাপ তো লাগার কথাই।
রাত্রি বুঝল এখন গোধূলি রেগে আছে। ছোট মানুষ,বুঝজ্ঞান কম। তাই উলটা পালটা বলছে। রাগ কমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ও বলল,
এমন কিছুই না,তুই এখন ঘুমা। আমি মা বাবাকে বুঝিয়ে বলব। এসব নিয়ে যেন অযথা রাগারাগি না করেন। মা মেরেছে বলে তুইও ভুলভাল ভাবছিস। রাগ কমলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাত্রি ওয়াশরুমে চলে গেল। নামাজ পড়ে তারপর ঘুমাবে। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না।
গোধূলি উঠে বসল। আপার মোবাইলটা বিছানায় রাখা। ও উঁকি দিয়ে দেখল বাথরুমের দরজা লাগানো। চট করে সাব্বিরের দেয়া নাম্বারে মেসেজ দিল।
কাল ছুটির পরে স্কুল গেটে আসবেন। এটা আপার নাম্বার। রিপ্লাই দেবার দরকার নেই।
মেসেজ সেন্ড করে সেন্ড অপশনে গিয়ে ডিলিট করে ফোনটা জায়গায় রেখে শুয়ে পড়ল গোধূলি। রাত্রি বুঝতেই পারলো না কিছু।
পরদিন ছুটির পরে সাব্বির আসল স্কুল গেটে।
গোধূলি এগিয়ে এসে বলল,
চলুন কোথাও গিয়ে বসে কথা বলি।
সাব্বির বাইক দেখিয়ে বলল,
উঠে বসো।
সাব্বির একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে নামল।
গোধূলি শুরুতেই বলল,
কাল বাসায় অনেক ঝামেলা হয়েছে।
কি হয়েছে?
আপনি নামিয়ে দিলেন। বাসায় জেনে গেছে। আমাকে ভীষণ মারধর করেছে।
কি বলো। গায়ে হাত তুলেছে?
হুম। আর বাবা বলেছে আমাকে বাড়িতে রাখবে না। মামার ওখানে পাঠিয়ে দেবে।
তাহলেতো সমস্যা হয়ে গেল?
এখন কি করব।
হুম দেখছি কি করা যায়।
আসার সময় সাব্বির একটা প্যাকেট দিলো গোধূলির হাতে।
এটা রাখো।
কি এটা?
খুলে দেখো।
গোধূলি খুলে দেখল একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল।
এটা কেন। আর তাছাড়া বাসায় কি বলব?
এটা দিয়ে আমার সাথে কথা বলবে, মেসেজ দিবে,ভিডিও কল করবে। আর বাসায় বলবে না। লুকিয়ে রাখবে।
এমা! একটা আস্ত ফোন লুকিয়ে রাখা যায়?
বেশিদিন রাখতে হবে না। খুব জলদি আমরা বিয়ে করব।
সত্যি!
হুম, তোমাকে তো কাল বললাম যে নিজেরাই বিয়ে করব। তারপর তোমাকে আর ঐ বাসায় থাকতে হবে না। তুমি এখন থেকেই তৈরি থেকো। আমি সব ব্যবস্হা করছি। আমি বললে বের হতে পারবেতো?
হুম পারব।
গুড। এখন সোজা বাসায় যাও। সবাইকে বলবে তুমি বুঝতে পারোনি। ভুল হয়েছে। আর কখনও এমন কিছু করবে না। মাফ চাইবে।
মাফ চাইব কেনো!
আরে নাহলে সন্দেহ করবে তো।
ও ঠিক বলেছেন।
আর এমন আপনি আপনি করলে কি হবে? তুমি করে বলতে হবে আমাকে।
আচ্ছা ধীরে ধীরে হবে।
সাব্বির মিটমিট করে হেসে বলল,
কত ধীরে।
ফোনে বলব।
আচ্ছা মানলাম।
গোধূলি বাসায় গিয়ে কাউকে কিছু বললো না। নিজের মতো চুপচাপ থাকল। ওকেতো আর সত্যি সত্যি মামার ওখানে পাঠানোর কথা হয়নি। ও নিজেই বানিয়ে বলেছে সাব্বিরকে। একটু জলদি যেন বিয়ের চেষ্টা করে ছেলেটা।
পরদিন স্কুলে ঢোকার মুখে রিয়াদ গোধূলির পথ আটকালো।
কি অবস্থা,কেমন আছো?
এইতো ভালো।
হুম ভালো তো থাকার কথাই। নতুন মাল জোগাড় করছো দেখলাম। বাইকে করে রোজ হুস করে হাওয়া হয়ে যাচ্ছো রোজ রোজ। আর আমি বললে সময় হয়না তোমার।
একদম বাজে কথা বলবে না। এসব কি ভাষা?
ও তুমি একজনকে ব্লাফ দিয়ে আরেকজনের সাথে ঢলাঢলি করছো আর মানুষ বলতেও পারবে না?
উনি আমার আত্মীয়।
হুম জানি তো। বড় বোনের সাথে বিয়ের কথা চলছিলো কিন্তু মালটা তোমাকে পছন্দ করছে। হাজার হোক কচি জিনিস তুমি।
একটা বাজে কথা বললে তোমার বোনের কাছে বিচার দেব।
ওহ হো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তা তোমার নতুন না*ঙ আমার কথা জানে না?
তোমার কথা আবার কি জানবে। তোমার সাথে আমার কি এমন সম্পর্ক যে সেটা সবাইকে জানাতে হবে। তুমি শুধু আমার বন্ধুর বড় ভাই। আর আমারো ভাইয়ের মতো।
ও এখন আমি ভাই হয়ে গেলাম। নতুন ভাতার পেয়ে আমাকে ভাই বানিয়ে ফেললা।
তুমি বারবার অপমান করছো। উনার সাথে কিছু নাই আমার। বড় আপার সাথেই বিয়ের কথা চলছে ওনার সাথে।
ও তাহলেতো ভাইরা ভাইয়ের সাথে পরিচিত হতেই হবে।
এসব করতে হবে না। আমি পরিচয় করিয়ে দেব সব ঠিক হলে।
তাহলে আজ আমার সাথে চলো বাইরে।
আজ না। অন্য দিন।
অন্য দিন আর হবে না তোমার। ঠিক আছে যাও।
গোধূলি চট করে চলে গেল স্কুলের ভেতর।
রাতে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সাব্বিরের দেয়া ফোন অন করল গোধূলি। অন হতেই দেখল সাব্বির মেসেজ পাঠিয়েছে।
বৌ কি করছ। ফোন অন করে কল দিও।
গোধূলি মেসেজ পড়ে লজ্জায় লাল হলো।
ও মেসেজ দিলো।
সাব্বির সাথে সাথে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিল। হঠাৎ রিং বেজে ওঠায় গোধূলি ফোন অফ করে দিল।
সাব্বির আগেই ঐ নাম্বারে আইডি খুলে সব সেট করে রেখেছে। গোধূলি জানতো না। একটু পর আবার ফোন অন করে সাইলেন্ট মুডে দিয়ে কল দিলো। ওপাশ থেকে রিসিভ করেই সাব্বির একটা চুমু খেলো গোধূলিকে। তারপর বলল,
আমার ঘুম আসছে না। শুধু তোমাকেই মনে পড়ছে সবসময়। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে হবে। না হলে পাগল হয়ে যাব আমি।
গোধূলি শুধু হাসল। আস্তে করে বলল,
তুমি একটা পাগলই।
সাব্বির ইয়াহু করে উঠল তুমি ডাক শুনে। তারপর বলল,
এখন তোমাকে কাছে পেলে কি হতো জানো?
কি হতো?
তোমাকে কাছে টেনে,,
এমন সময় রাত্রি বাইরে থেকে বলে উঠল,
এই গোধূলি বাইরে আয়,এত সময় বাথরুমে কি করছিস।
গোধূলি বাই বলে ফোন রেখে দিল।
ফোনটা বুকের ভেতর লুকিয়ে বাইরে এলো গোধূলি। তারপর চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
পরদিন সাব্বির অফিসে কাজ করছিল। অনেকগুলো হিসাব পেন্ডিং হয়ে আছে। আজকের মধ্যে সব মিলিয়ে দিতে হবে। এমন সময় পিওন এসে ওর দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিল।
এটা কি?
একজন আপনার নাম করে দিয়ে গেল।
কুরিয়ার এর অফিস থেকে?
না,এমনি একটা ছেলে দিয়ে গেল।
সাব্বির ভাবল কে আবার এমনি হাতে করে ওর জন্য খামে কিছু দিয়ে যাবে।
আছে এখনও?
না চলে গেছে সাথে সাথেই।
নাম জানতে চাওনি?
না,খুব তাড়াতাড়ি দিয়েই চলে গেল।
আচ্ছা ঠিক আছে।
পিওন চলে গেলে সাব্বির জলদি খামটা খুলল। কোনো চিঠি হবে হয়তো। খাম খুলতেই কয়েকটা ছবি বেরিয়ে পড়ল।
সেসবে গোধূলির সাথে একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। দু’জন কোথাও একটা রেস্টুরেন্টে খুব কাছাকাছি বসে আছে। একটা ছবিতে ছেলেটা পেছনে থেকে গোধূলিকে জড়িয়ে আছে। আরেকটায় গোধূলিকে একহাতে জড়িয়ে ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে।
(চলবে)