অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৮

0
180

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( অষ্টম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৬>
এরপর কোন রকমে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে তুলি ফিরেছিল বাড়ি। নিরুপমা তো সেদিন দরজা খুলে ভীষণ অবাক হয়ে গেল যেন! তুলি আর রঙ্গন তো একসাথে গেছিল পার্টিতে, তাহলে ফিরলো আলাদা আলাদা কেন! কথাটা ভাবতেই তুলি কেমন এলোমেলো হয়ে জিজ্ঞেস করলো ওকে,
——” মা, রঙ্গন ফিরেছে?”
এই প্রশ্নে নিরুপমা কিছু না বুঝতে পেরেই বললো,
——” হ্যাঁ, এই দশ মিনিট আগে ফিরেছে। কিন্তু কি হয়েছে? তুই এইভাবে আলাদা এলি কেন!”
এই প্রশ্নের ঠিক কোন উত্তর দিতে পারলো না তুলি এই মুহূর্তে। ও কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছিল যেন! তাই প্রায় দৌড়েই এসেছিল ঘরে, রঙ্গন এর কাছে।
কিন্তু রঙ্গন সেদিন আর নিজের মধ্যে ছিল না! ওয়াশ রুমের ওই দৃশ্যটা যেন ভাসছিল ওর চোখের সামনে। ঘর অন্ধকার করে তাই বসেছিল একা। ইচ্ছে হচ্ছিল হাতের কাছে যা আছে, সমস্ত কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে! শেষ করে দিতে সব কিছু। তখনই তুলি হঠাৎ ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। আজ তুলি ভীষণ অসহায় গলায় বলে উঠেছিল রঙ্গন কে,
—– ” তুমি বিশ্বাস করো, তুমি যা দেখেছ ভুল দেখেছ আজ। সুপ্রিয় আমাকে জোর করে!”
কথাটাকে ওর শেষ হতে না দিয়েই রঙ্গন এবার খাটের পাশে রাখা নাইট ল্যাম্পটাকে ছুঁড়ে ফেললো মাটিতে খুব জোরে। রাগে, ঘেন্নায় হাত পা কাঁপছিল যেন ওর। তুলি এসব দেখে কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। বুঝতে পারলো রঙ্গন আর কিছু শোনার মতন অবস্থায় নেই এখন।
তবে রঙ্গন এবার ভীষণ কঠিন গলায় বললো তুলিকে,
——” চলে যাও তুমি। জাস্ট লিভ, রাইট নাও..”
কথাটায় তুলির হঠাৎ ধাক্কা লাগল যেন! ও এবার শেষবারের মতন রঙ্গনের হাতটা ধরে ওকে বুঝিয়ে বললো,
——” তুমি ভুল বুঝছো আমাকে! আমি সত্যি কোনোদিন ঠকায়নি তোমাকে! আমি তো তোমাকে ভালো!”
না, এবারও ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়ে রঙ্গন জোরে হাতটা ছাড়িয়ে নিল নিজের। তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
——” আর কোন মিথ্যে না! আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। এই জন্য আজ অব্দি তুমি আমাকে নিজের থেকে দূরে রেখেছো! কারণ তোমার তো ওই ছেলেটার ছোঁয়া পছন্দ। আমি তো একটা বাইরের লোক তোমার কাছে!”
কথাগুলো শুনে তুলি আর কিছু বলতে পারলো না যেন! রঙ্গন যে ওকে এতটা নিচে নামিয়ে দেবে, এটা ভাবতে পারছিল না আসলে! কিন্তু রঙ্গন এবার শেষ বারের মতন বলে উঠলো খুব রুক্ষ স্বরে,
——” আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারবো না। আর খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমাকে এই বিয়েটা থেকে মুক্তি দিয়ে দেব! নাও জাস্ট লিভ.. চলে যাও তুমি।”
কথাগুলো বলেই রঙ্গন ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেল সেই সময়। কিন্তু তুলি কিরকম সব হারিয়ে একটা নিঃস্ব মানুষের মতন দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়। মনে হচ্ছিল যেই তাসের ঘরটাকে এতদিন একটু একটু করে বানিয়েছিল তুলি, সেটা এক ধাক্কায়ই ভেঙে গেল আজ! আর সব শেষ হয়ে গেল চোখের পলকেই।
<১৭>
সেদিন এরপর তুলি আর কিছু বলেনি, কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেনি নিজের হয়ে। কারণ রঙ্গন আর কিছু শোনার মতন অবস্থায় ছিল না। তাই সেই রাতে নিঃশব্দে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঐ বাড়িটা থেকে। নিরুপমা যদিও শেষ চেষ্টা করেছিল। ও খুব অসহায় হয়ে বলেছিল তুলিকে,
—–” জানি না তোদের মধ্যে কি হয়েছে! কিন্তু এইভাবে চলে যাস না মা! ছেলেটা এখন খুব রেগে আছে, তাই কি বলতে কি বলেছে! সব কথাকে এইভাবে ধরতে নেই। ওর মাথা ঠাণ্ডা হলেই আবার তোর কাছে আসবে।”
কথাগুলো শুনে তুলি ভীষণ থমকে থাকা স্বরে বলেছিল,
—–” ও আর আসবে না আমার কাছে মা। আর আমার এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়াটাই ঠিক।”
কথাটা বলে তুলি নিরুপমা কে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল সেই মুহূর্তে। তারপর ভেজা চোখেই বেরিয়ে এসেছিল দরজার বাইরে।

সেদিন এরপর বৃষ্টি নেমেছিল খুব শহরে। তুলি সেই বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ। ওই নোংরা ছেলেটা আজ ছুঁয়েছে ওকে। জোর করে নিজের পুরো শরীরটা চাপিয়ে দিয়েছে ওর ওপর! কথাটা ভেবেই কেমন গা গুলিয়ে উঠছিল যেন। মনে হচ্ছিল এই বৃষ্টিতে ভিজে যদি ওই নোংরা হাতের স্পর্শটাকে মুছে ফেলা যায়! কথাগুলো ভেবেই এই মুহূর্তে আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। কান্নায় ভেঙে পড়লো কেমন। এই বৃষ্টি ভেজা আবছা শহরে কিরকম ছন্নছাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়।
তবে সেদিন রঙ্গন এর কথাও মনে হচ্ছিল খুব। রঙ্গন শেষে এইভাবে ভুল বুঝলো ওকে! এতটা খারাপ ভাবলো! একবারও শুনলো না তুলির কথা! ওর ব্যাগ গোছানো দেখেও আটকালো না ওকে! কথাগুলো ভেবে সব কিছু কিরকম মিথ্যে লাগছিল আজ। মনে হচ্ছিল এতদিনের একসাথে থাকা, এত অগুন্তি মুহূর্ত, ভালো লাগা, সব মিথ্যে। আসলে হয়তো ভুলটা ওরই। ‘ ভালোবাসি ‘ এই কথাটা বোঝাতে পারেনি ছেলেটাকে। নিজের জন্য সেই বিশ্বাসের জায়গাটাই তৈরি করতে পারেনি! অনেক ফাঁক রয়ে গেছে। সেই জন্যই আজ এইভাবে এই বৃষ্টি ভেজা শহরে একা দাঁড়িয়ে তুলি।

যাইহোক, সেদিন এরপর অনেক রাতে মা বাবার কাছে গেছিল ও। অশোকবাবু আর ওয়েন্দ্রিলা তো এত রাতে মেয়েকে একা এইভাবে দেখে ঘাবড়ে গেছিল খুব! কি হলো হঠাৎ, যে তুলিকে এইভাবে এই বৃষ্টির মধ্যে আসতে হলো এখানে! কথাটা ভেবেই চিন্তায় ওরা রঙ্গনকে ফোন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তুলি তখনই ওদের আটকে দিয়েছিল ভীষণ দৃর গলায়। ও সেই মুহূর্তে খুব কঠিন হয়ে বলেছিল,
——” কাউকে ফোন করার দরকার নেই। তোমাদের যদি আমাকে থাকতে দিতে অসুবিধা হয়, তাহলে বলো, আমি অন্য কোথাও চলে যাবো। কিন্তু রঙ্গন কে আর জোর কোরো না আমার দ্বায়িত্ব নেয়ার জন্য। আমি চাকরি করি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট। নিজের টা ঠিক চালিয়ে নিতে পারবো।”
কথাটায় তুলির মা বাবা কিরকম থমকে গিয়েছিল যেন। বুঝেছিল খুব বড় কোন ঘটনা ঘটেছে! নইলে তুলি এসব কখনো বলতো না। তাই আর কথা বাড়ায়নি ওরা। আসলে মাঝে মাঝে একটু সময় দিতে হয়। সব প্রশ্ন যখন তখন করা যায় না! আর তুলি ছোট থেকেই ভীষণ অভিমানী। তাই ওকে নিজের মতন কিছুটা সময় দিতেই হবে।

যাইহোক, এরপর তুলি এই বাড়িতেই ছিল নিজের মতন। ও আর রঙ্গন কে ফোন করেনি। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। আর রঙ্গনও একই। সেইদিনের পর তুলিকে আর কোন রকম ফোন বা মেসেজ করেনি। শুধু মায়ের মুখে শুনেছিল তুলি নিজের বাড়িতে আছে, ব্যাস। তবে এর বেশি খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করেনি বিশেষ।
আসলে সেদিনের ওই ওয়াশরুমের দৃশ্যটা, সুপ্রিয়র কথাগুলো, আজও কানে বাজে ওর! তুলি কিস করছিল ছেলেটাকে! পার্টিতে, সবার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে ওই ছেলেটার ঠোঁটে মিশিয়ে দিচ্ছিল নিজের ঠোঁট। কথাটা ভাবলেই রাগে চারিদিকটা অন্ধকার লাগে ওর। মনে হয় ঠকিয়েছে তুলি ওকে, প্রথম থেকে। আসলে এই বিয়েটা করেছিল জাস্ট নিজের মা বাবার চোখে ভালো সাজার জন্য। কিন্তু রঙ্গনকে তো ও কোনদিন একসেপ্ট করতেই পারেনি। তাই কখনো রঙ্গনকে নিজের কাছে আসতে দেয়নি; ভালোবাসেনি! আর রঙ্গন এত বোকা, যে শুধু দিনের পর দিন অপেক্ষাই করে গেছে! একবারও বোঝেনি যে তুলি শুধু লোক দেখানোর জন্য ওর সাথে আছে, আসলে মনে মনে ও প্রত্যেকটা দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্ত নিজের পুরনো প্রেমিক সুপ্রিয়র সাথেই ছিল। তাই পার্টিতে ছেলেটাকে একবার দেখে আর সামলাতে পারেনি নিজেকে। শেষ পর্যন্ত সবার আড়ালে গিয়ে ওয়াশ রুমে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরেছে, আঁকড়ে ধরেছে নিজের সর্বস্ব দিয়ে! কথাগুলো ভেবেই এত রাগ আর ঘেন্না হয় ওর যে তুলির নামটাও আর মুখে আনে না নিজে থেকে। এর মধ্যে একদিন গিয়ে লইয়ারের সাথে কথাও বলে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি তুলিকে এই বিয়েটা থেকে মুক্তি দেবে রঙ্গন। নিজে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠাবে তুলির কাছে।
<১৮>
এই মন খারাপের অন্ধকার আর সম্পর্কের কাঁটা ছেঁড়ার মধ্যেই দিন কাটছিল তুলি আর রঙ্গন এর। এর মধ্যে একদিন ডিভোর্সের নোটিশটা সকালে হাতে পেয়েছিল তুলি। ভাগ্যিস সেদিন মা বাবা কেউ বাড়িতে ছিল না, মন্দিরে পুজো দিতে গেছিল! নইলে ওদের সামনে এই কাগজটা আসলে কখনো সাইন করতে দিত না তুলিকে। হয়তো রঙ্গনকে ফোন করে বোঝানোর চেষ্টা করতো! হাতে পায়ে ধরতো ওর তুলির সাথে সংসার করার জন্য! কিন্তু তুলি তো এটা চায় না। যার ওর ওপর এত অবিশ্বাস, যে এত বড় একটা ডিসিশন নেয়ার আগে একবার অন্তত তুলিকে একটা ফোন অব্দি করলো না, তার সাথে তুলি কেন জোর করে থাকবে! কেন নিজের সত্যিটা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে! এতটা সস্তা তো ও করবে না নিজেকে রঙ্গন এর কাছে। কথাগুলো ভেবেই সেদিন নিঃস্তব্ধভাবে সাইন করেছিল ডিভোর্স পেপারে। সেই মুহূর্তে এই ফাঁকা বাড়িতে অভিমানে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল তুলি। এত ঠুনকো ছিল ওদের সম্পর্কটা! এতটা দূর্বল! যে একটা ছোট্ট ঝড়ে ভেঙে গেল এইভাবে!
কথাগুলো রঙ্গনেরও মনে হচ্ছিল এই কদিন ধরে। এই বিয়েটা আসলে শুরু থেকেই হয়ত একটা ভুল ছিল! তাই এইভাবে ভেঙে গেল চোখের পলকে। উকিল একদিন আগে ওকে ফোন করে জানিয়েছে আসলে, যে ডিভোর্স নোটিশ পোস্ট করে দিয়েছে তুলিদের এড্রেসে। আজকের মধ্যে সেটা তুলির হাতে পৌঁছেও যাবে হয়তো! আর তুলি তো ওকে ভালোবাসে না। তাই এই পেপারটা দেখে হয়তো খুশিই হবে আজ।
সেদিন নার্সিং হোমে চেম্বার শেষ করে একা ঘরে এই কথাগুলোই ভাবছিল ও। এখন ঘড়িতে রাত এগারোটা। অন্যদিন হলে অনেক আগেই বাড়ি চলে যেত রঙ্গন। কিন্তু আজকাল আর ওই ফাঁকা ঘরটায় ফিরতে ইচ্ছে করে না যেন! যেদিকেই তাকায়, তুলির মুখটাই ভেসে ওঠে সারাক্ষণ।
যাইহোক, এই ভাবনার ভিড়ে সেদিন হঠাৎ ওর চেম্বারে একজন সিস্টার হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো,
——” স্যার একটা হাই প্রোফাইল কেস এসেছে ইমারজেন্সি তে। সুপ্রিয় সেন, ফেমাস সিঙ্গার, উনি গান গাইতে গাইতে স্টেজে সেন্সলেস হয়ে গেছেন চেস্ট পেইন নিয়ে। ওই প্রোগ্রামের অর্গানাইজাররাই এখানে নিয়ে এসেছে ট্রিটমেন্ট এর জন্য। প্লিজ, আপনি একটু চলুন।”
কথাটা শুনে রঙ্গন থমকে গেল কেমন! ওই ছেলেটার মুখ আবার দেখতে হবে ওকে! আর কোন হসপিটাল নার্সিং হোম কিছু পেল না যাওয়ার জন্য! আর এখন তো হার্ট সার্জেন ও ই আছে এভেলেবেল। ডক্টর আচার্য্য তো লিভ এ আছেন। তাই আর কোন উপায় নেই। ওকেই হ্যান্ডেল করতে হবে কেসটা। কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনাআপনি চলে এলো। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের ইমশনটাকে কন্ট্রোল করে উঠে দাঁড়ালো রঙ্গন, একজন ডাক্তার হিসেবে পেশেন্টের জন্য।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে