#অবেলার_মেঘ
#পর্ব_৭
#জীহানুর
সিঁড়ি থেকে নেমে এসে মার্জিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। ওকে খাটের পাশে বসিয়ে মেঘ হাটুগেড়ে বসে ওর সামনে।
-তোমাকে আজ কিছু বলবো যা তোমার জানা খুব দরকার। বোর্ডিং লাইফ শেষ হতে হতে ততদিনে আমি একেবারেই নিরব একজন মানুষ।কারো সাথে মিশতে পারতাম না, আশেপাশে বেশি মানুষের থাকা সহ্য করতে পারতাম না। একাকীত্ব আমাকে ততদিনে পুরোপুরিভাবে গ্রাস করে নিয়েছিল। আমার চারদিকে একটা দেয়াল গড়ে দেওয়া হয়েছিল যা আমি চাইলেও ভাঙতে পারতাম না। প্রথম কিছুদিন চেষ্টার পরে ব্যর্থ হয়ে আর কোনদিন আমি আমার সীমাবদ্ধ পৃথিবী থেকে বেরোতে পারিনি।সেই অন্ধকারময় জীবনে এক আশার আলো উকি দিয়েছিল। আয়রিন তার নাম। আমার ক্লাসমেট ছিল। সবার মধ্যে ও অন্যরকম ছিল। লম্বা কালো চুল, ঠিক তোমার মতন দেখতে। প্রচণ্ড চঞ্চল এক প্রজাপতি। হাসি-ঠাট্টায় মগ্ন এক প্রাণবন্ত রঙধনু। আমার কাছে ওকে লাল গোলাপ ই মনে হতো। আমি প্রায়শই ওর চুলে যত্ন করে লাল গোলাপ গুঁজে দিতাম,আর ও এক ঝর্ণাধারার মতো হাসি দিতো। আমি যে কতবার ওর সেই হাসিতে ডুব দিয়েছি তার কোনো হিসেব আমার কাছে নেই।আমার তখন ওকে সর্বক্ষণ আমার কাছেই চাই।ওকে না দেখলে যে অস্থিরতা আমাকে জ্বালাতন করতো তা আমার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব ছিল। দুই বছরের সম্পর্কে ধীরেধীরে ও কেমন যেন নিরব হতে শুরু করেছিল।বুঝতাম না কেন এমন হচ্ছিল ও।হঠাৎ একদিন জিজ্ঞেস করে বসি ওর নিরবতার কারণ। ও চিৎকার করে বলেছিল যে আমার পাগলামোতে ও অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।আমাকে দেখলে ওর ভয় লাগে। আমার কেয়ারিং-এ ওর দম বন্ধ হয়ে যায়। ও এসব থেকে মুক্তি চায়।হ্যা ঠিক ই তো।আমি ওকে আর কারো সাথে দেখতে পারতাম না। জানতাম ওর ফ্রেন্ড সার্কেল, তবুও আমার কেন জানি সহ্য হতো না। আমার কারণেই ও ধীরেধীরে পালটাতে শুরু করে। সবার থেকে দূরে সরে আসে। আমার লাল গোলাপটা দিনদিন মুরছা যেতে শুরু করে। ও আমার চারপাশের দেয়াল ভেঙে ভিতরে চলে এসেছিল ঠিক ই,কিন্তু আর কখনো বেরোতে পারেনি।আমি বের হওয়ার সুযোগ দিইনি। ওকে এক প্রকার জোর করেই নিয়ে আসি দেশে। আসতে চায়নি, তবুও অনেককিছু বলে নিয়ে আসি এই বাড়িতে।সায়লাকে বলেছিলাম ওর খাবারে যেন ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়।ভয়ের কারণে ও আমার কথা মতোই করেছিল। তখন ঠিক মাঝরাত ছিল,বিছানা থেকে উঠিয়ে খুব সাবধানে ওর হাত-পা বাধি।খোলা চুলে একটা গোলাপ গুঁজে দিই শেষবারের মতো। কোলে করে নিয়ে যাই বাগানে যেখানে সুন্দরভাবে আমি কফিন সাজিয়ে রেখেছিলাম আগে থেকেই।কফিনের ভিতরে শুইয়ে দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।কি নিষ্পাপ চেহারা। সত্যিই নারীদের ঘুমালে পরীর মতোই লাগে। হ্যা, একটা পরী শুয়ে আছে আমার সামনে।কয়েকবার পানির ছিটা দিতেই ওর জ্ঞান ফেরে।বড় বড় চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছিল। আর্তনাদের বৃষ্টি হচ্ছিল ওর চোখ দিয়ে।কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই, হবে কি করে! টেপ লাগিয়ে দিয়েছিলাম।ওর চিৎকার শুনলে হয়ত ওকে চুপ করাতে পারতাম না। হাতের জ্যেষ্ঠ আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে দু’চোখের পাতায় নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিই।তারপর আর দেখা হয়নি ওর দিকে ফিরে।কফিনের ঢাকনা লাগিয়ে খুব ধীরেসুস্থে মাটিচাপা দিয়ে ফেলি ওকে।কি জানি কেমন লাগছিল ওর। হয়ত এবার সত্যিই দম বন্ধ হয়ে গেছে।সেদিনের পর থেকে আর আমি বাগানে যাইনি।
মার্জিয়া থরথর কাঁপছে। আর ভয়ার্ত চোখ দিয়ে চুপ করে পানি ফেলছে। মেঘ ওর হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়।
-সপ্তাহ খানেক ছিলাম এখানেই। কিছুতেই মন বসছিল না।দিনদিন আরো উগ্র হয়ে পড়ছিলাম।ভাঙচুর,চিল্লাপাল্লা আমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল।তাই সিদ্ধান্ত নিই এখান থেকে ফিরে যাওয়ার। রওয়ানা দিয়েছিলাম।কিন্তু পথেই দেখা মিলেছিল তোমার। তোমাকে দেখতেই হৃদয় হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গিয়েছিল।মনে হচ্ছিল আমার লাল গোলাপটা মায়াবী বেশে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন আর কথা হয়নি।তুমি রিক্সায় করে চলে যেতেই আবার সেই অস্থিরতা শুরু হয়।অনেক খুঁজে তোমার বাসার ঠিকানা পেয়েছিলাম।তোমার সব ইনফরমেশন তার দু’দিনের মধ্যেই আমি জোগাড় করে ফেলি। আর আমি একা থাকতে পারিনি।হিরকের হাতে তোমার কাছে কার্ড পাঠাই।আর বাসা থেকে বের করে দেওয়ার অর্ডার আমিই দিয়েছিলাম।তারপরেই তুমি আসো এখানে। তুমি আসার পর থেকে সারাক্ষণ আমার চোখের সামনেই ছিলে, এমনকি রাতেও তুমি ঘুমানোর পর আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।ভোর হতেই আড়ালে চলে আসতাম। তোমাকে আমি হারাতে চাইনি বলেই সারাক্ষণ নিজের কাছেই রেখেছি। তোমার অনুপস্থিতি সহ্য করা দুষ্কর।
মার্জিয়া ভয় ভয় গলায় মেঘকে প্রশ্ন করে-
-তুমি কি আমাকেও মেরে ফেলবে?
-আমি জানি না।আমি কিছুই জানি না। আমি শুধু জানি তুমি আমার সাথেই থাকবে।তুমি আমার চোখের সামনে থাকবে।যদি দূরে যাওয়ার চেষ্টা করো তাইলে কি হবে আমি সত্যিই জানি না!আয়রিন নিজে থেকেই এসেছিল, তাই ও যেতে চাইলেও আমি যেতে দিইনি।আর তোমাকে আমি নিজেই আমার পৃথিবীতে নিয়ে এসেছি।তুমি আমার কাছে একটা এডিকশনের মতো,যা আমি নিজে কখনো ছাড়তে চাইবো না।
মার্জিয়া কাঁদছে। শব্দ করেই কাঁদছে ও।মেঘ দাঁড়িয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে নেয় ওকে নিজের বাহুডোরে।
-তোমাকে যে ভালবেসে ফেলেছি।তুমি ভাবতেও পারবেনা তুমি আমার জন্য কি! তোমার কতটা প্রয়োজন তুমি জানো না।কিন্তু আমি কোনোভাবেই তোমাকে হারাতে চাই না।
এদিকে হিরক ফোন করে সব জানিয়ে দেয় আমির সাহেবকে।বাগানে লাশের কথা শুনে ঘাবড়ে যায় আমির সাহেব।কারণ ওখানে শুধু মেঘের দাফন একটা লাশ না, আরো অনেক লাশ আছে…
#জীহানূর