#অবেলার_মেঘ
#পর্ব_৪
#জীহানুর
-জীবন্ত লাশ আছে মানে?বুঝলাম না ঠিক!
-ঐ যে মাটির গভীরে শিকড় চলে যাওয়া গাছগুলো, ওরা তো জীবন্ত লাশের মতোই। না হাটতে পারে, আর না কথা বলতে পারে।
-আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন না তো?
-আরে না না, কথা কেন ঘুরাবো! সায়লা এসে গেছে বোধহয়।
-কিহহহ!!! আচ্ছা আমি যাচ্ছি, পরে কথা হবে।
মার্জিয়া দ্রুত পদক্ষেপে মেঘের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর নিজের ঘরে চলে যায়। রাতে পড়ার টেবিলে বসে ভাবতে থাকে মেঘের কথা।
-যেমন টা শুনেছিলাম মেঘ মোটেই তেমন না। তার কথাবার্তায় কোনো উগ্র ভাব নেই,বেশ হাসিমুখেই কথা বলে। তাহলে সায়লা সেদিন ওভাবে কেন বললো!
মেঘ খাটে শুয়ে শুয়ে উপরের দেয়ালটা কে দেখছে।সাদার উপরে নীলচে আকাশী রঙ দিয়ে পেইন্ট করা। ঠিক যেন মেঘের খেলা চলছে ওর ঘরের ভিতরে।ছোটবেলায় বাবাকে বলে এমন রঙ করিয়েছিলো। জেদ করেছিলো যে মেঘের ঘরে আকাশ চাই।মেঘ একা থাকতে পারবেনা।বাবা রঙ করিয়ে দিয়েছিল। সেদিন সারা বাড়ি হৈ হৈ করে বলে বেড়িয়েছিল যে মেঘের ঘরে আকাশ নেমেছে। এতোটা চুপচাপ সে না। প্রচণ্ড চঞ্চলতায় ভরপুর ছিল ওর শৈশব। কিন্তু বাবার অতিরিক্ত শাসনে সবকিছু যেন পালটে যায়।ওর চঞ্চলতাই ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বনেদী ঘরের ছেলে পড়াশুনো বিমুখ কেন হবে, শৃঙ্খলতাবোধ শিখাতে ঐ ছোট বয়সেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় লন্ডন বোর্ডিং এ।কতো করে অনুরোধ করেছিল বাবার কাছে, কত কান্নাকাটি কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। মা’এর হাত ছাড়ার সময় কতটা কষ্ট হয়েছিল সে কথা আজও ওর মনে আছে। সেখান থেকেই বাবা বলতে ও শুধুমাত্র একটা পাথর কে চিনতো , নিষ্ঠুর যার কোনো দয়ামায়া নেই।বোর্ডিং এর জীবন ওর কাছে খুব ভয়ানক ছিল।কারণ মেঘ কখনওই নিজেকে কড়া নিয়মে বাধতে চায় নিই।ও প্রাণবন্ত খোলামেলা থাকতে ছেয়েছিল, কিন্তু বংশ পরিচয় তা হতে দেয়নি। তারপর সময় যতো যেতে থাকে ততোই ও সবকিছু মানিয়ে নিতে থাকে। কারো সাথে মিশতো না, কথা বলতো না। সবার থেকে আলাদা হয়ে চুপচাপ বসে থাকতো।
বোর্ডিং এর জীবন শেষে বাবা বলেছিল অনেকবার ফিরে আসতে, কিন্তু ও ফেরেনি। ফিরতে চাইনি এখানে। কারণ সেখানে ও কিছু একটার নেশায় পড়ে গিয়েছিলো। অদ্ভুত এক নেশা যা ত্যাগ করা ওর পক্ষে সম্ভব ছিল না।কিন্তু সেই নেশা ওকে ছাড়তে চেয়েছিল, তাইতো পুতে ফেলেছে।
মেঘের মুখে একটা বিজয়ের হাসি।শোয়া থেকে উঠে বসলো। কি যেন একটা ভেবে জানালার কাছে যায়।হাত দিয়ে পর্দা টা সরিয়ে বাগানের লাল গোলাপ গাছগুলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে-
-কি অদ্ভুত নিষ্ঠুর এই ফুলগুলো, লাশের শরীর থেকে রক্ত শুষে নিয়ে নিজের সৌন্দর্য দ্বিগুণ করছে!
-ডক্টর শেখ, আরো কিছুদিন সময় লাগবে মেঘকে আপনার কাছে পাঠাতে।এখন ওর যে কন্ডিশন তাতে কেউ ওর ধারেকাছেও যেতে পারবেনা। ও অনেকটা উগ্র হয়ে যায় তখন।কিন্তু আপনি সব ব্যবস্থা করে রাখেন। আমি সুযোগ পেলেই ওকে কন্ট্রোলে আনবো।
-আচ্ছা, কিন্তু সাবধান। কোনোরকম জোরজবরদস্তি করবেন না।মনে রাখবেন, ও যখন শান্তভাবে আসতে চাইবে ঠিক তখনি ওকে নিয়ে আসবেন।ওর উপর জোর খাটাতে যাবেন না, হিতের বিপরীতও হতে পারে।
-জ্বী, আমি খেয়াল রাখবো।
আমির আহমেদ ডক্টরের সাথে কথা বলে ফোনটা টেবিলের উপরে রেখে ইজি চেয়ারে গিয়ে গা এলিয়ে দেয়।
-সত্যিই তো ছেলেটাকে না পাঠালেও হতো।নিজের কাছে রেখে বুঝালেও পারতাম।ওর ভুলগুলো শুধরে দিলেও পারতাম।সেদিন এতোটা কঠোর না হলে আজ আমার ছেলের এই অবস্থা হতো না। এতো বড় অপরাধও সে করতো না।
এসব ভাবতে ভাবতে মেঘের বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
পরদিন বিকালে মার্জিয়া শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। তখন মেঘের গিটারের আওয়াজ শুনতে পায়।বইটা রেখে দিয়ে মেঘের ঘরের সামনে যায়। আজ দরজা খোলাই আছে। তাই ও ধীর পা’এ ভিতরে ঢোকে। জানালার সামনাসামনি একটা টুলে বসে মেঘ গিটার বাজাচ্ছে। দৃষ্টি বাগানের দিকে।মনে হচ্ছে ও গিটার দিয়ে কারো সাথে কথা বলছে।মার্জিয়া চুপটি করে ওর পিছনে হাত বেধে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু সময় পর মেঘ গিটারটা পাশে নামিয়ে রেখে বলে-
-ছোটবেলায় কি তোমার বিড়ালদের সাথে ওঠাবসা ছিল?
-মানে!? ওদের সাথে ওঠাবসা কেন করবো!
-এই যে চোরের মতো আমার ঘরে আসলে, তাই ভাবলাম চুরি বিদ্যাটা ওদের কাছ থেকে শিখেছ হয়তো!
-কিহ!আমি চোর?
-বিড়ালের শিষ্য যে খুব সাধু হবে এটা তো শুনিনি কখনো।
-আচ্ছা বেশ।চলে যাচ্ছি। আর আসবো না আপনার ঘরে।
এই বলে মার্জিয়া দরজার দিকে পা বাড়ায় আর মেঘ টুল ছেড়ে এসে ওর ডান হাত ধরে বসে। খুব করুণ মুখে করে বলে-
-যেওনা প্লিজ। আমার একা থাকতে ভালো লাগেনা।
-তাইলে বললেন যে আমি চুরি করে এসেছি!
-যা তোমার তা তুমি কখনো চুরি করতে পারবেনা। খুব বরঞ্চ লুকিয়ে রাখতে পারবে।
-কিছুই বুঝলাম না।
-আচ্ছা বসো তুমি এখানে।
ওর হাত ধরে টেনে এনে টুলের উপর বসায়।
-দেখো বাগান টা কতো নিরব লাগছে দেখতে।
-নিরব কোথায়! সুন্দর লাগছে।আমি তো ভুলেই গেছি, বাগানে যাবো এখন একবার।আপনি যাবেন আমার সাথে?
-না আমি ওখানে যাই না।দম বন্ধ হয়ে আসবে।
-উদ্ভট লোক তো আপনি।বাগানে গেলে কারো দম বন্ধ হয় না কি!
-আমার হয়।
-তাহলে আপনি থাকেন। আমি যাচ্ছি।আপনি বাগানে না গেলে আমার আর এই ঘরে আসা হবে না।
-এই না।এরকম করবেনা।
-আমি তাইই করবো।
-তাহলে তোমাকেও বন্দী করে রাখবো আমি।যেভাবে লাল গোলাপকে বন্দী করেছি…
#জীহানূর