#ধারাবাহিক
#অবেলার বকুল
পর্ব-চৌদ্দ
মাহবুবা বিথী
—দরজাটা বন্ধ করে নিলেই পারতে?
—-না,মানে। তুই এই মুহুর্তে এখানে কেন? তোর কোনো কান্ডজ্ঞান নাই? বিবাহিত মানুষের ঘরে ঢুকতে হলে নক করে ঢুকতে হয় এই কমনসেন্সটুকু অন্তত তোর থাকা উচিত ছিলো।
—তোমাকে দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছো। কে জানতো, তুমি জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে এই কাহিনী রচনা করবে? বৌয়ের মন গলাতে অজ্ঞান হয়ে যাবার ভান করেছিলে নাকি সত্যি জ্ঞান হারিয়েছিলে আমার এখন সন্দেহ হয়?
কথাগুলো বলে সায়ান মিটমিট করে হাসতে লাগলো।
—-তুই তো আচ্ছা বেয়াদব হয়েছিস?
—-না,সায়ান তোমার ভাই সত্যিই অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলো।
—-বুঝতে পারছি,আমে দুধে তোমরা এখন মিশে গিয়েছো। তবে ভাইয়া তুমি আমাকে বেয়াদব বলো বা আরো কিছু গালিগালাজ করো তাতে কোনো সমস্যা নেই, অসুস্থ অবস্থায় এতো তেল তোমার কোথা থেকে আসে বুঝে পাই না।
—আমাকে আর বলতে হবে না। তোমার বেলায় দেখবো, তুমি কি করো?
—মনে হয় না,তোমার মতো এতো তেল আমার থাকবে। যাইহোক এই ওষুধগুলো টেবিলে রাখলাম। সময়মতো খেয়ে নিও। আমার আবার কোচিং এ যেতে হবে।
সায়ান চলে যাবার পর আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-সায়ানটা পাজী আছে। ঘরে ঢুকে কাশি দিলো। আসলে ওর চুলকানি আছে তাই বিনা পয়সায় নাটক দেখতে এই কাহিনী রচনা করেছে।
আয়ান হঠাৎ খেয়াল করলো,বকুল ওর দিকে তাকাতে পারছে না। বকুলের লজ্জা মাখানো রক্তিম মুখটা দেখতে আয়ানের ভীষণ ভালো লাগছে। আয়ান বকুলের হাতটা ধরে নিজের কাছে টেনে এনে কানের লতিতে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—-আজ এপর্যন্ত থাক। বাকীটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকলো।
আয়ানের মুখে একথা শুনে বকুল লজ্জাবতী লতার মতো লাজে কুঁকড়ে গেল। ওর লাজ রাঙ্গা মুখটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে আয়ান বললো,
—-আর লজ্জা পেতে হবে না। আমার খিদে পেয়েছে। নীচে গিয়ে আম্মুর কাছ থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসো।
বকুল আয়ানের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
রাহেলা বেগম কিচেনে আয়ানের জন্য সুপ আর আপেলের জুস রেডী করছেন। বকুলকে দেখে বললেন,
—-তুই যখন এসে পড়েছিস খাবারটা নিয়ে উপরে চলে যা।
—-উনার নাকি খুব খিদে পেয়েছে। এখুনি নিয়ে যাচ্ছি।
ওদিকে আয়ানের মনে হচ্ছে বুকের উপর অনেক দিনের চেপে থাকা ব্যথার বোঝাটা যেন আজ নেমে গেল। বকুলকে ওর প্রথম থেকেই ভালো লেগেছে। যদিও ওর মাঝে অল্প বয়সী চপলতাটুকু ভালোই আছে। বকুলের বয়সটা কম হওয়াতে প্রথমে আয়ানের ওর সাথে অ্যাডজাস্ট করতে একটু সমস্যা হচ্ছিলো। আসলে একদম অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে ঘনিষ্ট আচরণ করতে একটু সংকোচ লাগে। যতই স্বামী স্ত্রীর বন্ধনে বাঁধা হোক না কেন? অথচ আগের যুগে সম্পূর্ন অপরিচিত দুটো মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো। সাথে সাথে দাম্পত্য জীবনও শুরু হয়ে যেতো। যাক সবাই তো একরকম নয়।
আয়ানের মনের পর্দায় আবারও জেসিকার মুখটা ভেসে উঠলো। ছয় বছরের প্রেম আর দু,বছরের সংসার জীবনও পারেনি জেসিকাকে আটকে রাখতে সেখানে একদম অপরিচিত বকুল ওকে আর কতটুকু ভালোবাসবে? কিন্তু আয়ান বকুলের চোখে ওর প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টি দেখেছে। আয়ানেরও ইচ্ছে হয় বকুলকে ভালোবাসতে। তাই আজ দু,জনের মাঝে দুরত্বের প্রাচীরটা আয়ান নিজ হাতে ভেঙ্গে দিলো। নিজেকে খুব হালকা লাগছে। বকুল নামক এক মাদকতায় আয়ানের চারপাশটা ভরে আছে। এ যেন বকুল ফুলের ঘ্রাণ।
আয়ান বারান্দায় গিয়ে রকিং চেয়ারটায় বসে হালকা দোল খেতে লাগলো। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। বারান্দায় টবে লাগানো শিউলি গাছটা থেকে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। বকুল রুমে এসে টেবিলের উপর খাবারটা রেখে আয়ানকে খুঁজতে লাগলো। বারান্দায় উঁকি মেরে দেখে আয়ান বসে আছে। বকুল কাছে এসে বললো,
—-আবারও বারান্দায় এসে বসেছেন?
আয়ান মুচকি হেসে বললো,
—বারান্দায় বসলে সমস্যা কি?
—-সকালে জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে যাবার পরও আপনার শিক্ষা হয়নি?
—-সায়ান কি বললো শোনোনি? আমি নাকি বউয়ের আদর খাওয়ার জন্য অজ্ঞান হবার ভান ধরেছি?
—আমি কি করে জানবো? আপনার মনের ভিতর কি চলছে? এখন খেতে আসেন।
বকুল রুমে এসে সুপের বাটিটি হাতে দিয়ে বললো,
—-চট জলদি খেয়ে নিন,ওষুধ খেতে হবে।
—আমার হাতে ব্যথা,
—এই চেয়ারটায় বসুন,আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
আয়ান চেয়ারটায় বসার পর বকুল চামচ দিয়ে ওর মুখে সুপ তুলে দিতে লাগলো। আয়ান এক দৃষ্টিতে বকুলের লজ্জারাঙ্গা মুখটির পানে তাকিয়ে থাকলো আর একটু একটু করে খেতে লাগলো। একটু আগে বকুলের জীবনে যা ঘটলো তাতেই ও লজ্জায় নুয়ে পড়েছে তারউপর আয়ানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বকুল মাথা নিচু করে বললো,
—-আপনি এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি খাওয়াতে পারবো না। আপনার খাবার আপনি খেয়ে নিবেন।
—-আমিও খাবো না।
—-মা কিন্তু মন খারাপ করবে? আপনার শরীর দুর্বল দেখে মা কষ্ট করে সাত সকালে খাবারগুলো রেডী করেছে।
— মায়ের মন খারাপ করবে সেটা আমি জানি কিন্তু আর কারো মন খারাপ হবে কিনা সেটা জানতে বড্ড ইচ্ছে হয়।
—-সেটা আপনি বুঝে নিন। এখন বড় বড় হা করে খুব দ্রুত সুপটা খেয়ে নিন।
—খাওয়া শেষ হলেই তো তুমি নিচে চলে যাবে। তোমাকে আটকে রাখার এটা একটা আমার বাহানা সেটা কি বুঝো না?
—-এখন বুঝেও লাভ হবে না। আমাকে নিচে যেতে হবে। আর আপনারও রাতে ঘুম হয়নি। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আয়ানের খাওয়া শেষ হলে বকুল এঁটো বাসনগুলো ট্রের মধ্যে গুছিয়ে নিতে লাগলো। হঠাৎ বকুল পিছন দিক থেকে এক বলিষ্ট হাতের জড়িয়ে ধরার স্পর্শ অনুভব করলো। এযে আয়ান ছাড়া কেউ নয় তা বকুল স্পষ্ট বুঝতে পারছে। এই মুহুর্তে এই ঘরে ও আর আয়ান ছাড়া কেউ নাই। আয়ান বকুলের ঘাড়ে মুখটা ঘষে আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
—-তুমি আমাকে ছেড়ে কোনোদিন চলে যাবে নাতো?তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে আমি আর বাঁচতে পারবো না।
বকুল আয়ানের বাঁধন থেকে নিজেকে আলগা করে নিয়ে বলে,
— প্রথমত এই পৃথিবীতে কারো জন্য কেউ বাঁচতে পারবে না। কথাটা ঠিক নয়। আল্লাহপাক যার হায়াত যতদিন রেখেছে তাকে ততদিনই বাঁচতে হবে। সময়ের সাথে মানুষ নিজেকে ঠিক সামলে নেয়।
—তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তরটা কৌশলে এড়িয়ে গেলে।
—-এখানে এড়িয়ে যাওয়ার কিছু নেই। কিছু কিছু ভাষা বুঝে নিতে হয়। এখন এতো বকবক না করে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আয়ানের মোবাইলটা টুং করে শব্দ হলো। মনে হলো কেউ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। মোবাইলের দিকে তাকানো মাত্রই আয়ানের মুখের মানচিত্র বদলে গেল। ভুরুটা কুঁচকে বকুলকে বললো,
—-আমি সময়মতো ওষুধ খেয়ে নিবো। তুমি নিচে চলে যাও।
হঠাৎ আয়ানের মুড চেইঞ্জ দেখে বকুলের কেন যেন মনে হলো জেসিকা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। একটু আগের আয়ান আর এই আয়ানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। বকুল এঁটো বাটিগুলো নিয়ে নীচে চলে গেল। এরপর ও দীর্ঘসময় উপরে যায়নি। আয়ানের উপর খুব অভিমান হয়েছিলো।দুপুরের খাবার রাহেলা বেগম নিয়ে গিয়েছিলো। আয়ানকে খাইয়ে দিয়ে নিচে চলে এসেছে। খাবার টেবিলে বকুল সায়ানের কাছে শুনেছিলো,ঢাকা ভার্সিটিতে সার্কুলার হয়েছে। দ্রুত পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। এখন পড়াশোনা ছাড়া আর কোনোদিকে মাথা ঘামানোর মতো সময় বকুলের হাতে নেই। রাতে আয়ানের রুমে ডিনার পৌঁছে দিয়ে পড়ার ছুঁতোয় আয়ানের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আয়ানও ভাবে, পরীক্ষা সামনে তাই হয়তো বকুল চলে গেছে।
আসল কথা হলো আয়ানের উপর বকুলের অভিমান হয়েছে। যাইহোক পরীক্ষা সামনে তাই বকুল পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো বিষয় নিজের ভাবনায় আনতে চায় না।
আয়ান সুস্থ হয়ে অফিস শুরু করলো। বকুলেরও পড়াশেনার চাপ দিনদিন বাড়তে লাগলো। এদিকে রাতে পড়তে বসে বকুল বুঝতে পারে আয়ান কার সাথে যেন কথা বলে। কেন যেন বকুলের মনে হয় আয়ান জেসিকার সাথে কথা বলে। সন্দেহ দূর করতে একদিন রাতে বকুল চুপি চুপি আয়ানের ঘরে ঢুকে মোবাইলটা চেক করে। এবং ওর সন্দেহটা সঠিক হয়। আয়ান জেসিকার সাথে রাতে চ্যাট করে। তবে ম্যাসেজগুলো সব ডিলিট করা। বকুল প্রচন্ড কষ্ট পায়। মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে বকুল পড়াশোনার ভিতর নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। এদিকে আয়ান বকুলকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার জন্য পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে।
চলবে