#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী
—-কিরে দাদাভাই, তোদের দিন দুপুরে এভাবে রোমাঞ্চ করা ঠিক হচ্ছে না। লোকে দেখলে মন্দ বলতে পারে? আফটার অল এটাতো ঢাকা শহর নয়। সেটা তোদের মনে রাখা উচিত।
—-না বুঝে শুনে কি সব বাজে কথা বলছিস?
—-একটু দুষ্টুমি করছিলাম। তোদের দুজনকে মানিয়েছে বেশ।
আয়ান সায়ানের কথা শুনে মনে মনে বললো,”আর মানামানি, জানি না এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি কি? আয়ান বাহ্যিক ভাবে স্বাভাবিক থেকে সায়ানকে বললো,
—–ওর চোখে ধুলো পড়েছিলো তাই ক্লিন করে দিচ্ছিলাম। এখন আসল কথা বল গাড়িটা ধুয়েছিস?
—-হুম,আম্মু তোদের ডাকছে।
—-তুই বকুলকে সাথে নিয়ে যা,আমি আসছি।
ওরা চলে যাবার পর আয়ান নদীর শীতল হাওয়া গায়ে মেখে ভাবছে,”সংসার নামক এই জটিল প্রাঙ্গনে কেউ জানে না কখন কি ঘটবে?যেমন সময়ের হাত ধরে জেসিকা ক্রমে চলে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে। তবুও হঠাৎ আলোর বিদ্যুৎ ঝলকানির মতো মাঝে মাঝে ওর কথা মনে পড়ে যায়। একসময় প্রবল আবেগে জেসিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আয়ান বলেছিলো ওর মতো একজনকেই ওর জীবনে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই সুন্দর সময়গুলোকে দুপায়ে মাড়িয়ে জেসিকা চলে গেছে আজ বহু দূরে। আয়ান কিছুদিন আগে শুনেছে জেসিকা বিয়ে করে স্বামীর সাথে অস্টেলিয়া পাড়ি জমিয়েছে। তাই ও আর দেরী করেনি। মায়ের কথা মতো বকুলকে বিয়ে করেছে। বকুলকি পারবে ওর দুষ্ট অতীতকে ভুলিয়ে দিতে? তা একমাত্র সময় বলতে পারবে।
গেস্টরা খাওয়া শেষ করে চলে যাবার পর রাহেলারা সবাই খেতে বসলো। বিকাল পাঁচটায় রাহেলাদের ফ্লাইট। তাড়াতাড়ি লাঞ্চ শেষ করে রাহেলা, রায়হান আর সায়ান বকুলের বাবা, দাদী থেকে শুরু করে আয়ানের মামা মামী রিক্তা সবার কাছে বিদায় নিয়ে সৈয়দপুরের দিকে রওয়ানা হলো। সেখান থেকে এয়ারে করে ঢাকার পথে রওয়ানা দিবে। আয়ান আর বকুলও সবার কাছে বিদায় নিতে লাগলো। ওদেরও যাওয়ার সময় ঘণিয়ে আসলো। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় হামিদুর আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না। বকুলকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলো। ওর দাদী আসমা খাতুনও গলা ছেড়ে কাঁদতে বসলো। এসব দেখে বকুল বললো,
—-তোমরা যদি এভাবে কাঁদো তাহলে আমি শ্বশুর বাড়ি যাবো না।
বকুলের কথা শুনে উনারা কান্নাকাটি বন্ধ করলেন। বকুল বিদায়ের পালা শেষ করে আয়ানের সাথে গাড়িতে উঠে বসলো। তখন বিকেল পাঁচটা বাজে। আর তো দেরী করা যাবে না। আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। ওর ধারণা ছিলো বকুল অনেক কান্নাকাটি করবে। কিন্তু সেসবের কিছুই হলো না। মনে মনে বললো,”বাব্বাহ্ ভারী শক্ত মেয়ে।”
গাড়ি চলতে শুরু করলো। ড্রাইভিং সীটে আয়ান আর পাশের সীটে বকুল বসেছে। গাড়ির গতির তালে তালে বকুলের কান্নার বেগ উথলে উঠতে লাগলো। আয়ান আড় চোখে খেয়াল করে ভাবছে,”এ আবার কি শুরু করলো কে জানে?”
—কি ব্যাপার এতোক্ষণ তো ভালোই ছিলে! কান্নাকাটি তো বিদায় নেওয়ার সময় করলে না তাই ভাবলাম উপরে উপরে যতই বিয়ে না করার ভাব দেখাও না কেন শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য মনে হয় পা বাড়িয়ে আছো।
—-শুনুন সব কিছু নিয়ে ফান করা ভালো লাগে না।
—-না,আমি তো ফান করি নাই। কথাটা সিরিয়াসলি বলেছি।
এ কথা শুনে বকুল কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—-এটা একটা মেয়ের কাছে কতো বড় কষ্ট আপনি কি করে বুঝবেন? নিজের চেনা পৃথিবীটা ছেড়ে যখন চলে যেতে হয় এই মুহুর্তটা যে কতটা বেদনার তা আপনার কাছে ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
—বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদলে না কেন?
—-এমনিতেই আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না। এটা আব্বু জানে। তার উপর যদি বেশী কান্নাকাটি করি তাহলে উনাদের মন ভেঙ্গে যাবে। তাই বহু কষ্টে কান্নাটা আটকে রেখেছিলাম।
—-এই টুকুন বয়সে অভিনয় করা শিখে গিয়েছো।
—–এই যে আমাকে এতো জ্বালাচ্ছেন কেন?
একথা বলে কান্নার বেগ বাড়াতেই বকুল বিষম খেয়ে হড়হড় করে গাড়িতে বমি করে দিলো। আয়ান অবাক হয়ে বললো,
—-এটা কি হলো?
—-,সেই তখন থেকে আমাকে জ্বালাতন করছেন এখন বুঝুন ঠেলা।
—-তাই বলে তুমি ইচ্ছা করে বমি করবে?
—-আমি ইচ্ছা করে করিনি। আমার এভাবে এসি গাড়ি চড়ার অভ্যাস নেই। তাই হয়তো বমি হয়ে গেছে।
রাস্তার পাশে একটা পেট্রোল পাম্পের কাছে আয়ান গাড়িটা থামিয়ে দরজা খুলে একটু রেগে বকুলকে বললো,
—গাড়ি থেকে নামেন মহারানি।
—-আমাকে বকছেন কেন?আমার বমি আমি পরিস্কার করছি।
—-তার দরকার নেই। আপাতত নেমে আমায় উদ্ধার করেন।
বকুল গাড়ি থেকে নেমে একপাশে দাঁড়িয়ে টিসু দিয়ে নিজের চোখ মুখ মুছতে লাগলো।
এরপর আয়ান গাড়ি পরিস্কার করতে গিয়ে বকুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—যে ভাবে মিষ্টিগুলো জেদ করে উদরে পুড়েছো তাতে এটা ঘটারই কথা ছিলো। সব মিষ্টিগুলো বের হয়েছে।
টিসু দিয়ে আয়ান বমিগুলো পরিস্কার করে ফেললো। এরপর ভিজা কাপড় দিয়ে পুরো জায়গাটা কয়েকবার মুছলো। দূর থেকে আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা তখনও কাঁদছে। ওর কেন যেন বকুলের জন্য মায়া হতে লাগলো।
এদিকে আয়ানকে পরিস্কার করতে দেখে বকুলের খুব অস্বস্তি হতে লাগলো। নিজের মাঝে গিলটি ফিল হচ্ছে। তাই আয়ানের কাছে এসে বললো,
—সরি,
আয়ান পানির বোতলটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—হাত মুখ ধুয়ে ফেলো। ফ্রেস লাগবে।
এরপর গাড়িতে উঠে বকুল সিটে হেলান দিয়ে বসলো। আয়ান গাড়ির জানালাগুলো খুলে রাখলো। সীটে বসে সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বকুল মৃদুমন্দ বাতাসে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। আয়ান ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। খুব নিস্পাপ মুখশ্রী। পুরো মুখে কোথাও কোনো কৃত্রিমতার ছাপ নেই। ভুড়ু প্লাক করা নেই। চুল কালার করা নেই। অথচ মেয়েটাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। আয়ানের মনে হলো আল্লাহপাক খুব নিপুনভাবে মেয়েটাকে গড়েছেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর কাছে একটা রেস্টুরেন্টে এসে আয়ান বকুলকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে বললো,
—-চলো কিছু খাবে। তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
—-আপনি খেয়ে আসুন। আমি খেলে আবার বমি হবে।
বকুল খেলো না বলে আয়ানও কিছু খেতে পারলো না। বাড়িতে পৌছাতে ওদের রাত বারোটা বেজে গেল।
রাহেলার ঘরে আজ খুশীর ঢেউ উথলে উঠেছে। এই খুশীটুকুর জন্য গত দু,বছর ধরে উদগ্রীব হয়ে ছিলো। গাড়ির হর্ণের শব্দ শোনা মাত্রই রাহেলা দোতলা থেকে নেমে এসে ছেলে আর বৌমাকে মিষ্টি মুখ করিয়ে ঘরে তুললো। উনি আগেই খবর পেয়েছিলেন বকুল বমি করেছে। তাই ওকে নিয়ে সোজা তিনতলায় উঠে গেলেন। গিজার আগেই ছেড়ে রেখেছিলেন। বকুলকে ফ্রেস হওয়ার জন্য গরম পানি দিয়ে গোসল করতে বললেন। বকুল সুটকেস খুলে একটা নীল রঙের সুতি শাড়ি পেটিকোর্ট ব্লাউজ অম্তর্বাস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। আয়ান অপর আর একটি ওয়াশরুম থেকে গোসল করে স্লিপিং সুট পরে বের হয়ে আসলো। বকুলও সবে ওয়াশরুম থেকে শাড়ি পড়ে বের হয়েছে। পিঠ ভর্তি ছড়ানো চুলের গোড়া দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আয়ান অবাক হয়ে ছিপছিপে গড়নের সেই সরল মুখের কান্তির দিকে তাকিয়ে ভাবলো,”মেয়েটা আসলেই শিউলফুলের মতো সুন্দর।” হঠাৎ বকুলের চোখে চোখ পড়াতে আয়ান বলে উঠলো,
—-শরীর এখন কেমন লাগছে?
—-ভালো
রাহেলা ততক্ষণে এঘরে গরম গরম ভাত তরকারি পৌঁছে দিয়ে বললো,
—–জার্ণি করে আসছিস। তাড়াতাড়ি ডিনার করে তোরা শুয়ে পড়।
খাওয়া শেষ করে আয়ান নিজের বেডরুমটা বকুলের জন্য ছেড়ে দিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। বকুল ক্লান্ত থাকার কারনে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখ জুরে রাজ্যের ঘুম নেমে আসলো। ওদিকে বিছানা চেঞ্জ হওয়াতে আয়ানের চোখের ঘুম ইনসমিয়ার দেশে হারিয়ে গেল। পুরোনো অনেক স্মৃতি মনের আঙ্গিনায় ভেসে উঠলো। ও ভাবছে ওর মাঝে কিসের অভাব ছিলো যে জেসিকা এমন আচরণ করলো? এতো ভালোবাসার পরেও যাকে আটকাতে পারেনি সেখানে নতুন করে আবারও কাউকে ভালোবাসায় জড়াতে বড্ডো ভয় হয়।
ভোরের দিকে আয়ানের চোখটা লেগে আসছিলো। কিন্তু ওয়াশরুমে পানি পড়ার শব্দে ঘুমটা আবারও ভেঙ্গে যায়। বকুলের উপর প্রচন্ড বিরক্ত অনুভব হলো। রেগে বিছানা থেকে উঠে পাশের রুমে গিয়ে যখনি বকুলকে ধমকাতে যাবে অমনি ওর প্রতি ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল। মেয়েটা অজু করে তখন নামাজে দাঁড়িয়েছে। আয়ানও ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে এসে ফজরের নামাজ আদায় করলো। বকুল নামাজ শেষ করে নীচে এসে শাশুড়ী রাহেলার সাথে কিচেনের কাজে সাহায্য করতে লাগলো। ওকে এতো সকালে কিচেনে আসতে দেখে রাহেলা বললো,
—-তোকে এখানে এতো সকালে কে আসতে বলেছে?
—-উনি তো অফিসে যাবেন তাই ভাবলাম তোমায় কাজে একটু সাহায্য করি।
—-তোকে এসব করতে হবে না। একটু পরেই জোহরা চলে আসবে। তুই বরং আমার ছেলেটাকে একটু মানিয়ে নিস। ওর জীবনের উপর দিয়ে বেশ ট্রমা গিয়েছে। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে একটু সময় লাগবে। ধৈর্য হারাস না। ওকে একটু সময় দে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাহেলার এসব কথায় বকুল যেন চাপ অনুভব করতে লাগলো। ও তো জানে না আয়ানের সাথে ওর জীবনের সমীকরণ একই রেখায় মিলবে কিনা। যদি না মিলে তবে এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি কি?
প্রসঙ্গ পাল্টাতে বকুল রাহেলাকে বললো,
—-মা, এখান থেকে উদ্ভাসের কোচিং সেন্টারটা কতদূর?
—-একটু দূর আছে। বাসে যাওয়া যায় আবার রিকশা করেও যেতে পারবি। তুই একা যেতে পারবি তো?
—-তা পারবো, আমার অভ্যাস আছে।
রাহেলা কথা বলতে বলতে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিলো। চা আর বিস্কুট রেডী করে আয়ানের জন্য বকুলের হাতে দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দিলো। এরমাঝে রায়হান চৌধুরী টেবিলে এসে বসলো। সায়ানও চলে আসলো। ওর আবার সকালে কোচিং আছে। টেবিলে সবাই মিলে চা খাওয়ার সময় জোহরা ডোরবেল বাজালো। রাহেলা টেবিল থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে ওকে বললো,
—-আগে সবজিগুলো কেটে দে। তারপর পরোটা বানানোর জন্য ময়দা ময়ান দিয়ে রাখ।
বকুল চা নিয়ে রুমে এসে আয়ানকে দেখে অবাক হলো। মানুষটা দেখতে ভারী সুন্দর। আয়ান তখন খালি গায়ে জিমের যন্ত্রপাতি দিয়ে ব্যায়াম করছে। বেশ সুপুরুষ বলিষ্ট মেদহীন ঝরঝরে ফিগার আয়ানের। বকুলের পায়ের শব্দে আয়ান পিছন ফিরে তাকিয়ে বললো,
—-চা,টা টেবিলে ঢেকে রাখো। আমি ফ্রেস হয়ে খেয়ে নিবো।
—ঠান্ডা হয়ে যাবে তো
—-সমস্যা নাই। আমার ঠান্ডা চা খাওয়ার অভ্যাস আছে। তুমি খেয়েছো?
—আমি নিচে গিয়ে খাবো।
বকুল চা দিয়ে নিচে নেমে এসে রাহেলার সাথে টেবিলে বসলো। রাহেলা ফ্লাক্স থেকে বকুলকে চা ঢেলে দিয়ে বললো,
—-ভাবছি তোকে আজকে কোচিং এ ভর্তি করে দিবো।
—-মামনি, আমার সময় বেশী নাই। সামনেই ভর্তি পরীক্ষাগুলো শুরু হবে।
—হুম,এজন্যই আর দেরী করবো না।
সেদিনই বিকালবেলা রাহেলা বকুলকে কোচিং এ ভর্তি করে দিলো। বকুল খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগলো। প্রতিদিন বকুল বাসে করে কিংবা রিকশা করে কোচিং এ আসা যাওয়া করে। এরমাঝে একদিন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। রাহেলা ফোন করে আয়ানকে বলে, অফিস থেকে ফেরার সময় যেন বকুলকে নিয়ে আসে।আয়ান কোচিং এর সামনে গিয়ে দেখে বকুল একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। এটা দেখার পর আয়ানের প্রচন্ড রাগ হয়। বকুলকে হ্যাঁচকা মেরে টান দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় বকুল অবাক হয় এবং নিজের ক্লাস মেটের সামনে এহেন আচরণে খুব অপমানিতবোধ করে।
চলবে