#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী
—–জ্বী_মানে
গাড়ি থেকে নেমে রাহেলা বকুলকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—–আমি তোমার রাহেলা খালা।
—–আসসালামু আলাইকুম। আজতো আপনাদের আমাদের বাসায় আসবার কথা।
—–হুম,তুমি এসময় কোথা থেকে ফিরছো?
——আমার টিচারের বাসায় পড়তে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই ফিরছি।
ততক্ষণে গাড়ি থেকে আয়ান সায়ান ও রায়হান নেমে এসেছে। আয়ান আর সায়ান একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে রাহেলা আর বকুলের কথা শুনছিলো। আয়ান ফিসফিস করে সায়ানকে বলছিলো,
—–মা কি শেষ পর্যন্ত এই জংলিটাকে ছেলের বউ হিসাবে পছন্দ করলো?
——তুমি কিন্তু আজকে ধরা খেয়েছো।
——আমার গাড়িটাকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছিলো। তাও আবার সাইকেল দিয়ে। তুই ওর সাহসটা দেখেছিস?
——যাই বলো দাদাভাই সাইকেলটা কিন্তু পঙ্খিরাজের মতো চালাচ্ছিলো। আমার কিন্তু বেশ লাগছিলো।
—–আর আমার রাগের পারদ ক্রমে বাড়ছিলো।
——তাতো বুঝতে পারছি। সেই কারনে তুমি ইচ্ছা করেই ধাক্কাটা মেরে দিলে। কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করোনি।
—–যা করেছি বেশ করেছি।
ওদিকে বকুলের সাথে রাহেলা আর রায়হানের পরিচয় পর্ব চলছিলো। রাহেলা বকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—–কেমন আছো মা?
——ভালো।
এরপর রায়হান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বকুল বললো,
——আঙ্কেল, আসসালামু আলাইকুম। আপনার শরীর ভালো?
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম,
আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহপাকের রহমতে বেশ ভালো আছি।
—–দুপুরে খাবারের সময়তো পেরিয়ে যাচ্ছে। আপনারা তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলুন। লোকেশনটা কি দেখিয়ে নিয়ে যাবো?
আয়ান একটু বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বললো,
(আপনার কারনেই তো দেরী হলো)
—–আমায় কিছু বলছেন?
——না, আপনাকে আর এতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। ঢাকা থেকে এতোটা পথ আমি তো একাই চালিয়ে নিয়ে আসছি।
—–ঢাকা থেকে আসুন আর আমেরিকা থেকে আসুন সেটা তো আমার হেডেক না। আপনি যখন আমার এলাকাতে এসেছেন এটুকু কেয়ার করা আমার ভদ্রতার মধ্যে পড়ে।
রায়হান চৌধুরী এটুকু একটা মেয়ের কাছে আয়ানের নাকানিচুবানি খেতে দেখে মনে মনে পুলকিত হচ্ছেন আর ভাবছেন এরকম একটা মেয়ে পরিবারে থাকা খুব দরকার। যে ভালোকে ভালো মন্দকে মন্দ অকপটে বলতে পারে। এমনসময় রাহেলা আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলছে,
—–কিরে তুই ওকে তখন থেকে আপনি আপনি করছিস কেন? ও তোর থেকে আট বছরের ছোটো।
——মানে কি? আমি কি ওকে নিয়ে পুতুল খেলবো নাকি।
রাহেলা আয়ানের কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে বকুলকে বললো,
—–মা,তুমি বাড়িতে যাও। যদিও অনেক পরিবর্তন হয়েছে তবুও আমি চিনে নিতে পারবো। আমিও তো এখানেই বড় হয়েছি।
বকুল চলে যাওয়ার পর রাহেলা আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–কিরে তোর কি ভদ্রতা জ্ঞান বলতে কিছুই নাই। বকুলের সামনে কি সব আবোল তাবোল বলছিস?
—–আবোল তাবোল বলিনি। ঠিক কথাই বলেছি। ঐ বাচাল মেয়েটার সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে এটা ভাবতেই মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
——এসব ভিত্তিহীন কথা না বলে গাড়িটা তাড়াতাড়ি চালানোর ব্যবস্থা কর।
আর মনে মনে রাহেলা বেগম বলছেন, তোমার মেরুদন্ড সোজা রাখার ব্যবস্থা করছি। এবার আর কোনো সাইকোথেরাপি দিবো না। এবার তোমাকে দেওয়া হবে বকুল থেরাপি। দেবদাস হয়ে থাকা এবার বার করছি। রাহেলা বেগমের মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখলো বড় ভাই সাইফুল ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করে রাহেলা বললো,
——হ্যালো, ভাইয়া এইতো চলে এসেছি।
—— আর কতদূর?
—–আর দু,মিনিট লাগবে। ফোন রাখছি।
এমন সময় বকুলও সাইকেলের ঘন্টা বাজিয়ে উঠোনে প্রবেশ করে বললো,
——মামা,উনারা এসে পড়েছেন।
হামিদূর রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে বললো,
—–তোর সাথে দেখা হয়েছে?
—–হুম,
বকুলের দাদী বের হয়ে এসে বললো,
—-তোর মুখটা বাংলার পাঁচ করে রেখেছিস কেন?
সাইকেলটা উঠোনের এক কোনায় রেখে বকুল নিজের রুমে আসলো। দাদী আসমা খাতুনও ওর পিছু পিছু এসে জিজ্ঞাসা করলো,
—–কিরে, তোর মন খারাপ?
——দাদী বিয়েটা কি করতেই হবে?
——কেন কি হয়েছে?
—–আমার অনেক পড়ালেখা করার ইচ্ছে। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হবো ছোটোবেলা থেকেই এই স্বপ্নটা দেখে আসছি।
—–তোর বাবা কথা বলেছে। ওরা বলেছে,তোকে পড়াশোনা করাবে।
—–আর ঐটাতো একটা বুইড়া খাঁটাশ।
——কেন ও আবার কি করলো?
——আমি আপন মনে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ পিছনদিক থেকে ধাক্কা দিলো।
—–ইচ্ছা করে হয়তো দেয়নি। এক্সিডেন্টলি ধাক্কা লেগেছে।
—–ইচ্ছা করে দিক বা এক্সিডেন্টলি ঘটুক এমন ছ্যাঁচা দিয়েছি বুঝবে আমি কি জিনিস?
এমন সময় গাড়ির হর্ণের শব্দে আসমা বেগম বকুলকে রেডী হতে বলে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। আয়ানের মামা সাইফুল মামী জরিনা আর হামিদুর গাড়ির কাছে এগিয়ে আসলো। বকুলের দাদী আয়ানের মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—–পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো মা?
—–না,খালাম্মা। আল্লাহপাকের রহমতে সহিসালামতে আসতে পেরেছি। মাশাআল্লাহ আমার আয়ানও খুব সুন্দর গাড়ি চালায়।
রাহেলা সায়ানকে গাড়ির বনেট থেকে মিষ্টির প্যাকেট একটা সুটকেস বের করে আনতে বললো। ও মত দিতে না দিতেই সব প্রস্তুতি নিয়ে ওর মা এখানে এসেছে দেখে আয়ান মনে মনে ওর মায়ের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলো। হামিদুর সবাইকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসালো। হামিদুর গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারী করে। বাকি সময়টা ক্ষেত খামার দেখাশোনা করে। আসমা বেগম কিচেনে চলে আসলেন। উনার সাথে আয়ানের মামীও চলে আসলো। জরিনা লেবুর সরবত বানিয়ে ফেললো। আসমা বেগম বকুলের হাতে সরবত দেওয়ার জন্য ওকে ডাকতে গিয়ে দেখেন ও একটা সুতির থ্রীপচ পড়ে বসে আছে। এটা দেখে আসমা বেগম রাগ দেখিয়ে বললেন,
—–এতো ভালো ভালো জামা কাপড় থাকতে এই থ্রীপিচটা পড়েছিস কেন?
—–আমার সুতির থ্রীপিচ পড়তে ভালো লাগে।
বকুলের মুখ গম্ভীর দেখে জরিনা আসমা বেগমকে বললেন,
——ও লেখা পড়ায় ভালো। আরো পড়াশোনা করুক। পরে দেখেশুনে একটা ফ্রেস ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিতে পারতেন। আয়ান যদিও ভালো চাকরি করে, ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে তারপরও তো ও দোঁজবর।
আসলে জরিনা ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছে। ও চেয়েছিলো ওর মেয়ে রিক্তার সাথে যেন আয়ানের বিয়ে হয়। রিক্তা জলঢাকা সরকারী কলেজে ডিগ্রী পড়ে। বকুলের দাদী জরিনার এ কথায় একটু বিরক্ত বোধ করলেন। বকুলের হাতে সরবতের গ্লাস দিয়ে ড্রইংরুমে পাঠিয়ে দিয়ে জরিনাকে বললেন,
—–রাহেলার যে রাজপুত্তুরের মতো ছেলে ঐটুকু ত্রুটি আছে বলেই না বকুলকে বউ করে নিতে রাজি হয়েছে।
—–খালা তোমার বকুল দেখতে বকুল ফুলের মতো সুন্দর। তুমি আয়ানের থেকে ভালো ছেলে দিয়ে ওর বিয়ে দিতে পারতে।
—–আয়ানকে স্বামী হিসাবে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। মায়ের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে এই মফস্বল শহর থেকে বউ আনতে রাজি হয়েছে। যে ছেলে নিজের মাকে সম্মান করে সে দিনশেষে বউকেও সম্মান করে। আর আমার বকুল সুন্দর আমি জানি। ওর ইচ্ছা ঢাকাতে পড়াশোনা করবে। গার্ডিয়ান ছাড়া ঢাকাতে পাঠাতে ভয় হয়। ওর বাবাও তো ঢাকায় গিয়ে থাকতে পারবে না। তবে এখানে বিয়ে হলে বকুলের সবকুল রক্ষা হবে।
বকুলের দাদীর কথাগুলো শুনতে জরিনার ভালো লাগলো না। আসমা বেগম জরিনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেবিলে খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন।
ওদিকে আয়ান বকুলকে দেখে খুব অবাক হলো। অতি সাধারণ একটা পোশাকে একটা মেয়েকে এতো স্নিগ্ধ লাগে ওর ধারণা ছিলো না। ওর বকুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছিলো। হঠাৎ মনে হলো এরকম একটা মেয়ের দিকে সারাজীবন তাকিয়ে থাকা যায়। একবার বকুলের চোখে চোখ পড়াতে কটমট করে বকুল ওর দিকে তাকালো। আর বিড় বিড় করে বুইড়া খাঁটাশ বলে গাল দিলো। আয়ান ওর ঠোঁটটাকে নড়তে দিকে মনে মনে ভাবতে লাগলো,এই জংলীটা কি ওকে গাল দিলো?
চলবে