অবেলার বকুল পর্ব-০৩

0
685

#ধারাবাহিক গল্প
#অবেলার বকুল
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

“আম্মু তোমার কথা শেষ হয়েছে”?
” না এখনও শেষ হয়নি? যে মেয়েকে আমি তোমার বউ করে এ বাড়িতে নিয়ে আসবো তাকে তোমার পরিপূর্ণ স্ত্রীর মর্যাদা দিতে হবে। ওর এতোটুকু অসম্মান আমি মেনে নিবো না”।
“ঠিক আছে। স্ত্রীর প্রতি আমার যে দায় দায়িত্ব সেখানে আমার কোনো গাফিলতি থাকবে না। এর বেশীকিছু দিতে পারবো না। তুমি এখন ঘুমাতে যাও। রাত অনেক হয়েছে”।
—–তুমি খাবে না?
—–না আমি খেয়ে আসছি।
—–তবে বিয়ের পর তোমার এই অভ্যাস বদলাতে হবে।
—–মা, তুমি তো আমার বিষয়টা জানো। তাহলে সব বিষয়ে এতো জোর করছো কেন?
—–কারণ তুমি যেভাবে চলছো এটা দেখার জন্য আমি তোমাকে মানুষ করিনি? আমি জানি তুমি একজনের কাছে তোমার ভালোবাসাকে পরাজিত হতে দেখেছো তাই বলে জীবন তো এখানেই থেমে যেতে পারে না। তুমি ও সায়ান তোমরা যেন সুখে থাকো সেজন্য আমি ঢাকায় থেকে তোমাদের ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছি। যার জন্য আমি ও তোমাদের বাবা দুজনেই আমাদের গোল্ডেন পিরিয়ডটাকে সেক্রিফাইস করেছি। সুতরাং তুমি নিজেকে ভেঙ্গেচুরে আবার নতুন করে সব শুরু করবে। আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে মানুষ চেষ্টা করলে জীবনে সফলতা আসবে। ইনশাআল্লাহ, তুমিও সুখী হবে। তাহলে ঐ কথাই থাকলো, সামনের শুক্রবারে আমরা সবাই মিলে জলঢাকা যাবো।
——তুমি কি আমার জন্য বউ আনতে জলঢাকা যাবে?
—–কেন সমস্যা কি?
—–আজিব তো! ঢাকা শহরে কি মেয়ের আকাল পড়েছে?
—–ঢাকা শহরে মেয়ের আকাল পড়েনি। তবে আমার ছেলের বউয়ের আকাল পড়েছে। যা এখন ঘুমুতে যা।
একথা বলে রাহেলা বেগম আয়ানকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিলেন। আর মনে মনে ভাবলেন কাল হামিদুর ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। বেশী দেরী করা যাবে না। নিজের সই মরিয়মের মেয়েকে ছেলের বউ হিসাবে রাহেলা মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন। যদিও আয়ানের থেকে মেয়েটা ন,বছরের ছোটো হবে তাতে কি? আয়ান যেবার এসএসসি পরীক্ষা দেয় সেবার পরীক্ষার পর জলঢাকায় রাহেলা বেগম নিজের বাপের বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলেন। এরপর আর যাওয়া হয়নি। আসলে মা,বাবা কেউ বেঁচে না থাকাতে ভাইয়েরাও তেমন খোঁজ খবর করে না। দু,ভাই দুজনের মতো আলাদা থাকে। রাহেলা বেগমেরও আর বাপের বাড়ি তেমন একটা যাওয়া হয় না। বড়ভাইটা জলঢাকাতেই থাকে আর ছোটো ভাইটা রংপুর শহরে থাকে। যাইহোক এই সুবাদে বাপের বাড়ির মুখটা রাহেলা বেগম আবার দেখতে পাবেন এই খুশীতে উনি পুলকিত। মেয়েটার জন্মের পরপর মরিয়ম মারা যায়। এমনিতেই বিয়ের আট বছর পর অনেক চিকিৎসা করে মেয়েটার জন্ম হয়েছিলো। মরিয়ম মারা যাওয়াতে হামিদুরের সমস্ত অভিমান জমা হয় ঐ বাচ্চা মেয়েটার উপর। দু,বছর মেয়েটাকে কোলে নেয়নি। মেয়েটার নাম রাখা হয়েছিলো বকুল। মরিয়মের বকুল ফুল খুব পছন্দের ছিলো।
এরপর থেকে দাদীর কাছে বকুল বড় হতে থাকে। সেবার রাহেলার বকুলকে দেখে মনে হয়েছিলো এ যেন সেই ছোটোবেলার মরিয়ম। দু,বছর বয়সে বকুলের চেহারায় মরিয়মের আদল দেখে হামিদুরের সব অভিমানের বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছিলো। সেই থেকে মেয়ে আর মাকে ঘিরেই হামিদুরের সংসার আবর্তিত। উনি আর বিয়ে করেননি। যদিও হামিদুরের মা ছেলেকে বিয়ে দিয়ে আবার সংসারী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে রাজী হয়নি।

নিজের রুমে এসে আয়ান ধপাশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সাথে সাথে কিছু পুরনো স্মৃতি আয়ানকে ঘিরে ধরলো। আয়ানের চোখের কোনটা আদ্র হয়ে গেল। এক সময় ভেজা দুচোখের পাপড়িতে ঘুমের রাজ্য এসে ভর করলো।

খুব সকালে আয়ানের ঘুম ভাঙ্গলো। আয়ান বাসাতেই জিমের ব্যবস্থা করেছে। ব্যায়াম সেরে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে ফেললো। অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে নিচে নামতে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর চোখ পড়লো। ওকে দেখে রায়হান সাহেব লুচির নিচে বিফের পিচগুলো লুকিয়ে ফেললেন। সেটা আয়ানের চোখ এড়ালো না। সায়ানও বাবার সাথে বসে ব্রেকফাস্ট করছিলো। ওর সকালে উদ্ভাসের কোচিং এ যেতে হবে। ও এবছর গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে এইচএসসি কমপ্লিট করেছে। আয়ান এসে ওর বাবার প্লেটের লুচি সরিয়ে টপাটপ দু,টুকরো মাংস মুখে পুড়ে সায়ানকে বললো,
—–তোর সামনে আব্বু মাংসের পিচগুলো তুলে নিলো তুই আব্বুকে কিছু বললি না কেন?
—–বললে তো আব্বু শোনে না। তাছাড়া উনি তো ছোটো বাচ্চা নন যে নিজের ভালো বুঝবেন না?
——আয়ান, তুই এটা কি করলি?
—–কি করেছি?
—–মাংসগুলো খেয়ে ফেললি। আমি লুচি কি দিয়ে খাবো?
——তোমার তো এতো প্রোটিন একসাথে খাওয়া ঠিক হবে না।
——হুম, এখন বল রোজা রাখতে। যাতে খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
——খাওয়া বন্ধ হবে কেন? সব্জি দিয়ে খাবে। তোমার বাইপাসের কথা ভুলে গেছ? আর আম্মুও বটে! সুযোগ পেলেই আমার উপর ছড়ি ঘোরাবে এদিকে তোমাকে কন্ট্রোল করতে পারে না।
আয়ানকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে দেখে রায়হান সাহেব মনে মনে ভীষণ খুশী হলেন। রাহেলা বেগম কিচেন থেকে গরম গরম লুচি আর গরুর মাংস এনে আয়ানকে খেতে দিলেন। আয়ান প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিলো। ও গোগ্রাসে মুহুর্তে লুচি আর মাংস সাবাড় করে ফেললো। তারপর চা খেয়ে অফিসের দিকে রওয়ানা হলো। সায়ানও ব্রেকফাস্ট সেরে কোচিং এর পথে পা বাড়ালো। রাহেলা বেগমও নিজের নাস্তা নিয়ে টেবিলে বসে পড়লেন। রায়হান চৌধুরী খাওয়া শেষ করে রাহেলা বেগমকে বললেন,
—–অনেকদিন পর ছেলেটাকে স্বাভাবিক হতে দেখলাম। খুব ভালো লাগলো। তুমি ওর সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছো?
—–হুম বলেছি। জলঢাকা যাচ্ছি শুনে একটু অবাক হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে।
——কবে যাবে ঠিক করেছো?
——সামনের শুক্রবার।
——আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহপাকের রহমতে ভালোভাবে যেন সব শেষ হয়। তুমি আয়ানের বিয়ে এবং ডিভোর্সের কথা হামিদুর ভাইকে বলেছো তো?
——হুম বলেছি। হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে কেন?
——দেখো ছেলে কিংবা মেয়ে বলে কথা নয়। এখনও এ সমাজে ভিভোর্সের তকমা লেগে গেলে সেটাকে ত্রুটি হিসাবে ধরা হয়। ওদের মেয়েটা ফ্রেস। জেনে বুঝে আমাদের ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে তো? বিয়ের আগেই এই বিষয়গুলো পরিস্কার হওয়া দরকার। যাতে পরবর্তীতে জটিলতার সৃষ্টি না হয়।
—–ফোন করে সবই বলেছি। শুধু আয়ানের একবছর ডিপ্রেশনে থাকার কথা বলিনি। এছাড়া আমি হামিদুর ভাইকে সবটা জানিয়ে আয়ানের জন্য মেয়ে দেখতে বলেছিলাম। হামিদুর ভাই নিজ থেকে বকুলের সাথে আয়ানের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। পাশাপাশি আর একটা কথাও বলেছে।
——কি বলেছে?
——বলেছে, মাতৃহীনা বকুলকে আমি যেন মায়ের ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নেই। এটুকু পেলেই উনি খুশী। উনার বিশ্বাস বকুলের অনাদর আর অবহেলা আমি কোনোদিন করবো না। সেই ভরসায় উনি আমার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।
শুক্রবারে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠার আগেই রাহেলা বেগম সবাইকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে জলঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো। রাহেলা ড্রাইভারকে সাথে নেয়নি। যেহেতু আয়ানের বিয়ের ব্যাপারে যাচ্ছে তাই কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করতে হচ্ছে। ঘরের একান্ত গোপন কথাগুলো বাইরে প্রকাশ করা হচ্ছে ড্রাইভার আর কাজের অ্যাসিসটেন্ট এর কাজ। সেই সচেতেনতা থেকে রাহেলার ড্রাইভারকে সাথে নিতে ইচ্ছা হয়নি।
ড্রাইভিং সিটে আয়ান বসেছে। খুব সকালে রওয়ানা দেওয়াতে জ্যাম শুরুর আগেই ওরা ঢাকা ছাড়তে পেরেছে। রায়হান সাহেব হুমায়ুন আহমেদ এর মিসির আলি বইটা সঙ্গে করে এনেছে। একবই যে কতোবার পড়তে পারে এটা দেখে রাহেলা অবাক হয়। সায়ান গান শুনছে। আর মোবাইলে গেম খেলছে। দশটার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে গেল। তারপর ঐ পারে ফুড ভিলেজ নামে একটা ফুড কোটে ঢুকে সকালের নাস্তার পাট চুকালো। চা কফি খেয়ে আয়ানও জড়তা কিছুটা কাটালো। অনেকদিন পর ঢাকার একঘেঁমেয়ি জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়ে সবারই ভীষণ ভালো লাগছে। গাড়ি আবারও চলতে শুরু করলো। আয়ান ভালোই গাড়ি চালাচ্ছে। ড্রাইভিং এর উপর ফ্যাসিনেশন থাকায় গাড়ি চালানোটা ভালোই রপ্ত করেছে। রাহেলা বেগম আর রায়হান সাহেব গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃষ্টিনন্দন সোনালী ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন অক্টোবর মাস। হেমন্তকাল। নবান্নের মরশুম। রাহেলা যেন মুহুর্তে তার ছোটোবেলার স্মৃতির মাঝে হারিয়ে গেল। তখনও চালের আটা তৈরী করার মেশিনের প্রচলন ছিলো না। তাই উত্তরবঙ্গে সেসময় ছাম আর গাইন(অন্যান্য অঞ্চলে কাহালছিয়া বলা হতো) দিয়ে চালের গুড়ি তৈরী করা হতো। সবার বাসায় ছাম গাইনের ধুপধাপ শব্দ। পিঠা আর পায়েসের মৌ মৌ সুবাসে চারিদিকে যেন উৎসবমুখর পরিবেশ। মরিয়ম রাহেলাদের বাসায় বেড়াতে আসতো। আবার রাহেলা ওদের বাসায় বেড়াতে যেতো। কতো না মধুর ছিলো সেসব দিন। সকালের শিশির ভেজা ঘাসের উপর হাঁটতে খুব ভালো লাগতো। শিউলি ফুল ফুটে গাছের নীচে ঝরে পড়তো। সেই ফুল কুড়িয়ে রাহেলা মালা গাঁথতো।

গাড়ি জলঢাকায় পৌঁছাতে তিনটা বেজে গেল। হামিদুর এর মধ্যে কয়েকবার রাহেলা আর রায়হানের সাথে কথা বলে নিয়েছে। এরপর বালাগ্রামের পথে গাড়ি চলতে শুরু করলো। ম্যাপ দেখে আয়ান এতোটা পথ গাড়ি সুন্দরভাবে চালিয়ে আসলো। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষাতে রাহেলার ভাবনার জগতে ছন্দপতন ঘটলো। হেজাব পড়া একটা মেয়ে সাইকেল হাতে গাড়ির জানালার কাঁচ নক করছে। আয়ান কাঁচ নামিয়ে সরি বলাতে মেয়েটা তেতে উঠে বললো,
——ফেলে দিয়ে এখন সরি বলা হচ্ছে। এই যে মিস্টার গাড়ি যখন চালাতে পারেন না তখন চালাতে যান কেন? আর একটু হলেই আমার জানটা আপনার গাড়ির চাকার তলায় পিষ্ট হতো।
—–পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া করছেন কেন? সরি বললাম তো। জংলী কোথাকার।
—–অন্যায় করছেন আবার জংলী বলে গাল দিচ্ছেন। এ যেন চোরের মায়ের বড় গলা।
ওদের চিৎকার চেঁচামেচিতে রাহেলা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
——তুমি মরিয়মের মেয়ে বকুল না?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে