#অবুঝ_দিনের_গল্প
#লেখনীতে_সাবরিন_জাহান
#পার্ট_১৬
আজ বিরক্তির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলো অরিন!সৌরভ বার বার এক কথা বলে মাথা খাচ্ছে..এমন না ও খারাপ ছেলে..কিন্তু ওকে না করার যথেষ্ট কারণ আছে।সেটা ও বলেছেও!
অরিন: সৌরভ ভাই প্লিজ!আমি আর এ নিয়ে কথা বলতে চাই না,ভাগ্যে যা আছে তাই হবে!
সৌরভ: কিন্তু..
অরিন আর কিছু না শুনে আসতে নিলেই সৌরভ ওর হাত ধরে আকুতি মিনতি করে।অরিন এখন কি করবে বুঝছেনা!
আদ্রিয়ান: বাহ ভালোই তো!
দুইজন ভরকে যায়!এই মুহূর্তে ওকে কেও আশা করেনি এখানে! আদ্রিয়ান সৌরভের হাতের দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে! তা দেখে সৌরভ জলদি হাত সরিয়ে নেয়।আদ্রিয়ান কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিলো!
অরিন: ইংরেজ বাবু!
আদ্রিয়ান: আমার নাম আদ্রিয়ান!এসব ফা’লতু নামে ডাকবে না আমায়!
অরিন আহত হলো।
অরিন: আপনাকে আমি এক্সপ্লেইন করছি!একটু শুনুন!আপনি কি আমায় সন্দেহ করছেন?
আদ্রিয়ান দাড়িয়ে গেলো!মলিন হেসে বললো,”হ্যাপী জার্নি ফর ইউর নিউলী লাইফ”
থমকে গেলো অরিন!মানে বুঝতে একটুও দেরি হলো না।ওর ইংরেজ বাবু ওকে ভুল বুঝেছে!আদ্রিয়ান গাড়ি নিয়ে বাড়ি আসলো। অরিনও ফিরে এসেছে!আদ্রিয়ান রুমের দরজা আটকে বসে আছে!মামা মামী কি নিয়ে দেখলো আলোচনা করছে!
কিছুক্ষণ পর ওরা অরিন আর আদ্রিয়ান কে ডাকলো।আদ্রিয়ান গম্ভীর হয়ে নিচে আসলো।অরিন মলিন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে!আদ্রিয়ান একবারও ওর দিকে তাকায়নি।
মামা: আমরা চাচ্ছি কয়েকমাস পর অরিনের তো আঠারো হয়ে যাবে..তখন তোদের এনগেজমেন্ট সেরে ফেলতে আর তারপর ওর কলেজ শেষ হলে বিয়ে।
আদ্রিয়ান নিরব থেকে উত্তর দিলো,”আমি এই বিয়ে করতে পারব না!”
উপস্থিত সবাই চমকে গেলো!অরিন আহত দৃষ্টিতে তাকালো!
মামা: এটা কেমন ফাজ’লামি?একবার অরিন কে বিয়ে করবে বলে রিখিয়াকে রিজেক্ট করতে চাইলে ,এখন আবার অরিনকে বিয়ে করবে না বলছো?
আদ্রিয়ান: আমার সিদ্ধান্ত আমি জানিয়েছি!
বলেই উঠে চলে গেলো।
মামা: তোমার ছেলে কি শুরু করেছে?
মামা মামীর সাথে রাগারাগি শুরু করলো।মামী উনাকে শান্ত করছে।অরিন এলো মেলো পায়ে নিজের ঘরে গেলো।আনমনে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো।তখনই ফোন দিল লামিয়া!
লামিয়া: এই রামুর কিছু কর!
অরিন: কি হয়েছে?
লামিয়া সব খুলে বললো,অরিন মৃদু হাসলো!
অরিন: আবিদ ভাইয়াই ওকে সোজা করে দিবে…
লামিয়া: কি হয়েছে তোর?
অরিন: কি হবে?
লামিয়া: গলা কেমন শোনাচ্ছে!
অরিন: ঘুম পাচ্ছে, কাল আবার সকালে কলেজ!
লামিয়া: ওহ আচ্ছা ঘুমা!
লামিয়া রেখে দিল।
অরিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো!কিছু একটা ভেবে বিথীর নাম্বারে ফোন দিল!
বিথী: কিরে এত রাতে?
অরিন: আমাকে কয়েকটা টিউশনি খুঁজে দিবি?
বিথী: হটাৎ?
অরিন: প্লিজ!
বিথী: দেখছি!কিন্তু কারণ কি?
অরিন: পরে বলবো!
বলেই রেখে দিল!
হৃদি: কে রে?
বিথী: অরিন!
হৃদি: এত রাতে?
বিথী: বললো টিউশনি খুঁজে দিতে!
হৃদি: হটাৎ টিউশনি?
বিথী: কিছু বললো না তো!
হৃদি: কি হলো আবার!
_______
কেঁটে গেলো কয়েকটা দিন,অরিন এই কয়েকদিন কলেজে যায়নি।বাইরে বের হয়ে টিউশনি খুঁজেছে!পেয়েও গেছে কয়েকটা!এতেই ওর হোস্টেলে থাকার খরচ উঠে যাবে সাথে পড়াশোনাও,শুধু হিসেব করে চলতে হবে!আদ্রিয়ান ভাবতো অরিন হয়তো সৌরভ এর সাথে বের হয়।কিন্তু আদ্রিয়ান এর ব্যাবহার দেখে সৌরভ সেদিনের পর আর অরিনের সাথে কথা বলেনি।নিজের কাজে ব্যাস্ত!বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে মামা মামীর রুমে গেলো ও!
অরিন: মামা!
মামা: হুমম, কিরে মা!কিছু বলবি?
অরিন একটু চুপ থেকে বললো,”আমি কাল থেকে হোস্টেলে থাকবো!আর নিজের খরচ নিজে চালাবো!”
মামী: হটাৎ এমন ভাবনা?
অরিন চুপ রইলো।
মামা: ঠিক আছে।
মামা এত সহজে মেনে যাওয়ায় মামী আর অরিন অবাক হলো।মামা হেসে বললো,”জানি না তোর এর আদ্রিয়ান এর মাঝে কি হলো,হুট করে দুইজন দুই মেরুর মানুষ হয়ে গেলি!জানতে চাই ও না!কিন্তু জানি তোরা আবার এক হবি!মিলিয়ে নিস!”
অরিনের কান্না পাচ্ছে তাই কোনো উত্তর না দিয়ে চলে এসে ব্যাগ গুছালো!
আরিফা: ভাইয়া!
আদ্রিয়ান: কিছু বলবি?
আরিফা: অরিন আপু কাল থেকে হোস্টেলে উঠবে!
আদ্রিয়ান এক পলক তাকালো,ভাবলো বাহ এখন বাড়িতেও থাকবে না।ভালোই তো!
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,”তাতে আমার কি?”
আরিফা: তোর খারাপ লাগবে না?
আদ্রিয়ান: না!
বাইরে থেকে সবটাই শুনলো অরিন!দরজা ঠেলে পারমিশন চাইলো,”আসবো ইংরে..”
থেমে গেলো,নিজেকে সামলে বললো,”আসবো আদ্রিয়ান ভাইয়া?”
দুইজনই চমকালো,এই প্রথম অরিন আদ্রিয়ান কে ভাইয়া বললো!
আদ্রিয়ান নিরুত্তর রইলো,অরিন ভিতরে ঢুকলো।
অরিন: আরিফা একটু বাইরে যাবে?
আরিফা: আচ্ছা আপু!
আরিফা বেরিয়ে গেলো।আদ্রিয়ান মনের সুখে ফোন দেখছে।মনে হচ্ছে এখানে আর কেউ ই নেই!
অরিন পাত্তা না দিয়েই বলতে লাগলো,
অরিন: ভেবেছিলাম কাল যাবো,কিন্তু আমি বিকেলেই যাচ্ছি।
আদ্রিয়ান নিরব!অরিন হতাশ হলো।
অরিন: বিশ্বাস হলো ভালবাসার মূল ভিত্তি || তো ভালবাসার ভিত্তি গুলো যদি না থাকে, তাহলে সেখানে ভালবাসা থাকবে কি করে!ব্যাপারটা আপনার ক্ষেত্রে কি আমি জানি না,কিন্তু একটাবার যদি ভুল না বুঝে বিশ্বাস রাখতেন তাহলে হয়তো আজ এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। যাই হোক ভালো থাকবেন আসছি!
অরিন বেরিয়ে গেলো,আদ্রিয়ান তখনও ফোনের দিকে তাকিয়ে,ওর প্রতিটা কথাই শুনেছে।এখন ওর মনে একটাই প্রশ্ন,”যা করলো,ঠিক করলো তো?”
______
অরিন চলে গেছে প্রায় আট নয় মাস!এবার কলেজ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও। হোস্টেলেই থাকে!বিথী আর হৃদির সাথে।সেদিনের পর আর কেউ কাউকে দেখে নি।যদিও ছবিতে দেখেছে কিন্তু বাস্তবে কেউ আর দেখা করেনি!এর মাঝে পাল্টিয়েছে অনেক কিছু!সাগর সেটেল হয়ে রোজ কে নিয়ে সংসার করছে।বিথী আর আকাশের আকদ করে রাখা হয়েছে।বিথীর পরীক্ষা শেষে অনুষ্ঠান করে ওকে নিয়ে আসা হবে। আদিব আর লামিয়ার বিয়েও হয়ে গেছে। রিখিয়া আর জয়কেও ওদের পরিবার মেনে নিয়েছে।সবাই ভালোই আছে,শুধু ভালো নেই আদ্রিয়ান আর অরিন!..দুইজনই এখন গম্ভীর থাকে।প্রয়োজন ছাড়া কেউ ই কথা বলে না আশেপাশের কারোর সাথে।
আজ রিখিয়ার জন্য আদ্রিয়ান সহ ওর ফ্রেন্ড সার্কেল এক সাথে হয়েছে।সৌরভ ও আছে!সৌরভ আদ্রিয়ান এর সাথে কথা বলতে চাইলেও আদ্রিয়ান মোটেও কথা বলছে না।
রিখিয়া: তোর কি হয়েছে আদ্রিয়ান?
আদ্রিয়ান: কি হবে?
রিখিয়া: আমি দেখছি তুই সৌরভ কে ইগ্নোর করছিস কিন্তু কেন?
আদ্রিয়ান: কোথায়?
জয়: আমরা সবাই বুঝতে পারছি!
সৌরভ: তুই কি এখনও আমার উপর সেদিনের জন্য রাগ?ওটা মিসটেক ছিল,আমি অরিনের হাত ভুলে আবেগবশত ধরেছি!
আদ্রিয়ান: আমি চাই না এই বিষয়ে কথা বলতে!
রিখিয়া: অরিন কোথায়?
আদ্রিয়ান: হোস্টেলে!
সৌরভ: হোস্টেলে কেন?
আদ্রিয়ান: এমন ভাব করছিস যেনো জানিস না কিছু?
সৌরভ: আজব ,আমি কিভাবে জানবো?
আদ্রিয়ান: কেন অরিন তোর প্রপোজাল একসেপ্ট করেনি?
সবাই চমকে সৌরভের দিকে তাকালো!
সৌরভ: মানে?
আদ্রিয়ান: কেনো তুই অরিন কে প্রপোজ করেছিস ,অরিন বুঝি একসেপ্ট করেনি?
সৌরভ: জাস্ট শাট আপ আদ্রিয়ান!অরিন কে আমি বোনের মত ভাবি!
আদ্রিয়ান: ও তাই না?তাহলে সেদিন কিসের উত্তর দিতে বললি?
সৌরভ চুপ করে গেলো।আদ্রিয়ান হাসলো,
আদ্রিয়ান: তোদের দুইজনকে এই এক প্রশ্ন করলেই তোরা চুপ হয়ে যাস!তাহলে মানে কি দাড়ায়?
সৌরভ: ভেবেছিলাম অরিন হয়তো ভুল যাতে না বুঝিস তাই সব বলেছে,এখন দেখছি কিছুই বলেনি!
আদ্রিয়ান: মানে?
সৌরভ: আমি তনয়াকে ভালোবাসি!
উপস্থিত সবাই অবাক হলো, বেশি অবাক আদ্রিয়ান!
আদ্রিয়ান: হোয়াট?
সৌরভ : হুমম,সেদিন অরিন কে আমি ঐটাই বলি! সাথে এটাও বলি আমি বাবা মাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যেতে চাই!কিন্তু অরিনের এক কথা, তনয়াকেও যদি শহরে নিয়ে আসি তাহলে ওর মা যে মেয়ে শূন্য হয়ে থাকবে! ও চাইলেই তোকে বলতো কিন্তু তুই যদি রাগ করিস আমার উপর তাই বলেনি!কিন্তু কে জানত তুই এসব ভাববি!
আদ্রিয়ান স্তব্ধ,এত সামান্য এক ব্যাপারকে ও কত বড় করে দেখলো!
রিখিয়া: ঠিক করিসনি তুই!
আদ্রিয়ান: আই এম সরি ইয়ার, আমি ওকে নিয়ে এতটাই সেনসিটিভ যে ওকে কারোর সাথেই মানতে পারতাম না,সেখানে ঘটনা গুলো এমন ভাবে আসলো,আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না!
রোজ: রিলাক্স!এখন আগে অরিনকে সরি বল,না জেনে ওকে কতটা হার্ট করেছিস!
আদ্রিয়ান এখন বুঝছে অরিনের সেই দিনের কথার মানে!নিজের উপর ওর রাগ হচ্ছে!এতটা অবিশ্বাস কিভাবে করলো?অরিন কি আর ওকে মেনে নিবে?নিজের ভুলেই অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও। বারবার বাঝছে অরিনের কথা গুলো।কি করবে ও এখন?
হামি দিতে দিতে হোস্টেল থেকে নিচে নামলো অরিন!টিউশনিতে যাবে!কিন্তু ওর ঘুম পাচ্ছে!রাতে ওই ব’দ ইংরেজ বাবুর কথা ভেবে ঘুম হারাম করছে ও।গেট দিয়ে বেরিয়েই সামনে আদ্রিয়ান কে দেখে চমকে গেলো।ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।আদ্রিয়ান ওকে দেখেই বেক্কল মার্কা হাসি দিল।অরিন খেয়াল করে দেখলো সরি লিখা টিশার্ট পরেছে! যা বুঝার বুঝে গেলো।ভেংচি কেটে পাশ কাটিয়ে যেতে লাগলো।
আদ্রিয়ান: ও অরি পাখি সরি!
অরিন: আমার নাম অরিন!এসব ফা’লতু নামে ডাকবেন না!
আদ্রিয়ান নিজের মাথায় নিজে থা’প্পড় মার’লো।মেডাম যে খুব অভিমান করেছে বুঝলো।
আদ্রিয়ান: আরে বললাম তো মিসটেক ছিলো।আর হবে না প্লিজ!
অরিন দাড়ালো,আদ্রিয়ান এর দিকে ঘুরে তাকালো।
অরিন: মিসটেক বললেই কি সব ভুলে যাওয়া যায় আদ্রিয়ান?শুধু ভালোবাসলেই হয় না বিশ্বাস ও রাখতে হয়!আর আপনার ভুল ভেঙেছে আট মাস বারো দিন পর!এই আট মাস বারো দিনে একবারও তো আমায় দেখতে আসলেন না!কেমন আছে আপনার অরি পাখি!এমনকি লামিয়া আপুর বিয়ে আর বিথীর আকদেও এলেন না,ওই বাহানা দিয়ে এলেও অন্তত বুঝতাম আপনি আমার জন্য এসেছেন!প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষা করেছি আপনি আসবেন ভেবে!কিন্তু অপেক্ষা অপেক্ষাই রইলো!আমার এই মর্মান্তিক অনুভূতিগুলোকে ভুলে যাবো এত সহজে?যাকে ভালোবাসেন,যাকে নিয়ে এতটা সেনসিটিভ,যাকে অন্যের পাশে দেখলে সহ্য করতে পারেন না!একবারও কি তাকে বিশ্বাস করতে পারতেন না?শুনতে পারতেন না সত্য কি?বুঝতে পারতেন না আমায়?যদি আমি বাড়ি ছেড়ে এখানে আসার সময়ও একবার জেদ নিয়ে বলতেন,”তোমার মা এখানে থাকার দায়িত্ব আমাদের দিয়েছে,তুমি এখানেই থাকবে!” তাহলেও হয়তো খুশি হতাম এই ভেবে আপনি আমাকে যেতে দিতে চান না!প্রতিটা মুহূর্তে হতাশ করেছেন!এগুলো সব কি একটা মিসটেক ওয়ার্ড এ মুছে যাবে আদ্রিয়ান?ভুলে যাওয়া যাবে?সামান্য ব্যপারটা আপনি কতটা নিষ্ঠুর ভাবে দেখেছেন?
আদ্রিয়ান চুপ রইলো,অরিনের একটা কথাও ভুল না!দোষ তো ওরই!আসলেই যদি একটি বিশ্বাস রাখতো,জেদ ধরে না বসে থাকতো তাহলে হয়তো সব ঠিক হতো!সব!
#চলবে…
#অবুঝ_দিনের_গল্প
#লেখনীতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_১৭
টিউশনি থেকে ফিরে এসে অরিন দেখলো আদ্রিয়ান এখনও ওখানেই দাড়িয়ে আছে।তখন আদ্রিয়ান কিছু বলেনি। অরিনও উত্তরের আশায় না থেকে চলে গিয়েছিল।ফিরে এসে আদ্রিয়ানকে এক জায়গায় দেখে অবাক হলেও প্রকাশ না করে ওর কাছে গেলো।
অরিন: এটা গার্লস হোস্টেল।প্লিজ এভাবে রাস্তার বখাটে ছেলেদের মত করবেন না।সবাই আপনাকে খারাপ ভাববে।চলে যান!
আদ্রিয়ান মলিন চোখে তাকালো।কিছু না বলে হাঁটা লাগালো।অরিন যাওয়া অব্দি তাকিয়ে রইলো।তারপর নিজেও ভিতরে আসলো।আসার সাথে সাথে কয়েকটা মেয়ে ওকে চেঁপে ধরলো।
ঈশি: ঐটা তোমার বয়ফ্রেন্ড?
নেহা: আমরা তো ভেবেছিলাম ওয়ান সাইডেড লাভার!
ফিহা: কি কিউট!
অরিন ওদের কথার কিছুই বুঝলো না!
অরিন: মানে?
ফিহা: মাঝরাতে এসে হোস্টেলের সামনে দাড়িয়ে তোমার রুমের দরজায় তাকিয়ে থাকা,প্রতিদিন তুমি বের হলে গাছের আড়ালে দাড়িয়ে তোমাকে দেখা..আমরা তো ভেবেছিলাম ওয়ান সাইডেড লাভার হয়তো।এখন দেখলাম তুমি ওর সাথে কথাও বলো!
অরিন স্তব্ধ।মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব!
নেহা: তুমি কিছু জানো না?
অরিন ডানে বামে মাথা নাড়লো!
নেহা: রোজ যখন তুমি হোস্টেল থেকে বের হও,তখন উনি ওই গাছের আড়ালে দাড়িয়ে তোমায় দেখে!প্রথম ভাবতাম আমাদের মনের ভুল।কিন্তু বেশ কিছুদিন আমরা খেয়াল করলাম।তুমি হয়তো করো নি।প্রায় দেখতাম তোমার মন খারাপ!তারপর যখন মাঝরাতে তোমার ঘুম না এলে করিডোরে এসে জানালায় চাঁদ দেখো।তখন নিচ থেকে উনি তোমাকে দেখতেন!যেহেতু আমরা রাতে আড্ডা দেই তাই সবটাই খেয়াল করি!মাঝে মাঝে দেখি তোমার সাথে কলেজ অব্দিও যায়!কিন্তু তোমার থেকে নিজেকে আড়াল রেখেছে!আমরা ভেবেছিলাম তোমায় বলবো!পড়ে ভাবলাম এভাবেই তো বেশ লাগে!
অরিন কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো!
হ্যাঁ ও প্রতিনিয়ত হতাশ হয়েছে ,কিন্তু ওর আড়ালেই ওর প্রতি নিয়ত খবর রেখেছে! আড়ালেও ভালো বেসেই গেলো!আনমনে সব ভাবছিলো তখন ফোন বেজে উঠলো!স্ক্রিনে ‘মা’ নামটা জ্বল জ্বল করছে!
রিসিভ করার পর যা শুনলো তাতে মুখে এক চিলতি হাসি ফুটলো….
____
আজ আবারও কয়েক মাস পর আদ্রিয়ানদের বাড়িতে পা রাখলো অরিন!সোহা আর তনয়া দুইজনই বৃত্তি পেয়েছে!স্টুডেন্ট হিসেবে ওরা ভালোই!এখন ওই বৃত্তির টাকা দিয়ে দুইজন এখানে থেকে অরিনের সাথে সেম কলেজে পড়বে!তাই অরিনকেও চলে আসতে বললো!অরিন টিউশনি ছাড়েনি!বোনদের জন্যই আবার এখানে আসা।বাড়িতে কেমন একটা আমেজ আমেজ ভাব!অরিন এর এখন অনেকটা হালকা লাগছে!এত দিন কেমন দম বন্ধ করা পরিবেশে থাকতো! আরিফাও ভালো রেজাল্ট করেছে।
আরিফা: ভাবীপু আসবো?
অরিন মুচকি হেসে আসতে বললো।
আরিফা: এত শুকিয়ে গেছো কেনো?
অরিন কিছু বললো না!
আরিফা: একটা কথা বলবো?
অরিন: বলো!
আরিফা: তোমাদের ব্যাপারে সবটা জানি, সাদ ভাইয়া বলেছে!তাই বলছিলাম কি এবারের মত ভাইয়া কে ক্ষমা করে দেও না!ভাইয়াটা না আগের মত নেই!কেমন একটা হয়ে গেছে! জানো ভাইয়া মধ্য রাতেও তোমার কথা মনে হলে হোস্টেলের সামনে চলে যেতো!
অরিন তাকালো!আরিফা কিভাবে জানে?
আরিফা: আমার এক বান্ধবীর বাসা ওদিকে!ওই ই বলে আমায়!
অরিন আর কিছু বলল না!
বিকেলে সবাই হাঁটতে বেরিয়েছে!আদ্রিয়ান বার বার অরিনের কাছে গিয়েও ফিরে এসেছে।ভাবছে থাকুক ও,আপাতত না জ্বালাক!অরিন খেয়াল করেছে!
লেকের ধারে সৌরভ কে দেখে অরিন চমকে গেলো।সৌরভ এদিকেই তাকিয়ে আছে!তবে ওর দিকে নয়!তনয়ার দিকে!এতদিনে বুঝলো!সৌরভ সবসময় তনয়াকেই খেয়াল করে গেছে!
সৌরভ: কেমন আছো অরিন?
অরিন: ভালো!আপনি?
সৌরভ: ভালো!আর সরি আমার কারণে তোমাদের মাঝে এত কিছু হলো!
তনয়া: কি হয়েছিল?
সৌরভ: তুমি বুঝবে না!
অরিন: বাদ দিন!
আদ্রিয়ান কি বলবে!এখনও ওর মাঝে অনুশোচনা আছে।অরিন,সৌরভ দুজনেই বুঝেছে!আরো কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করলো সব!রাতে ঘুমাতে গিয়ে সারাদিনের হিসেব মিলাচ্ছে অরিন…এই সব কিছুতেই অরিন খেয়াল করেছে! তনয়াকে নিয়ে সৌরভ বেশ কেয়ারিং!ঘুমন্ত তনয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলো!থাক না সৌরভ ওর লাইফে!এমন একটা কেয়ারিং পারসন থাকলে বোনটা খুশি থাকবে!ভেবেই মুচকি হাসলো!আদ্রিয়ান এর কথা মাথায় আসতেই বেরিয়ে গেলো রুমের বাইরে!দরজায় আদ্রিয়ান আগে থেকেই ছিল!এভাবে হুট করে অরিনের সামনে পড়ায় আদ্রিয়ান ভরকে গেলো!
আদ্রিয়ান: ঘুমাওনি এখনও?
অরিন বুঝতে পারলো আদ্রিয়ান ওকে দেখতেই এসেছে!
কিছু না বলে নিচে নামলো!ওর পিছু পিছু আদ্রিয়ান ও!
আদ্রিয়ান: এত রাতে একা বাইরে যাচ্ছো কেনো ?
অরিন: একা কোথায়?আপনি আছেন তো!
আদ্রিয়ান কিছু বললো না!অরিন বাইরে গিয়ে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে লাগলো!সেই সাথে আদ্রিয়ান!সম্ভবত পূর্ণিমা!নাহলে চাঁদ এত গোল আর আলো দিচ্ছে কিভাবে?এভাবে নির্জন রাস্তায় চন্দ্র বিলাস দারুন লাগে।পাশে যদি থাকে প্রিয় মানুষটি!অরিন এক পলক আদ্রিয়ান এর দিকে তাকালো!লোকটি ওর দিকে খেয়াল রেখেই হাঁটছে!হুট করে অবিশ্বাস্য কাজ কর বসলো!আদ্রিয়ান এর হাত জড়িয়ে হাঁটছে ও!আদ্রিয়ান বেশ চমকালো!
অরিন: একটা কথা বলবো?
আদ্রিয়ান নিজেকে সামলে বললো,”বলো”
অরিন: আর কখনো অবিশ্বাস করবেন না!কষ্ট হয় ভীষণ!
আদ্রিয়ান: এক বার শিক্ষা হয়েছে!দ্বিতীয়বার ওই ভুল করবে কোন পাগলে?
অরিন হাসলো!
অরিন: আদ্রিয়ান!
আদ্রিয়ান: উহু ইংরেজ বাবু!
অরিন: এক সময়। এই নামে ডাকলে প্রচুর বিরক্ত হতেন!
আদ্রিয়ান: তখনের সময় আর এখনের সময় আলাদা অরি!
অরিন: চাইলে আরো রাগ দেখিয়ে কথা না বলে থাকতে পারতাম!কিন্তু চাই না!রাগের কারনে আমরা আরো দূরে চলে যাই!রাগ যে একটা সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ!
আদ্রিয়ান: সরি!
অরিন: আমিও!
আদ্রিয়ান: কেনো?
অরিন: আপনাকে যদি আগে বলে দিতাম তাহলে হয়তো আপনি ভুল বুঝতেন না। দোষটা আমারও তো ছিল!
আদ্রিয়ান: হুশ..বাদ দেও!
অরিন কিছু বললো না আর!
_____
অরিন,আরিফা,তনয়া,সোহা এক সাথে কলেজে ঢুকলো!
সোহা: কি সুন্দর,তুমি এই কলেজে পড় আপু!
অরিন: না,আকাশে পড়ি!এইটাই এনেছি তাহলে তো এটাতেই পড়বো তাই না?
সোহা: রাগ দেখাও কেন?
অরিন: আসো আদর দেই!
সোহা: তোমার মাথা… উমা…কোন কানা রে!
অরিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে কারোর সাথে ধাক্কা খেলো সোহা!
“কানা কাকে বললে?”
সোহা: আপনাকে!দেখে চলতে পারেন না?
“তুমি দেখে চলতে পারো না?”
সোহা: দেখেন না কথা বলছিলাম?
“তুমি দেখো না আমিও ফোন চালাচ্ছিলাম”
সোহা: আপু!
“অরিন!”
অরিন: তোরা দুইটা থাম!আর অগ্নি তুই এত ঝগড়াটে হলি কবে থেকে?
অগ্নি: এই আমি মোটেও ঝগড়া করিনি!এই পিচ্ছি কে?
সোহা: ওই পিচ্ছি কাকে বলেন?
অরিন: সোহা থাম! অগ্নির বাচ্চা!তুই ওর মত ঝগড়া করিস কেন!
অগ্নি: আমি মোটেও ঝগড়া করিনি!
সোহা: আমিও না!
লে আরিফা আর তনয়া একসাথে,”আমরা করছিলাম ঝগড়া”
অরিন মাথা চাপ’রালো!সব গুলোই বা’ন্দর!
________
অগ্নি: বললি না তো?ওরা কে?ওদের ক্লাস খুঁজে বসিয়ে দিয়ে আসলি!
অরিন: আমার বোন তনয়া!আর যার সাথে ঝগড়া করলি ও সোহা। চাচ্চুর মেয়ে!আর আরিফাকে তো চিনিস ই।আদ্রিয়ান এর বোন!
হৃদি: মানে ওর ননদ!
অরিন সাইড থেকে পাথর ছুড়ে মারলো!
অরিন: টিট’কারী ছাড়া তোদের কি আর কোনো কাজ নেই?
বিথী: সত্যি বললেও দোষ!
অরিন: সত্যি বললে দোষ না!দোষ টিট’কারী দিলে!
অগ্নি: একদম ঠিক বলেছেন আপু!
সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকালো!
বিথী: আপু?
হৃদি: কিরে তোর আবার কি হলো!
অগ্নি লাজুক হেসে বললো,”কয়েকদিন পর ওর বোন জামাই হবো,তো ওর বোনের বড় বোন তো আমার আপুই!তাই না?”
বিথী কুচকানো ভ্রু আরো বেশী কুচকে বললো,”তনয়াকে বুঝালি?”
অগ্নি: আরে না!
অরিন: যার সাথে ঝগড়া লাগলো সে!
অগ্নি: বাহ কি সুন্দর বুঝে গেলি!
অরিন হেসে বললো,”পায়ে আমার কি আছে?”
অগ্নি পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”জুতা!”
অরিন: ওই জুতা খুলে তোকে পিটাবো!লজ্জা করে না?আমার সামনে আমার বোনকে নিয়ে ভাবিস!
অগ্নি: লজ্জার কি আছে!সবার আগে তুই আমার ফ্রেন্ড,বলতেই পারি!
হৃদি: আপু ডাকার আগে তোর মনে ছিল না!
অগ্নি: নিজেরে মিংগেল আছিস,এই সিঙ্গেল বান্দার উপর দয়া কর!
অরিন: আহারে!আচ্ছা.. দয়া করলাম…ছেলে হিসেবে খারাপ না।কিন্তু ফ্রেন্ড হিসেবে তুই
বিথী আর হৃদি এক সাথে,”হা’রা’মী”
অগ্নি: দূর হ তোরা!জামাই পাবি না!
বিথী: অলরেডি আছে!
হৃদি: আমার নেই!
অরিন: এটা বলার আগে অনিক ভাইয়ের সাথে ইটিশ পিটিস করার কথা মনে রাখিস।
হৃদি ভরকে গেলো।ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখলো,তিনজন দাত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে।গলা ঝেড়ে বললো,”তোরা..”
আর কিছু বলার আগে অগ্নি বললো,”আমরা সব জানি!”
হৃদি আর কি বলবে! মেকি হাসি দিল.
বিথী: এবার বল কাহিনী কি!
হৃদি: কিসের কাহিনী?
অরিন: উই আর নট শিশু বেবী!
হৃদি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,ফ্রেন্ড মানেই সিআইডি!
হৃদি: জানি না কিভাবে জানি ঝগড়ার মধ্যেই হয়ে গেলো!যদিও কেও কাউকে বলিনি!তবুও বুঝতে পারি,উপলব্ধি করতে পারি!এভাবেই খুনশুটি চলে!এখনও কেউ ভালোবাসি বলিনি!
অরিন গাছের সাথে হেলান দিলো।প্রত্যেকেই ভালোবাসার মুহূর্তে হারিয়ে গেছে!মুহূর্ত গুলো হয়তো সিনেমার মত কল্পনার রাজ্য না,কিন্তু প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারা এক মূল্যবান স্মৃতি!
অরিন মুচকি আনমনেই বললো,” আমার ইংরেজ বাবু!”
_____
লামিয়া: ও আদিব ভাইয়া!
আদিব: থাপড়িয়ে কান লাল করে দিবো!জামাইকে কেউ ভাইয়া ডাকে!
লামিয়া: তো বউকে কেউ তুই ডাকে?
আদিব ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি বললি?”
লামিয়া: রাগো কেন? শুনো না!
আদিব: বল!
লামিয়া: চলো না,অরিনের বাসায়!তনয়া ওরা সব একসাথে!আমি বেচারি একা!
আদিব: কাজ আছে,লামিয়া!জেদ করিস না!
লামিয়া: ঢাকাতেই তো!
আদিব অসহায় চোখে তাকালো!ওদের কাছে যাবে বলে মাথা খারাপ করে ফেলছে পাগলীটা!রামু লামিয়াকে প্রচুর জ্বালাতো!এটা আদিবের সহ্য হতো না।শুরু থেকেই লামিয়াকে ও ভালোবাসে!কিন্তু কখনো বলেনি!কয়েকদিনের মাঝেই চলে যেতো!কিন্তু রামুর কাণ্ড দেখে লামিয়া কে বিয়ে করে নিয়েই চলে আসে!এদিক দিয়ে লামিয়া ভীষণ খুশি!মনের মানুষটাকে পেলো!…
অরিন: কার সাথে কথা বলছিস আরু?
আরিফা তড়িঘড়ি করে ফোন লুকালো!
আরিফা: ইয়ে মানে ওই ফ্রেন্ড আপু!
অরিন বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে রইলো।
আরিফা মেকি হাসলো!কিন্তু লাভ হলো না।ধরা পড়ে ও গেছেই!
মিনমিন করে বললো,”সাদ ভাইয়া!”
অরিন: কি চলে?
আরিফা: ইয়ে মানে আপু..
অরিন: সত্যি বলবি!
আরিফা: উনি ই আগে বলেছে,আমারও ভালো লাগতো তাই…
অরিন: সবাই কি ফাস্ট রে ভাই!
আরিফা: হি হি!
অরিন: আবার হাসে! যা পড়তে বস!
আরিফা: তুমি আর আদ্রিয়ান ভাইয়াও কিন্তু কম না…
অরিন আরিফার কান ম’লে দিয়ে বললো,”বেশি পেঁকে গেছো না?”
আরিফা: ভাবীপু লাগছে,আচ্ছা যাও আর বলবো না!
অরিন: মনে থাকে যেন!
আরিফা অরিন এর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছে গেলো।
উকি মেরে বললো,” মাঝে মাঝে তো তোমাদের ফ্রি রোম্যান্স দেখতেও পাই!”
বলেই এক দৌড় দিল।অরিন চোখ বড় বড় করে তাকালো!
বির বির করে বললো,”যেমন ভাই তেমন বোন!অ’সভ্য”
#চলবে