#অবুঝ_দিনের_গল্প
#লেখনীতে_সাবরিন_জাহান
#পার্ট_২
অরিন আবারও হাতের দিকে ইশারা করলো।এভাবে বার বার পরে অপমানিত হওয়ার থেকে ইগোকে সাইডে রেখে ওর হাত ধরাই বেটার।এই ভেবে আদ্রিয়ান ওর কাঁদায় লেপ্টে যাওয়া হাত দিয়ে অরিনের হাত ধরলো।অরিন শক্ত করে ধরলো।অরিনের সাহায্যে উঠে দাড়ালো ও। হাত ছেড়ে আবার সামনে যেতে নিলেই পিছলে পড়তে নিলো।কিন্তু তার আগেই অরিন ধরলো।
অরিন: মশাই,একটা কাজ করুন।বাকিটা কাঁদাময় রাস্তা আমার হাত ধরেই পার করুন।গ্রামের মেয়ে,তাই এই রাস্তায় চলাচলে অভ্যাস আছে।
আদ্রিয়ান কথা বাড়ালো না।এভাবে পড়লে লোকে কি বলবে।এমনেই ব্লেজার ,প্যান্ট কাঁদায় ভরে গেছে।
উঠোনে তনয়া পড়ছিলো। সোহা ভিতরে গেছে জামা কাপড় নিতে।সামনে কয়েক জোড়া মানুষের পদধ্বনি শুনতে পেয়ে বইয়ের থেকে নজর সরিয়ে সামনে তাকালো।সামনে তাকাতেই চোখ পড়লো প্রথমে কাঁদায় লেপটানো আদ্রিয়ানের দিকে।মুহূর্তেই ফিক করে হেসে দিল।
আরিফা: তনু মনু কেমন আছিস?
তনয়া: আলহামদুলিল্লাহ।মামা মামী কেমন আছো তোমরা?
দুইজনেই বললো ভালো।
আদ্রিয়ান চারপাশে কাউকে খুঁজতে লাগলো।মূলত অরিনকে দরকার ।এভাবে আর কতক্ষন।ফ্রেশ হতে হবে। শাওয়ার টা কোনদিকে কাকে জিজ্ঞেস করবে বুঝছে না।
আদ্রিয়ান: এই শুনো!
তনয়াকে সামনে পেয়ে তাকে ডাকলো।
তনয়া: জি ভাইয়া!
আদ্রিয়ান: আই ওয়ান্ট টু টেক শাওয়ার! হুয়ার ইজ ইট?
তনয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো।যদিও কি চাচ্ছে বুঝতে পেরেছে।কিন্তু এ এত ফটর ফটর ইংলিশ কেন বলে?
পিছন থেকে অরিন বললো,”আসুন আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
আদ্রিয়ান অরিনের সাথে গেলো।বাড়ির পিছনে একটা ইট পাথরের ছোট ঘর দেখতে পেলো।
অরিন: কল চেপে পানি তুলে দিতে হবে নাকি নিজে নিবেন?
আদ্রিয়ান: মানে?
অরিন দরজা ঠেলে দিল।উপরে কোনো আস্তরণ নেই।উপর দিক খোলা ।দেয়াল যথেষ্ট উচু তাই কেউ চাইলেও এটা টপকে দেখতে পারবে না।ভিতরে এক কোণে বালতি আর মগ রাখা আছে চাপ কলের নিচে।তার বামে গোসলের জন্য সাবান, শ্যাম্পু আরো কিছু জিনিস।সব টুকু মিলিয়ে অসাধারণ একটা গোসলখানা।কিন্তু চাপ কল চেপে পানি তুলতে হয় এটা বিরক্ত লাগলো আদ্রিয়ান এর।
আদ্রিয়ান: আজকে তুলে দেও।আমি টায়ার্ড।
অরিন কথা বাড়ালো না।চুপচাপ কল চেপে দুই বালতি পানি ভরে দিল।দিয়ে পিছনে ঘুরতেই চোখ ছানাবড়া।দু হাতে চোখ চেপে মৃদু চিৎকারে বললো,”আরে আরে,আচ্ছা অসভ্য লোক তো আপনি!”
আদ্রিয়ান: হোয়াট?
অরিন চোখ ধরে রেখেই বললো,”এখানে একটা মেয়ে আছে,তার সামনেই নিজের টিশার্ট এভাবে খুলতে লজ্জা করলো না আপনার?”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো।অরিন এখনও চোখে হাত দিয়ে আছে।মাথায় শয়’তানি বুদ্ধি খেলে গেল।
বেশ অনেক্ষণ চোখে হাত দিয়ে রাখার পরও কোনো সাড়া না পেয়ে আস্তে আস্তে মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো।তাতেই ওর চোখ ছানাবড়া।আদ্রিয়ান ওর থেকে এক আঙ্গুল দূরে দাড়িয়ে আছে তাও উইদাউট টিশার্ট। সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে পিছাতে নিলেই পা স্লিপ করে মেঝেতে পড়তে নিলেই আদ্রিয়ান ওর এক হাত ধরে আটকে নিলো।
অরিন: আপনি মারাত্মক অস’ভ্য একটা লোক!হাত ছাড়ুন অস’ভ্য!
আদ্রিয়ান: আমি অ’সভ্য?
অরিন: হ্যাঁ,অনেক অ’সভ্য!মারাত্মক অ’সভ্য!এক নাম্বারের..
আর কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান ওকে ছেড়ে দিলো।এভাবে হুট করে ছেড়ে দেওয়ায় ব্যাথা না পেলেও একটু ভরকে গেলো।
অরিন: ফা’জিল লোক!আপনার জন্য আমিও ভিজে গেলাম!এভাবে কেউ ফেলে দেয়?
আদ্রিয়ান: ছাড়তে কে বলেছিল?
অরিন কট মট করে তাকালো।
অরিন: ফা’জিল,অ’সভ্য ইংরেজ বাবু!
আদ্রিয়ান: এখন কি আমার শাওয়ার নিবে মিস?
অরিন ছোট জলদি উঠে দাড়ালো, দাত কিরমির করে অ’সভ্য বলে বেরিয়ে গেলো।আদ্রিয়ান হাসলো।
আদ্রিয়ান: ইন্টারেস্টিং!
সোহা: অরিপু তুমি ভিজা কেনো? কাদায় পড়েছিলে নাকি?
অরিন: কাদায় পড়লে গায়ে কাদা থাকার কথা না?
সোহা: তাও ঠিক!
অরিন: তাহলে পানি আছে দেখিস না চোখে?
অরির মা: এই বান্দর তুই ওর সাথে চেঁচামেচি কেন করছিস!
অরিন: কপাল আমার!
বলে হন হন করে ভিতরে চলে গেলো।
সোহা ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,”এর আবার কি হলো?”
ঘরে এসে খাটে বসে ফুসতে থাকলো।তনয়া শুকনো কাপড় গুচাচ্ছিল।
তনয়া: আপু কি হয়েছে?
অরিন: অ’সভ্য!
তনয়া: কিহ!
অরিন: এত কি কি করছিস কেনো কাপড় গুছা না!
তনয়া পাত্তা দিল না!এই মেয়ের কখন কি হয় তা ও আজও বুঝে উঠতে পারেনি।
খাবার খেতে আসলো সবাই।আদ্রিয়ান তখনও অরিনের দিকে তাকিয়ে হাসছে।অরিনের গা জ্বলছে।খাবার মোটামুটি ভালো কিন্তু পানি নিয়ে আদ্রিয়ানের সমস্যা।এরা আর্সেনিকমুক্ত চাপ কলের পানি খায়। যা ওর রুচিতে যাচ্ছে না।শহর থেকে আনা মিনারেল ওয়াটার দিয়েই কাজ সারলো।কিন্তু এই পানি আজই যাবে। কাল কিভাবে ম্যানেজ করবে?ভাবতেই নিজের বাবা মায়ের রুমে গেলো।
আদ্রিয়ান: মা আমি কাল ফিরে যাবো!
আদ্রিয়ানের মা: সেকি?আজই তো এলি!
আদ্রিয়ান: এই পরিবেশে আই কান্ট ম্যানেজ মা!
বাবা: আদ্রিয়ান!এভাবে আজই এলে আর কাল গেলে লোকে কি বলবে?
আদ্রিয়ান: আই ডোন্ট কেয়ার বাবা!এসেছি?সবাইকে দেখেছি? এনাফ!এখন আমি ব্যাক করছি।তোমরা তোমাদের মন মতো এসো।
বলেই বেরিয়ে গেলো।
আদ্রিয়ানের বাবা: ছেলেটাকে আর দেশী কালচার উপভোগ করাতে পারলাম না। দোষটা আমাদেরই।ছোট থেকে যদি ওকে বিদেশে বড় না করতাম হয়তো এই পরিবেশটাকেও উপভোগ করতে পারতো।
দুইজনই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।বাইরে অরিন সবটাই অরিন শুনলো।
অরিন: নক নক!আসবো ইংরেজ বাবু!
আদ্রিয়ান: তুমি?এসো
অরিন: চলে যাচ্ছেন?
আদ্রিয়ান: ইয়াহ! কালকে সকালেই!
অরিন: থেকে যেতেন!
আদ্রিয়ান দুষ্টু হেসে বললো,”কেনো দুপুরের ঘটনা ভুলে গেছো বুঝি?”
অরিন রেগে বলল,”আপনার সাথে কথা বলাই বৃথা।মারাত্মক ফাজিল আপনি। ধ্যাত!”
চলে যেতে নিয়েও ফিরে এসে আদ্রিয়ান এর খাটে বসলো।আদ্রিয়ান কিছু বললো না।মেয়েটা মিশুক।কয়েক ঘন্টায় আদ্রিয়ান ওর সাথে ফ্রি হয়ে গেছে।
অরিন: আপনি কখনো ভোরের বাতাস উপভোগ করেছেন?
আদ্রিয়ান: করেছি তো,বিদেশে কত ভোরে উঠেছি।অনেক ভালো লাগে।
অরিন: বিদেশ এর গ্রাম বাংলা এক না ইংরেজ বাবু!”অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি”
আদ্রিয়ান তাকালো।অরিনের কথা বোঝার চেষ্টা করলো!
অরিন: জানেন?আমাদের দেশ এই ছোটো ছোটো গ্রামগুলির জন্যই অনেক সুন্দর ।গ্রামের আলোতে আমরা দুচোখ মেলেছি।বুক ভরে নিয়েছি দূষণমুক্ত বাতাস।মাঠে চাষের শস্য কণা,বাগানের ফলমূল মিটিয়েছে ক্ষুধার চাহিদা আর দেহের পুষ্টি।এখানকার মাঠ ঘাট,গাছ-গাছালি,জীবজন্তু,নদীনালা,পুকুর ও মানুষজনের সঙ্গে ঘটেছে হৃদয়ের গভীর যোগ।চারিদিকে আম,জাম,নারকেল,কাঁঠাল,সুপারির বনবীথি এ যেন আবহমান গ্রাম বাংলার একটি ছায়া ঢাকা শান্তির নীড়।গ্রাম আমাদের ‘ শিশুশয্যা, যৌবনের উপবন,বাধ্যকের বারাণসী।’যা শহরে বা বিদেশে পাবেন না।বাংলার গ্রামগুলোর এমনই রূপ।এই গ্রাম গুলিই হল আমাদের দেশের প্রানবিন্দু।ছায়া শীতল শান্ত পরিবেশে গ্রাম গুলির অবস্থান। হয় মাঠের প্রান্ত ছুঁয়ে কত গুলো বাড়ির ঘরের জটলা, অথবা জনপদের পা ছুঁয়ে দিগন্ত বিস্তৃত অবারিত সবুজ চাষের জমি।অনেক অনেক গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে আঁকা বাঁকা নদী।ছোটো ছোটো পুকুর, কোথাও পায়ে হাঁটা সরু পথের দুধারে বাঁশের ঝাড়,কোথাও আবার ঝুরি নামিয়ে গ্রামের সমস্ত ইতিহাসের সাক্ষী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন বট গাছ।ঘন ছায়াতে আম কাঁঠালের বাগান যেন রাখালের খেলাঘর। মুক্ত বাতাসে মনের আনন্দে পাখিদের ডাক।কোকিল ডাকে পঞ্চমে।চাতকের কাতর ধ্বনি,ঘুঘুর ক্লান্ত স্বর গ্রাম্য প্রকৃতির রূপকে দেয় এক নতুন বাহার।একেক ঋতুতে একেক রূপ!আহা কি মনো মুগ্ধকর।ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন সাজে সজ্জিত হয় বাংলার গ্রাম গুলি।গ্রীষ্মের খরতাপে পুকুর, খাল নদীনালা শুকিয়ে যায়।দুর দুরন্ত পর্যন্ত শস্য শূন্য চাষের জমি।চারিদিকে শুষ্ক রুক্ষ ভাব।জনমানব শূন্য মাটির রাস্তা আর ঘুঘুর মন উদাস করা ডাক বাংলার গ্রামের এক পরিচিত চিত্র।বর্ষার আবির্ভাবে আকাশে ভেসে বেড়ায় সজল মেঘমালা।এক নতুন জীবনের আশ্বাসে সবুজ সাজে সেজে ওঠে বাংলার প্রকৃতি। “অরুণ আলোর অঞ্জলি” নিয়ে হাজির হয় শরৎ। হেমন্তে শিশির আর হিমের পরশে মাঠের মঞ্জুরিত শস্যে ধরে সোনার রং। শীতের কুয়াশা ঢাকা সকাল আর উত্তুরে হিমেল হাওয়ায় জড়তার ভাব।” ফাগুনের আলোর সোনার কাঠিতে” বাংলার গ্রামের সকাল হয়।গাছের পাতা ঝরে,আবার নতুন পাতায় ফুলে ফলে ডাল গুলি নতুন ভাবে সেজে ওঠে।দীর্ঘ দিনের অবহেলা আর বঞ্চনাকে কাটিয়ে অনেক গ্রামেই উন্নত হয়ে উঠেছে।আগের মত গ্রাম গুলিতে আর বিদ্যুৎ,শিক্ষা,পথঘাট,যানবাহনের অভাব নেই।শহরের সাথে পাল্লা দিয়ে গ্রাম গুলি উন্নত হয়েছে।তবুও এখনও বাংলার গ্রাম গুলিতে আছে সরলতা,শান্তি,বুক ভরে টেনে নেওয়ার মতো প্রানদ বাতাস।আর চোখ ভরে দেখার মতো সজল শ্যামলতা।
আদ্রিয়ান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
অরিন: আপনার কাছে আর্জি।যে কয়েকটা দিন আছে আমার মত অর্থাৎ গ্রামের মানুষদের মত থেকে দেখুন।ভীষণ উপভোগ করবেন।ছেড়ে যেতেই চাইবেন না।এর প্রতিটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারবেন।
অরিন দাড়ালো।এগিয়ে যেতে যেতে বলল।
অরিন: এখন আপনি ভাবুন!আমার মত উপভোগের মজা নিবেন নাকি কাল চলে যাবেন।বাকিটা আপনার ইচ্ছে।আমি আমার অনুরোধ করেছি।সেটা রাখবেন কিনা আপনার বিষয়।শুভ রাত্রি ইংরেজ বাবু। সকালেই না হয় জানবো উত্তর।টাটা!
চলে গেলো অরিন।আদ্রিয়ান ভাবলো কিছু ভেবে মুচকি হাসলো।
সকালে উঠোনে সবাই বসে আছে।আদ্রিয়ান বের হবে একটু পর।অরিন দাত দিয়ে নখ কাটছে।আদ্রিয়ান কি চলে যাবে।
আদ্রিয়ান জিন্স আর টিশার্ট পরে বেরিয়ে এলো।সবাইকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বললো ,”তোমরা এভাবে বসে আছো কেনো?”
আরিফা: তুই তো চলে যাবি।তাই সবাই দেখা করে নিচ্ছে।
আদ্রিয়ান হাসলো।
আদ্রিয়ান: অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম থাকি কয়েকটা দিন। গ্রামটাও ঘুরে নিবো।
আরিফা: সত্যি!!!
আদ্রিয়ান: হুমম!
আরিফা: ইয়ে!! আই লাভ ইউ ভাইয়া!
সবার মুখেই হাসি। কারোরই ভালো লাগে নি আদ্রিয়ান আজকেই চলে যাবে।তাই মন খারাপ করে ছিল।এখন সবাই খুশি।
আদ্রিয়ান অরিনের দিকে তাকালো।ইশারায় বুঝালো,”রিকুয়েস্ট একসেপ্ট”
অরিন মুচকি হেসে সায় দিল।
#চলবে