অবাধ্য অনুভূতি পর্ব- ০৯

0
2520

@অবাধ্য অনুভূতি
#পর্ব_০৯
#লেখিকা_আমিশা_নূর

“সূচি,আমিও চাকরি করবো।তখন টাকা শোধ করতে সুবিধে হবে।”
“কীহ?”
“হ্যাঁ।তুই একটা কাজ করিস।তোর বসের সাথে আমার কথা বলিয়ে দিস।”
“কে..কেনো?”
“কেনো কী আবার?মাসে কতো করে শোধ করতে হবে,আর কী কী…”
“ভূমি,আমি আছি না?তোর শোধ করার দরকার কী?সবটা আমিই করবো।”
“এতোটাকা তোর একার দ্বারা সম্ভব না সূচি।”
“সম্ভব সম্ভব।তুই মাথা ঘামাস না তো।রান্নায় মন দে।”
“রান্না তো করছি।তুই কিন্তু বিষয়টা সিরিয়াসলি নিচ্ছিস না সূচি।”
“আহা!আচ্ছা ভেবে দেখবো।”
“হুম।”

ভূমিকা রান্নায় মন দিলো।সূচনা ভাবতে লাগলো এখন ভূমিকাকে কী বলবে?টাকা তো সে সুক্ষ্মের কাছ থেকে নিয়েছিলো।

সূচনার মায়ের পেটে টিউমারের দেখা পেয়েছিলো।তাদের আর্থিক অবস্থা অতোটা ভালোছিলো না।আর না সূচনা তখন চাকরিও করতো।সেই সময় সুক্ষ্ম এসে প্রস্তাব দিয়েছিলো ভূমিকা’র সাথে সমুদ্রের বিয়ে দিতে বিনিময়ে সে তার মায়ের অপারেশনের টাকা সাথে জব দিবে।প্রথম বারের তো সেদিন সূচনার বুক ক্ষেপে উঠেছিলো।কিন্তু সেই শর্ত মেনে না নিয়েও সূচনার কোনো পথ ছিলো না।মা’কে বাঁচানো টা তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো।

সূচনা থতমত করছিলো সেই সময়।তখন সমুদ্র এসে তাকে আরো জানায় যে ভূমিকা সমুদ্রকে ভালোবাসে আর সমুদ্রও কীভাবে অজান্তে ভালোবেসেছে।তারপর সূচনার সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকে না।তাই বাধ্য হয়ে সেই শর্তই মেনে নে।কিন্তু ভূমিকাকে জানিয়েছিলো সে ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়েছে।
.
.
ভূমিকা সূচনার রুমের পাশ দিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিলো।তখন তার কানে ভেসে আসলো কারো ফুঁপানি আওয়াজ।ভূমিকা চলা থামিয়ে সূচনা’র রুমে উঁকি দিলো।দেখলো সূচনায় বালিশ বুকে চেপে ধরে কাঁদছে।কেনো কাঁদছে সূচনা?

“সমুদ্র..পারছি না তো তোমার সাথে ভূমিকে সইতে।পারছি না,খুব কষ্ট হচ্ছে।সমুদ্র আমাকে কেনো ভালোবাসেনি?ও ও কে কেনো ভালোবাসলো?সমুদ্র..”

সূচনা’র বলা প্রত্যেকটা কথা ভূমিকা’র কানে বাজছে।সূচনায় কান্নায় তারও কষ্ট হচ্ছে।এখন আর কী করার?কিন্তু সমুদ্র সূচনাকে ভালো না বাসলে কাকে ভালোবাসে?ও মানে কে?

ভূমিকা’র চোখের কোণা কাঁপছে।এমনটা তখনি হয় যখন তার কান্না পায়।কিন্তু এখন কেনো কান্না পাচ্ছে?সূচনা কাঁদছে বলে নাকি সমুদ্র অন্য কাউকে ভালোবাসে তা শুনে?


“ও ভূমিকা?”
“হুম সুক্ষ্ম।কখন আসছো তোমরা?”
“এইতো বের হচ্ছি।”
“আচ্ছা আসো।মামুনি’র জন্য আমি নিজে রান্না করছি বলো।”
“ওকে ওকে।”

ভূমিকা কল কেটে পেছন ফিরতেই সমুদ্রের সাথে ধাক্কা খেলো।ভূমিকা মাথা উঠিয়ে দেখে সমুদ্র।ভূমিকা মনেমনে বললো,”কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে বুঝিই না।লাল জল্লাদ একটা,মুখটাকে এখনো লাল করে রেখেছে।কিন্তু রেগে আছে কেনো?”

মুখ ফুটে ভূমিকা কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না।তখন সমুদ্র বললো,”তোমাকে না বললাম সুক্ষ্ম’কে ভাই করে ডাকতে।”
“ভা..ভাই?স..সরি মনে ছিলো না।”
“সেকেন্ড বার যেনো এই ভূল না হয়।”
“ওকে।”

ভূমিকা আস্তে আস্তে সে স্থান ত্যাগ করতে চাইলে সমুদ্র তার হাত ধরে ফেলে।বিদ্যুৎ’র শকট খাওয়া মতো অনুভব করলো ভূমিকা।বুকের ভেতর কে জেনো হাতুড়ি পেটা করছে।ভূমিকা চোখ তুলে সমুদ্রের দিকে তাকাতে সে বললো,”কোথায় যাচ্ছো?”

শীতল সে কন্ঠ!শীতল দু চাহনি!একে অপরের দিকে তাকাতেই দুই শীতল দৃষ্টি’র মিলন হলো।দুজনের চোখের অসীম ভালোবাসা!একজন সেটা দেখছে আর অন্যজন খুঁজছে!সমুদ্র ভূমিকা হাতটা টেনে কাছে নিয়ে নিলো।অনেকটা কাছে!এতোটা কাছে যে ভূমিকা’র বুকের ধকধক আওয়াজ সমুদ্র শুনতে পাচ্ছে।তাকে এক অজানা শক্তি চারিদিকে ঘিরে ধরেছে।একটা ঘোরের মধ্যে আছে।সমুদ্র চাইছে না এই অজানা সুখ থেকে বের হতে।কিন্তু মাঝে বিপত্তি ঘটিয়ে ভূমিকা বললো,”কাজ আছে।”

সমুদ্র কিঞ্চিৎ রেগে ভূমিকা হাত ছেড়ে দিলো।ছাড়া পেয়ে ভূমিকা দৌড়ে পালালো।
.
.
বাসার কলিং বেল বাজলো।অনিচ্ছার সত্ত্বেও দরজা সূচনা’কে খুলতে হলো।আজ শুক্রবার বিধায় তার অফিস যাওয়া হয়নি।তার মা আর ভূমিকা রান্না ঘরে আছে।তাই দরজা তাকেই খুলতে হলো।

সূচনা দরজা খুলতেই দেখলো সুক্ষ্মের সাথে তার মা দাঁড়িয়ে আছে।সুক্ষ্মের মাকে দেখে সূচনা সালাম দিলো।তখন সুক্ষ্মের মা রুনা হাসান সূচনা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।তারা দুজনে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে সোফায় বসলো।তখন ভূমিকা এসে তাদের সাথে কথা বলতে লাগলো।

“ভূমিকা,ভালো আছো মা?”
“হ্যা মামুনি।তুমি ঠিক আছো?ওষুধ খাচ্ছো তো ঠিক মতো?সুক্ষ্ম খেয়াল রাখছে তোমার?”
“কতো প্রশ্ন করিস।হ্যা হ্যা সব ঠিক আছে।”

রুনা হাসান হাসছে।রুনা হাসান জানে ভূমিকা তার মেয়ে।আর তাকে এখন বিয়ে দেওয়া হয়েছে।ভূমিকা’র সামনে এলে উনি মন খুলে হাসেন।মনে হয় যেনো উনিই পৃথিবীর সুখি ব্যাক্তি।
.
.
“চটপটি তুমি কী যেনো জানতে চাইছিলে?”
“অনেক কিছু।”
“বলো?”
“সমুদ্র-ভূমিকা’কে ভালো রাখতে গেলে আপনার স্বার্থকতা কোথায়?”
“বলেছিলাম না সেদিন,ভূমিকা’র ভালো থাকাটাই আমার লাভ।”
“সেটা কেনো?”
“অতো সহজ একটা গণিত তুমি বুঝলে না?”
“বুঝিয়ে বলুন?”
“ভূমিকা আমার মা’কে সুস্থ করে দিয়েছে আর তাকে ভালো রাখা’টা আমার কর্তব্য না?”
“আর আমার ভালো থাকাটা?আমি ভালো আছি?”

করুণ কন্ঠ,চোখ ভর্তি জল নিয়ে সূচনা সুক্ষ্মের দিকে তাকিয়ে আছে।এমন চাহনিতে সুক্ষ্মের বুকটা কেঁপে উঠলো।ভূমিকা’কে ভালো রাখতে গিয়ে মেয়েটাকে কী খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে?

সূচনা আগের মতো বললো,”কেউ বুঝছে না আমিটা কেমন আছি,আমি…”শব্দ আর বের হচ্ছে না।সূচনা বুঝতে পারলো এখন তার চোখ থেকে বিনা বাধায় জল গড়িয়ে পরবে।যার নাম কান্না!

সূচনা বিপরীতে মুখ করে আছে।এতোদিনে সুক্ষ্মের অপরাধবোধ হচ্ছে।সূচনার কষ্ট তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না।কেনো যে ভূমিকা’র সুখ দেখতে গিয়ে এমনটা করে বসলো?

সুক্ষ্মের খুব করে ইচ্ছে করছে সূচনার চোখের জল মুছে দিতে।কিন্তু কোন অধিকারে সে এমনটা করবে?সূচনার উপর তো তার কোনো অধিকার নেই¡সুক্ষ্ম ঠিক করলো এই অধিকার সে জলদি আদায় করবে।

সুক্ষ্ম ছাঁদ থেকে নেমে যেতে চাইলে পেছন থেকে সূচনা প্রশ্ন করলো,”আপনি কীভাবে জানলেন ভূমিকা সমুদ্রকে ভালোবাসে?”

সুক্ষ্ম পেছন ফিরে তাকালো।কালো’র সাথে বেগুনি কালারে ছোট ছোট ফুলের সেলোয়ার-কামিজ পরে আছে রমণী!বিকেলের ঠান্ডা হাওয়া বইছে।সেই হওয়া’র ধাক্কায় রমণী’র চুল উড়ছে।রমণী’টি তাকিয়ে আছে নীল আকাশের দিকে।

এই দৃশ্য কী ছিলো সুক্ষ্ম জানে না।তবে চাইছিলো সময়টা এখানে থমকে যাক।চলতে থাকুক প্রকৃতির খেলা বিনাবাধায়!

সুক্ষ্ম ততক্ষণ এভাবে তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ না সূচনা তার দিকে মুখ করলো।সূচনার চেহেরা দেখা যেতে সুক্ষ্ম ঘোর থেকে বেরিয়ে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো সূচনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে।
.
.
“উফ,সূচনা তুমি একা ছাঁদে?ভূমিকা কোথায়?”

শতদিনের চেনা কন্ঠস্বর শুনে সূচনা পেছন ফিরলো।এখন পড়ন্ত সন্ধ্যা!সূর্য ডুবার জন্য যেনো উঠে পড়ে লাগছে।শীতল চাহনিতে সূচনা সমুদ্রের দিকে তাকালো।এতে সমুদ্রের কোনো পরিবর্তন হলো না।সে ভূমিকা’কে খুঁজছে,সূচনা’কে না!

সমুদ্র সূচনার উত্তরের জন্য দাঁড়িয়ে রইলো।তখন সূচনা বললো,”নিচে ছিলো।”
“নিচে পেলাম না।ভাবলাম এখানে আছে।উফ!কোথায় যে গেলো?”

মাত্র এক মাস আগে দেখা সমুদ্রের সাথে যেনো এই সমুদ্রের কোনো মিলই নেই।ভূমিকা’কে খোঁজে না পেয়ে তার কপালের দুশ্চিন্তার ছাপ।কেনো যেনো সূচনার হিংসে হলো।সে কোনো কথা না বলে আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো।

তখন সমুদ্র সূচনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,”সূচনা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।তুমি যদি ভূমিকা’কে আমার হাতে তুলে না দিতে তাহলে হয়তো সারাজীবনের মতো ও কে হারিয়ে ফেলতাম।আর ডায়েরি’টা দেওয়া জন্য আরো একবার ধন্যবাদ।”
“হুম।সমস্যা নেই।”
“কেমন আছো?”

এই দুইটা শব্দের ছোট বাক্যে কী ছিলো সেটা সূচনা জানে না।তবুও যেনো তার মনে ঝড় উঠলো।আজ সমুদ্র তাদের বাসায় এসেছে দুদিন হতে চললো।অথচ সূচনার সাথে তার মাত্র এখন কথা হলো,চোখাচোখি হলো।সূচনা নিজেও সমুদ্রের প্রশ্নের উত্তর খোঁজে পেলো না।কেমন আছে সে?ভালো তো?কী উত্তর দেওয়া উচিত সমুদ্রকে তার?

সূচনার কোনো উত্তর না পেয়ে সমুদ্র বললো,”কোথায় হারিয়ে গেলে?কেমন আছো?”
“হু হু,ভালো।”

হালকা হেসে সমুদ্র ছাঁদ থেকে নেমে গেলো।সূচনা একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো।সমুদ্রের কী কিছু মনে নেই?আজ তো তাদের প্রেমের তিনবছর হলো।সমুদ্র এতো জলদি ভূলে গেলো?খুব কান্না পাচ্ছে সূচনার।খু-ব!

সুক্ষ্মরা চলে গেছে অনেক আগে।ভূমিকা রান্না ঘরে জিনিস গোছাচ্ছিলো।তখন সমুদ্র এতে বললো,”তুমি এখানে?”
“হ্যা।সূচি কে দেখেছেন কোথাও?”
“ছাঁদে দেখলাম।”
“ও আজ দুপুর থেকে ছাঁদে কী করছে?”
“সেটা তুমি জিজ্ঞেস করো।তোমাকে সারা বাড়ি খোঁজে এখানে পেলাম।আর তুমি…”
“আমাকে কেনো খোঁজ ছিলেন?”
“কাজ শেষ হলে রুমে এসো।”
“আচ্ছা।”

সমুদ্র রুমে এসে ভূমিকা অপেক্ষা করছে।তখন ভূমিকা এসে বললো,”বলুন?”
“আমরা কাল বাড়ি চলে যাচ্ছি।”
“কীহ?কাল?”
“হুম।অফিসে একটা মিটিং আছে পরশু।আমাকে মিটিং এর সব পেপার’স রেডি করতে হবে।”
“আচ্ছা।আমি মা’কে বলে আসছি।”
“হুম।যাও।”
.
.
ভূমিকা সকালে সূচনার রুমে এসে দেখলো সূচনা ঘুমিয়ে আছে।ভূমিকা তার কাছে গিয়ে বসলো।সূচনা’র চোখ দুটো ফোলা,আর চুল রুক্ষ,আর পড়ার টেবিলটা এলোমেলো।খাতা ছেঁড়া পরে আছে এদিকে-ওদিকে।

এসব দেখে ভূমিকা বেশ অবাক হলো।সূচনা এই অবস্থা?ভূমিকা কাগজের ছেঁড়া তুলে নিয়ে দেখলো সব কাগজে শুধু একটাই বাক্য লেখা,”আই লাভ ইউ সমুদ্র!”

ভূমিকা দু’পা পিছিয়ে গেলো।সূচনা এখনো সমুদ্রকে ভালোবাসে?তাহলে কী ভূমিকা তাদের জীবনে তৃতীয় ব্যাক্তি নাকি সমুদ্র যাকে ভালোবাসে সে?

ভূমিকা টেবিলের গুছিয়ে রেখে সূচনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।স্রোতের কোনদিকে চলছে তাদের জীবনটা?

ভূমিকা সিদ্ধান্ত নিলো যেভাবে হোক সে সূচনাকে আর কষ্ট পেতে দিবে না।সমুদ্রের সাথে কথা বলে সবকিছুর একটা শেষ সে দেখবেই!

[চলবে]

বি.দ্রঃভূলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে