@অবাধ্য অনুভূতি
#পর্ব_০৭
#লেখিকা_আমিশা_নূর
“মামুনি কেমন আছে এখন?”
“আলহামদুলিল্লাহ যথেষ্ট ভালো,ভূমিকা তোমাকে সত্যি অনেক ধন্যবাদ।”
“সুক্ষ্ম,আমাকে কতো ধন্যবাদ দিবে আর?দেখো তুমি এমন করলে কিন্তু আমি রেগে যাবো।”
“হাহাহাহা।”
সুক্ষ্ম’র হাসি দেখে ভূমিকাও মুচকি হাসলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো চেহেরায় বিরক্তির চাপ নিয়ে সমুদ্র জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।ভূমিকা মনে মনে বললো,”এই লাল জল্লাদটা সবসময় এমন করে রাখে কেনো চেহেরাটা?”
কিন্তু আফসোস ভূমিকা কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারলো না।সুক্ষ্ম সামনে বসে গাড়ি চালাচ্ছে আর পেছনের সিটে ভূমিকা-সমুদ্র বসে আছে।হঠাৎ সমুদ্রের উদ্দেশ্য সুক্ষ্ম বললো,”তো ব্রো,বিবাহিত সংসার কেমন চলছে?”
সমুদ্র ভূমিকার দিকে দৃষ্টি তাক করে বললো,”বিবাহের পর আবার জীবন?”
“হাহাহাহা,নাইস জোক্স।”
ব্যাপারটা সমুদ্র মজা করে বললেও ভূমিকা’র তা কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো।তিন বছরের সম্পর্ক ভূলে অন্যজনকে বিয়ে করলে সত্যি কী জীবন আর জীবন থাকে না?সূচনা যে কেনো তাদের তিনজনের জীবনটা এমন তৃরাস্তার মোড়ে দাঁড় করালো!
“কী ভূমিকা?বিয়ের পর সমুদ্রকে কী ভালো থাকতে দিচ্ছো না?কষ্টে বেচারা’র মুখটা শুকিয়ে গেছে..হাহাহাহা।”
সুক্ষ্ম কথা শেষ করে নিজে নিজে হেসে ফেললো।ভদ্রতার জন্য ভূমিকা মৃদ্যু শুকনো হাসলো।কিন্তু সমুদ্রের মুখ ভার।ভূমিকা’র সাথে সুক্ষ্মের করা মজা সমুদ্রের একদম ভালো লাগছে না।আর তার প্রত্যেক কথায় মুচকি হাসার মানে কী?কই,কোনোদিন সমুদ্রের কথায় তো সে হাসেনি।সুক্ষ্মের সাথে কী সম্পর্ক তার?
“এই যে তোমাদের সাথে মজা করতে করতে বাসার সামনে পৌঁছে গেলাম।”
ভূমিকা-সমুদ্র গাড়ি থেকে নেমে সুটকেস নামালো।তারপর ভূমিকা সুক্ষ্মের উদ্দেশ্য বললো,”বাসায় আসো।”
“না না ভূমিকা।আজ না।বাড়িতে মা একা আছে।”
“তাহলে কালকে মামুনিকে সাথে করে আসো।আমি দু’তিনদিন থাকবো।”
“আচ্ছা।মাও তোমাকে দেখতে চাইছিলো।”
“তাহলে আর কী?নিয়ে আসো।”
ভূমিকা-সমুদ্র সামনের এগোনোর জন্য পা বাড়ালো।ওমনি পেছন থেকে সুক্ষ্ম বললো,”ভূমিকা তৃষ্ণা পেয়েছে।এক গ্লাস পানি তো খাওয়া যায়।”
মুচকি হেসে ওদের পেছনে সুক্ষ্ম বাড়িতে প্রবেশ করতে লাগলো।আজ পঞ্চম বারের মতো সুক্ষ্ম বাড়িটাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।আজ কেনো যেনো ভিতরে লুকিয়ে থাকা তার প্রেয়সীকে দেখতে ইচ্ছে হলে।অনেকদিন দেখা হয় না।কে জানে মেয়েটা নিজের কী হাল করেছে!
সুক্ষ্মের পেছন পেছন আসাটা সমুদ্রের সন্দেহ হলো।প্রথমত সুক্ষ্ম আগে থেকে বাসা চিনে।দ্বিতীয়ত,সে ভালো মতো জানে গাড়িতে পানির বোতল থাকে তাহলে শুধু শুধু বাড়িতে ঢোকার দরকার?কার টানে আসছে?ভূমিকার না তো?
এতোক্ষন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সূচনা সবটা দেখছিলো।সুক্ষ্ম নামের সুদর্শন ছেলেটাকে দেখে তার মুখের রং পাল্টে গেলো।চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।এই মানুষটার জন্যই তো তার ভালোবাসাকে ত্যাগ করতে হলো।আর সে এখন তাদের বাসায় কী করছে?নিশ্চয় এখন তার সাথে কথা বলার সুযোগ খোঁজবে।তাই সূচনা রুমে গিয়ে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানোর নাটক করলো।
কেনো যেনো লোকটার সামনে যেতে তার ইচ্ছে করছে না।খুব রাগ উঠছে ছেলেটাকে দেখে।তাই এখন তার বোনের চেয়ে রাগটাকে বড় করে দেখলো।
।
“মা,সূচি’কে দেখছি না কোথায় ও?”
“ছাদে ছিলো মনে হয়।দাঁড়া আমি গিয়ে দেখছি।”
“না মা।তুমি থাকো,আমি ডেকে আনছি।বসো,সুক্ষ্ম আসছে।”
আমিশা আলম’কে সোফায় বসিয়ে ভূমিকা ছাঁদে গেলো।কিন্তু তাকে ছাঁদের কোথায়ও পেলো না।তারপর রুমে চেক করে দেখে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমে আছে।ভূমিকা মৃদ্যু হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।তারপর ড্রয়িং রুমে সবাই বসে আছে মাথায় আসতেই তাদের সামনে গেলো।
ভূমিকা এসে দেখে ওরা সবাই নাস্তা করছে।ভূমিকা’কে একা দেখে আমিশা আলম বললেন,”সূচনা আসেনি?”
“ও তো রুমে ঘুমাচ্ছে।শরীর খারাপ নাকি মা ওর?”
“সকালে বললো মাথা ব্যাথা।তাই অফিসেও যায়নি।”
“ওহ।”
ভূমিকা আর আমিশা আলমের আলাপ শুনে সুক্ষ্ম বেশ বুঝতে পারছে সূচনা তার সামনে আসতে চাইছে না।তাই তো সে অফিসেও গেলো না।আর ছাঁদে মনে হয় সুক্ষ্মের আসা দেখছিলো তাই লুকিয়ে পড়েছে।কিন্তু মেয়েটা তার থেকে লুকাচ্ছে কেনো?
নাকি সুক্ষ্ম লেবু বেশি টিপে ফেলেছে যে তিতা বের হচ্ছে।এতোদিন ভয় দেখাতে দেখাতে নাকি সূচনা বিষয়টাকে দূর্বল ভাবছে?কে জানে!তবে সুক্ষ্ম এখন আরো বেশি সাবধান হয়ে যাবে।
এসব ভাবনা থেকে বেরিয়ে সুক্ষ্ম আমিশা আলম’কে বললো,”শরীরের খেয়াল রাখছেন তো আন্টি?নাকি ভূমিকা নাই দেখে হেয়ালি করছেন?”
“না না বাবা,আমি ঠিক মতো ওষুধ খাচ্ছি।ওষুধ না খেলে সূচনা লন্ডভন্ড করে ফেলে।”
“হাহাহাহা,যাক তাহলে আন্টি।আমি আসি।”
“সে কি,আরো কিছুটা পরে যেও।”
“না না আন্টি।অফিস থেকে ফিরার সময় ওদের দেখা মিললো।এখন বাড়ি যাবো।মা অপেক্ষা করছে।”
“আচ্ছা বাবা।সাবধানে যাও।”
“দোয়া করবেন আন্টি।”
“ইনশাআল্লাহ।”
তাদের কথা বার্তা শুনে সমুদ্রের মনে হলো অনেক আগে থেকে ওরা একে অপরকে চিনে।কিন্তু সূচনা তো কোনোদিন তাকে সুক্ষ্ম নামের কোনো ব্যাক্তির কথা বলেনি।তাহলে এ কে?
সবার থেকে বিদায় চেয়ে সুক্ষ্ম বেরিয়ে পড়লো।ভূমিকা রুমে এসে কাপড় গোচ্ছিলো।তখন কোথা থেকে সমুদ্র তেড়ে এসে বললো,”সুক্ষ্ম তোমার কে হয়?”
প্রশ্নটা ভূমিকা বুঝলো না।”সুক্ষ্ম তোমার কে হয়?”ভূমিকার মনে হলো এটা অর্থ বিহীন প্রশ্ন।তাই সে বিপরীতে জিজ্ঞেস করলো,”মানে?”
“মানে হলো,সুক্ষ্মের সাথে তোমাদের কী সম্পর্ক?”
“ওহ।সেই অনেক কাহিনী।তবে তার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক নেই।”
“রক্তের সম্পর্ক না থাকলে এতো নাচানাচি কেনো?”
সমুদ্রের কথা শুনে ভূমিকা ভ্যাচকা খেলো।নাচানাচি কখন করলো সে?আর সমুদ্রই বা এতো রেগে আছে কেনো?ভূমিকা সাধারণত সমুদ্রের রাগকে ভয় পায় কিন্তু আজ কেনো যেনো মোটেও ভয় করছে না।ভূমিকা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।তখন সমুদ্র বললো,”কী হলো?কিছু বলছো না কেনো?সুক্ষ্ম…”
“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেনো?সুক্ষ্ম..”
“কীভাবে কথা বলছি আমি?সুক্ষ্মের সাথে এতো ন্যাকামি কেনো?কে হয় ও তোমার?”
“প্লিজ আমাকে বলতে দিন।”
“বলো… ”
সুটকেস থেকে কাপড় বের করে কাবার্ডে রাখতে রাখতে ভূমিকা বললো,”আমার খুব ভালো বন্ধু।”
“শুধু বন্ধু?”
“অনেক ভালো বন্ধু।”
সমুদ্র ভূমিকা’কে টেনে দেয়ালের সাথে আটকে দিয়ে দুহাতে ভূমিকা’র বাহু চেপে জিজ্ঞেস করলো,
“পরিচয় কীভাবে তোমাদের?”
“আশ্চর্য!আপনি এমন বিহেভ কেনো করছেন?”
“বেশি কথা না বলে যা বলছি তার আন্সার দাও।”
“একবছর আগে আমি রিকশা করে কলেজ যাওয়ার সময় একজন মহিলা গাড়িতে এক্সিডেন্ট করতে যাচ্ছিলো।তাকে আমি বাঁচানো পর জানতে পারি উনি মেন্টাল পেসেন্ট।একা থাকতে থাকতে মাহিলাটি ডিপ্রেশনে ডুবে গেছিলো।আর একসময় মেন্টাল পেসেন্ট হয়ে যায়।উনাকে ডাক্তার দেখানো পর বলেন উনার সঙ্গ দরকার।তখন আমার কাছে একজন মানুষের প্রাণ বড় মনে হয়েছিলো তাই আমি উনাকে সঙ্গ দিতে,হ্যাপি রাখতে উনার সাথে থেকেছিলাম।আর প্রায় ছয়মাসের মাথায় গিয়ে মহিলাটি সুস্থ হন।মহিলাটি ছিলেন সুক্ষ্মের মা।”
“উনি একা কেনো থাকতেন?সুক্ষ্ম,উনার স্বামী বা মেয়ে?”
“একটা এক্সিডেন্টে সুক্ষ্মের ১৬বছরের বোন আর বাবা দুজনে মারা যায়।তাই বিজনেসের জন্য সুক্ষ্ম বাড়িতে থাকতে পারেনা।কিন্তু তার মায়ের দেখাশোনার জন্য একজন কে রেখেছিলো।তবে কোনো লাভ হয়নি কারণ উনার আপন কারো দরকার ছিলো।আর উনি আমাকে নিজের মেয়ে মনে করেন।তখন থেকে সুক্ষ্ম আমার ভালো বন্ধু।”
“ওহ।”
সমুদ্র ভূমিকাকে ছেড়ে দিয়ে হিসেব মিলাতে লাগলো।তারপর ভূমিকাকে বললো,”আজ থেকে সুক্ষ্ম’কে ভাই বলে ডাকবে।”
“এ্যাহ?ভাই?”
“হুম।”
সমুদ্রের কন্ডিশনের আগামাথা ভূমিকা বুঝলো না।সুক্ষ্ম’কে ভাই কেনো বলতে হবে?কিন্তু সেই প্রশ্নটা সমুদ্রকে করার মতো দুঃসাহস ভূমিকা করলো না।সে চুপচাপ নিজের কাজে মন দিলো।
।
ভূমিকা’কে দেয়ালের সাথে আটকিয়ে সমুদ্রের কথা বলার দৃশ্যটা দরজা’র ফাঁক দূর থেকে সূচনা দেখেছে।ভূমিকা’কে সমুদ্রের এতো কাছাকাছি দেখে সূচনা’র কষ্ট হচ্ছে।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো তার বুকে কেউ আঘাত করেছে।সূচনা নিজেকে বকছে,কী দরকার ছিলো ওদের বিয়ে দেওয়ার?মিথ্যা হলেও তো সমুদ্রকে পেতো।ঠোঁট কামড়িয়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করছে সূচনা।অভি তো তার চোখ থেকে জরছে বিনা বাঁধায়।সব সুক্ষ্মের জন্য হয়েছে।সে যদি তাকে ব্ল্যাকমেইল না করতো তাহলে কিছুতেই বিয়ে দিতো না।
সূচনার ফোন বেজে উঠলো।মোবাইলের ওয়ালপেপারে “আননোন” নামটা ভাসছে।সূচনা অনিচ্ছার সত্ত্বেও চোখের জল মুছে কল রিসিভ করলো।তখন ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
“চটপটি,তুমি আমার সামনে আসতে চাওনি কেনো?পালাচ্ছো কেনো আমার থেকে?”
“পালাবো কেনো আমি?আজকে মাথাব্যথা ছিলো ম্যানেজার’কে তো জানালাম…”
“সেটা তো মিথ্যা বললে চটাপটি।আজকে যে আমি তোমাদের বাসায় গেলাম সেটা জানো তো?”
“আমাদের বাসায় কেনো আসলেন?”
ওপাশ থেকে সুক্ষ্ম হু হু হেসে উঠলো।সূচনা বুঝছে না হাসার মতো সে কী এমন বললো?তখন বিষয়টা সুক্ষ্ম ক্লিয়ার করলো,”তারমানে তুমি জানো যে আমি তোমাদের বাসায় আসছিলাম।”
“বাজে কথা না বলে কেনো কল করেছেন সেটা বলেন।”
“তেমন কিছু না।এমনি কল করলাম।আজ কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কথা নেই।”
“ওকে।বাই,”
“একমিনিট সূচনা,তুমি কী কাঁদছো?”
কথাটা শুনে সূচনার চোখ থেকে আবারো জল গড়িয়ে পড়লো।সুক্ষ্মের কল সে কেটে দিলো।এখন সে একা থাকতে চায়।একদম একা!উঁহু,সাথে তার চোখের জলও সঙ্গী হবে।
এভাবে কল কেটে যাওয়ায় সুক্ষ্ম বুঝতে পারলো সূচনার অবস্থা।মেয়েটা দিনদিন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে।আগের মতো বকবকও করেনা।সুক্ষ্ম ডুব দিলো তার সাথে সূচনার প্রথম কখন দেখা হয়েছিলো।
ভূমিকা’কে তাদের বাড়িতে ড্রপ করতে এসে দেখে ভূমিকা’র মতোই দেখতে একটা মেয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে পাগলের মতো এলোমেলো নাচছে।মেয়েটার মনে যেনো আনন্দের ঢেউ উঠেছে।সুক্ষ্ম ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো মেয়েটা লং স্কার্ট’কে লুঙ্গির মতো পরেছে।আর সাথে টি-শার্ট।সেই এলোমেলো দেখা মেয়েটাকে নিয়ে সুক্ষ্ম সেদিনই স্বপ্নের রাজ্যের পাড়ি দে।তবে যখন জানতে পারে মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড আছে তখন সুক্ষ্ম নিজের অনুভূতি আটকানোর চেষ্টা করে।কিন্তু অনুভূতি কী কারো গোলাম?সে অবাধ্য,অবাধ্য অনুভূতি!
[চলবে]