গল্প : অবশেষে | পর্ব : নয়/শেষ পর্ব
বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে দিয়া। পরনের লেহেঙ্গা দু’হাতে আগলে ধরে এক পা এক পা ফেলে এগোচ্ছে আর পিছন ফিরে তাকাচ্ছে সে। তার থেকে হাত দশেক দূরে দূরে হাঁটছে রোদ। মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে ডাকছে, এই, দাঁড়া। ভালো হবে না কিন্তু। দিয়া, দাঁড়া।
এমনিতেই সূ্র্যটা মাথার উপর। অসহ্য গরম লাগছে। তার উপর গায়ে জড়ানো ভারী পোষাক। দিয়ার গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। দিয়া এক আধবার কপালের ঘাম মুছে নিয়ে এদিক ওদিক দেখে নিচ্ছে। আশপাশের লোকজন উৎসুক ভঙ্গিতে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। তাকানোই স্বাভাবিক। বিয়ের সাজে সজ্জিত একটি মেয়ে ছুটছে এবং তার পিছু নিয়েছে একটি সুদর্শন যুবক। এ-দৃশ্য নিঃসন্দেহে প্রথমবার দেখছে ওঁরা।
রোদ আবার ডাকল, আরে কথা তো শুনবি, না কি? একটু দাঁড়া। এভাবে পালিয়ে কতটা পথ যেতে পারবি বল তো?
কথা সত্য। এভাবে ছুটে ছুটে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়। এখনই হাঁফ ধরে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। এই মুহূর্তে এক গ্লাস পানি প্রয়োজন। কিন্তু না, থামা যাবে না। দিয়া ছুটে। ছুটতেই থাকে। রাস্তার দু’পাশের মানুষ তীব্র আগ্রহ নিয়ে সেই দৃশ্য দেখে। কেউ কেউ আড়ালে কাউকে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলে, দ্যাখ, মাইয়্যাডা ভাগতাছে।
অন্যজন বলে, তয় পোলাডা ক্যাডা? ওয় মাইয়্যার পিছে ভাগতাছে ক্যা?
এবার রোদ দৌড়ে এসে দিয়ার পথ আটকে দাঁড়ায়। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে, একটু পরে আমি তো জামাই হব। কিছুটা সম্মান দে! এভাবে ইগনোর করে আগে আগে ছুটলে হবে? আমার হাত ধর। একসাথে পালাই।
ইশ! জামাই হবে! বিয়ে করলে তো! দিয়া মুখ ভেঙচিয়ে বলে।
বিয়ে করবি না? তুই করবি তোর বাপ করবে।
তাহলে যাও। বাবাকে বিয়ে করো গিয়ে।
এই মুহূর্তে মজা করতে পারছিস দিয়া? তুই আমাকে ঠিক বিপদে ফেলবি। বলে পকেট থেকে ফোন বের করে রোদ। এক হাত দিয়ে দিয়াকে ধরে রাখে। অন্য হাত দিয়ে স্মার্টফোন।
হ্যালো, রবিন?
হ্যাঁ, বল।
একটা হেল্প লাগবে দোস্ত। এজন্য ফোন করেছি।
জানি জানি। বিপদে না পড়লে আমাদের কথা মনে পড়ে না। বিপদে পড়েছিস বলেই ফোন দিয়েছিস।
বাজে কথা রাখ। কাজের কথা বলি।
বকো।
একজন কাজী যোগাড় করে দিতে পারবি?
ওরে-বাবা! ঘটনা কী রে? সি-ধা কাজী? মেয়ে পেলি কই?
মেয়ের চিন্তা তোকে করতে হবে না। মেয়েকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছি। তুই শুধু কাজী যোগাড় কর। আর হ্যাঁ, সাক্ষীও লাগবে।
সে-সব হবে মামা। কিন্তু…
কিন্তু কী? ট্রিট তো? পাবি।
উঁহু। ট্রিট তো দিবিই। আর কিছু…
আর কিছু মানে?
দোস্ত। সোজা সাপটা বলি। তোর পুরনো বাইকটা আমার লাগবে।
বিপদে পড়েছি বলে স্বার্থ উদ্ধার করে নিচ্ছিস? তবে মনে রাখিস, এক মাঘে শীত যায় না।
তাহলে বাইকটা দিচ্ছিস?
ভেবে দেখব। তুই আজকেই কাজী আর সাক্ষী নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে আয়।
ওক্কা দোস্ত। যো হুকুম।
সন্ধ্যার আগে আগে ওঁদের বিয়েটা হয়ে যায়। চড়ুই পাখির মতো সারাক্ষন এখানে ওখানে লাফিয়ে বেড়ানো দিয়া কেমন যেন শান্ত হয়ে যায়। তার চঞ্চল চোখদু’টো স্থির হয়ে আসে। গভীর রাতে নিঃস্তব্ধ বেলকনিতে একা একা দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবে আর আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দিয়া। দূর আকাশে ভেসে বেড়ানো গোলাকার চাঁদটাও বুঝি তার মতোই একা!
রোদ কখন দিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল নেই। যখন রোদের আঙুলগুলো দিয়ার কপালের চুল সরিয়ে দেয়, তখন দিয়া মৃদু কেঁপে উঠে রোদের মুখের দিকে তাকায়। রোদ মুখ বাঁকিয়ে বলে, খুব তো বাড় বেড়েছিলি। আমাকে তুই করে বলেছিস। গালি দিয়েছিস। এবার কী শাস্তি দেব বল?
দিয়া কোমল গলায় বলে, শাস্তি? সে তো আমি পেয়েই গেছি।
ও-কী-রে! কখন দিলাম?
আমাকে আমার মা-বাবার কাছে থেকে কেড়ে আনলে। এটা কি শাস্তির পর্যায়ে পড়ে না?
দূর! সব মেয়েই তো একসময় তার ভালোবাসার মানুষের কাছে যায়।
দিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তা যায়। তবে মেয়েদের প্রথম ভালোবাসা তাদের মা-বাবা। যারা তাকে জন্ম দেয়। কোলেপিঠে করে মানুষ করে। কথা বলতে শিখায়। হাঁটতে শিখায়। বাঁচতে শিখায়। ঘটনাক্রমে হয়তো একসময় সব মেয়ের জীবনেই কোনো এক সুপুরুষ আসে। তবে সেটা মেয়েদের জন্য যেমন সুখকর তেমনি কষ্টদায়ক। সারা জীবনের ভালোবাসার মানুষদের ছেড়ে আসাটা এক ধরণের শাস্তিই। সেটা কোনো পুরুষ কখনো বুঝবে না।
বা-বা! রাজকন্যার মুখে বুলি ফুটেছে! কিন্তু তোর এসব কথা আমি মানি না। তোকে শাস্তি দেব মানে দেব।
দিয়া ঠোঁট উল্টে বলে, কচু! শাস্তি পাবার জন্য বিয়ে করেছি নাকি?
ও-তাই! তবে কেন বিয়ে করেছিস শুনি?
দিয়া মুখ টিপে হাসে। রোদ ভ্রু কুঁচকে বলে, খুব দুষ্টু হয়েছিস, না? নটি গার্ল!
দিয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে। রোদ একটু এগিয়ে যায়। আরো একটু এগোয়। শেষমেশ দিয়ার চুলের ঘ্রাণ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, শাস্তিটা তোকে পেতেই হবে। যতই ধানাই পানাই করিস না কেন। আজ তোর রক্ষে নেই।
রোদের বুকে আলতো ধাক্কা দিয়ে ভেতরের ঘরে চলে যায় দিয়া। কে জানে কেন, তার বুকে আজ উত্তাল ঢেউ। ঘন ঘন নিঃশ্বাস কিছুতেই শান্ত হতে চাইছে না। শত কষ্টের মাঝেও ঠোঁটে হাসি লেপ্টে আছে। রোদ হঠাৎ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে, শাস্তিটা তবে দিয়েই দেই। কী বলিস?
সমাপ্ত।