গল্প : অবশেষে | পর্ব : পাঁচ
কিন্তু এই সিক্রেট রুমের কী দরকার ছিল?
দিয়ার প্রশ্নের জবাবে রোদ মুচকি হাসে শুধু।
এই ঘরটা বিশাল বড়ো। গাদাগাদি জিনিসপত্র এলোমেলো করে রাখা। বেশিরভাগ জিনিস ফেলনা, নষ্ট। সেগুলো কোনো রকম কাজে আসবে বলে মনে হয় না। দিয়ার দৃষ্টি আটকায় মেঝেতে পড়ে থাকা গোলাকার স্টিলের বাক্সটার উপর। দিয়া সেটা হাতে তুলে নেয়। বলে, এটা কী জিনিস?
জিনিস বলিস না। এটা একটা বাক্স। স্পেশাল বাক্স। স্পেশাল কেন জানিস?
কেন? দিয়া সচকিত প্রশ্ন করে।
রোদ দম নিয়ে বলে, এটা দিয়ে তুই আমাকে আঘাত করেছিলি। তোর হয়তো মনে নেই। তখন আমরা খুব ছোটো ছিলাম। আমার কপালে যে দাগটা দেখছিস… বলে কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে বহু পুরনো কাটা দাগ দেখায় রোদ।
এই এখানটায় ছুঁড়ে মেরেছিলি। কেটে গিয়েছিল অনেকখানি।
দিয়া অপরাধবোধে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ছোটোবেলা সে রোদকে আঘাত করেছে! ভাবতেই অবাক লাগে। এই প্রতিশোধ-ই বোধহয় নিচ্ছে রোদ। ভালোবেসেও বাসছে না। নানান ছুতো করে শাস্তি দিচ্ছে। আর…
এ-ঘরে জানালা নেই। ফ্যানও নেই। গাদাগাদি জিনিসপত্র কেমন যেন গন্ধ ছড়াচ্ছে। গরম লাগছে খুব। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। দিয়ার গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। পরনের হালকা নীল জামার পিঠের দিকে, বগলের নিচে আরও বিভিন্ন জায়গায় ভিজে জবজবা হয়ে আছে। অস্বস্তি লাগছে। এই মুহূর্তে কাপড়গুলো বদলে ফেলতে পারলে ভালো হত।
এই জুতোজোড়া কার? দিয়া প্রশ্ন করে।
খুব ছোটো ছোটো একজোড়া জুতো হাতে তুলে নেয় রোদ। জুতোজোড়া কোলে নিয়ে বলে, এগুলো তুই পরতি। তখন তোর বয়স তিন বছর।
আর এই কানের ঝুমকো? এই নূপুর? এই চুড়িগুলো? আর এই ওড়না? এরকম ওড়না তো আমারও ছিল। কয়েকদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছি না।
রোদ মাথা নিচু করে বলে, সবকিছু তোরই। আমি চুরি করেছি।
চলে আসার সময় এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দেয় রোদ। দিয়া কাগজ হাতে নিয়ে বলে, এটা কী?
চিরকুট। সময় করে পড়ে নিস।
দিয়া সঙ্গে সঙ্গে কাগজের ভাঁজ খুলতে যাচ্ছিল। রোদ বাধা দিয়ে বলে, এখন না। বাসায় গিয়ে পড়বি। স্পেশাল। বলে চোখ টিপ দেয় রোদ। দিয়া মৃদু হেসে বেরিয়ে আসে।
বাসায় এসে ভাবতে বসে যায় দিয়া। চিঠিটা এখন পড়বে? না কি গভীর রাতে পড়লে ভালো হবে? কী আছে এই চিঠিতে? রোদ তো দিয়াকে ভয় পায় না। যা বলার, দিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলে ফেলতে পারত। তবে চিঠি লিখতে গেল কেন?
ভাঁজ করা কাগজের টুকরোটা বালিশের নিচে রেখে বাথরুমে চলে যায় দিয়া। লম্বা সময় শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। বেরিয়ে এসে বই পড়ে। বিছানায় গড়াগড়ি খায়। উদ্বেগ কাটে না। কী আছে চিঠিতে?
রাত বারোটায় বালিশের নিচ থেকে চিঠিটা বের করে আনে দিয়া। কাগজের ভাঁজ খুলতেই আরো এক টুকরো কাগজ পড়ে যায়। সেই ছোট্ট কাগজে বড়োবড়ো অক্ষরে লেখা, ভুল বুঝিস না।
আশ্চর্য! ভুল বুঝবে কেন?
সব চিন্তা বাদ দিয়ে মূল চিঠি পড়তে শুরু করে দিয়া।
প্রিয় বউ,
স্যরি, তোকে বউ বলেই সম্বোধন করলাম। এজন্য ক্ষমা চাই। কিন্তু কী জানিস, তোকে আমার বউ বলে ডাকতেই ভালো লাগে। তাই ডাকলাম। মন খারাপ করিস না। লক্ষ্মী বউ!
তোর আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেই ছোটোবেলায়। তখন অতশত বুঝতাম না। শুধু পরিবারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, একদিন তুই আমার বউ হবি।
ভালোবাসার মানে তখন মা-বাবা আর বুড়ো দাদু। কিন্তু একদিন, হঠাৎ একদিন। স্যরি, দিন নয়, রাত। এক রাতে যখন তুই বিপদে পড়েছিলি, তখন তখন আমিই তোকে সাহায্য করেছিলাম। সেদিন রাত ন’টায় কোচিং শেষে বাসায় ফিরছিলি। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। অবশ্য, তোর সঙ্গে ছাতা ছিল। বৃষ্টির জল তোকে ছুঁতে না পারলেও একদল বখাটে ছুঁতে চেয়েছিল তোর নরম শরীর। ভোগ করতে চেয়েছিল তোকে। সেদিন ঠিক সময়ে যদি সেখানে উপস্থিত না হতাম, তবে হয়তো…
পরদিন আমিই ওই কোচিং সেন্টার বন্ধ করিয়েছিলাম। রাত ন’টা পর্যন্ত কোচিং। মেয়েদের সেইফটি কে দেবে? কোচিংয়ের এক স্যার এলোমেলো যুক্তি দিচ্ছিল। সেদিন ইয়া বড়ো ইট স্যারের মাথায় মেরেছিলাম। তারপর তোর হাত ধরে ভোঁ-দৌড়!
সেদিনের কথা আজও মনে পড়ে। তখন তুই ক্লাস এইটে পড়িস। আর আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। সেদিন তোর হাত ধরে পালানোর সময়ের অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার মতো না। বিশ্বাস কর, সেদিনের অনুভূতি আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। সেদিন প্রথমবার মনে হয়েছিল, আমি তোকে ভালোবাসি।
এটুকু পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে দিয়া। তার হাত কাঁপছে। পা কাঁপছে। বুক কাঁপছে। চোখের কোলে বিন্দু বিন্দু জল। এ-অশ্রু আনন্দের। দিয়া লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে চিঠির বাকি অংশ পড়তে শুরু করে।
তবে তোর ফেলনা জিনিসপত্র একদম ছোটোবেলা থেকেই সংগ্রহ করে রাখতাম। তোর ছেঁড়া জুতো, আধ-খাওয়া ললিপপ, পুরনো ফ্রক এইসব। কিন্তু সেদিনের পর থেকে তোর জিনিসপত্র চুরি করতে শুরু করেছিলাম। সেসব চুরি করে জমানো জিনিসপত্র একটা গোপন ঘরে রেখে দিয়েছি। আমার সিক্রেট রুমে।
কিন্তু ইদানীং খুব দ্বিধায় ভোগছি, জানিস? আমি কিন্তু আজও তোকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা কীরকম, তা জানি না। তবে বাসি। এটাই সত্যি। তবে দ্বিধা হচ্ছে অন্য জায়গায়। আমাদের বিয়ে নিয়ে আজকাল খুব বলাবলি হচ্ছে জানিস তো? দুই পরিবারই চাচ্ছে বিয়েটা যত দ্রুত সম্ভব হয়ে যাক। কিন্তু বিয়ের কথা উঠতেই আমার খারাপ লাগা শুরু হয়। মনে হয়, কেউ আমাকে খাঁচায় বন্দি করতে চলেছে।
আশা করি বুঝতে পারছিস, কী বলতে চাচ্ছি। তুই বুদ্ধিমতী মেয়ে। সব বুঝিস, জানিস। আমার মনের ব্যাপারটাও বুঝবি। আমি তোকে সত্যি ভালোবাসি। তবে এখনি বিয়ের কথা ভাবতে পারছি না। কতদিন পর বিয়ের কথা ভাবতে পারব তা-ও জানি না। তবে আমার মনে হয়, তোর অন্য কাউকে বিয়ে করে নেওয়া উচিত। কেন শুধু শুধু আমার মতো একজনের জন্য অপেক্ষায় থাকবি?
ভুল বুঝিস না, লক্ষ্মী বউ। আবার বউ ডাকলাম। ক্ষমা করে দিস। তুই ভালো থাক এ-ই আমি চাই।
ইতি,
তোর বর।
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুজল পড়ে হাতের চিঠিটা ভিজে যাচ্ছে। দিয়ার বুক দুরুদুরু করছে। নিঃশ্বাসে কাঁপন। শরীর এতটাই দুর্বল, নড়াচড়া অবধি করতে পারছে না। দিয়া এভাবে শক্ত পাথরের মতো বসে থাকে প্রায় এক ঘন্টা। বাথরুমে গিয়ে মুখে এক ঝাপটা পানি মেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সে কি দেখতে খারাপ? কিন্তু সবাই যে বলে দিয়ার মতো সুন্দরী এ-এলাকায় একটাও নেই! বাবা বলেন দিয়ার মতো সুন্দরী পুরো সিলেটে দ্বিতীয়টি নেই!
দরজায় দাঁড়িয়ে ধরা গলায় ডাক দেয় দিয়া, বাবা, ও-বাবা!
কী রে, এখনও ঘুমাসনি? বাবা ঘুম জড়ানো চোখে বলেন।
আমি বিয়েটা করছি না বাবা। দিয়া গম্ভীর গলায় বলে।
কেন রে? রোদের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?
না, ঝগড়া হয়নি। ওঁকে আমার পছন্দ না। তুমি অন্য কাউকে দ্যাখো। আমি এ-মাসেই বিয়ে করব।
চলবে