অবশেষে পর্ব-০৩

0
1721

গল্প : অবশেষে | পর্ব : তিন

এদিক ওদিক তাকিয়ে চারপাশ দেখে নেয় দিয়া। রাস্তার দু’পাশে বিদীর্ণ ফসলি জমি। দূর দূর পর্যন্ত জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। এই মুহূর্তে চিৎকার দিলে কেউ শুনবে না। কেউ বাঁচাতে আসবে না তাকে।

মাঝবয়েসি লোকটা বলে, ও-ম্যাডাম! কী এত ভাবছেন? থানায় নিয়ে যাবার কথা বলিনি। সামনেই আমার বাসা। আপনাকে বাসায় নিয়ে যাব। সকালে ঘুম থেকে উঠে যেখানে খুশি চলে যাবেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।

কী করবে ভেবে পায় না দিয়া। লোকটা ধীরে ধীরে একদম কাছাকাছি চলে আসে। আর তখনই সাঁই করে ছুটে আসে কালো গাড়িটা। ব্রেক কষতেই রোদ বেরিয়ে আসে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, গাড়িতে বোস।

দিয়া বাধ্য মেয়ের মতো গাড়িতে গিয়ে বসে। রোদ মাঝবয়েসি কালো, মোটা লোকটার সঙ্গে অনেক্ষণ কথা বলে কিছু টাকা লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়িতে বসে। সামান্য শব্দ তুলে চলতে শুরু করে গাড়িটা। কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। ড্রাইভার এক মনে গাড়ি চালায়। রোদ চুপচাপ বসে থাকে। দিয়া অপেক্ষা করে। সে যে পালানোর চেষ্টা করেছিল, এর শাস্তি এখনও পাওয়া হয়নি। রোদ অত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। একটা না একটা শাস্তি তো দেবেই। কিন্তু কীরকম শাস্তি দেবে? ভাবতেই দিয়ার গা কাঁটা দিয়ে উঠে। কান ধরে উঠবস করা কিংবা এ-জাতীয় কিছু হলে অনায়াসে মাথা পেতে নেওয়া যেত। কিন্তু রোদ অদ্ভুত সব শাস্তি আবিষ্কার করে। গতবারের কথাই ধরা যাক না! রোদ শাস্তি হিসেবে বলেছিল, কাপড় খোল!

অসভ্য! কথাটা অজান্তেই দিয়ার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

দিয়ার কখন ঘুম লেগেছিল খেয়াল নেই। তবে হঠাৎ চোখ খুলে আবিষ্কার করল, তার মাথাটা রোদের কাঁধের উপর ঝুঁকে আছে। অজানা এক অনুভূতিতে আপাদমস্তক কেঁপে উঠে তার। সে দ্রুত রোদের থেকে দূরে সরে গিয়ে বসে। পরক্ষণেই খেয়াল করে, রোদ ঝিমাচ্ছে। ঝিমাতে ঝিমাতে একসময় রোদের মাথাটা দিয়ার কাঁধের উপর ঝুঁকে পড়ে। অস্বস্তিতে দিয়ার পুরো দেহ কেঁপে কেঁপে উঠে। কালো গাড়িটা দ্রুত গতিতে ছুটে চলে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ওঁরা?

সিলেট থেকে নারায়নগঞ্জ।
লম্বা সময় ছুটে চলার পর গাড়িটা মৃদু শব্দ করে থেমে যায়। ড্রাইভার হাই তুলে বলে, আইসা পড়ছি ভাবি। ভাইজানরে ডাইকা তুলেন।

রোদ তখন দিয়ার কাঁধে মাথা রেখে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। দিয়া রোদের গালে আলতো হাত রেখে ডাক দেয়, শুনছো? চলে এসেছি।

রোদ চোখ কচলে তাকিয়ে বলে, চলে আসছি?
ড্রাইভারকে বলে, নারায়নগঞ্জ চলে আসছি?

ড্রাইভার মাথা নেড়ে জবাব দেয়, জি ভাইজান, নারায়নগঞ্জ।

রোদ আর দিয়া গাড়ি থেকে নামতেই কালো গাড়িটা সবেগে ছুটে যায়। রোদ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে, ক’টা বাজে রে?

দিয়া ঘড়ি দেখে বলে, একটা তেইশ।

অন্ধকারে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা বাড়িটার দোতলায় উঠে ডোরবেল চাপে রোদ। কিছুক্ষণ পর লুঙ্গি পরা মাঝবয়েসি একজন দরজা খুলে দেন। রোদকে দেখে বলেন, দূর মিয়া, এখন আইলা! দাওয়াত দিলাম মিয়া তিন দিন আগে। বিয়া দশটার মধ্যে শেষ হইছে। আর তুমি মিয়া রাইতের একটায় আইছো!
হঠাৎ দিয়ার দিকে চোখ পড়তেই বলেন, ভাবি নাকি?

রোদ মাথা নেড়ে জবাব দেয়, হ্যাঁ। আমার বউ।
দিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, দিয়া, ইনি আমার অফিসের প্রোপ্রাইটার। আজ উনার মেয়ের বিয়ে ছিল। আমরা লেট করে ফেলেছি।

ভদ্রলোক দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলেন, আসেন ভাবি, আসেন। রোদ, তুমিও আসো।

তারা দু’জন যেহেতু স্বামী-স্ত্রী তাই তাদেরকে এক ঘরে থাকতে দেওয়া হয়। দিয়া আগ বাড়িয়ে বলে, আমি ফ্লোরে ঘুমাতে পারব। তুমি বিছানায় শুয়ে পড়ো।

দিয়া যখন উদাম টাইলসে কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে বেঘোরে ঘুমায়, তখন রোদ কী যেন ভেবে উঠে দাঁড়ায়। একটা মেয়ে তার সামনে এতটা কষ্ট করবে তা সে কোনোভাবেই চোখে দেখতে পারবে না।

রোদ যখন কোনোকিছু না বলেই ঘুমন্ত দিয়াকে কোলে তুলে নেয় তখন রোদের স্পর্শ দিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। তবে সেটা রোদকে বুঝতে দেয় না। চুপচাপ ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে রাখে। রোদ দিয়াকে কোলে রেখেই বিড়বিড় করে বলে, পালাইছিলি না? তোর জন্য পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এর শাস্তি তুই পাবি।

দিয়া মনে মনে বলে, এখনই দাও! এখনই দাও! আজ যা শাস্তি দেবে, মাথা পেতে নেব।

রোদ আস্তে করে দিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে, মেয়ে মানুষের চুলের ঘ্রাণ এত মারাত্মক হয়! বাবারে বাবা, নেশা লেগে যায়। উফ্!

পরদিন তারা চলে আসার সময় রোদের অফিসের প্রোপ্রাইটার ভদ্রলোক বলেন, তুমি মিয়া মেজাজ খারাপ কইরা দিছো। আমার একমাত্র মাইয়্যার বিয়া। তোমারে তিনবার দাওয়াত দিছি। তা-ও তুমি সময়মতো আইলা না। ভাবিরে নিয়া আইছো বইলা কিছু কইলাম না।

এবার দিয়া বুঝতে পারে, কেন তাকে বউ সাজিয়ে নিয়ে এসেছে রোদ। যাতে দেড়ি করায় বকা শুনতে না হয়।

বিকেল চারটা নাগাদ সিলেটে পৌঁছে তারা। রোদের চোখদু’টো টকটকে লাল। গতকাল শেষরাতে আর ঘুমায়নি সে। জেগে ছিল। দিয়ার চারপাশে ঘুরঘুর করছিল আর একটা দুইটা মশা দিয়ার গায়ে বসলে সেগুলোকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল। ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকা দিয়া এই ভেবে অবাক হচ্ছিল যে, রোদ এতটা যত্নশীল! এতটা আগলে রাখতে জানে সে!

ছ’মাস পরের কথা।
শীতের সকালে প্রাতঃস্নান সেরে দোতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়েছে দিয়া। তখনই লোহার গেট ঠেলে বাড়িতে প্রবেশ করে রোদ। দিয়া আপনমনে চুল শুকাতে শুকাতে নিজের ঘরে প্রবেশ করে। ইদানীং রোদকে দেখলেই কী যেন হয়ে যায় তার। আগে অতটা এমন হত না৷ আজকাল হয়। ওঁদের বিয়েটা বুঝি বেশি দেড়ি নেই। দুই পরিবার আড়ালে আড়ালে বিয়ের সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। সেদিন তো বাবা দিয়াকে ডেকে বললেন, তোরা যে হারে ঘুরে বেড়াস। রাত নেই দিন নেই যখন ইচ্ছে রোদের বাসায় চলে যাস। এটা কি দশজনে ভালো চোখে দেখে? একদিন তো নারায়নগঞ্জ থেকেও ঘুরে এসেছিস। এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। একবার বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর যা খুশি করিস।

রোদ দিয়ার ঘরে প্রবেশ করেই চমকে উঠার ভান করে বলে, উরিব্বাস! সকাল আটটায় গোসল করছিস! এই শীতের সকালে গোসল! ব্যাপার কী রে, হুম? বল? বল?

দিয়া লাজুক ভঙ্গিতে বলে, গোসল করতে ব্যাপার লাগে নাকি?

রোদ দিয়ার একদম কাছে এসে চুলের ঘ্রাণ শুঁকে বলে, আহ্! কী ঘ্রাণ রে বাবা!
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোদের হাতটা যখন শাড়ির ফাঁক দিয়ে দিয়ার পেট স্পর্শ করে, তখন দিয়া মৃদু কেঁপে একটু দূরে সরে যায়। রোদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে চলে যাবার উদ্যোগ করে। তখন তার হাত ধরে ফেলে দিয়া। আস্তে করে টেনে তার পেটের কাছে রোদের হাত চেপে ধরে। যেখানে রোদ ভুল করে স্পর্শ করেছিল, সেখানেই। হঠাৎ দিয়ার কণ্ঠ কেমন যেন পাল্টে যায়৷ সে সম্পুর্ণ অন্যরকম গলায় বলে, ভালোবাসো?

রোদ প্রশ্ন এড়িয়ে বলে, পাগলামো করিস না দিয়া। হাত ছাড়।

ছাড়ব না। আগে বলো, ভালোবাসো কি না?

রোদ ছোটো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, হাত ছাড় দিয়া!

ছাড়ব না। ছাড়ব না। আগে জবাব দাও। ভালো যদি না-ই বাসো তবে বিয়ে করবে কেন? বলো?

রোদ ধমক দিয়ে বলে, এক চড় মারব! হাত ছাড়!

ধমক শুনে অবাক কান্ড করে বসে দিয়া। রাগে ফুঁসতে থাকা রোদের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।

চলবে
মো. ইয়াছিন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে