#অবশেষে তুমি আমি~৪,
?️Chhamina Begam
-“কি হলো দাড়িয়ে আছ কেন ? বসো ”
-“না ঠিক আছে আব্বু ”
বাবা-চাচার সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে শাওন । ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর আব্বু । শাওন একটা শুকনো ঢোক গিলে আসন্ন পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে । বড়োদের মুখের ওপর কথা বলার অভ্যাস ওদের পরিবারের কারোই নেই । কিন্তু আজ চুপ থাকলে হয়তো ইহজীবনের সব থেকে বড় ভুলটা ওই করবে । মনে মনে কিছু কথা সাজায় শাওন আব্বুকে বলার জন্য । সব শেষ হওয়ার আগে একবার শেষ চেষ্টা তো করতেই হবে । আব্বু চাইলেই সব কিছুর সমাধান সম্ভব । রোজাকে পাওয়ার জন্য যদি একবার আব্বুর হাতের থাপ্পর খেতে হয় তবে সে হাসি মুখেই সেই থাপ্পর খাওয়ার জন্য প্রস্তুত । কিন্তু ব্যাথা …অজান্তেই শাওনের বাঁ হাতটা ওর গালে পৌঁছে যায় । ছোট চাচার ডাকে শাওন ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে,
-“শাওন , কি ভাবছিস ?”
-“কিছু না চাচা , এমনি ”
– “শাওন আমরা আমরা যা শুনলাম তা কি সত্যি ? ..দাদুর কণ্ঠস্বর শুনে মাথা তুলে তাকায় শাওন। তারপর কিছু না বলে মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানায় ।
– “কত দিন থেকে চেনো তাকে ? ”
-“আমরা একসঙ্গেই পড়ি দাদু ”
-“দেখেছেন আব্বা , সাহস কত বড় ছেলের !এই, তোমাকে আমি শহরে কেন পাঠিয়েছি ? পড়াশোনা করতে নাকি প্রেম করতে? ছেলে বড়ো হয়ে নাকি বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে । কিন্তু তুমি তো আমার সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছ ! ” মেহেতাব সাহেবের গম্ভীর স্বরে পুরো বাড়ি গমগম করে ওঠে ।
– “তোমাকে আগেই বারণ করেছিলাম দাদা ,এতদূর ভর্তি না করাতে । সেখানে কেউ শাসন করার মতো লোক নেই জন্য উচ্ছন্নে গেছে । এই তো সেদিন মইনুলদা দোকানে আলোচনা করছিল তার ছেলে নাকি শাওনকে একটা মেয়ের সাথে দেখেছে শহরে। বাড়ি এসে সে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিল । ”
একটু থেমে মেজ চাচা আবার বলা শুরু করেন,
-” তোমার জেদের জন্য আমরা তোমাকে শহরে পাঠিয়েছি আর তুমি ওখানে ফুর্তি করে আমাদের নাক কাটানোর ব্যবস্থা করছ ! “..
মেজ চাচার কথায় শাওন অসহায় বোধ করে । কি বলবে ও ?সাজানো কথা গুলো আবার জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আম্মু-চাচিদের কাছ থেকে তো সাহায্যের আশা করা বোকামি । কেউ ওর বাবার ওপর একটা কথাও বলবে না । শাওন একবার মাথা তুলে ছোট চাচার দিকে তাকায় এই আশায় যে তিনি হয়তো ওর স্বপক্ষে কিছু বলবেন? দেখে চাচা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে ।তার দৃষ্টি বলছে তিনি সেফ জোনে থাকতে চান। আজ মনে হয় ছোট চাচাও ওর সঙ্গ দেবে না ।
-” আমার এই এলাকায় একটা সম্মান আছে । তুমি তো আমাদের নাক কাটার সব বন্দোবস্ত করে রেখেছ !এবার তুমি বলো কি করা উচিত তোমার সঙ্গে ? সমাজের এই সব সমস্যায় লোকে আমাকে ডাকে সালিশির জন্য । কিন্তু এখন লোক আমার দিকেই আঙ্গুল তুলবে । লোকে তো এটাই বলবে যে নিজের বাড়ির মানুষের সুশিক্ষা দিতে জানে না সে একটা সমাজের কর্মকর্তা হয় কি করে ? ”
মেহেতাব সাহেবের গলায় আক্ষেপ ঝরে পরে । শাওন আহত হয় আব্বুর কথায় । নিজেকে অপরাধী মনে হয় । কিন্তু মনের ওপর যে জোর চলে না । সে তো তার ইচ্ছে মতো চলতেই পছন্দ করে ।
-” আহ, মেহেতাব । কি হচ্ছে ? তোরা দুজন তো ওকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে দিচ্ছিস । ওকেও কিছু বলার সুযোগ দিবি নাকি তোরা শুধু নিজেরাই বলবি ? ” শাওনের দাদু আবদুল্লাহ সাহেব ছেলের আচরণে বিরক্ত বোধ করেন । ওনার ধীর অথচ দৃঢ় কন্ঠস্বর শুনে সবাই চুপ হয়ে যায় । তারপর শাওনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করেন ,
-” কিরে ,তুই কিছু বলবি ? ”
দাদুর কথায় শাওন ভরসা পায় । আব্বুর জলন্ত চোখ , মেজ চাচার হতাশা আর ছোট চাচার নীরবতা সব আশার ওপর জল ঢেলে দিয়েছিল । কিন্তু এবার সুক্ষ্ম হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে শাওন । একবার দাদুকে কনভিন্স করতে পারলেই কেল্লাফতে । তারপর আব্বুকে রাজি করতে সময় লাগবে না । কারণ দাদুর কথার ওপর কেউ কিচ্ছু বলবে না এটা শাওন জানে । আর দাদুর একটা বিশেষ ক্ষমতা হল তার তীক্ষ্ম ব্যক্তিত্ব যা যে কোনো মানুষের ওপর খুব দ্রুত প্রভাব ফেলে । শাওন নিজে ওর দাদুর মতো হওয়ার চেষ্টা করে সবসময় । তাই নিজেকে আবার প্রস্তুত করে মনে মনে।
– “কি রে ? বল ? ”
-“দাদু , রোজা খুব ভালো মেয়ে । হঠাৎ করেই ওর আব্বু ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে । আমরা দুজন দুজনকে খুব পছন্দ করি । দাদু, রোজা খুব কান্নাকাটি করছে । প্লিজ দাদু ,কিছু একটা করো ”
আবদুল্লাহ সাহেব খুটিয়ে খুটিয়ে নাতিকে পর্যবেক্ষণ করেন । আগের বার যখন এসেছিল অনেকটা স্বাস্থ্যবান মনে হয়েছিল । কিন্তু এবার মুখ চোখ শুকনো লাগছে । বাড়ি ফিরে গোসল করেছে তবুও মুখের ক্লান্তি ভাবটা যায়নি এখনো । চোখের নিচে কালি পড়েছে । যা সাক্ষী দিচ্ছে কয়েকরাত নিদ্রাহীন কেটেছে শাওনের । মায়া হয় শাওনের মুখটা দেখে ।
বাবাকে চুপ থাকতে দেখে মেহেতাব সাহেব বলে ওঠেন ,
-“তোমার বয়স কত শাওন? ”
হঠাৎ করে এইরকম অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন করায় শাওন হতচকিয়ে যায় । তারপর নিজেকে সামলে বলে ,-
“একুশ চলছে আব্বু ”
-“বিয়ে করতে চাচ্ছ ! নিজেই এখনো নিজের খরচ চালাতে পারো না । বিয়ে করে বৌকে কি খাওয়াবে ? ”
-“আমাদের এখনি বিয়ে করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না আব্বু । কিন্তু হঠাৎ করেই ওর আব্বু বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে ! “..নিচু স্বরে বলে শাওন ।
-” রিযিকের মালিক তো আল্লাহ । আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকের জন্য তার রিযিক ঠিক করে দিয়েছেন । তাই কে, কি ,কিভাবে খাওয়াবে এই চিন্তা করা অবান্তর ।”
আবদুল্লাহ সাহেব ছেলের কথার জবাব দেন । তারপর শাওনকে জিজ্ঞেস করেন ,
-“কবে বিয়ে ঠিক করেছে ?”
-“সামনের শুক্রবার ”
-“মেয়ের বাবা কি করে ? ওনার নম্বর আছে তোর কাছে ? ”
-” রোজার আব্বু ডিফেন্সে চাকরি করত । এখন রিটায়ার্ড নিয়েছেন । ওনার নম্বর আছে আমার কাছে ”
-“আমাকে দিয়ে যা । ”
শাওন মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় । এর কিছুক্ষণ পর এসে নম্বর দিয়ে যায় । দাদু ওকে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিতে বলেন । তারপর আব্বু-দাদু-চাচাদের মধ্যে কি কথা হয় শাওন বুঝতে পারে না । আম্মু-চাচি সবাই মুখে কুলুপ এটে আছে । ছোটদের কাছ থেকে শোনার ও উপায় নেই । কারন ওদের বাড়ির বৈঠকে ছোটদের থাকার অনুমতি নেই ।
-“রোজা , নে তোর হবু শাশুড়ি ফোন করেছে । বিয়ের শাড়ি কেমন কালারের নিবি জানতে চাচ্ছে ?”..
রোজার দাদা আরাব হাসি মুখে নিজের ফোনটা বোনের দিকে এগিয়ে দেয় । রাতের খাবার খেতে বসে সবে মুখে ভাত তুলেছিল রোজা , দাদার কথায় কটমট করে তাকায় । তারপর ভাতে জল ঢেলে দিয়ে ধুপধাপ পায়ে নিজের ঘরে চলে যায় । আরাব অবাক হয়ে যায় রোজার আচরণে । বলে,
– “এর আবার কি হল ? ” এখনো হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে আরাব বাবা-মায়ের দিকে । সে নিজেও একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর । রাত আটটা অবধি ওর আজ ডিউটি ছিল । কাল রাতে রোজা ঝামেলা করেছে ঠিকই কিন্তু আজকের কাহিনী ওর অজানা ।
-“তোমার মেয়ে আবার ঝামেলা করছে ! ওকে বারণ করো ঝামেলা করতে । বিয়ে ওর ওখানেই হবে । ”
সামসুল সাহেব গলায় কাঠিন্য এনে রুবিনার দিকে তাকিয়ে বলেন ।
-” ওহ, দোষ করলেই এখন মেয়ে শুধুই আমার হয়ে গেল !”
-“আম্মু , আব্বুকে বলে দাও । আমি এখন এডাল্ট হয়ে গেছি । আর এটাও মনে রেখ আমি একজন মুসলিম মেয়ে । আমার পূর্ণ সম্মতি ছাড়া তোমরা আমার বিয়ে দিতে পারবে না “.. আব্বুর কথা শুনে নিজের ঘরে বসেই চিৎকার করে বলে রোজা ।
সামসুল সাহেব কটমট করে তাকান রুবিনার দিকে । বলেন,
-“দেখেছ , কেমন বেয়াদব মেয়ে ? এখন বাবার মুখে মুখে কথা বলতে শিখে গেছে !”
-“আমাকে কেন বলছ ? তুমি নিজেই তো বলতে ছোট বড়ো সবাইকে নিজের মতামত জানানোর সুযোগ দেওয়া উচিত । এখন তার ফল ভোগো। ”
আরাব হাঁ করে বাবা-মায়ের কথা শুনছে । যার মাথামুন্ডু কিচ্ছু তার মাথায় ঢুকছে না । অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“আম্মু কাহিনী কি ? বলবে একটু ”
রুবিনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সন্ধ্যার ঘটনা সবটা খুলে বলে ছেলেকে । আরাব সবটা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ে । সামসুল সাহেব অল্প করে খেয়েই উঠে যান ।
বেলকনিতে ইজি চেয়ারে বসে বসে সিগারেটে টান দিচ্ছেন সামসুল সাহেব । শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আকাশ পানে । প্রচণ্ড চিন্তা হলে তিনি এভাবেই বসে পড়েন বেলকনিতে । ফোনের রিংটোনে ওনার ধ্যান ভঙ্গ হয় । রুবিনা এতক্ষণ বিছানায় বসে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন । চিন্তা যে ওনার হচ্ছে না তা নয় । তবে মেয়েটা তার বড্ড একরোখা স্বভাবের । বিছানার পাশে টেবিলে ফোন বাজতেই তার ও ধ্যানভঙ্গ হয় । ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে আসেন । সামসুল সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দেন ফোনটা ।
বাড়ি ফিরলেই শাওনকে ছোট ছোট ভাইবোনেরা সবাই ঘিরে ধরে । কত কথা তাদের জমানো থাকে দাদাকে শোনানোর জন্য । আব্বুর কাছ থেকে ছুটি পেয়ে সবে মাত্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে শাওন। সারাদিন ধকল কম যায়নি আজ। আসার পর রোজাকে জানানো হয়নি এখনো । ফোনটা হাতে নিয়ে পাওয়ার বটনে ক্লিক করবে তখনই হুরমুর করে কচিকাঁচারা ঢুকে পড়ে শাওনের রুমে । আর সুইচ অন করা হয় না ফোন । ওদের সাথে গল্পে মশগুল হয়ে যায় শাওন। একটু পরেই আম্মু খাওয়ার জন্য ডাকতে আসে । খাওয়া দাওয়া , সবার হালচাল জিজ্ঞেস করা, তারপর গল্প করতে করতে রাত সাড়ে দশটা হয়ে যায় ।
To be continue…..