#- অপ্রিয় সে
#- সানজিদা সন্ধি
#- পর্বঃ১১
সবাই রিমুর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কারণ সে একটা ছেলেকে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলেছে। রূপম আর রিমুর বিয়ের মধ্যে হাজার ঝামেলা নিয়ে সবার মন যখন বিক্ষিপ্ত তখন কোথা থেকে যেন একটা ছেলে তার পরিবার নিয়ে এসেছে রিমুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। ইতিমধ্যে ছেলের পরিবার রিমুকে দেখতে চাচ্ছে। বাসার সবাই শিষ্টাচার বজায় রাখতে গিয়ে কিছু বলতেও পারছে না। নয়তো সবার মন-মানসিকতা যে পরিমান খারাপ হয়ে আছে তাতে নিশ্চয়ই একটা সিন ক্রিয়েট হতো।
রূপম সবকিছু থেকে বেশ কয়েকবার দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সে দেখতে পেলো ড্রইংরুমে অতিথি এসেছে। কিন্তু কারা এসেছে বুঝতে পারলোনা। তাদের কাছে যেতেই রূপমের মাথায় বোধহয় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সে আরিয়ানের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ। তারপর রূপমের বাবা মায়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলে জানতে পারলো তারা রিমুকে দেখতে এসেছে। কথাটা শোনার পরপরই রূপম উঠে গিয়ে রিমুর দরজায় ঠকঠক করতে থাকে। বলে, ” কী রে! তোকে তো দেখতে এসেছে! আমার সাথে তো বিয়েটা করলি না। এখন অন্যখানে করে নে। যাইহোক এবার বিয়েতে কিন্তু ঝামেলা করিসনা৷ অবশেষে তোর বিয়ে হচ্ছে কী বল! ”
রূপমের বাহিরে থেকে বলা কথাগুলো এ টু জেড রিমু স্পষ্টভাবে শুনতে পেলো। সে ভেবে পাচ্ছে না যার সাথে কালকেই বিয়ের কথা ছিলো রূপমের সেই মেয়েকেই আজ অন্য কেউ দেখতে এসেছে আর রূপম কীভাবে এভাবে কথা বলতে পারছে? মিনিমাম খারাপ লাগা টুকু নেই? তবে যাই হোক বিষয়টা রিমুর জন্য ভালোই হয়েছে। রিমু কোনোভাবেই চায়না রূপম বিন্দুমাত্র ঝামেলা করুক।
তাই ভেতর থেকে রিমু জবাব দিলো, ” না না এবার আর বিয়েতে ঝামেলা করবো না। এবার বিয়েতে ঝামেলা করলে আপনাদেরকে মুক্তি দিবো কীভাবে বলুন? ঠিকঠাকমতো সব কিছু হলে খুব শীঘ্রই আপনাদেরকে চিরমুক্তি দিয়ে এই বাড়ির বাহিরে পা রাখবো। আর ফিরবো না ইনশাআল্লাহ। ”
রূপম হেসে বললো, ” যাক আপদ তাহলে এবার পারমানেন্টলি বিদায় হবি। আলহামদুলিল্লাহ। রেডি হয়ে বাহিরে আয়! আমিও একটু বাজিয়ে দেখি তোর হবু বরকে।”
রিমু কোনো জবাব দিলো না আর। রূপম কয়েকমিনিট কোনো উত্তর না পেয়ে চলে গেলো।
রিমু একটা লাল রঙের শাড়ি পড়েছে। রিমু যদিও খুব একটা পছন্দ করে না রঙটা। লাল রঙের কিছু পড়লে দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। এইজন্য সে এড়িয়েই চলে। কিছুক্ষণের জন্য তার মনে হলো বাড়ির কাউকে না জানিয়ে এরকম আচরণ করা ঠিক হয়নি তার। মনে মনে খানিকটা অনুতপ্ত হলো। তারপর ভাবলো সে এ বাড়িতে থাকা একটা অপ্রয়োজনীয় বস্তু। যার কোনোকিছুই অপর কাউকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা রাখেনা। রিমুর এই ধরনের আচরণও কাউকে আহামরি প্রভাবিত করবে বলে মনে হয় না। তাই সে নির্দ্বিধায় রেডি হয়ে নিলো। এই বাড়ি থেকে চলে যেতে পারলেই সে একপ্রকার মুক্তি পাবে।
রিমু ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমের দিকে এগোতে ওমনিই কোথা থেকে যেন রূপম আকাশ ফুঁড়ে পাতালে এলো। রূপমের মুখোমুখি হয়েই রিমুর বিরক্ত লাগলো।
রূপম চেহারার মধ্যে একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব এনে বললো, ” তুই যে কী! আমি বুঝিনা। তুই কী চাচ্ছিস তোকে এই ভয়ানক রূপে দেখে পাত্রপক্ষ পালিয়ে যাক। কী পড়েছিস এটা? ক্যাটক্যাটে রঙ। একদম ফালতু লাগছে তোকে। যা চেঞ্জ করে আয়। রিমু রূপমের কথাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে সিরিয়াস হয়ে বললো, ” আমাকে দেখতে বাজে লাগছে ভালো কথা। আমি যেমন অবস্থাতেই থাকি না কেন যে আমাকে মন থেকে ভালোবাসে সে আমাকে গ্রহণ করে নেবে সেই অবস্থাতেই। আর আমাকে কেমন লাগছে সেটা আপনার বিচার করার প্রয়োজন নেই। যাদের ভালো লাগা দরকার তাদের ভালো লাগলেই হবে।
রূপম অপমানিত বোধ করলো। এ কী শুরু করেছে রিমু? তার সাথে কথায় কথায় এরকম আচরণের মানে কোথায়? কিছুক্ষণের জন্য কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা বোধ হলো রিমুর ভেতর।
রিমু নিচে গেলো। তার মাথায় কাপড় দেওয়া। বাড়ির প্রত্যেকে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে আছে। তাদেরকে না জানিয়ে রিমু এই ধরনের কিছু করতে পারে তা সবার কল্পনাতীত। তবে কী রিমুর কাছে কারো দামই নেই? আরিয়ানের বাবা মা রিমুকে কাছে ডেকে নিলেন। তারা সবটাই জানেন রিমুর বিষয়ে। আরিয়ান তাকে একতরফা ভালোবাসে আর তারা যে আজ রিমুকে দেখতে আসবে এটা বাড়ির কেউ জানে না। এদের সবার মধ্যে রায়হান খানকেই মনে হলো একটু খুশি। তিনি মিষ্টি হেসে বললেন সেই তথাকথিত কথাগুলো, ” আমাদের মেয়ে কিন্তু ভারী লক্ষ্মী। আপনাদের ছেলেকে সুখেই রাখবে।
রূপম শকুনের দৃষ্টিতে আরিয়ানের দিকে চেয়েই রয়েছে। আরিয়ানের দেখে মনে হচ্ছে তার চেয়ে কেউ সুখে নেই। রূপম আরিয়ানের কাছে গিয়ে তার কাঁধে শক্ত করে চাপড় দিয়ে তার কানেকানে কী যেন বললো, ” হুট করেই রিমুর চোখ আরিয়ান আর রূপমের দিকে গেলো। তাদের দিকে চোখ যেতেই রিমু দেখলো দুজনের মুখেই উপচে পড়া হাসি। যেন হাসির প্রতিযোগিতা লেগেছে। কে কার চেয়ে বেশি হাসতে পারে। ”
রিমুর মনে হলো আরিয়ান কোনোভাবে রূপমের কাছের কেউ নয়তো। যদি হয়ই তাহলে রিমুর পেছনে সে পড়েছে কেন। এই রূপম আসলে চাচ্ছে টা কী? সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। রিমু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজ ভীষণ কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দেবে সে৷ একটা মানুষ আর কতই বা সহ্য করে।
রিয়াজুল করিম বাসায় নেই৷ তাই তার অনুপস্থিতিতে বিয়ের কথা অসম্পূর্ণ রাখলো সবাই। রিমু আর আরিয়ানকে আলাদা ভাবে কিছু বলার জন্য পাঠাতে চাইলেন আরিয়ানের বাবা মা। প্রস্তাবটা শুনেই আরিয়ানের মুখের হাসি হাসি ভাব যেন আরো কয়েক শত গুণ বেড়ে গেলো। রিমু চাচ্ছিলো না আলাদা ভাবে কথা বলতে আরিয়ানের সাথে কিন্তু সবাই আছে ভেবে সে কথা বলতে গেলো। কথার শুরুতেই রিমু বললো, ” আপনি রূপম ভাইয়ার কাছের কেউ তাইনা? আপনারা আমার সাথে পেয়েছেন টা কী? আপনাদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি? জবাব দিন একটু।”
আরিয়ান রিমুর জেরা শুনে বোকা বনে গেলো। সে সালাম দিলো রিমুকে। কাল সালাম নিয়ে যেই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছিলো সে আজ পড়তে চায়না। সালাম দিয়ে আরিয়ান বললো, ” আমি আসলে তোমার কথা বুঝতে পারছি না। আমি তোমাকে আগেই অবগত করেছি রূপম আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে অনেক ব্ল্যাকমেল করেছে। তবে তোমার কেন মনে হলো রূপম আমার কাছের কেউ?
রিমুর কোনো এক অদ্ভুত কারণে মেজাজ ভীষণ বিগড়ে গেলো। সে খানিকটা উগ্র গলাতেই বললো, ” তাহলে দুজনে কথা বলার সময় এতো হাসছিলেন কেন?”
আরিয়ান এবার কোনো জবাব দিতে পারলো না। যেন কেউ তার মুখের মধ্যে কুলুপ এঁটে দিয়েছে। এবার রিমু সম্পূর্নভাবে শিওর হলো নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। নিত্যদিনের একই বিষয় নিয়ে রিমু ভীষণ বিরক্ত। রোজ রোজ কার ভালো লাগে এই একই কাহিনী?
রিমু আর কথা বলতে চাইলো না আরিয়ানের সঙ্গে। পরে কথা বলবে বলে সবার সামনে এলো সে। এদিকে আরিয়ান আশাহত হলো। আজ প্রথম বার সুন্দর ভাবে রিমুর সাথে কথা বলার সুযোগ ছিলো আরিয়ানের। কিন্তু রূপমের কারণে সেটাও হলো না।
রূপমের বাসা থেকে অনেক রাতে আসায় রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি তৃপ্তি। তাই সে এখন অবধি ঘুমাচ্ছে। ফোনে রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো তৃপ্তির। স্ক্রিনে রূপমের নাম দেখে ভীষণ বিরক্ত হলো তৃপ্তি। ইচ্ছে মতো কয়েকটা গালি দিয়ে নিলো। কিন্তু রূপমের কান্নার শব্দ শুনে সে মুহুর্তই চুপ হয়ে বললো। রূপম আবার? রূপম নিজেকে কোনোভাবেই সামলাতে পারলো না। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। এদিকে তৃপ্তি হয়ে গেলো হতবিহ্বল। তারও যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে প্রিয় বন্ধুর অবস্থা দেখে। কিন্তু কী-বা করার আছে তার।
চলবে,,,,