# অপ্রিয় সে
# সানজিদা সন্ধি
# পর্ব ১z
সুন্দরী মেয়েদের বুকে না কি তিল থাকে! তোর বুকেও তো তিল আছে। কিন্তু তুই তো সুন্দরী না রিমু। একদম পেত্নীর মতো দেখতে লাগে তোকে। কথাগুলো বলেই ফোনে মনযোগী হয়ে পড়লো রূপম। আর এদিকে রিমুর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না রূপমের এক কথাতেই যেন মুহুর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেলো।
কয়েকমিনিট আগেও, ” মা আমি রূপম ভাইকে বিয়ে করবোনা ” বলে কেঁদে কেঁদে মেঝের এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো রিমু। তার মা রেহনুমা বেগম ভ্রু কুঁচকে ভীষণ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে খাটে বসে তার কাহিনি দেখছিলো। আর রিমুর বাবা রিয়াজুল করিম অসহায়ের ভঙ্গিতে মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলো। রিয়াজুল করিম কাছে যেতেই রিমুর কান্নার বেগ যেন চক্র হারে বাড়তে থাকে। তাই একপর্যায়ে তিনিও হাল ছেড়ে চুপচাপ বসে পড়েন। স্বামী, স্ত্রী দুজনের মনে এখন একটাই ভয়। কোনো ভাবে যদি রিমুর পাগলামির কথা রূপমের কানে যায় তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
আজকে রিমুর গায়ে হলুদ। তার খালাতো ভাইয়ের সাথে। কিন্তু রিমু কিছুতেই তাকে বিয়ে করতে চায় না। বিয়েতে রিমুর সম্মতি নেই সবাই জানে এটা। তারপরও রূপমের সাথেই রিমুর বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর তারা। কারণ সবাই জানে রূপম যা চায় সেটাই নিজের করে নেয়। রিমুর চাচ্চু, বড় আব্বু, ফুপিরাও বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। কারণ রূপম তাদের ভাগিনা বলে কথা। রিমুর মা আর বাবা পরস্পর চাচাতো ভাইবোন। তাই রূপম রিমুর একহিসেবে তার ফুপাতো ভাই আর এক হিসেবে খালাতো ভাই।
রিমুর বাবা মাকে আর বেশিক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হলো না। ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো রূপম। আর তখনই রিমুর কথা তার কানে আসে। সব কাজকর্ম ফেলে ঘরে আসে সে। রূপমকে দেখেই রিয়াজুল করিম আর রেহনুমা বেগম ঘর থেকে বের হয়ে যান। এদিকে রিমু এককাধ হয়ে মেঝেতে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে থাকায় খেয়ালই করেনি ঘরে কী হচ্ছে।
রিমু মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বারবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, ” আম্মু, আব্বু তোমরা আমাকে রূপম ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিও না। আমি বিয়ে করবোনা ওই রাক্ষসটাকে। এর চেয়ে ভালো আমাকে কোনো রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দাও।”
বিছানার এককোণে বসে রিমুর কথা চুপচাপ হয়ে শুনছে রূপম। একপর্যায়ে রূপম রিমুর বুকের মধ্যে থাকা তিলের কথা বলে উঠতেই রিমুর কান্না থেমে যায়। আর তারমধ্যে জেঁকে বসে একরাশ আতঙ্ক।
রিমু তড়িঘড়ি করে পাশ ফিরে রূপমকে দেখতে পায়। রূপম অন্য পাশে তাকিয়ে বলে, ” ওই! বুকে ওড়না থাকে না কেন তোর ? বাড়ির মানসম্মান তো ডুবিয়ে ছাড়বি। এতোবড় মেয়ে হয়েছিস অথচ নিজের দিকে খেয়াল রাখতে পারিস না? আমি বলেই তোকে বিয়ে করছি। নয়তো আজীবন তোকে ওই সিঙ্গেলই থাকতে হতো। ”
মেঝেতে গড়াগড়ি করতে গিয়ে অসচেতনতায় নিজের ওড়ানা যে কোন মুলুকে রেখেছে জানেই না রিমু। তাই চট করে বসে দুহাটু একসাথে করে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করলো সে। লাভের লাভ কিছুই হলোনা। উল্টে রূপমের কথা শুনে আরো বেশি লজ্জায় পড়ে গেলো রিমু। রূপম মিনমিনে হেসে বললো, “কালকের দিনটা এলেই তুই সম্পূর্ণভাবে আমার। এতো কাহিনি করার দরকার নেই।”
সেসব কথাকে পাত্তা না দিয়ে বিয়ে ভাঙার ছুঁতো খোঁজায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো রিমু। আজীবন সিঙ্গেল থাকার কথা শুনে সে চট করে বলে উঠলো, ” আমি আজীবন সিঙ্গেলই থাকতে চাই রূপম ভাই৷ তুমি আমাকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা নষ্ট করিও না৷ আমাকে বিয়ে করে তোমার কোনো লাভ হবে না বুঝলে? আমার বাবা তোমাকে টাকাপয়সাও দিবে না। তুমি বরংচ একটা সুন্দর মেয়ে বিয়ে করে নাও। আমাকে বিয়ে করিওনা রূপম ভাই। ”
রিমুর কথা শুনে রূপম বিরক্ত হলো। ভীষণ রকম বিরক্ত হলো। যেখানে সব মেয়েরা তার জন্য পাগলের মতো পাগল সেখানে এই রিমু টা কেন তাকে এতো ভয় পায়? সে কি বাঘ না কি ভাল্লুক যে খেয়ে ফেলবে রিমুকে। সবসময় রূপমকে এড়িয়ে চলে রিমু। রূপমের ছায়াও মারাতে চায়না। যেন রূপমের ছায়ার মধ্যে বিষ আছে।
রূপম মুখে থাকা সেন্টার ফ্রেশটা চিবোতে চিবোতে বললো, ” তোর বাপের টাকা দিয়ে আমি কী করবো হ্যাঁ? ফাজিল মেয়ে। আমার আর আমার বাবার কী টাকার অভাব পড়েছে? যে তোর বাপের থেকে টাকা নিতে হবে আমায়? যেদিন থেকে তোর আর আমার বিয়ের কথা ঠিক হয়েছে সেদিন থেকে তুই বিয়ে করবোনা, বিয়ে করবোনা বলে চেঁচাচ্ছিস কেন বলতো? আর খালামনি, মামাকে এতো বিরক্ত করিস কেন? আমার সামনে তো বলিস না কখনো। তখন তো ঠিকই লক্ষ্মী হয়ে থাকিস। তবে আমি চলে গেলেই কেন সবার মাথা খারাপ করিস? তোর মাথায় কোনো গণ্ডগোল আছে না কি রে? তাহলে তো মহা সমস্যা। একেই পেত্নী আর তারউপর পাগল বউ নিয়ে সংসার করতে হবে আমাকে।”
রিমু বুঝে গেলো আর যাই হোক না কেন রূপম তাকে বিয়ে করবেই। রূপমের সাথে এক ছাঁদের নিচে থাকতে হবে ভেবেই রিমু চিৎকার করে উঠলো। এরপর আবার শুরু হলো তার কান্নাকাটি। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে জড়ো করলো। তারপর বুকে প্রচন্ড সাহস নিয়ে রূপমের সামনে থেকেই বললো, ” রূপম ভাই আমি তোমাকে বিয়ে করবোনা। তোমাকে কখনো ভাই ছাড়া অন্য কোনো ভাবে দেখিনি। তাছাড়া তোমার মতো ফেমাস পারসনকে আমি বিয়ে করতে পারবোনা। ফেমাস সবকিছুতেই আমার এলার্জি আছে। ”
এই প্রথমবার রূপমের সামনে বিয়ে না করার কথা তুললো রিমু। এখন সে ভয়ে আছে না জানি কী হয়ে যায়।
রূপম ধীরপায়ে উঠে এসে কষিয়ে থাপ্পড় বসালো রিমুর গালে। রিমুর ফর্সা টকটকে গাল লাল বর্ণ ধারণ করলো। রূপমকে রাগতে দেখে ঘরে যারা এসেছিলো সবাই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। যেন এখান থেকে বেরোতে না পারলে মহাবিপদ সংঘটিত হবে।
রিমু আর রূপম ঘরে একা এখন। রূপম আস্তে করে বললো, ” তোর ভালোই সাহস রে। আমি ভেবেছিলাম তুই আস্ত একটা ভীতুর ডিম। কিন্তু না! তুই তো মহা সাহসী। আমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার ইচ্ছে টা আমার সামনেই প্রকাশ করে শুধুশুধু থাপ্পড় টা খেলি। আমাকে রাগালে তো এমনটা হবেই। অস্বাভাবিক কিছু নয়। যাইহোক কান্নাকাটি রেখে গায়ে হলুদের জন্য রেডি হয়ে নে। ”
এক বাড়িতে ছোট থেকে মানুষ হয়েছে রিমু আর রূপম। কারণ রূপমের মায়ের বিয়ে তাদের এলাকাতেই হয়। রূপম ছোট থেকে নিজের বাড়িতে থাকার চেয়ে এখানেই পড়ে থাকতো। রিমু রূপমের তিন বছরের ছোট। রিমুর জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে দেখছে রূপমের আধিপত্য ঠিক কতটা৷ রূপম যা চেয়েছে সবকিছুই পেয়েছে। রূপমের ইচ্ছের বিরূদ্ধে কেউ কখনোই যায় না। আর যার ফলে ভুগতে হয়েছে রিমুকে। কোনো এক অজানা কারণে রূপম সেসবই চেয়েছে যা চাইলে রিমুর অসুবিধা হয়।
সেবার রিমু ক্লাস এইটে। সামনে মডেল টেস্ট পরীক্ষা থাকায় মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে। ছাত্রী হিসেবে রিমু মাঝারি। অঙ্কে ভীষণ কাঁচা। দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসলো তার। রিমুর যেদিন ম্যাথ এক্সাম সেদিন রূপমের ইচ্ছে হলো পিকনিক করবে। রূপমের ইচ্ছে মঞ্জুর হলো৷ পুরো বাড়িতে গান-বাজনা হই হুল্লোড় ভরে গেলো । রিমু পরীক্ষার টেনশন আর গান বাজনায় জ্ঞান হারিয়ে পরেরদিন এক্সামে খারাপ করলো৷ ফলাফল পরীক্ষার ফেল করে বসলো।
ফেল করার দরুন সবার কথা শোনা আর রূপম তাকে ফেলটুস ট্যাগ লাগিয়ে দিলো। এরকম অসংখ্য ঘটনার সমন্বয় রূপম আর রিমু।
রিমুর প্রতি হওয়া নানান ঘটনার কারণে রূপমের প্রতি একপ্রকার বিতৃষ্ণা কাজ করে রিমুর। কিন্তু কিছু বলার বা করার সাহস হয়ে ওঠেনি তার। যার ছায়াতেও রিমুর অস্বস্তি হয় তার সঙ্গে আজীবন কাটাবে কী করে?
চলবে,,,