#অপ্রিয়_প্রিয়জন
#Fiza siddique
#পর্ব-11
আজ মেঘ আর বৃষ্টির গায়েহলুদ। সকাল থেকেই সবাই ভীষন ব্যাস্ত। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ছেলে আর মেয়ের হলুদের জায়গা পাশাপাশি করা হয়েছে। আজ কোনো পার্লারের লোক আসেনি বৃষ্টিকে সাজাতে। ঘরোয়াভাবেই সেজেছে সে নিজে। বৃষ্টিকে দেখে মেঘ চোখ ফেরাতে পারছেনা। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি, গায়ে ফুলের গহনা, হাতে ফুলের মালা, কোমরে ফুলের কোমরবন্ধনী, নাকে ফুলের নথ, চুলগুলো কার্ল করে খুলে রাখা, মুখে হালকা মেকাপ। এতেই অসম্ভব সুন্দর লাগছে, মনে হচ্ছে ফুলনগরীর রানী আজ সয়ং এসেছেন বৃষ্টি রূপে।
মেঘকেও আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে, ফর্সা গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি অনেক মানিয়েছে। অনেকেই হা করে গিলছে মেঘকে, এটা দেখে বৃষ্টি রাগে ফুসছে একপ্রকার। বেশ জাকজমোক ভাবেই হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হলো। তারপর সবাই রিসর্টের নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে যায় রেস্ট নেওয়ার জন্য।
রুমে ঢুকে সবেমাত্র ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে বৃষ্টি। পরনের শাড়ি আর গহনাগুলো এখনো খোলেনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সবেমাত্র ফুলের গহনাগুলো খুলতে যাবে তখনি কিছু একটা পড়ার আওয়াজে ব্যালকনিতে যায়। মেঘকে এমন অবস্থায় এখানে দেখে ভীষণ অবাক হয় বৃষ্টি। এখনও পর্যন্ত একই সাজে রয়েছে। বৃষ্টিকে এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ বৃষ্টির হাত ধরে রুমে নিয়ে আসে।
কি ব্যাপার মেঘ, আপনি এই সময় আমার রুমে। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে তো। আপনার কি কিছু লাগবে?
বৃষ্টির কথা শুনে ঠোঁটে বাঁকা হেসে আস্তে আস্তে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে আসে। আর বৃষ্টিও পিছাতে থাকে একটু একটু করে। একসময় বৃষ্টির পিঠ দেওয়ালে লেগে যায়। পাশ দিয়ে বৃষ্টি চলে যেতে চাইলে মেঘ নিজের হাত দিয়ে আটকে দেয়। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
আমার যেটা চাই সেটাই তো নিতে এসেছি বৃষ্টিরানি। আমার জিনিসটা আদায় না করা পর্যন্ত আমার ঘুম আসবেনা যে।
পেটে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে বৃষ্টি। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে তার আগেই মেঘ হাঁটু গেঁড়ে বসে আস্তে করে পেটের কাছের শাড়ীটা কিছুটা সরিয়ে ডান হাতে থাকা হলুদ লাগিয়ে দেয়। মেঘের ছোঁয়ায় বৃষ্টির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অজানা শিরহন কাজ করে বৃষ্টির সারা শরীর জুড়ে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা। মেঘ সেখান থেকে উঠে আবারো বৃষ্টির কানে মুখ দিয়ে আস্তে অস্তে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,
সবাই তো হলুদ লাগলো অথচ আমার হবু বউকে আমিই হলুদ ছোঁয়ালাম নাহ। তাই অপূর্ণ কাজটা পূরণ করতে এলাম। বলেই নিজের বাম গালটা বৃষ্টির ডান গালের সাথে আলতো করে ঘষে সবটুকু হলুদ লাগিয়ে দেয়। তারপর গালে টুপ করে একটা কিস করে চলে যায়।
এতটা সময় বৃষ্টি চোখ বন্ধ করে শাড়ি খামচে ধরে দাড়িয়ে ছিলো। নিশ্বাস নিতে যেনো ভুলে গেছিলো। অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ খুলে মেঘকে কোথাও না দেখে সস্তির নিঃশ্বাস নেয়। তারপর মেঘের পাগলামীর কথা মনে করে আনমনেই হেসে দেয়। আস্তে আস্তে আয়নার সামনে গিয়ে পেটের কাছে শাড়ি কিছুটা সরিয়ে হলুদ লাগানো জায়গাটা দেখে লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
______________________
বিয়ের সাজের জন্য পার্লার থেকে একজন মেকাপ আর্টিস্ট আসে। তবে মেঘের কড়া নির্দেশ যেনো হালকা সাজানো হয় বৃষ্টিকে। জাম আর হলুদ রঙের মিশ্রনে শাড়ি সাথে সোনালী পাড়, ভারী গহনা, হালকা ব্রাইডাল মেকাপ, হাত ভর্তি চুড়ি, চুলগুলো খোপা করে ফুল দেওয়া, সাথে লাল ওড়না। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। সৃজা আর মেকাপ আর্টিস্ট মিলে সাজাচ্ছে বৃষ্টিকে। বৃষ্টিকে দেখে কেঁদে দেয় সৃজা। আর বলে,
আমি জানতাম বৃষ্টি একদিন তুই খুব সুখী হবে। জীবনে যে কষ্ট পেয়েছিস তুই তা সুদেআসলে সুখ হিসেবে ফেরত পানি তুই। আমি আজ খুব খুশি বৃষ্টি।
কথার আগামাথা কিছু না বুঝতে পারলেও চুপ করে থাকাটা ঠিক বলে মনে করলো বৃষ্টি। ওদিকে বৃষ্টির আম্মু আর মেঘের আপু বৃষ্টিকে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসে। মেয়েকে বিয়ের সাজে দেখে চোখ দুটো ভরে ওঠে রাহেলা বেগম এর। তাই কোনরকম নিজেকে সামলে বৃষ্টিকে নিয়ে স্টেজের দিকে যান। হালকা মাথা তুলে মেঘের দিকে তাকাতেই বৃষ্টি আর একদফা ক্রাশ খায়। মেরুন পাঞ্জাবী সাথে সাদা পাজামা, চুলটা বরাবরের মতো সেট করা, হাতে একটা ব্ল্যাক ওয়াচ, ঠোঁটে লেগে আছে একটা মিষ্টি হাসি, আর চোখে একরাশ মুগ্ধতা। এটুকু দেখেই বৃষ্টির ভীষণ লজ্জা লাগে তাই চোখ নামিয়ে নেয়।
এদিকে মেঘের অবস্থা বেসামাল। বৃষ্টিকে দেখে একরাশ মুগ্ধতা এসে গ্রাস করে তাকে। বুঝে পায়না কি আছে এই মেয়ের মধ্যে যা এতটা মুগ্ধ করে ওকে। মেয়েটার আশেপাশে থাকলেই কেমন বেসামাল হয়ে পড়ে।
স্টেজের কাছে আসতেই মেঘ নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টিও মেঘের হাত ধরে গিয়ে মেঘের পাশে বসে পড়ে। মেঘের কথা অনুযায়ী আগে রিং বদলের অনুষ্ঠান হবে তারপর বিয়ে। বৃষ্টিকে দাড় করিয়ে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মেঘ। তারপর বৃষ্টির হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলতে শুরু করে,
জীবনে সফলতা তো প্রয়োজনীয় সাথে তুমিও। আমার হাতে এই ঘড়িটাতো মানায় কিন্তু তোমার হাত আমার হাতে বেশি মানায়। চোখ বন্ধ করলে ঠিক যেমন অন্ধকার দেখতে পাও, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন ঠিক তেমনি।
এই বৃষ্টির নেশাতে চায় মন হারাতে। সব সীমা ছাড়িয়ে এই মন চাই শুধু তোমাকে। দেবে কি তোমার মনে একটু ঠাঁই? দেবে কি তোমার হাতটা এইভাবে ধরে সারাজীবন পার করার সুযোগ?
মেঘের এমন আবদারে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে বৃষ্টি। আস্তে করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে মেঘ ডায়মন্ডের আংটিটা বৃষ্টির আঙ্গুলে পড়িয়ে দেয়। তারপর হাতে একটা কিস করে উঠে দাড়ায়।
চারিদিকে ছোটবড় সবার তালি আর চিল্লানিতে বৃষ্টির ভীষণ লজ্জা করে। তাও কোনরকম মেঘের আঙ্গুলে রিংটা পরিয়ে দেয়।
কাজিসাহেব নিয়ে পড়ানো শুরু করেন। বৃষ্টিকে কবুল বলতে বললে বৃষ্টির চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরতে থাকে। এতটা কষ্ট কেনো হচ্ছে কবুল বলতে নিজেও বুঝতে পারছেনা। একটা মেয়ের জীবনের এই অনুভূতিটা হয়তো সেই মেয়েটাই বোঝো। ছোট থেকে যে পরিবারকে নিজের বলে জেনেছে, যে পরিবারকে আকড়ে বড়ো হয়েছে, যে বাড়িতে ছোট থেকে বড়ো হাওয়ার সবটুকু সৃতি জড়িয়ে আছে সেই বাড়ি ছেড়ে, আপন মানুষগুলোকে ছেড়ে যাওয়াটা যে কতটা কষ্টের সেটা এখন ভালোভাবে টের পাচ্ছে। অনেক কষ্টে তিনবার কবুল বলে। এরপর মেঘকে কবুল বলতে বললে এক নিঃশ্বাসে তিনবার কবুল বলে দেয়।
অবশেষে চলে এলো বিদায়ের সময়। বিদায়ের সময়টা আরও বেদনাদায়ক। আশরাফ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে বৃষ্টি। এদিকে রাহেলা বেগমও আড়ালে দাড়িয়ে আঁচলে নিজের চোঁখ মোছেন বারবার। তারপর ভাইকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করে। আর বাবা মার খেয়াল রাখার কথা বলে। মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আশরাফ হোসেন মেঘের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বলেন,
” বাবা বৃষ্টি আমাদের বড়ো আদরের মেয়ে। একটা ফুলেরমত করে বড়ো করেছি ওকে। কখনও কোনও কষ্ট পেতে দেয়নি। তাও মেয়েটা আমার অনেক কষ্ট পেয়েছে। তুমি সবটাই জানো। আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো।”
মেঘও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়ে গাড়ীতে। শুরু হয় এক নতুন পথচলা। গাড়ী চলছে নিজের গতিতে আর বৃষ্টি একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আর মাঝে মাঝে ফোফাচ্ছে। বৃষ্টির একহাত মেঘ নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মাথাটা নিজের কাঁধে রাখে। একটা ভরসার স্থান পেয়ে আস্তে আস্তে বৃষ্টির কান্না কমে আসে। ততক্ষনে মেঘের বাড়ীর সামনে গাড়ী এসে থামে। গাড়ী থেকে নেমে মেঘ বৃষ্টিকে কোলে তুলে নেয়। মেঘের এমন আচরণে থতমত খেয়ে যায় বৃষ্টি। তারপর……..
চলবে?