#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১৪ (অস্তিম পর্ব)
গ্রামের জমিদার হার্টঅ্যাটাক করে মারা গিয়েছে শুনে সকলে জমিদার গৃহে এসে উপস্থিত হয়। আশেপাশের গ্রামের লোকরাও আসে। সকলেই আপসোস করলো। কেউ কেউ দুঃখিত হলো। শুধু গৃহের মানুষদেরই কোনো দুঃখ কষ্ট নেই। তুলসী অসুস্থ মানুষ। এটা শোনার পর আগের ভঙ্গিতেই বিছানায় পরে রইলো। সাইয়েরার নিলিপ্ত ভঙ্গি। অনেক চেয়েও এক ফোঁটা অশ্রুও তার চক্ষু থেকে বের হলো না। ইয়াশার এসেছে। ছায়াও মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাহেরার কাছে। তাহেরা, তুলিকা, তারনা কান্না করছে। তাহেরা আব্বাজান বলে চিৎকার করছে। সোহরাব অনুভূতিহীন।
ভোরে গৃহে আসে সে। ছায়া জেগেছিলো তখন। সোহরাব পিতার কক্ষে যেতেই জমিনে পরা পিতার বীভৎস মরাদেহ দেখতে পায়। চিত্ত কেঁপে উঠে তার। আর্তনাদ করে উঠে। ছায়াও দৌড়ে আসে। আলাউদ্দিনকে দেখে বমি করে দেয় সে। সোহরাব সবটা লক্ষ্য করে বুঝতে পারে তার পিতাকে বিষ দেওয়া হয়েছে। আর এটা কে করেছে সেটাও বুঝতে পারে সোহরাব। সেই মুহূর্তে জ্বলে উঠা ক্রোধ দমিয়ে রাখে। গ্রামের সবাই যদি জানতে পারে আলাউদ্দিনকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে তাহলে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যাবে। পুলিশও আসতে পারে তদন্ত করতে। তাই সোহরাব হার্টঅ্যাটাক বলে বিষক্রিয়ার কথাটা লুকিয়ে ফেলে।
ছায়া সোহরাবের মৌনের পরিনাম বুঝতে পেরে দৌড়ে উপমার কক্ষের দ্বারে তালা লাগিয়ে চাবি নিজের বিছানার নিচে রেখে দেয়। যাই হয়ে যাক আজ সে উপমার কক্ষের চাবি দেবে না। সোহরাবকে উপমার কোনো ক্ষতি করতে দিবে না।
আলাউদ্দিনকে গোসল দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কবরস্থানে। উপমা আর নিজের কক্ষ থেকে বের হতে পারলো না। তার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আলাউদ্দিনের মৃত দেহ সকলের সামনে দেখার।
দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো। কবর দিয়ে সকলে ফিরে আসলেও সোহরাব মাত্রই গৃহে এসেছে। এলোমেলো পায়ে সদর দ্বার পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সকলে যার যার কক্ষে। হটাৎ সোহরাবের মনে পরে উপমার কথা। মস্তিস্ককে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠে। সকাল থেকে উপমাকে সে বাহিরে দেখেনি। উপমার ভয়ংকর অবস্থা করবে ভেবে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের কক্ষে না যেয়ে সোজা উপমার কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। তার পিতাকে যেভাবে কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে তার থেকেও দ্বিগুন কষ্ট দেবে উপমা কে। মনে মনে শপথ করলো উপমাকে মারবে না। জিন্দা রেখেই জাহান্নামের অনুভূতি অনুভব করাবে।
ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হয়ে পরলো সোহরাব। ভয়ংকর হয়ে উঠলো তার কৃষ্ণবর্ণ চেহারা। উপমার কক্ষের স্মুখীন ঝুলন্ত তালা দেখে তার রাগ আরো বেড়ে গেলো। ফোঁস ফোঁস নিঃশাস ছেড়ে মনে মনে ভাবলো তালা কে দিতে পারে। অতঃপর পা বাড়ালো ছায়ার কক্ষের দিকে।
আজও বাহিরে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। আকাশ মাটি কাঁপিয়ে বজ্রপাত হচ্ছে। বিছানার মধ্যখানে বসেছিলো ছায়া। সোহরাব শব্দ করে তার কক্ষে প্রবেশ করে। ছায়া মাথা তুলে তাকায়। সে যেনো সোহরাবের আশায়ই ছিল। মুখে অমায়িক হাসি দিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ায় ছায়া। আজ আর মাথায় ঘোমটা দিয়ে নেই। বড় বড় চুলগুলো অগোছালো হয়ে পরে আছে পিঠে, কোমরে। সোহরাব এগিয়ে এসে ক্রোধে রণরণে কণ্ঠে বলল,
-চাবি দেও।
ছায়ার ভীষণ ইচ্ছে ছিল সোহরাব একদিন তাকে তুমি বলে সম্বন্ধ করবে। আজ সেই ইচ্ছে তো পূরণ হলো তবে অসময়ে! মুচকি হাসলো ছায়া। সোহরাবের ছায়াকে পাগল মনে হলো। অকারণেই হাসছে ছায়া। সোহরাব পুনরায় বলল, -চাবি দেও।
-ছেড়ে দিন না এইসব। উনি উনার শাস্তি পেয়ে গিয়েছে আপনিও ভালো হয়ে যান না। আমাদের অনাগত সন্তানের কথা ভেবেই নাহয় সব ভুলে যান।
অনেকটা ব্যথার্ত কণ্ঠে বলল ছায়া। সোহরাবের বিরক্ত লাগছে ছায়ার এহেন কথা। তাকে শান্ত স্বরে আবারও বলল,
-আমাকে চুপচাপ চাবি দেও।
-আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি সোহরাব। আমার আপনাকে নিয়ে যে অনেক স্বপ্ন!এভাবে আমার স্বপ্ন ধ্বংস করে দিবেন না।
সোহরাব এবার নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ছায়ার গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দেয়। তাল সামলাতে না পেরে জমিনে বসে পরে যায় ছায়া। গালে হাত দিয়ে করুণ নজরে তাকিয়ে থাকে সোহরাবের পানে। কী ভয়ংকর লাগছে লোকটাকে!কোনো জংলী জা’নো’য়ার! সোহরাব কক্ষের আনাচে কানাচে চাবি খুঁজতে থাকে। কোথাও না পেয়ে চিৎকার করে উঠে। চোখ বদ্ধ করে ফেলে ছায়া। কোনোরকম শরীরে শক্তি জোগাড় করে উঠে দাঁড়ায় সে। সোহরাব হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করছে। তার কাছে আসে। হাতের দু বাহু চেপে ধরে চিবিয়ে বলল,
-জলদি বল চাবি কোথায় রেখেছিস তুই?
শুকনো ঢোক গিললো ছায়া। শেষে সোহরাবের এইরকম রুপও তার নসিবে ছিল ভাবতেই কান্নারা গলায় এসে ঠেকলো। ছায়া শান্ত স্বরে বলল,
-ওকে মারবেন না দোয়েয়া করে।
ছায়া বিছানার নিচ থেকে চাবি নেয়। ধীর পায়ে হেঁটে সোহরাবের স্মুখীন এসে দাঁড়ায়। ছলছল নয়নে মন ভরে একবার সোহরাবকে দেখে নেয়। কাঁপা কাঁপা হাতে চাবি এগিয়ে দেয়।
সোহরাব ছোঁ মেরে চাবি নিয়ে নেয়। ছায়াকে কিছু বলতে উদ্যত হবে তার পূর্বেই ছায়া সোহরাবের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। সোহরাব ছায়াকে ছাড়ানোর প্রয়াস করে আকস্মিক এক সময় সোহরাবের মুখ থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।
সোহরাবের বুক থেকে লাল রঙের তরল পদার্থ গড়িয়ে পরে তলিয়ে গেলো জমিন মুহূর্তেই। চোখ বড় বড় হয়ে আছে। শব্দ করে সোহরাবের বুক থেকে রক্তাক্ত ছু’রি বের করে ছায়া দূরে সরে যায়। ধপাস করে জমিনে পরে গেলো সোহরাব। ছু’রি নিচে ফেলে ছিটকে আরেকটু দূরে সরে গেলো ছায়া। হটাৎই তার কী হলো দৌড়ে এসে সোহরাবের পাশে বসে পরলো। সোহরাব বড় বড় শ্বাস ত্যাগ করছে ছায়ার দিকে তাকিয়ে। ছায়া আজ একটুও কাঁদলো না। সযত্নে সোহরাবের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসে। করুণ কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-আপনাকে আমি মারতে চাইনি আমার অপ্রিয় জনাব। একসময় যে আপনি আমার খুব প্রিয় ছিলেন!আমি ভাবতেও পারিনি কোনো একদিন আপনি আমার এতো অপ্রিয় হয়ে উঠবেন! আপনার ভয়ংকর রুপ আমার সহ্য হয় না জানেন? আমি জানতাম না ভালো সোহরাবের পিছনে একটা নিকৃষ্ট সোহরাবও রয়েছে। আমি আপনাকে অনেক ঘৃণা করি। অনেক। চিন্তা করবেন না আমাদের সন্তানকে নিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাবো। তাকে একজন ভালো মানুষ বানাবো।
যন্ত্রনায় তড়পাতে থাকলো সোহরাব। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠলো জমিন সহ ছায়ার শাড়ী। কাঁপা কাঁপা হাতে ছায়া সোহরাবের পুরো মুখে হাত বুলালো। সত্যি আজ তার একটুও কান্না আসছে না। কষ্টে চিত্ত ফেঁটে যাচ্ছে তবুও তার কাঁদতে মন চাইছে না। ছায়া শেষ বারের মতো সোহরাবের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-আমার স্বপ্নে আমাদের এইরকম পরিণতি ছিল না! খোদা আপনার ওপর দোয়েয়া করুক। প্রিয় না হলেও শ্রেষ্ঠ অপ্রিয় মানুষ হিসেবে আপনি আজীবন আমার মনে গেঁথে থাকবেন।
উঠে দাঁড়ায় ছায়া। হাতে চাবি নিয়ে উপমার কক্ষে যায়। দরজা খোলার সাথে সাথেই উপমা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ছায়াকে দেখে ধক করে উঠলো তার বক্ষস্থল। বিচলিত হয়ে ছুটে যায় ছায়ার কাছে। শাড়ীতে রক্ত দেখে আত্মা কেঁপে উঠে তার। ছায়ার গালে হাত দিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-তোর শাড়ীতে রক্ত কিসের? তুই ঠিক আছিস তো ছায়া?
ছায়া বড়ই ক্লান্ত স্বরে বলল,
-আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল উপমা। আমি বাঁচতে চাই, আমার সন্তানকে একজন ভালো মানুষ বানাতে চাই। আমাকে অনেক দূরে নিয়ে চল।
-সোহরাব,,,,
উপমাকে সম্পূর্ণ কথা বলতে দিলো না ছায়া। তার পূর্বেই বলল,
-মেরে ফেলেছি তাকে। কোনো কীটপটঙ্গের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ভবিষ্যতে আরেক আলাউদ্দিন মির্জাকে দেখতে চাই না আমি।
উপমা থমকে গেলো। কণ্ঠণালী দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না তার। ছায়া অসহায় ভঙ্গিতে উপমার দুইহাত চেপে ধরে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-খোদার দোহাই আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল উপমা।
-তুই তোর বাবার বাসায় চলে যা ছায়া এদিকটা আমি দেখি।
উপমার শান্ত কণ্ঠস্বর। ছায়া ত্বরিত গতিতে বলল,
-না। আমি অনেক দূরে চলে যেতে চাই কারো সাথে যোগাযোগ রাখবো না। তুইও আমার সাথে যাবি। আমাকে একা ছাড়িস না উপমা।
উপমা খানিকটা সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবলো। বড় বড় পা ফেলে আলমিরা খুলে ছায়াকে একটা শাড়ী ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-শাড়ী পরিবর্তন কর। সেখানে আমাদের জন্য কেউ সংসার সাজিয়ে বসে নেই!আমাদের কিন্তু কষ্ট করতে হবে তুই রাজি?
-আমার সন্তানের জন্য আমি সব করতে রাজি। তুই শুধু আমার পাশে থাকিস।
_________________________
“দশ বছর পর,,,,,,,,,,,,,
-সোহাইব মির্জা স্ট্যান্ডআপ
পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস চলছিল। হটাৎ ম্যামের কথায় সবাই চুপ হয়ে যায়। এই ম্যামকে সবাই ভীষণ ভয় পায়। কেমন রাগচন্ডা! সবসময়েই এই ম্যামের মুখে রাগ লেগেই থাকে। শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত কয়েকজন বালক বালিকা আস্তে আস্তে বলল,
-সোহাইব আজ গিয়েছে! আজ না ম্যাম ওকে ওর আম্মুকে নিয়ে আসতে বলেছিলো!
কথার পাল্টায় আরেকজন বলল,
-আমি ওকে গতকাল বলেছিলাম বেশি দুষ্টামি করিস না ম্যাম শুনলে বকবে। কিন্তু ও আমার কথা শুনলো না।
-আমার তো ভীষণ খারাপ লাগছে ওর জন্য। বেচারা এখন অনেক বকা শুনবে।
দুঃখী দুঃখী মুখ করে কথাটা বলল একজন বাচ্চা মেয়ে। সকলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
ম্যাম শ্রেণীকক্ষে কোথায়ও সোহাইবকে না দেখে পুনরায় উঁচু স্বরে বলল,
-সোহাইব কী আজ আসেনি ক্লাসে?
সোহাইবের বন্ধু মুখ ফুটে বলতে যাবে সোহাইব আজ স্কুলে আসেনি তার আগেই দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছোট একটি ফুটফুটে বালক বলল,
-ম্যাম আসতে পারি?
ম্যাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বালকটিকে পরোক্ষ করলো। দেখতে কত শান্ত ভদ্র মনে হয়! কী মায়া মুখটিতে! অথচ আচরণ আস্ত একটা বাঁদরের মতো! ম্যামের নজর পরলো সোহাইবের পাশে দাঁড়ানো একটি রমণীর ওপর। সেলোয়ার কামিজ, মাথায় হিজাব পরনে তার। শ্রী মুখশ্রীতে মোটা কালো ফ্রেমের একটি চশমা। ম্যাম তাকে দেখে এগিয়ে গেলো। হালকা হাসি দিয়ে বলল,
-আসসালামু ওলাইকুম হুমাশা ম্যাম।
-ওলাইকুম আসসালাম। আপনি সোহাইবকে তার পেরেন্ট’স নিয়ে আসতে বলেছিলেন ম্যাম?
নম্র স্বরে বলল হুমাশা মির্জা। সোহাইব তার হাত ধরে আছে। ভীত চাহনি তার। শ্রেণীকক্ষে তার বন্ধুরা চোখের ইশারায় দুষ্টামি করছে। সোহাইব তাঁদের ভেংচি কাটে।
ম্যাম কক্ষ থেকে বের হয়ে হুমাশাকে নিয়ে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়ায়। বিরক্ত কণ্ঠস্বরে বলল,
-সোহবাইব কাল আবার একটা ছেলেকে মেরেছে হুমাশা ম্যাম।
হুমাশা রাগী চোখে সোহাইবের দিকে তাকায়। সোহাইব মাথা নাড়িয়ে অকপটে বলে,
-আমি তাকে মারতে চাইনি খালামুনি। ঐ সিয়াইম্মা মিয়াইম্মা আমাকে কুকু’রের বা’চ্চা বলে বকা দিয়েছিলো তাই তো আমি তাকে মেরেছি। এভাবে ডিসুম ডিসুম দিয়েছি।
শেষের কথাটা অনেকটা অভিনয় করে বলল সোহাইব। হুমাশা তার দিকে একটু ঝুঁকে গালে হাত দিয়ে বলল,
-বাবা এভাবে কাউকে মারতে নেই। সে তোমাকে বকা দিয়েছিলো তুমি ম্যামকে বলতে পারতে। এভাবে তাকে মেরে তুমি কিন্তু খালামুনিকে অপমানিত করছো!
দুঃখী দুঃখী মুখ করে ফেলে সোহাইব। মাথা নত করে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে,
-সরি খালামুনি আর করবো না এমন।
-আমার সোনা বাচ্চা। তোমার সাথে কেউ বাজে ব্যবহার করলে তুমি ম্যামকে বলবা নাহয় আমাকে বলবা। ঠিক আছে?
-ঠিক আছে।
সোহাইব কানে হাত দিয়ে ম্যামের দিকে তাকায়। অনুতপ্ত স্বরে বলল,
-ম্যাম আপনাকেও সরি।
ম্যাম মৃদু হেসে সোহাইবের মাথা হাতিয়ে দেয়। তারপর হুমাশাকে বলে,
-আপনার ভাগ্নে টা এমন তার সাথে আমি রাগ করে বা উঁচু স্বরে কথাই বলতে পারি না!দেখলেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চায়।
হুমাশা স্বচ্ছ হাসলো। আগলে ধরলো সোহাইবকে। ম্যাম পুনরায় বলল,
-আপনি কলেজে আসছেন না কেনো ম্যাম? আপনার ছাত্রছাত্রীরা আমাকে আপনার কথা জিগ্যেস করে।
-একটু অসুস্থ কিছুদিন ধরে সুস্থ হলেই আসবো।
আরো কিছুক্ষন কথা বলল দুইজন অতঃপর হুমাশা সোহাইবকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজ তাঁদের অনেক স্পেশাল একটি দিন। চলন্ত রিকশায় বসে সোহাইব বলল,
-খালামুনি দেখো কী সুন্দর ফুল! আম্মু অনেক পছন্দ করবে।
হুমাশা মুচকি হাসলো। রিকশা থেকে নেমে পরলো দুইজন। ফুল বিক্রেতাকে বলল ফুল দিতে। সোহাইব আশেপাশে তাকিয়ে মানুষজন দেখছিলো। সহসা তার নজর পরে সামনে তাঁদের দিকেই অগ্রসর হওয়া কয়েকজন ছেলে আর মেয়ের দিকে। কপাল কুঁচকে ফেলে ছোট বালক। বিড়বিড় করে বলল,
-উড়ি মা! আমার না হওয়া বাবা তো তার হাতির মতো বন্ধুদের নিয়ে এদিকেই আসছে!
সোহাইব জলদি লুকিয়ে পরলো হুমাশার পিছনে। হুমাশা সামনে তাকাতেই ফিক করে হেসে উঠলো। তার বন্ধুদের দল এদিকেই আসছে। আসতে আসতে একজন যুবক বলে উঠলো,
-প্রফেসর হুমাশাকে তো এখন দেখাই যায় না! তা আমাদের ভয়ে আবার ঘরের ভিতর লুকিয়ে থাকে নাকি!
হুমাশা গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। নিদ্রান আর সহিফা নামক দুইজন হাসতে হাসতে এগিয়ে হাসলো হুমাশার কাছে। সহিফা জড়িয়ে ধরলো হুমাশাকে। উৎকণ্ঠে বলল,
-কেমন আছিস জান? কতদিন পর দেখা হলো।
-ভালো ছিলাম না বাঁদরদের সাথে দেখা হয়ে ভালো হয়ে গেলাম।
নিদ্রান হুমাশার মাথায় চাপর মারলো। এই দুইজন হুমাশা ওরফে উপমার কলেজের জীবনের বন্ধু। এখনও তারাই তার বেস্টফ্রেন্ড। আরো কয়েকজন ছিল সবার সাথে কথা বলল। নিদ্রানের এক পর্যায় নজর পরলো ছোট সোহাইবের দিকে। তাকে টেনে নিয়ে আসে হুমাশার কাছ থেকে। দুইগাল চেপে দিয়ে বলল,
-মাই চ্যাম্প, মায়ের মতো গোলুমলু হয়ে যাচ্ছ দেখি!
সোহাইব বিরক্ত হলো। মুখ ফুটে কিছু বলল না। নিদ্রান হুমাশার হাতে ফুলের তোড়া দেখে জিগ্যেস করে,
-ফুল কার জন্যে?
-কেমন প্রেমিক পুরুষ তুই বেটা! প্রিয়তমার জন্মদিন মনে রাখিস না!
-আসলে ভুলে গিয়েছিলাম।
অপরাধী স্বরে বলল নিদ্রান। সোহাইব তখন ফট করে বলে ফেললো,
-যাও যাও আঙ্কেল, তোমার মতো মনভুলা লোকের সাথে আম্মুর বিয়ে দেবো না।
সকলে একসাথে হেসে উঠলো সোহাইবের কথা শুনে। হুমাশা সবাইকে বলল সন্ধ্যার পর তাঁদের বাসায় আসতে। ছোটোখাটো আয়োজন করেছে। তারপর তারা তাঁদের বাসায় চলে গেলো।
কয়েকবার কলিংবেল বাজাতেই এক নারীমূর্তি দরজা খুলে দেয়। সোহাইব ছুটে তাকে জড়িয়ে ধরলো। রমণী গিলগিল করে হেসে ফেললো। হুমাশা তাকিয়ে দেখতে থাকলো মা ছেলেকে। এই নারীর এখন ত্রিশের ওপরে বয়স অথচ সেই দশ বছর আগের মতোই শ্রী মুখশ্রী! হুমাশা মনে মনে হাসলো আর বলল, “এনার সৌন্দর্য আর কমবে না। ওহে সোহরাব মির্জা তুমি বড়ই দুর্ভাগা! এতো সুদর্শন নারী তোমাকে জান প্রাণ দিয়ে চাইলো অথচ তুমি সর্বদা তাকে উপেক্ষা করেই গেলে!”
হুমাশা হালকা কাশির নাটক করতেই সোহাইব মাকে ছেড়ে দেয়। ছায়া উঠে দাঁড়ায়। সোহাইব আর হুমাশা মিলে ফুলের তোড়া এগিয়ে দেয় ছায়ার নিকট। বড় একটি হাসি উপহার দিয়ে দুইজন একসাথে বলল,
-শুভজন্মদিন সোহাইবের আম্মু।
ছায়া গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। অতঃপর হাসি মুখে ফুলের তোড়া নিয়ে বলল,
-ধন্যবাদ আমার প্রিয় মানুষ।
ক্লান্ত হয়ে নিজের কক্ষে আসে হুমাশা। মাথার হিজাব খুলে শান্ত হয়ে বসে বিছানায়। ঠান্ডা মস্তিকে ভাবতে থাকে সেইদিন রাতের কথা।
সেইদিন রাতে আর কোনোদিক ভাবে না হুমাশা। দরকারি কিছু জিনিস সাথে নিয়ে ছায়াকে নিয়ে বেরিয়ে পরে জমিদার গৃহ থেকে। ছায়ার কাছে মোটামোটি ভালো অংকের টাকাই ছিলো। সেগুলো নিয়ে তারা ঢাকায় চলে আসে। হুমাশা তার ফ্লাটে আসে। বিয়ের পূর্বে সে যেখানে থাকতো সেখানে এসে তার জমানো কিছু টাকা পয়সা ছিল। তার পালিত বাবার কিছু জমিজমা ছিল। তার পড়াশোনার জন্য সেগুলো বিক্রি করে টাকা এনে দিয়েছিলো তাকে। সেই টাকা নিয়ে তারা অন্য জায়গায় চলে যায়।
হুমাশার বন্ধু বান্ধব তাঁদের অনেক সাহায্য করে। নিদ্রান বড়োলোক বাপের একমাত্র ছেলে। ছায়াকে প্রথমদিন দেখেই মন দিয়ে ফেলে তাকে। পাগল প্রেমিক হয়ে উঠে চোখের পলকে। সে-ই তাঁদের থাকার ফ্লাট খুঁজে দেয়। হুমাশা টিউশন করতে থাকে কোনোরকম নিজের পড়াশোনা স্টার্ট করে। নিদ্রান, সহিফা টাকা দিয়েও তাঁদের অনেকভাবে সাহায্য করে। ছায়াও বাচ্চা হওয়ার পর টুকটাক ছাত্রছাত্রী পড়াতো। বেচারা নিদ্রান ছায়ার সবটা জেনেও তাকে অনেক ভালোবাসে। কয়েকবার প্রপোসও করেছিলো। শেষে একবার ক্রোধে ছায়া তাকে চড় মারে। অনেক কান্নাকাটি করে বলে তারা যাতে শুধু বন্ধু হয়েই থাকে এর বেশি কিছু না। সে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না নিজের ছেলেকে নিয়েই থাকতে চায়।
এভাবেই দিন চলে যায়। পড়াশোনার শেষ পর্যায় নিদ্রানের সাহায্যে হুমাশা কলেজে প্রফেসরের জব পেয়ে যায়। তারপর আর সে ছায়াকে কিছু করতে দেয়নি। ছায়ার কাজ শুধু সোহাইবকে দেখাশোনা করা আর তাঁদের জন্য রান্না করা। কয়েকটা বছর দুর্দিনের পর এখন তাঁদের জীবনে সুখের শেষ নেই। জমিদার গৃহের আর কারো সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ রাখেনি। ইয়াশার, তাহসিয়ার সাথেও না। ছায়াও তার পরিবার স্বজনের সাথে যোগাযোগ করেনি।
নিদ্রান এখনও একতরফা ভালোবাসে ছায়াকে। ছায়ার সমবয়সী হওয়ার সত্ত্বে এখনও বিয়ে করেনি। ছায়া তাকে রিজেক্ট করেছে এতে তার একটুও আপসোস বা ক্ষোপ নেই। ভালোবাসলে পেতেই হবে এটা ভুল! দূরের থেকেও ভালোবাসা যায়।
________________________
সন্ধ্যার পর হুমাশা আর সোহাইব মিলে তাঁদের ঘরের ড্রইংরুম সুন্দর করে সাজায়। ছায়াকে ঘরবন্দি করে রাখে তখন। হুমাশা নিজ হাতে বাহারি রকমের খাবার রান্না করে। যেটার ঘ্রাণে তাঁদের পুরো ফ্লাট মৌ মৌ করছে। সোহাইব তাকে টুকটাক সাহায্য করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই উপস্থিত হয় হুমাশার বন্ধুগণ। নিদ্রান চোরা চোখে প্রেয়সীকে খুঁজতে থাকে। সহিফা হুমাশাকে পরিবেশন করতে সাহায্য করে। সাত আটজন মিলে হুমাশাদের ফ্লাট মাতিয়ে নিয়েছে একদম! সোহাইব দরজা খুলে মাকে নিয়ে আসে।
লাল রঙের শাড়ী পরিহিত ছায়াকে দেখে চিত্ত ধক ধক করতে থাকে নিদ্রানের। ছায়া খুশিতে পুলকিত হয়ে উঠলো। ছেলের গালে চুমু খেলো। কেক কাট করলো। সোহাইব হুমাশা একসাথে নাচলো। হুমাশার সকল বন্ধুরা একে একে ছায়াকে গিফট দিলো। সবকিছু দেখে ছায়া হাসতে হাসতে শেষ। সবার গিফট দেওয়া হলে নিদ্রান আসে। ছায়ার হাতে গিফট ধরিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
-অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে।
-ধন্যবাদ নিদ্রান।
নিদ্রান মাথার পিছনে হাত দিয়ে মুচকি হাসলো। এতো খুশির মধ্যে ছায়ার মনে পরলো তার অপ্রিয় পুরুষটির কথা। তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ তিনটে পুরুষ। তার বাবা যে সারাজীবন একটা পুত্রের আশার তাকে অবহেলা করে চলেছে। তার স্বামী ছিল এক পুরুষ। যে তাকে সারাজীবন দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে রাখতো। আর এখন তার পুত্র তার জানের টুকরা, যে তার হাসিখুশি থাকার কারণ। তাকে কিভাবে খুশি করবে, কিভাবে হাসাবে সেই মনস্থিরেই থাকে!
সব কিছুর উর্ধে ছায়ার শ্রেষ্ট পাওয়া হুমাশার মতো একজন বেস্টফ্রেন্ড অথবা বোন। এই মানুষটার জন্যেই সে এখন এখানে আছে। তার এই সুখনীরের মূলই হুমাশা মির্জা। যদি আজ হুমাশা না থাকতো তাহলে হয়তো সে কখনই সুখী হতে পারতো না! হুমাশাকে সে বলেছিলো আরেকটা বিয়ে করে নিতে। কিন্তু হুমাশা তাকে বলেছিলো আমি আমার পরিবার পেয়ে গিয়েছি আর বিবাহ করবো না। প্রতিউত্তরে ছায়া আর কিছুই বলতে পারে নাই।
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো ছায়া। হুমাশা, সোহাইব উঁচু স্বরে ডাকছে তাকে। কী সুন্দর সবাই মিলে নাচছে। কত হাসিখুশি সকলের মধ্যে! হুমাশার জন্যে ছায়াও কতগুলো ভাইবোনের মতো বন্ধুবান্ধব পেয়েছে।
সোহাইব দৌড়ে এসে মাকে টেনে নিয়ে যায় সকলের মধ্যে। হুমাশা, সহিফা, নিদ্রান, সোহাইব বাকি সকলে ছায়ার চারোপাশে গোলগোল ঘুরে গানের সাথে নাচতে থাকে।
ছায়ার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। সকলের আড়ালে চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে তার। এটা যে সুখের অশ্রু! বিড়বিড় করে বলল,
-মাশাআল্লাহ! আমার স্বপ্নের সংসার! কারো নজর লাগুক। খোদা আমার মানুষ দুইজনকে এভাবেই সবসময় হাসিখুশি রেখো। আমার সকল সুখও তুমি তাঁদের দিয়ে দিও।
____সমাপ্ত____