অপ্রাপ্তি পর্ব-০৮

0
989

#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ০৮

হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছি। একটু দূরত্বেই কাগজ হাতে ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিশান। পাশেই বসে আছে মিহির। আর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রবিউল হাসান, রাহেলা বেগম, ইশান আর রুমি। রিশান এক দৃষ্টিতে কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে।

.

নিভু নিভু নেত্রকোণে অশ্রু জমা হলো। মাথা টা ধরে আছে। পাশে লক্ষ করলাম মিহির চেয়ারে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। চারপাশ টা লক্ষ করতেই বুঝলাম আমি হসপিটালে আছি। কিন্তু.. আমি তো.. কী হয়েছিল আমার? এখানে কী করে এলাম আমি? আমার ভাবনার মাঝেই মিহির জেগে উঠল। অস্থির হয়ে বলল, ‘ভাবী! তুমি.. তুমি ঠিক আছো? কেমন লাগছে এখন?’

‘আ-আমি.. ঠিক-আছি.. মি-হির। কিন্তু.. আমি-এখানে-কেন?’

মিহির শক্তমুখে বলল, ‘অনেক কিছু হয়ে গেছে ভাবী। আমি আর তোমাকে ওই বাড়িতে রাখব না৷ তুমি.. তুমি কালই ওই বাড়ি থেকে তোমার সব জিনিস নিয়ে চলে যাবে ওকে?’

‘কি-ন্তু কী হ-য়েছে তা-তো.. ব-লো।’

‘ওরা তোমার খাবারের মধ্যে ইঁদুরের বিষ মিশিয়েছিল ভাবী। ভাগ্যিস তুমি সব খাও নি। কিন্তু বিষক্রিয়া ঠিক’ই হয়েছিল। যদি তুমি সঠিক সময়ে আমাকে না ডাকতে তাহলে আজ সব শেষ হয়ে যেত ভাবী।’

ছিঃ কী বাজে লোক এরা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। তারা একটু আধটু খারাপ কাজ করতেই পারে৷ কিন্তু এত খারাপ কাজ.. ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! আমি ঠিকভাবে কথা বলতে পারছি না। ক্লান্ত লাগছে খুব। মিহির বলল, ‘ঠিক আছে তুমি এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও ভাবী। পরে সব হবে।’

দুপুরের দিকে মিহির খাবার আনে। সে নিজ হাতেই খাইয়ে দেয় আমাকে। মিহিরকে ননদ হিসেবে নয় বোন হিসেবে পেলে আমি খুন ভাগ্যবতি হতাম। যদিও ননদ হিসেবে পেয়ে গর্বিত আমি। খাওয়া শেষে মিহির বলল, ‘আমি পুলিশে ফোন দিব ভাবী। আমি আর সহ্য করতে পারছি না ওদের পাপ গুলো।’

থামিয়ে দিলাম, ‘না মিহির। পুলিশ কী করবে? সর্বোচ্চ জেলে দেবে। শেষে ঠিক’ই জামিন করিয়ে ছেড়ে দেবে। এখন তো টাকাই সব। আর কিছু হবে?’

‘তাহলে কী করব ভাবী বলো?’

‘আমার রব এর বিচার করবেন। আমি আর কিছুই করব না। শুধুই ধৈর্য ধরো। দেখ এই পরিবারের কী হয়।’

‘আমি আর থাকব না ওই বাড়িতে।’

‘রিশান সাহেব কোথায়?’

‘আছে বাড়িতে। থাকতে চেয়েছিল রাতে আমি দেই নি। কী দরকার মিছে যত্ন দেখিয়ে?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলললাম। তারপর বললাম, ‘ডিভোর্স পেপার রেডি আছে?’

‘হ্যাঁ ভাবী। কালই পাব।’

‘শুনো! আমি শুধু ডিভোর্সই দেব না। সাথে কিছু কথা শুনাতে না পারলেই নয়।’

‘হুম।’

‘ইশি নামের মেয়েটাকে ডাকতে হবে।’

‘ভাইয়াকে দেখাবে নাকি?’

‘হ্যাঁ! আমি চাই সব একসাথে করতে। বাকি টা প্রভু করবেন।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

আমাকে আরো দু’দিন রাখতে চেয়েছিল। যদিও বাবার সঙ্গে পরিচিত ছিল তারা। তাই বলাতে বিকালেই ডিস’চার্জ করে দেয়। মিহির কোনমতে ইশির ঠিকানা জো’গাড় করে তাকে পর’দিন উপস্থিত থাকতে বলে।

.

প্রায় কিয়ৎক্ষণ কাগজটার দিকে তাকিয়ে রিশান অস্ফুট স্বরে বলল, ‘এটা কী ইবনাত?’

‘কেন আপনি এটা চিনেন না? ডিভোর্স পেপার এটা।’

‘মানে? তুমি আমায় ডিভোর্স দিচ্ছো?’

‘আপনার হবু কাজ টা আমিই সেরে দিলাম মি. রিশান। আমি সাইন করে দিয়েছি। এবার আপনার শুভ কাজ টা শেষ করুন।’

‘ম-মানে? এসব কী বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে?’

‘কেন ঠিক থাকবে না মি. রিশান? আপনিই তো ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন আমায়৷ কিন্তু আপনি হয়তো বলতে পারছেন না। তাই আমি নিজেই দিয়ে দিলাম৷ নিন সাইন করে আমায় মুক্তি দিন।’

‘তুমি আমার থেকে মুক্তি চাচ্ছ?’

‘মুক্তি তো আপনি চাচ্ছেন।’

‘মানে? আমি তোমাকে কখনো বলেছি আমার মুক্তি লাগবে তোমার থেকে?’

‘বলেন নি? কিন্তু.. কথার আর কাজের মাধ্যমে তো বুঝিয়েই দিয়েছেন আপনি ঠিক কী চাচ্ছেন আমার থেকে?’

‘কী করেছি আমি?’

‘উফ মি. রিশান। এত কথা বলছেন কেন? আপনার কী নূন্যতম জ্ঞানবোধ নেই যে আপনি এটুকু বুঝতে পারছেন না?’

‘ইবনাত তুমি ঠিক কী করতে যাচ্ছ? আমি তোমাকে বলেছি যে আমি ডিভোর্স চাই?’

‘তা আপনি কী চান না?’

রিশান চুপ মেরে যায়। মিহির বলল, ‘ভাইয়া শুধুই টাইম ওয়েস্ট করছো৷ সাইন করে দাও। সব শেষ!’

মিহিরের দিকে তাকিয়ে ও বলল, ‘মানে তুইও আছিস এতে?’

‘থাকি না থাকি বিষয় না। তুমি তোমার কাজ করো। অনেক পুড়িয়েছো ভাবীকে.. মানে আপুকে৷ এখন মুক্তি দাও।’

রিশান আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে বললেই পারতে তুমি অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে আছো।’

‘শাট আপ! একদম বাজে কথা বলবেন না। নিজেই আপনি অন্য মেয়েতে আসক্ত আর আপনি আমায় বলছেন আমি সম্পর্কে জড়িয়েছি? লজ্জা করছে না? খুব তো বলেছিলেন সারাজীবন একসাথে থাকব। কিন্তু? কই গেল আপনার এই ওয়াদা? কই গেল আপনার ভালোবাসা?’

‘ম-মানে? কী বলছো এসব?’

মিহির বলল, ‘হয়েছে আর ন্যাকা সাজতে হবে না। [অতঃপর চিল্লিয়ে] ইশি আপু!’

রিশান ‘ইশি’ নাম টা শুনায় ভীষণ চমকে গেল৷ হাসলাম আমি। দরজার উপাশ থেকে ইশি ভেতরে প্রবেশ করল। আমি হেসে বললাম, ‘কী মি. রিশান? এবার আপনার অভিনয় বন্ধ করবেন প্লীজ?’

রিশান হা হয়ে ইশির দিকে তাকিয়ে রইল। ইশি বলল, ‘কী ব্যাপার রিশান? সাইন করছো না কেন তুমি?’

‘ত-তুমি? এখানে কী করছো ইশি?’

ইশি কিছু বলল না। আমি বললাম, ‘আপনি আমায় ধোঁকা দিয়েছেন। খুব ভালোবেসেছি আপনাকে। কিন্তু আপনি? কোন মূল্য দিলেন না। তখন তো খুব বলেছিলেন আমায় আগলে রাখবেন। কথা রেখেছেন? না রাখেন নি। আপনি তো নিজেই আমায় ডিভোর্স দেওয়ার প্লান করছিলেন। আমি সব জানি। আর তা এক মাস আগে থেকেই জানি।’

রিশান হেসে ফেলল, ‘জেনেই যেহেতু গিয়েছো তাহলে তো আমার কাজ আরো সোজা হয়ে গেল। থ্যাংক ইউ ইবনাত। তুমি কত সহজেই বুঝে নিলে আমি কী চাই। তোমার মতো মেয়েই দরকার প্রত্যেকটা স্বামীর জন্য।’

‘শাট আপ! সবাইকে নিজের মতো ভাববেন না।’

রুমি বলল, ‘ভেবে চিন্তে করছো তো ভাবী? পরে কিন্তু পস্তাবে।’

‘আমি কারো জন্য পস্তাই না মিসেস. রুমি। সবাই আমার জন্য পস্তায়। আর হা মি. রিশান আপনার মু’খুশের আড়ালের চেহারার সাথে তো আমি সেই দু’মাস আগেই পরিচিত হয়ে গেছি। নতুন করে পরিচয় হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তো এখন কী দয়া করে এই মিছে সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিবেন আমায়?’

রিশান কিছুক্ষণ তাকিয়ে হেসে সাইন করে দিল। কেঁপে উঠলাম খানিকটা। মানা টা বড় কষ্টকর যে আমি আর রিশানের নেই৷ এবার আমি রুমি আর মিসেস. রাহেলার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে রইলাম। বললাম, ‘খুব তো চেয়েছেন যেন আমি চলে যাই আপনাদের মাঝ থেকে। যাচ্ছি না বলে মেরেও ফেলতে চেয়েছেন। আমি চাইলে তো আপনাদের পুলিশে দিতে পারতাম। কিন্তু.. আমি দেব না। কারণ আমি জানি আর আমার আল্লাহ্ জানে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি, কতটা আঘাত পেয়েছি এ দু’বছরে। তার চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছি আপনার ছেলের এই অ’সময়ে বদলে যাওয়াতে। যখন তাকেই আমার পাশে দরকার ছিল তখন’ই সে অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে গেছে। আর আপনারা? কেন এমন করলেন আমার সাথে? দু’বছর ধরে আমার সঙ্গে অন্যায় করে এসেছেন। আর এর প্রতিবাদ করেছি বলে আমায় দুনিয়া থেকেই বিদায় করে দিচ্ছেন? হার্টলেস আপনারা। মিসেস. রাহেলা আপনি তো আপনার মেয়েকেও ভালোবাসতে জানেন না। কারণ আপনি যেখানে নিজের মেয়ের মতো একজনকে মেরে ফেলতে পারেন খাবারে বিষ মিশিয়ে সেখানে আপনি নিজের মেয়েকে মারতেও দ্বিধা করবেন না। আমিও তো একটা মেয়ে আপনার মেয়ের মতো। আমিও তো আপনার বউমা আপনার ছোট বউমার মতো। তাহলে আমাকে কী আপনার ছোট বউমার মতো ভালোবাসা যায় না? তার মতো গুরুত্ব দেওয়া যায় না? আমিও তো কোন মায়ের মেয়ে। আর আপনিও তো একজন মা। তাহলে তাকে এভাবে কষ্ট দিতে, এভাবে মেরে ফেলতে বুক কাঁপল না? আপনি তো মায়ের মতো নিষ্পাপ পবিত্র নাম টায় কালি লাগাচ্ছেন। কেন মা? মায়ের পরে আপনাকেই ভালোবেসেছি৷ আপনার মন পেতে কী না করেছি আমি। তবু আপনি.. কীভাবে পারলেন?’

রাহেলা বেগম চুপ করে রইলেন। তবে উনার অসহায় দৃষ্টি টা চোখে পড়ল। রুমির দিকে তাকালাম, ‘বোন! যখন নতুন বিয়ে হয়েছিল তখন ভেবেছিলাম তুমি আমার বোন হবে৷ আর মিহিরের মতো আমায় বুঝবে৷ কিন্তু.. কে জানতো তুমি তাদের মতোই হবে। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের ক্ষতি কীভাবে করতে পারে তা তোমাকে দেখেই শিখলাম। আচ্ছা বোন৷ তোমার কী নিজের বোন নেই? যদি থাকত তার সঙ্গে এমন করতে পারতে বলো? আমি কী দোষ করেছিলাম? যে আমার সঙ্গেই এমন করলে? মিলেমিশে থাকা যেত না? থাকলে কী খুব অসুবিধা হয়ে যেত?’

রুমি চুপ করে রইল। রবিউল হাসানের দিকে এগিয়ে গেলাম, ‘বাবা! জানেন এই দু’বছরে বাবাকে অনেক মিস করেছি৷ তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে মাত্র হাতে গোনা ক’বার। তাই বাবার শূন্যতা টা আপনাকে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি? বাবার শূন্যতা তো পূরণ করেন নি তার উপর অপমান করে গেছেন আমাকে। কেন? কী দোষ করেছি আমি? শুধু তো একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম বাবার। আপনি তাতো দিলেন না৷ তার উপর প্রাপ্য সম্মান টাও দেন নি। কেন? আমি কোন পাপ করেছি? আপনাদের মন পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা টা করেছি। তবু কেন পাইনি?’

বাকিদের উনিও চুপ। ইশানের দিকে এগিয়ে গেলাম, ‘ভাই! আমার কোন ভাই নেই। তাই তোমাকেই ভাই ভেবেছিলাম৷ কিন্তু তুমি বোন তো দূর ভাবীর সম্মান টুকু দাও নি৷ কেন? আমি কী খারাপ? তোমাকে অবহেলা করেছি? অপমান করেছি? মে’রেছি? তাহলে? কেন এত বাজে ব্যবহার?’

ইশানও বাকিদের চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। রিশানের দিকে এগিয়ে গেলাম। হেসে বললাম, ‘মি. রিশান৷ দোয়া করি আপনার জন্য। শত শ্রদ্ধা। যে ঘরে বউ রেখে অন্য নারীতে আসক্ত হয়েছেন। তাকে দিনের পর দিন অবহেলা, অত্যাচার করে পরনারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আপনি তো কাপুরুষ। যে পরনারীতে আসক্ত আপনি। আপনাকে আর কিছু বলার নেই। শুধু এটুকুই বলব, আল্লাহ্ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখুক।’

অতঃপর চিল্লিয়ে বললাম, ‘আমি তো কিছু করব না। কিন্তু আমি কাউকে ছাড়ব না। আল্লাহ্ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। উনি আপনাদের কাউকেই ছাড়বে না। আমার সাথে করা প্রতিটা অন্যায়ের হিসাব উনি নেবেন।’

হাতে কিছুই নিলাম না। দরকার নেই আমার এসব জিনিসের। মোবাইল টা নিয়ে বেরিয়ে আসার পূর্বে ইশিকে বললাম, ‘যে অন্য নারীর জন্য তার বউকে ছাড়তে পারে। সে আরেকজনের জন্য তোমাকেও ছাড়তে পারে মিস. ইশি। কথাটা মনে রেখো।’

বেরিয়ে এলাম ওই ঘর থেকে। আর কবে এর মুখ দেখব জানি না। তবে এই পরিবারের পরিণতি দেখতে অবশ্যই ফিরে আসব।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে