#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ০৭ [হালকা ধামাকা]
নেত্রপল্লব গ্রথন করে কল অপশনে চাঁপ দিলাম। দু’বার রিং হতেই ফোন রিসিভ হলো। যেন এই ফোনেরই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কাঁপা গলায় বললাম, ‘হ-হ্যালো বাবা।’
স্পিকার অন করা ছিল। উপাশ থেকে অস্ফুট স্বর ভেসে এলো, ‘মা!’
আঁখিকোণ ভিজে উঠল। প্রায় ন’মাস পর ডাকটা শুনেছি। হ্যাঁ! শেষবার বাবা আর মায়ের সঙ্গে ন’মাস আগে কথা হয়েছে আমার। তাও তারা নিজ থেকে দিয়েছিলেন। আমি দেই নি৷ ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে৷ তখন মোবাইল নেওয়ারও সুযোগ ছিল না আমার।
‘মা কেমন আছিস তুই?’
‘ভ-ভালো আছি.. বাবা। ত-তুমি কেমন.. আছো?’
‘আমি ভালো নেই রে মা। তুই কী কাঁদছিস?’
‘ন- না না। আমি.. কাঁদছি না৷ তুমি ভালো নেই মানে?’
‘আর বলিস না। কিছুদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছি। আর তোর মা প্রেশারে।’
‘মানে কী? আমায় একটা কল করতে পারলে না?’
‘তুই করতে পারলি না? এই অভাগী বাবা মায়ের খোঁজ তুই নিতে পারলি না?’
থমকে গেলাম। সেটাই তো। তারা কেন কল করবে? আমি কী করতে পারতাম না? একটা বার তাদের খোঁজ নিতে পারলাম না? কী নিষ্ঠুর আমি! এত জঘন্যতম কাজ আমি কীভাবে করতে পারলাম? আমি তো এমন ছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা। আমি সত্যি দুঃখিত। আমিও ভালো নেই বাবা। তোমাদের ছাড়া একদম ভালো নেই। তুমি ঠিক’ই বলেছিলে সে’দিন। রিশান আমাকে সুখ দিতে পারবে না।’
বাবার অস্থির কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো, ‘মানে? কী বলছিস এসব? রিশান কী করেছে তোর সাথে? ইবনাত মা কী হয়েছে?’
‘সে অনেক কথা বাবা। আমি আসছি আর কিছুদিনের মাঝে। তখন বলব। তো ডাক্তার দেখাও নি?’
‘হ্যাঁ দেখিয়েছি। এসবের কারণে দু’টা সার্জারী বাদ গেছে৷’
‘সার্জারী বড় না তুমি বড়?’
‘মানুষের জীবন’ই বড়। ওরা চেয়েছিল আমিই করি। জানিস? কাল একটা সার্জারী ছিল আমার। মেয়েটা একদম তোর মতো। ওকে দেখে এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি আমার মেয়েকে ফিরে পেয়েছি। ওর বাবা মা নেই। আমাকেই বাবা ডাকছিল। ক’দিন পর বাবা ডাকটা শুনলাম। মেয়েটা প্রেম করে বিয়ে করেছিল। তিন মাস পেরুতে না পেরুতেই নির্যাতন শুরু করে দেয়। সে’দিন বিছানা থেকে ফেলে দেওয়ায় পেটে বড় রকমের আঘাত পায় আর জখম হয়। তখন আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু আমি তো পারিনি। শুধু তাকে সাহস আর স্বান্তনা দিয়েছি৷ আর সে আমায় বাবা ডেকেছিল। আর আজ আমি আমার মেয়ের মুখে ‘বাবা’ ডাকটা শুনলাম।’
নেত্রকোণায় জমা জল গুলো টুপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। বললাম, ‘বাবা! তুমি কী আমায় ভুল বুঝেছো?’
‘না রে মা। তোকে কেন আমি ভুল বুঝব?’
‘যে আমি তোমার বিশ্বাস ভেঙে রিশানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছি। তোমার অমতে বিয়েও করেছি। তোমার সঙ্গে কথাও বলিনি। কতটা স্বার্থপর আমি।’
‘তুই স্বার্থপর না। তুই বাচ্চা মেয়ে কোন টা সঠিক কোনটা ভুল না বুঝেই করে ফেলেছিস।’
‘সংসারী একটা মেয়েকে তুমি বাচ্চা বলছো?’
বাবা হেসে বললেন, ‘আমার কাছে তো তুই বাচ্চাই।’
হেসে ফেললাম। মিছে ছলনায় পড়ে বাবা নামক বটছায়ার থেকে দূরে ছিলাম আমি। ভাবতেই গলা আটকে আসছে। বাবা ডাকলেন, ‘ইবনাত মা। তুই কী আসবি আমাদের কাছে একটা বার?’
‘হ্যাঁ বাবা একবার কেন? আসব আমি। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমি একেবারের জন্য চলে আসব।’
‘একেবারব মানে বুঝলাম না৷ এই তোর কী কিছু হয়েছে মা?’
‘সে অনেক কথা বাবা আসলে বলব। আচ্ছা ধরো তুমি মিহিরের সঙ্গে কথা বলো।’
বাবার সঙ্গে যতবার কথা হয়েছে তখন মিহিরও কথা বলেছিল। আর বাবা মিহিরকে আমার মতোই ভালোবাসেন। মিহির ফোন কানে লাগাল, ‘হ্যালো আঙ্কেল। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম মিহির মামনী। কেমন আছো?’
‘এই তো আঙ্কেল ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু শ্বাসকষ্ট চলছে।’
‘হুম আঙ্কেল শুনেছি। ডাক্তার দেখান নি?’
‘হ্যাঁ তা দেখিয়েছি। তা তোমার কী খবর? পরীক্ষার কী অবস্থা?’
‘হ্যাঁ আঙ্কেল সামনেই পরীক্ষা। দোয়া করবেন।’
‘হ্যাঁ তা তো করব।’
‘তো আঙ্কেল আন্টি কোথায়? উনি কেমন আছে?’
‘আছে তোমার আন্টি৷ প্রেশার লো। শুয়ে আছে।’
‘উনাকে একটু দিন না।’
‘হ্যাঁ আচ্ছা। ইফা! ইফা! এই নাও।’
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, ‘কে?’
‘আরে দেখোই না কে।’
মিহির ফোন আমায় ধরিয়ে দিল। কান্নামিশ্রিত গলায় বললাম, ‘হ্যালো আম্মু।’
কিছুক্ষণের জন্য ওপাশ টা থমকে গেল। কোন আওয়াজ আসছে না। একটু পর মা অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, ‘ইবনাত!’
‘হ্যাঁ আম্মু আমি। কেমন আছো?’
‘আমার কথা ফেল। তুই কেমন আছিস? কোথায় ছিলিস এত দিন? আমার কথা কী তোর মনে পড়ে নি?’
‘পড়েছে তো। কিন্তু.. অনেক সমস্যা হয়েছে তাই..’
‘সে রাখ। কেমন আছিস তুই?’
‘ভালো নেই আমি আম্মু। তোমাদের ছাড়া একদম ভালো নেই।’
‘কেন মা কী হয়েছে?’
‘সে বলব তোমাদের। আমি আর কিছুদিন পর আসছি তোমাদের কাছে।’
‘সত্যি তুই আসছিস?’
‘হুম আম্মু। শুধু আমি না মিহিরও আসবে।’
‘মিহিরও? আচ্ছা আসিস। মেয়েটাকেও দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘আচ্ছা।’
‘তো রিশান কেমন আছে?’
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, ‘ওর কথা একদম জিজ্ঞাস করবে না আম্মু।’
‘কেন ইবনাত? কী হয়েছে?’
‘অনেক কিছু হয়ে গেছে।’
‘কী?’
‘বলব আর কিছুদিন সময় দাও।’
‘আচ্ছা। ক’দিন লাগবে আর?’
‘এই ধরো আর এক সপ্তাহ বাদেই আসছি।’
‘ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস।’
‘আচ্ছা আম্মু রাখি৷ আল্লাহ্ হাফেজ।’
‘আচ্ছা ফি আমানিল্লাহ্। আল্লাহ্ হাফেজ।’
কল কেটে মিহিরের দিকে তাকালাম। মিহির বলল, ‘আর এক সপ্তাহও নয় ভাবী। আঙ্কেলের সঙ্গে আমার আজ সকালে কথা হয়েছিল। উনি বলেছে আর পাঁচ দিনের মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে। পেপার্স উনি পাঠিয়ে দেবেন।’
মুখ মলিন হয়ে এলো। শতহোক একটা সময় রিশানকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। কিন্তু আজ! আজ আমরা বিচ্ছিন্ন। শুধু তার জন্য। মিহির বলল, ‘মন খারাপ করছো ভাবী?’
‘নাহ্! মন খারাপ কেন করব?’
‘আমি তো দেখতে পাচ্ছি তোমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।’
‘থাক ওসব বাদ দাও।’
‘হুম।’
.
প্রায় দু’দিন পেরিয়েছে৷ আমি একটা কাজও করিনি। শুধুই বসে বসে খেয়েছি যেভাবে রুমি আর রাহেলা বেগম করেছেন।
‘আর কত’দিন তোর এই ডানা উড়বে হ্যাঁ? দেখে নিস এই ডানা আমি কেঁটেই ছাড়ব।’
রাহেলা বেগমের কথায় হাসলাম। বললাম, ‘আমি মানুষ। আমার কোন ডানা নেই। আর উড়ছি? সেই তো বায়ুথলি গুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম উড়ার জন্য। অনেক জমা হয়েছে। এতদিন জমিয়েছি, আপনারা উড়েছেন। এবার আমার পালা।’
‘তুই কী ভেবেছিস বসে বসে খাবি? দেখ আজ তোর কী হয়।’
আমি বরাবর’ই সোফায় বসে রইলাম। আজ স্কুল কোন এক কারণে বন্ধ। মিহির স্কুলে। রুমি আজ রাহেলা বেগমের আদেশে ভার্সিটি যায়নি। যেহেতু এত কাজ করা উনার পক্ষে সম্ভব নয়। নিশাত আপু কাজ কর্ম করে না। সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। শত বলেও কাজ করাতে পারে না ওকে দিয়ে। যাক এতেই ভালো একটু শিক্ষা হোক।
.
প্রায় দুপুর। মিহির বাসায় এসেছে টিফিন ছুটিতে। তাড়া দিয়ে বলল, ‘আম্মু ভাত দাও তাড়াতাড়ি। আমার দেরি হচ্ছে।’
ততক্ষণে আমি গোসল আর নামাজ সেরে নিচে এসেছি। রাহেলা বেগম আর রুমি খাবার টেবিলে আনল। নিশাত আপুও নিচে নেমে এলো। সবাই বসলে রুমি আর রাহেলা বেগম খাবার সার্ভ করলেন। হঠাৎ দেখতে পেলাম রুমি আলাদা একটা প্লেট আনছে। সেখানেও ভাত, মাংস সাজানো ছিল।৷ ভ্রু কুঁচকালাম। সবার জন্য ভাত তরকারি সার্ভ করা শেষ হলে আমি একটা নিতে গেলে রাহেলা বেগম থামিয়ে বললেন, ‘দাঁড়া ওটা তোর না।’
‘মানে? এখানে কী খাবার আলাদা খাওয়া হয় নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই নিয়ম আবার কবে চালু হলো আজব।’
রাহেলা বেগম একটা প্লেট এগিয়ে বললেন, ‘এটা তোর।’
লক্ষ করলাম এটা সেই প্লেট যেটা রুমি আলাদা ভাবে আনছিল। সন্দেহ জাগল মনে। কিছু তো হয়েছে। তারপর সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। কিছু করতেই হবে। আমার পাশেই নিশাত আপু বসে ছিল। হঠাৎ নিশাত আপুর হাত থেকে চামচ পড়ে গেল। গড়াগড়ি খেয়ে ডাইনিং টেবিলের নিচে ঢুকে গেল। নিশাত আপু নিতে গেলে রুমি বলল, ‘থাক আমি নিচ্ছি আপু।’
রুমি নিশাত আপুর পাশে এসে ডাইনিং টেবিলে মাথা ঢুকিয়ে হাত বাড়িয়ে চামচ টা নিতে যায়। আর নিশাত আপু রুমির দিকেই তাকিয়ে ছিল। এদিকে রাহেলা বেগম মিহিরকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিল। এই তো সুযোগ! চট করে আমার প্লেট টা নিশাত আপুর সামনে রেখে তার টা আমার সামনে নিয়ে এলাম আর রিল্যাক্স হয়ে বসলাম। মিহির ব্যাপার টা লক্ষ করলে ভ্রু কুঁচকে ইশারায় প্রশ্ন করে, কী? আমি ইশারায় বললাম, দেখে যাও। রুমি চামচ নিয়ে উঠে এসে নিজ আসনে বসল। নিশাত আপু সোজা হয়ে বসল। আর রাহেলা বেগমও চেয়ারে বসে খাওয়া শুরু করলেন। লক্ষ করলাম রুমি আর রাহেলা বেগম আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার অগোচরে হাসলাম। আমি আস্তে করে নিশাত আপুর দিকে তাকালাম। নিশাত আপু মাংস সমেত ভাত মুখে দিতেই তার মুখ বিকৃত হয়ে এলো। তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেসিনে গিয়ে সব বমি করে ফেলে দিল। ভ্রু কুঁচকালাম। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ফিরে এসে প্লেট টা নিয়ে ফ্লোরে সজোড়ে ছুড়ে মারল। সবাই চমকে উঠল৷ নিশাত আপু চিল্লিয়ে বলল, ‘এসব কী? কী খাবার দিয়েছো আমাকে? কী আছে এতে? এক দানা লবণও নেই। মরিচ আর হলুদ গুঁড়ো দিয়ে তেঁতো বানিয়ে ফেলেছোম ছিহ্ কী বাজে! এত বাজে রান্না কে করেছে?’
আচ্ছা? এবার বুঝলাম৷ লবণ বিহীন বেশি করে মরিচ গুঁড়ো আর হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে আমাকে খাওয়াতে চেয়েছিল। বাহ্! কী সুন্দর পরিকল্পনা! আমি বললাম, ‘তুমি তো জানোই আপু কিছু দিন ধরে আমি রান্না করছি না।’
রুমি আর রাহেলা বেগম একে অপরের দিকে তাকাল। রুমি বলল, ‘কিন্তু আপু আমি তো এমন করব না তোমার সঙ্গে।’
নিশাত আপু চিল্লিয়ে বলে, ‘তো? কে করেছে এমন? নিশ্চয়ই কেউ করেছে। জ্বীন এসে তো করে যাবে না।’
রাহেলা বেগম আর রুমি সন্দিহান চোখে তাকায় আমার দিকে। আমি ক্রিপি হাসি দিলাম। রুমি বুঝতে পেরে তেড়ে এসে বলল, ‘তুমি করেছ না? আমি জানি তুমিই করেছ।’
‘কিন্তু.. রান্না তো আমি করিনি।’
‘রান্না করো নি তো কী। কাজ টা তো তুমিই করেছ।’
‘কোন কাজ?’
‘এই কাজ টা।’
‘আচ্ছা? এক মুহুর্তের জন্যও আমায় কিচেনে যেতে দেখেছো?’
‘অগোচরেই করেছ জানি।’
‘হুম ঠিক বলেছো। অগোচরেই করেছি।’
‘দেখেছো আপু আমি বলেছি না?’
নিশাত আপু বলল, ‘কেন করলে এমন?’
‘আমি তো করিনি আপু। রুমিই করেছে।’
‘কীসব তোমরা দু’জন?’
‘আমি বলছি আপু। রান্না টা আমার জন্যই করেছ রুমি রাইট? কিন্তু.. আমি জানি তোমরা কিছু একটা করেছ খাবারে। তাই আমি ট্রাই করতে নিশাত আপুর টা অদলবদল করলাম। আর দেখ! তোমাদের প্লান টা নিশাত আপুর উপর কাজ করেছে। বলেছি না? আমাকে দমাতে যেও না। নিজেই ফেঁসে যাবে।’
মিহির বলল, ‘এই যে ছোট ভাবী। সে’দিন কী বলেছিলাম? কোন প্লান করলে তার ঠিকভাবে কাজ করবে। দেখেছো আজও ধরা খেলে।’
আমি আর মিহির হেসে উঠলাম। নিশাত আপু বলল, ‘এক্ষুণি আমার খাবার চাই রুমি ফাস্ট!’
নিশাত আপু রুমে চলে গেল। ততক্ষণে আমার আর মিহিরের খাওয়া শেষ। দু’জন এঁটো হাত ধুঁয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মিহির হাত মুছতে মুছতে বলল, ‘নাও আবার রান্না করো যাও। হাহা!’
.
‘ওয়াও ভাবী। ওদের রিয়েকশন টা দেখেছো? আল্লাহ্ কী বলব আর। ফাঁটিয়ে দিয়েছো একদম।’
‘আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে এসেছে রুমি। ও জানে না আমি ইবনানের মেয়ে।’
‘হুম।’
‘ওরা কিন্তু থেমে থাকবে না মিহির৷ নজর রাখতে হবে ওদের উপর।’
‘হুম আমারো তাই মনে হচ্ছে। এত সহজে ছাড়বে না তোমাকে।’
‘আচ্ছা পেপার গুলো কবে দেবে?’
‘ডোন’ট ওয়ারি ভাবী। কালই দিয়ে দেবে।’
‘কালই?’
‘হুম।’
‘ওহ্ আচ্ছা।’
‘ভাবী? আমি বুঝতে পারছি। মায়া জন্মে গেছে না এই বাড়ির প্রতি?’
‘হুম। তবে মানুষ গুলো এই বাড়ির সঙ্গে বড্ড বেমানান।’
‘বিধাতা এমনই করে রেখেছেন।’
‘রিশান এভাবে বদলে যাবে ভাবিনি। কখনো ভাবিনি।’
‘যাক কী করবে আর? ভাইয়া হয়তো তোমাকে ভালোই বাসেনি।’
‘দুঃখ বিলাস গান টা গাইতে মন চাইছে। ও আমায় ভালোবাসেনি।’
‘ওয়াও ভাবী। গানের গলা তো খুব ভালো।’
‘হাহা! তখন রিশানকে গান গেয়ে শুনাতাম।’
‘আর এখন ভাইয়া শুনাচ্ছে তার প্রেমিকাকে।’
‘বাদ দাও।’
‘ভাবী.. কালই চলে যাবে?’
‘থাকতে বলছো?’
‘না মানে.. আর ক’টা দিন।’
তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে বলল, ‘না মানে তোমার অসুবিধা হলে থেকো না।’
‘না না। তুমি বলছো যখন দু’টা দিন থেমেই যাই।’
হাসল মিহির।
.
রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে বেসিনে দাঁড়িয়ে হাত ধুঁচ্ছিলাম। দেওয়ালের উপারেই কিচেন৷ হঠাৎ কিচেন থেকে কিছু কথোপকথনের আওয়াজ শুনলাম। হ্যাঁ রুমি আর রাহেলা বেগম কথা বলছেন। কী বলছেন তা শুনার উদ্দেশ্যে কিচেনের ওদিকে দরজার পাশে দাঁড়ালাম। এখন শুনতে পাচ্ছি। রুমি বলছে, ‘আজ তো কাজ হলো না। ওই মুখপুড়ি টাকে কোনমতে তাড়াতেও পারছি না। কী করা যায়?’
‘আমার তো ইচ্ছে হচ্ছে কালনাগিনী টাকে গলা টিপে মেরে ফেলি।’
‘আমারও তো ইচ্ছে হচ্ছে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলি।’
‘আজ কী খাওয়াবে ওকে?’
‘দেখি আজ এমন ডোজ দিব। একদম শেষ করে দেব।’
‘কীভাবে?’
‘ওই যে দেখ ইঁদুরের…’
আর কিছু শুনার পূর্বেই দূর থেকে মিহির ডাকল। না শুনেই সেদিকে চলে গেলাম। কিন্তু মাথায় একটা চিন্তা থেকেই গেল। কী করবে ওরা এখন? খাবারে আবার গোলমাল করবে না তো? নাহ্ কিছু তো করতেই হবে। এবারও খাবার অদলবদল করব? কিন্তু ওরা আগে যা ঘটেছে এর জন্য নজরদারী করবে। কিছু তো করতেই হবে।
‘কী এত ভাবছো ভাবী?’
‘ক-কই? কিছু না তো।’
‘আচ্ছা। এই ভাবী। দেখ কাপড় টা খুব সুন্দর না? অর্ডার করব?’
‘করো না সুন্দর লাগলে।’
‘তোমার জন্য সহ করি।’
‘আরে না না।’
‘উহু! করছি।’
কিন্তু আমি অন্য ভাবনায় মগ্ন। কী করবে এখন?
‘সবাই খেতে এসো। বাবা, ইশান, রিশান ভাইয়া, নিশাত আপু, মিহির। খেতে এসো। আর হা বড় ভাবীও এসো।’
সবাই টেবিলে বসে পড়লাম। রিশান বরাবর’ই মোবাইলে মত্ত। আমি বারবার সন্দেহের নজরে তাকাচ্ছি। একটু পর খাবার সার্ভ করল রুমি। কিন্তু আগের মতো সন্দেহজনক কিছু দেখছি না। কিন্তু.. একটা সন্দেহ থেকেই যায়। এত কেয়ার করে দিচ্ছে কেন? এমনিতে তো মুখে সবসময় ঝাল লেগে থাকে। রুমি আমার দিকে খাবার বেড়ে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও ভাবী। আজ খুব যত্ন করে বানালাম। দুপুরের মতো হয়নি৷ খাও খাও।’
সামনে নিয়ে বসে রইলাম। খাব? যদি কিছু করে? দুপুরের যা করল। কিন্তু তাদের দেখাতে এক লোকমা মুখে দিলাম। গা গুলিয়ে এলো৷ রুমি আর রাহেলা বেগম হাসিমুখে চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম, ‘আমার দিকে চেয়ে আছেন কেন? খেয়ে নিন।’
রাহেলা বেগম বললেন, ‘সবার খাওয়া হলেই খাব। তুমি খেয়ে নাও মা।’
মা? এত ভালোবাসা দেখাচ্ছে কেন হঠাৎ? বললাম, ‘আচ্ছা? সবার খাওয়া হলে খেতে হবে না। বসে পড়ুন।’
রাহেলা আর রুমি বসলেও নজর আমার দিকেই। কিন্তু দু’লোকমার বেশি খেতে পারলাম না। উঠে দাঁড়ালাম। রুমি বলল, ‘আরে আরে ভাবী! উঠলে কেন? খেয়ে নাও।’
‘আর খাব না ক্ষিধে নেই।’
‘ক্ষিদে নেই মানে? খেয়ে নাও বলছি। অনেক কষ্ট করে রান্না করেছি। খেতে তো হবেই।’
‘কেন? আগে তো না খাওয়ানোর জন্য উঠে পড়ে লাগতে। আজ এত খাওয়াতে মন চাইছে কেন?’
রুমি চুপ মেরে গেল। আমি হাত ধুঁয়ে উপরে চলে গেলাম। মিহির কিছু টা সন্দেহের চোখে তাকাল।
রুমে এসে বসলাম। কেমন যেন অস্থির লাগছে। গা গুলিয়ে আসছে। পেটে গুড়গুড় করছে। প্রায় দশ মিনিট যাবৎ এই অবস্থাই চলল। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ধো’লাম। মাথায় পানি দিলাম। হঠাৎ! বাথরুমের আয়নায় দেখতে পেলাম আমার চোখ দু’টো লাল হয়ে যাচ্ছে। মুখের রঙ’ও বদলে গেছে। হালকা নীল হয়ে গেছে। পেটে ভীষণ ব্যাথা শুরু করেছে। সাথে সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। ইয়া আল্লাহ্! এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? পেটে হাত দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম। আর পারছি না আমি দাঁড়িয়ে থাকতে। জড়োসড়ো হয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম। ইয়া আল্লাহ্ আমায় রহম করো। আমি যে আর এই যন্ত্রণা নিতে পারছিনা। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। অবশ হয়ে যাচ্ছি আমি। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম, ‘মিহির!!!’ তারপর শরীরের ভার ছেড়ে দিলাম ফ্লোরের বুকে। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছি। মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচব না। একটু পর দেখতে পেলাম মিহির দৌড়ে এসেছে। সাথে রিশানও। মিহির আমাকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে এলো। ততক্ষণে আমার মুখ থেকে ফেনা বেরুতে শুরু করেছে। মিহির চিৎকার করে কেঁদে ফেলল, ‘ভাবী। ভাবী এটা কী হলো তোমার। ভাইয়া গো! দেখ না ভাবীর কী হলো। ভাবী!!!’
আর শুনতে পাচ্ছি না কিছু। দেহ নিস্তেজ হয়ে এলো। নেত্রযুগল বন্ধ হয়ে এলো। এই বুঝি আমার সমাপ্তি? এই বুঝি আমার প্রাপ্তি গুলো পূরণ হলো না। রয়ে গেল অপ্রাপ্তি?
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]