অপ্রাপ্তি পর্ব-০৬

0
952

#অপ্রাপ্তি 💔
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ০৬

‘আপনি পাস হয়েছেন মিসেস. ইবনাত। ওয়েলকাম টু রহমান আইডিয়্যাল স্কুল।’

মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠল প্রিন্সিপাল ম্যামের কথা শুনে। হাসিমুখে বললাম, ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। আমি কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না।’

‘আরে আরে ইবনাত ম্যাম। ধন্যবাদ জানানোর কী আছে? আপনি নিজ যোগ্যতায় শিক্ষিকা হয়েছেন। আর আপনার যোগ্যতা, সঠিক জবাব আর বিনয়ী হওয়ার জন্যই সিলেক্ট করা হয়েছে। আর আপনার পরীক্ষার ফলাফলও খুব ভালো এসেছে৷ তা ছাড়া আমাদের কাছে অনেক এপ্লিকেশনই আসে। কিন্তু আমরা অনেককেই রিজেক্ট করি। পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের যোগ্যতা, ব্যবহার, স্টুডেন্টদের প্রতি কোমল আচরণ দেখেই সিলেক্ট করি। আর আপনি পাস হয়েছেন।’

হাসিমুখে মাথা নাড়লাম। উনি পাশে থাকা একজন ম্যামকে আদেশ দিলেন, ‘নিধি ম্যাম। আমাদের নতুন ম্যামকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। আর পুরো স্কুল ঘুরিয়ে দেখাও।’

‘জ্বী ম্যাম।’

নিধি নামের মেয়েটি আমাকে কোমল স্বরে, ‘আসুন’ বলে হাঁটা ধরল। আমিও তার পিছু পিছু গেলাম। তিনি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আমি নিধি সরকার। এই স্কুলে আছি প্রায় দু’বছর হচ্ছে। সেকেন্ড সিনিয়র ম্যামদের মাঝে আছি এখন। আর কিছুদিন পর সবার প্রমোশন দেওয়া হবে।’

‘আপনি তো আমার সিনিয়র ম্যাম। আমাকে আপনি বলার দরকার নেই। আমি ইবনাত চোধুরী। ইবনাত বলেই ডাকবেন।’

‘আচ্ছা। তা তোমাকে মিসেস বলতে শুনলাম। বিবাহিত?’

‘আপাতত বিবাহিত। ক’দিন পর এই ট্যাগ টাও উঠে যাবে।’

‘মানে?’

‘ডিভোর্স হয়ে যাবে ক’দিন বাদে।’

‘কেন?’

‘সে অনেক বড় কাহিনী ম্যাম। অন্য একদিন বলি?’

‘আচ্ছা। এখন চলো তোমার ক্লাস দেখিয়ে আসি আগে। তোমাকে ক্লাস টু এর ক্লাস টিচার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।’

নিধি ম্যাম আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করালেন। বর্তমানে আমি সবার জুনিয়র। স্কুলে স্যার নেই বুঝাই যাচ্ছে। প্রথম জীবনে কিছু করলাম৷ আজ ক্লাস টু আর ফাইভের ক্লাস নিয়েছি। সবাই আমাকে পছন্দ করেছে। দিন খুব ভালোই কাটল। তার মাঝে আমার সঙ্গে বেশি সখ্যতা গড়ে উঠেছিল রুহানি ম্যাম এর সঙ্গে। উনি আমার সিনিয়র। কিন্তু বয়সে আমরা সেম। সারাদিন টা এভাবেই কেটেছে। বলতে গেলে তাদের সঙ্গে মিশে এক মুহুর্তের জন্য আমার কালো জীবনের কথা টা প্রায় ভুলেই গেছিলাম।

.

ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। বাসায় প্রবেশ করতেই রাহেলা বেগমের সম্মুখীন হলাম। চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘কী মহারাণী? দিনভর কই ছিলেন?’

‘যেখানেই থাকি আপনাকে কেন বলব?’

‘আমাকে কেন বলবি মানে? সারাঘরে কাজ পড়ে আছে আর তুই দিনভর কোন নাগরের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলি?’

ধমকে উঠলাম, ‘খবরদার মিসেস. রাহেলা! আপনার ছেলের এসব লম্পটগিরী করতে পারে। আমি নই। আর সারাঘরে কাজ পড়ে আছে মানে? কাজ পড়ে থাকুক তো আমি কী করব? ঘরে কী আর কোন বউ নেই যে কাজ গুলো করতে পারেনা?’

‘চুপ মুখপুড়ি। আমার বউমা কে দিয়ে কাজ করাবি? তার ভার্সিটি নেই? সে কী তোর মতো বসে বসে খায়?’

‘তো আমার কী কাজ নেই? চাকরী নেই? আমি কী ওর বা আপনার মতো বসে বসে খাই? আর আমাকে মুখপুড়ি বলার সাহস আপনার হলো কী করে? মুখ আমার নয় আপনার আর আপনার প্রাণের বউয়ের পুড়েছে শুনেছেন? দেখি সরুন।’

ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলাম। হন হন করে রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। মিহির স্কুল থেকে ফিরেছে মাত্র। সিড়িতে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘দিন কেমন কাটল ভাবী?’

‘খুব ভালোই কেটেছে মিহির। কী আর বলব? উনারা এত ভালো। আর এত ভালো ব্যবহার করেছেন প্রশংসা না করে পারছিনা।’

‘হাহা! ঠিক আছে এখন অন্তত এসবে নিজেকে ব্যস্ত রাখ। আমার একজন ফ্রেন্ডের বাবা আছেন ল’য়ার। উনার সঙ্গে কথা হয়েছে। ডিভোর্স পেপার রেডি করতে উনি দু’মাস সময় চেয়েছেন। আমি সব ইনফরমেশন তাকে দিয়ে এসেছি।’

‘ভেরি গুড মিহির। ব্যস আর কিছুদিন।’

‘তোমাকে অনেক মিস করব ভাবী।’

‘মিস করতে হবে না। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব তোমার স্কুলে। চিন্তা করো না।’

‘উফ! থ্যাংক ইউ ভাবী।’

‘আচ্ছা যাও স্কুল ড্রেস খুলে ফ্রেশ হয়ে নাও।’

‘আচ্ছা।’

.

‘তুমি কাল দিনভর কোথায় ছিলে?’

রিশানের কথায় কিছুটা অবাক হই। সে বাসায় ছিল না। আমি কোথায় ছিলাম না ছিলাম ও কেমনে জানল? প্রশ্ন করলাম, ‘আপনাকে কে বলেছে?’

‘যেই বলুক। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’

‘যেখানেই থাকি। আপনার কী?’

‘ইবনাত! বেশি কথা বলছো। যা জিজ্ঞাসা করেছি তার জবাব দাও।’

‘পারব না।’

‘ইবনাত! আমার সত্যি রাগ উঠছে। কোথায় ছিলে তুমি? তোমার জন্য আজ রুমি ভার্সিটিতে যেতে পারেনি। আম্মুকে আর ওকে সব কাজ করতে হয়েছে।’

‘আচ্ছা? দু’বছর ধরে সব আমিই করে আসছি। আজ একদিন ওরা করেছে এতেই আপনার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে?’

‘চুপ! সারাদিন বাইরে বাইরে কী শুনি?’

‘আপনি চুপ করুন৷ অনেক শুনেছি আপনাদের কথা। আর কোন কথা শুনব না। অনেক কাজ করেছি অনেক খেঁটেছি কাজের লোকের মতো আপনার ঘরে আর না। এখন আপনারা আমার কথা শুনবেন৷ আর আপনারা সেই সব করবেন যা আমি করে এসেছি এই দু’বছর ধরে। আপনাদের কারণে মা-বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হতে যাচ্ছে। এই দু’বছরে মাত্র চারবার, মাত্র চার টা বার আমি আমার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি।’

রিশান চুপ করে রইল। আমি মুখ ঘুরিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলাম মোবাইল নিয়ে। একদিন আমার জন্য রুমি ভার্সিটি যায়নি। এটা নিয়ে তার অভিযোগের শেষ নেই। আর আমি? এতটা বছর কাজের লোকের মতো এই বাড়িতে থেকেছি। কই আমার জন্য তো কোন চিন্তা, অভিযোগ নেই তার? রিশান কেমন ছিল আগে? আর এখন কেমন হয়ে গেল? এটাই কী ছিল আমার ভাগ্যে? ভাবতেই চোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রুর ধারা বইতে শুরু করল।

.

এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে৷ এই এক সপ্তাহে আমি নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছি। স্কুলে এখন অনেক নাম পেয়েছি। আর বিনয়ীভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছি।
মিহির আর আমি বসে আছি তার রুমে। ফোন হাতে এক দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি। স্ক্রিনে ‘বাবা’ নাম টা জ্বলজ্বল করছে। মিহির আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মিহির বলল, ‘এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবে ভাবী? কল দাও।’

‘আ-আমি পারব না মিহির। আমি জানি না বাবা কেমন রিয়েক্ট করবে।’

‘একজন বাবা কী পারবে তার মেয়ের সঙ্গে কথা না বলে থাকতে? ফোন করো। এভাবে বসে থাকলে কিছুই হবে না শুধুই কষ্ট পাবে।’

কিছু না বলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মিহির আবারো বললে নেত্রপল্লব গ্রথন করে কল অপশনে চাঁপ দিলাম। রিং একবার পড়তে না পড়তেই কল রিসিভ হলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘হ-হ্যালো!’

[চলবে.. ইনশা আল্লাহ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে