অপ্রত্যাশিত বাসর ০৮

0
3493

অপ্রত্যাশিত বাসর

০৮.

পূণম বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। পানির তৃষ্ণায় জিভ, গলা এমনকি পেটটাও হয়তো শুকিয়ে গেছে। এটাচড টেবিলেই জগ ভর্তি পানি আছে। হাত বাড়লেই আনা যায়, উঠতেও হবে না তাকে। অথচ সে-ই শক্তি কিংবা সাহস সে পাচ্ছে না। ভয়ে কুঁকড়ে তার অবস্থা কাহিল। বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠছে।

গলাও চূড়ান্ত রকমের শুকিয়ে আছে। নিজেরই শরীরের অঙ্গ। অথচ কি পরিমাণ অবাধ্য! মালিকের অবস্থা বুঝতে পারছে না। নাহ! পানি পান না করলে আর চলবেই না পূণমের। মনে হচ্ছে, এক গ্লাস পানি পান করলেই তার সব সমস্যার অবসান ঘটবে। শুকনো ঢোঁক গিলে পানি আনার জন্য হাত বাড়ায় সে। তখনি আর্ভিন ঘরে আসে।

আর্ভিনকে সামনে পেয়ে পূণম বিছানার সাথে আরো কিছুটা এঁটে যায়। ভয়ার্ত চোখ মেলে তাকায় ওর দিকে। তার ফিনফিনে পাতলা এবং সাদা শার্টটাতে এখনো রক্ত লেগে আছে, বুকের ঠিক মাঝ বরাবর।

আর্ভিনের দৃষ্টি আজ অন্য রকম। পূণমের বোঝার বাইরে। সে বিছানায় পূণমের সামনের দিকটায় বসে। লম্বা দম নিয়ে বলে,
– আসলে তুমি ঠিকই বলেছো, পূণম। আমি সত্যিই অসুস্থ।’

আবারও কেঁপে ওঠে পূণম। আজ কি প্রথম আর্ভিন তাকে তার নাম ধরে ডেকেছে? হ্যাঁ, তাই তো! পাশাপাশি সে বিস্মিতও। হতভম্ব চোখে আর্ভিনের দিকে তাকালে আর্ভিন আবারও বলে,
– রেইনফিল্ডস সিনড্রোম আছে আমার। আর আমি স্যানগুইনারিয়ানে আক্রান্ত।’

পূণম পূর্বের তুলনায় আরো বেশি বিস্মিত। একরাশ ভয় আর কৌতূহল নিয়ে আর্ভিনের দিকে তাকায় সে। ভয়ে ভয়ে বলে,
– মানে?’
আর্ভিন শব্দ করে একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়ে। পূণমের চোখে চোখ রেখে থমথমে গলায় বলে,
– তোমার বেঁচে থাকার জন্য যেমন পানি খুব জরুরি। তেমনি আমার বেঁচে থাকার জন্য রক্ত জরুরি। খুব, খুব, খুব বেশি জরুরি। বুঝেছো এবার?’

আর্ভিনের কথা এবং প্রশ্নে আৎকে উঠে পূণম। আতঙ্কে তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। শুধু বেহুঁশ হওয়ার বাকি। ভাঙা ভাঙা গলায় কাঁপা কাঁপা সুরে সে বলে,
– আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’ অতঃপর ঢোঁক গিলে জিজ্ঞেস করে,
– আচ্ছা? আপনি কি কোনো ভ্যাম্পয়ার? রূপকথার কাহিনীগুলো থেকে উঠে এসেছেন?’

আর্ভিন শক্ত গলায় বলে,
– উহু! এটা রূপকথা না। ঘটে যাওয়া ভয়ংকর বাস্তব। স্যানগুইনারিয়ান একটা অসুখ, পূণম। যারা রক্ত পান করে তাদের স্যানগুইনারিয়ান বলে। আর স্যানগুইনারিয়ান দের রক্তপান করার ইচ্ছাটাকে বলে রেইনফিল্ডস সিনড্রোম।’

এতটুকু বলে আর্ভিন থামে। চোখে পৃথিবী সমান হতাশা নিয়ে পূণমের দিকে তাকায়। করুণ কণ্ঠে বলে,
– আমি জানি না এটা কি ধরনের অসুস্থতা। একটু আগে, তু..তুমি যখন হারিয়ে গিয়েছিলে কিছুক্ষণের জন্য, বিশ্বাস করো, আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মস্তিষ্ক আমার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। মেজাজ ভয়ংকর রকমের খারাপ হয়। মুড ঠিক রাখার জন্যই তখন আমাকে রক্ত পান করতে হয়েছিল। আর তুমি সেটাই দেখে ফেলেছো।’

হতাশার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আর্ভিন। চোখের কোণে চিকচিক করা পানি নিয়ে মৃদু আওয়াজে ফের বলে উঠে,
– পূণম! সমস্যাটা শুধু আমার মানসিক না, শারীরিকও। রক্ত না পেলে কিছুদিনের মধ্যেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ধরাশায়ী অবস্থা হয় আমার। কি..কিন্তু তুমি জানো? গত দুইদিন আমি রক্তের ঘ্রাণটাও নেই নি। তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে বলেই আমাকে এটা করতে হয়েছিল। মানে, রক্তপান করতে হয়েছিল। কেন হারিয়ে গিয়েছিলে, পূণম?’

আর্ভিনের কাতর সুর পূণমের ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়। নিমিষেই আবার তার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। এগিয়ে আসে পূণমের দিকে। তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে। ঝাঁকুনি দিতে দিতে জিজ্ঞেস করতে থাকে,
– বলো, পূণম! কেন চলে গিয়েছিলে? কেন? স্পিক আপ, পূণম! বলো কেন চলে গিয়েছিলে?’
আর্ভিন ধমকের সুরে কথাগুলো বললেও তার গাল বেয়ে টুপটাপ ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ঝরছে।

পূণম হা করে সেদিকে চেয়ে রয়। আশ্চর্য! ওর তো ভয় পাওয়ার কথা। সে এমন একটা অসুস্থ মানুষের সাথে থাকে, যার রক্ত পান না করলে চলে না। রক্তপান যার কাছে শ্বাস নেওয়ার মতোই জরুরি। অথচ পূণম তাকে ভয় পাচ্ছে না। বরং মানুষটার জন্য তার ভেতরটা ধুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। গালের উপর নোনতা পানিগুলো দেখে মনে হচ্ছে, মানুষটা যদি কখনো রক্ত না পায় তাহলে সে নিজেকে সপে দিতে পারে তার হাতে। ইচ্ছে করছে মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।

মনের চাওয়া পূরণ করতে পূণমও কিছুটা এগিয়ে যায় আর্ভিনের দিকে। কিন্তু আর্ভিন হুট করেই দূরে সরে যায়। পূণম থতমত খেয়ে আগের জায়গায় ফিরে আসে। নিজের মনটাকে একটা দাবাং মার্কা কিন্তু অদৃশ্য থাপ্পড় মারে।

.
.
(চলবে)

#অপ্রত্যাশিত_বাসর
® নবনীতা নূর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে