অপ্রত্যাশিত বাসর
(বড় একটা পর্ব। ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে পড়বেন। চট করে পড়তে গেলে কিছুই বুঝবেন না।)
১০.(ক)
আধো আধো চোখ মেলে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে আর্ভিন। পাহাড়সম ভারী মাথা নিয়ে তীব্র অনিচ্ছায় উঠে বসে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে চোখের পাতা খুলে আশপাশে তাকায়। যন্ত্রণায় দু’হাতে চেপে ধরে নিজের মাথা। নিজেকে সামলাতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নেয় সে। পুরোপুরি হুঁশ ফিরলে বুঝতে পারে সে ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে পড়ে আছে।
তার বিশাল এই বাড়িটায় ছ-সাতটা ঘর আছে। ঘরগুলোও বিশালাকায়। তাই তার ফ্লোরে শুয়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু কাল খাওয়ার পর পরই চোখের পাতাগুলো ভীষণ ভাবে ভারী হয়ে পড়েছিল। এতটাই ভারী যে, সে নিজের ঘর অবধি যেতে পারে নি। সোফায়ই শুয়ে পড়েছিল। যদিও পূণমকে বলে দিয়েছিল, একটু পরই যেন তাকে ডেকে দেওয়া হয়।
আশ্চর্যের বিষয় পূণম তাকে ডেকে দেয় নি। সোফা থেকে ফ্লোরে পড়ে যাওয়া স্বত্বেও না। ভীষণ রকমের বিরক্তিকর এই মেয়েটা। এবার এই বিরক্তিকর মেয়েটার দফারফা করে ছাড়বে সে। এত কিসের প্রেম? হৃদমের কীর্তি বলে দেওয়ার পরও কেন তাকে ভুলতে পারছে না? ‘ডিজগাস্টিং’ শব্দটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে সে। পর পরই কণ্ঠে একরাশ অভিযোগ নিয়ে ডেকে উঠে,
– পূণম! পূণম? কোথায় তুমি? পূণম!’
ডাকতে ডাকতে সে পূণমের ঘরের সামনে চলে আসে। দরজা ভিড়িয়ে দেওয়া। তবে কি ও ঘুমুচ্ছে? আর্ভিনকে বাইরে এই অবস্থায় ফেলে এসে মহারাণী ঘুমোচ্ছে? আর্ভিন কপট রেগে ধড়াম শব্দে দরজা খুলে। এ কি! পূণম তো নেই ঘরে। ওয়াশরুমে না-কি? মুখ কুঁচকে ওয়াশরুম, ব্যালকনি চেক করে সে। নাহ! পূণম নেই। কোত্থাও নেই। বেসমেন্ট, রুফটপ, গার্ডেন.. কোত্থাও না।
ধ্বক করে উঠে আর্ভিনের বুকের বাম পাশের যন্ত্রটায়। কয়েক মুহুর্তের জন্য যন্ত্রটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল বোধ হয়। স্তব্ধ আর্ভিনের অবাধ্য চোখ দুটো যখন পানি লুকাতে ঘনঘন নড়ছিল, ড্রয়ারের উপরের খোলা ফার্স্টবক্স দেখে তখন সেগুলো থেমে যায়। এগিয়ে যেতেই ফ্রিজিয়াম ট্যাবলেটের খালি প্যাকেটগুলোও চোখে পড়ে।
এবার সবটা পরিষ্কার হয় তার কাছে। গতরাতে খাবারের সময় হুট করে পূণম কেশে উঠে। আর্ভিন পানি দিলে সে খেতে অস্বীকার করে এবং ঠান্ডা পানির আবদার ধরে। তখন খাবার ছেড়েই আর্ভিনকে উঠতে হয়। কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানি আনতে সে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে দেয়। আর তখনই পূণম তার খাবারে ঘুমের এই ওষুধগুলো মেশায়। যার কারণে ঘর অবধি যাওয়ার আগেই সে ঘুমের গভীর দেশে তলিয়ে যায়। আর সে ভেবেছিল রক্তের পিপাসায় সে ক্লান্ত।
যথারীতি আর্ভিনের নীলচে তারার চোখে অগ্নী রশ্মির দেখা মিলে। অতিরিক্ত রাগের চোটে কপালের রগ ফুলে-ফেঁপে নীল। সামলাতে না পেরে সামনে থাকা দরকারী, অদরকারী জিনিসগুলো ভেঙে চুরে একাকার করে দিচ্ছে সে। ভাঙচুর শেষ হলে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে সে। পরক্ষনেই ভাবলো, মেজাজ খারাপ করে লাভ নেই। পূণমকে খুঁজতে হবে তাকে।
আর্ভিন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ে। ড্রাইভওয়ে পেরুতেই ফোনের কথা মাথায় আসে তার। ফের ছুটে যায় বাড়ির ভেতর। হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে থাকে ফোনটা। বিধি বাম! ফোন নেই৷ পূণম ফোন নিয়েই পালিয়েছে। সহজ সরল চেহারার ভেতরের অত্যধিক চালাক পূণমের পরিচয়ে সে হতবিহ্বল।
বাড়িতে ল্যান্ডলাইন আছে। কিন্তু কাজ করে কি-না কে জানে! উফফ! একেই তো ঘুমের ঠেলায় মাথা পৃথিবী রূপ ধারণ করেছে। তার উপর এই পূণমের পালিয়ে যাওয়া। কি যন্ত্রণাময়! আচ্ছা? সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে? ট্যাবলেট তো বেশ কয়েকটাই মিসিং। চিন্তাগুলো মাথায় আসতেই হন্যে হয়ে নিজের ঘরে যায় আর্ভিন। ল্যাপটপে সময় দেখে তার মাথায় হাত পড়ে, একেবারে দুই হাত।
গুণে গুণে আঠাস ঘন্টা ধরে সে ঘুমে আছে। মাই গড! একদিনেরও উপর। তার জানামতে ক্যানবেরায় পূণমের পরিচিত কেউ থাকে না। তার একার পক্ষে বাংলাদেশে যাওয়াও টাফ। তবুও যদি চেষ্টা করে থাকে তাহলে প্রথম দিনে গিয়েই সে ফ্লাইট পাবে না। ইমার্জেন্সি ধরলেও দু’দিন তো লাগবেই সব কিছু ঠিকঠাক হতে। তাহলে পূণম কোথায় হতে পারে এখন?
কিছুক্ষণ ভাববেই গত পরশুর ঘটনা মনে পড়ে আর্ভিনের, যখন পূণম উধাও হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। এখনো জানা হয় নি সে কোথায় গিয়েছিল বা কি করছিল ওই সময়টায়। জানা যাবে যদি তার ফোনের কল রেকর্ড চেক করা হয়। পূণম নিশ্চয়ই ফোনেই কিছু করছিল। তা না হলে সে জানতো না তার ফোনের লক হৃদমের ফোনের কপি। চট করে উঠে দাঁড়ায় আর্ভিন এবং ঝট করে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি ছেড়ে।
(খ)
হসপিটালের ধবধবে সাদা বেডে শুয়ে আছে হৃদম। তার অসার একটি হাত পূণমের বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ। পূণম বহু যন্ত্রণা পেরিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে তাকে। সে বাংলাদেশে ফিরেছে ঘন্টা দুয়েক হবে। এই কিছু সময়ে হৃদমের অস্থির আচরণে সে ভীষণ রকম ক্লান্ত। আজ থেকে ও মুক্ত, আর্ভিন নামক সাইকো’টার থেকে। যার দরুন এই ক্লান্তিটাকেও ভালো লাগছে ওর। আনন্দের সাথে মেনে নিচ্ছে সব।
লম্বা একটা দম নেয় পূণম। তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু হৃদমের হাত ছাড়া দায়। ছাড়তে গেলেই দেখা যাবে জেগে গিয়ে হইচই বাঁধিয়ে দিবে। অনেক কষ্টে শান্ত করা হয়েছে তাকে। এখন জাগিয়ে দিয়ে কাজ নেই। তার চে’ বরং একটু কষ্ট করাই যাক। কথায় আছে, দুঃসময় আসলে দল বেঁধে আসে। কেউ কখনো আরও একটা সত্যি কথা বলে না। যেমন, ভালো সময় আসলেও দল বেঁধে আসে। যদি না-ই আসতো, তাহলে পূণমের শ্বশুরমশাই কখনো তার জন্য পানি নিয়ে হাজির হতেন না এই সময়।
পূণম কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে শ্বশুরের আনা পানিটুকু পান করে নেয়। হুট করেই অজানায় মনে হলো, আর্ভিন বোধ হয় তাকে না পেয়ে রক্ত পান করছে। যেমন সে এখন পানি পান করছে, তেমন।
– তুই ফিরলি কি করে, মা?’
শ্বশুরের প্রশ্নে আর্ভিনের ধ্যান ভাঙ্গে পূণমের। সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে উনি ফের প্রশ্ন করেন,
– আর্ভিন সহজে নিশ্চয়ই তোকে ছাড়েনি। তাহলে কিভাবে আসতে পারলি?’
পূণম এবার মুচকি অথচ প্রাণ খোলা হাসি হাসে। বেশ গর্বের সাথে বলে,
– আপনার বন্ধুর ফোন নম্বর দিয়েছিলেন না? উনার সাহায্যে। প্রথম একদিন ফোন দিয়ে আপনার পরিচয় দিয়েছি। বলেছি, আমি আপনার ছেলের বউ। উনি তো মহা খুশি। দেখা হওয়ার পর তো কেঁদে-কেটে অস্থির। আপনার নামে নালিশও করেছে।’
– ও কি ভাবে সাহায্য করলো?’
শ্বশুরের সন্দিহান দৃষ্টির থমথমে গলার প্রশ্ন।
পূণম মিনমিন করে উত্তর দেয়,
– ইয়ে মানে.. বলেছি যে আপনার ছেলের সাথে হানিমুনে এসে আমি হারিয়ে গিয়েছি। তাই যেন আমাকে দেশে ফিরে আসতে সাহায্য করে। প্রথমে বিশ্বাস করতে চান নি। দেখা হওয়ার পর ছবি দেখে বিশ্বাস করেছে। আর্ভিনের ফোনেই আমাদের সবার ছবি আছে, সেগুলোই দেখিয়েছি। তখন উনি গলে ঘি। তৎক্ষনাৎ টিকিট হাতে ধরান। আগেই বলে রেখেছিলাম। তাই দেরি হয় নি। গত রাতের ফ্লাইটেই চলে এসেছি।’
পূণমের পরিকল্পনার বাহবা দিতেই হয়। কিন্তু আর্ভিন তাকে সহজে ছাড়বে না। এও নিশ্চিত তার শ্বশুর। পরে কি হবে এটা ভেবেই উনার কপালের ঘাম ছুটছে। পূণম বুঝতে পারে উনার অবস্থা। কিন্তু এবার সে নিজেই ছাড়বে না আর্ভিন নামের বদ্ধ উন্মাদ’টাকে।
পূণম দেশে ফেরার পর আরো দুইদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। হৃদমের ইনজুরি পুরোপুরি না সারলেও রিলিজ দেওয়া হয় তাকে। এটা মূলত তার মানসিক সুস্থতার জন্যই। যেহেতু রোড এক্সিডেন্ট হওয়ায় হৃদমের মুখাবয়ব পরিষ্কার ছিল না, তাই পাড়া-পড়শী এবং আত্মীয়রা জানে হৃদম নামক যে লাশটা বিয়ের দিন এসেছিল, সেটা ভুলবশত ভুল বাড়িতে পাঠানো হয়। আর সত্যিকারের হৃদম নামক মানুষটা হাসপাতালে ছিল এতদিন। নাটকীয় ভাবেই উপস্থাপন করা হয় বিষয়টা। যদিও আসল ঘটনা তেমন নয়।
বাড়ি ফেরার পর নতুন করে তোড়জোড় করা হয় তাদের বিয়ের। যদিও তাদের ডিভোর্স হয়নি। বিয়ের পর দিন একটা কাগজে সই করলেই ডিভোর্স হয় না। আইনের একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু আর্ভিনের সাথে তার রেজিস্ট্রি টা সত্য। কিন্তু সেটাও বিয়ে বলে মানা যায় না। যেহেতু পূণমের ডিভোর্স-ই হয়নি। তবুও নতুন করে আনুষ্ঠানিকতা মানা হচ্ছে।
দ্বিতীয় বার বিয়ের জন্য পূণমকে নিজে বাড়ি থাকতে হচ্ছে। যদিও হৃদমের সাথে তার যোগাযোগ হচ্ছে চব্বিশ ঘন্টাই। প্রযুক্তির বিশাল আবিষ্কার মোবাইল ফোনের জন্যই সম্ভব হচ্ছে এটা। পূণমও উপভোগ করছে সময়গুলো। মনের খুব গভীরে যদিও আশঙ্কার বিশাল একটা পাহাড় রয়ে গেছে।
আর তার এই আশঙ্কা সত্যি হয় বিয়ের আগের দিন রাতে। একটা সময়ের পর বিয়ে বাড়ির হইচই কমে গেলে শুতে যায় পূণম। ঘুমের আবেশ অনুভব হতেই মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরও যখন স্বাভাবিক হতে পারছে না, তখন সে উঠে বসে। টেবিল লাইট জ্বালতেই দেখে আর্ভিনের নীল চোখ দুটো তাকে দেখছে, সে-ই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
পূণমকে উঠতে দেখে আর্ভিন সহজ, স্বাভাবিক গলায় বলে,
– কিডন্যাপ করতে চাইছি না তোমায়। কথা বলতে চাইছি।’
পূণম তার থেকেও সহজ ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
– আমিও। আপনি কি বাইরে যাবেন আমার সাথে? বাসায় বলা বোধহয় ঠিক হবে না।’
আর্ভিন বাইরে বেরিয়ে যায় ওর কথায়। পূণম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে-ও চলে পিছু পিছু।
আর্ভিন ব্রিজের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে, নিচের দিকে মাথা গুঁজে। আর পূণম রাতের একচ্ছত্র আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে-ই শুরু করে প্রথম কথা বলা।
– হৃদম সব বলেছে আমায়। তিন বছরের বাচ্চাকে ফেলে এসে সত্যিই অন্যায় করেছে হৃদমের মা। কিন্তহ আপনার মনে হয় না, আপনি উনার থেকেও বেশি অন্যায় করছেন? কিছু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে।’
– কে নিরপরাধ, পূণম? আমার জন্মদাত্রী? যে আমাকে তিন বছরের রেখে পালিয়ে এসেছে প্রেমিকের হাত ধরে? না-কি আমার জন্মদাতা? যে কি-না নিজেরশিশু পুত্রকে একা বাড়িতে রেখে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ফূর্তি করতে ব্যস্ত।’
আর্ভিনের শান্ত গলার বলা কথাতেও পূণমের বুক চিরে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আর্ভিনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জিজ্ঞেস করে,
– আর মণিরা কি ভুল করেছিল, আর্ভিন ফ্রাঙ্কলীন?’
– হৃদমকে ভালোবেসেছে সে। যার জন্য আমার মা আমাকে ছেড়ে এসেছে। হৃদম যদি না আসতো উনার মাঝে, তাহলে উনি আমাকে ফেলে আসতেন না।’
– তার মানে আপনি আমাকেও মেরে ফেলতেন? মানে, আমিও তো হৃদমকে ভালোবাসার মতো ভুল করেছি।’
– তোমাকে মারতে হলে বিয়ে করতাম না। মণিরাকেও মারতে চাই নি। বুঝিয়েছি, হৃদমকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সে তো ছাড়েই নি, উল্টো হৃদমকে সব বলে দিয়েছে। যার জন্য হৃদম সব জানতে পেরেছে আমার সম্পর্কে।’
– আমাকে মারতেন না কেন? আমাকে মেরে ফেললেই তো আপনার ইচ্ছে পূরণ হতো। হৃদম তার প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে ভেঙে পড়েছিল। এবার আমাকে হারালে শেষ-ই হয়ে যেত। আর ওর মা-ও।’
আর্ভিন নিচের থেকে চোখ সরিয়ে আনে। পূণমের চোখে চোখ রাখে। করুণ দৃষ্টি তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
– তোমার বলা শেষ?’
পূণম মৌন। আর্ভিন সম্মতি ভেবে বলতে থাকে,
– তখন আমার বয়স ছয়। ড্যাড তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে তৃতীয় হানিমুনে সুইজারল্যান্ড, একা বাড়িতে ছয় বছরের শিশুপুত্র কে রেখে। যে তখনও জানতো না কিভাবে ওভেন ব্যাবহার করতে হয়। ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার দু’দিনেই শেষ। উনারা তিন দিনের মাথায় ফিরবে বলে পুরো চারটে দিনই কাটিয়ে দিয়েছেন। পঞ্চম দিনেও দেখা নেই তাদের। তুমিই বলো, ছয় বছরের বাচ্চা কিভাবে পাঁচটা দিন একা কাটাতে পারে? তাও তিন দিন খাবার ছাড়া?’
পূণম নির্বাক ও নিরুত্তর। আর্ভিন ঠোঁট চেপে ধরে। শুকনো ঢোঁক গিলে সাথে গলায় দলা বেঁধে থাকা কান্না গুলোও। অতঃপর বলে,
– সেদিন আমি খালি পেটে থাকি নি, পূণম। পেট ভর্তি করেছিলাম অনেক অনেক ক্ষোভে। আর সাথে নিজের রক্তেও। তোমাকে সেদিন আমি মিথ্যে বলেছিলাম। নিজের বাবার রক্ত কখনো ছুঁয়েও দেখিনি। উনার মতো ঘৃণ্য মানুষের রক্ত খাওয়া অসম্ভব। হজম করবে না আমার পাকস্থলী। নিজের রক্ত ওই লোকটারই তো, তাই ওইদিন তোমায় বলেছিলাম ঐ লোকটার কথা। কিম্বা ভয়েও। যদি তুমি ভয় পাও আমায়। যে-ই লোক নিজের রক্ত খেতে পারে, তাকে তো কেউ ভালোবাসবে না। এই ভয়ে। পূণম? আমার তেরো বছর বয়সে বাবা প্রথম জানতে পারেন, আমি একজন রক্তপিপাসু। সাথে সাথেই তিনি আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। আর আমি নিজেকে বাঁচাতেই উনাকে মেরে ফেলি। আর উনার স্ত্রীকেও। এতে আমার কি দোষ,পূণম?’
পূণম এবারেও নিশ্চুপ। আর্ভিনও অপেক্ষা করে না উত্তরের। সে ভাঙা গলায় বলে,
– কখনো কারোর ভালোবাসা চাই নি আমি, পূণম। প্রথমবার চেয়েছি, কেবল এবং কেবল মাত্র তোমার।’
– ভালোবাসার স্বার্থ ত্যাগে, আর্ভিন।’
– তুমি বোধহয় প্রথমবার আমাকে নাম ধরে ডেকেছো।’
– হ্যাঁ, আর শেষ বারও।’
পূণমের জবাবে মুচকি হাসে আর্ভিন। থমথমে গলায় বলে,
– কখন কিভাবে ভালোবাসা হয়েছে? আমি জানি না। আর জানতেও চাই না। ভালোবাসা যখন হয়েছেই, তখন আমি তোমায় অন্য কারোর হতে দেখতে পারি? বলো?’
পূণম দাঁত চেপে ধরে। রাগ সামলাতে না-কি কান্না আটকাতে সে জানে না। তবে শক্ত গলায় সে এবার আর্ভিনের সাথে কথা বলবে। নরম হবে না। না, না, না। একবার না হয় হৃদমকে সে কিডন্যাপ করে রেখেছিল, কিন্তু এবার সে না হৃদমকে আটকাতে পারবে। আর না ও কে। চোয়াল শক্ত করে পূণম। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পানিতে ধপাস করে পড়ার শব্দ পেয়ে আৎকে উঠে সে। ব্রিজের নিচে তাকিয়ে দেখে পানিতে উত্তালতা। আর সামনে আর্ভিন উধাও।
পরিশিষ্টঃ আধঘন্টা যাবৎ ঘরের বাইরে পায়চারি করছে হৃদম। ভেতরে ঢোকার সাহস সে পাচ্ছে না। কি অদ্ভুত অনুভূতি! সে বিশ্বাস করতেই পারছে না যে আজ সেই কাঙ্খিত দিন। যে দিনটার অপেক্ষায় সে প্রহর গুণে ক্লান্ত হতো। সুখময় সে-ই অদ্ভুদ ক্লান্তি।
লম্বা দম ফেলে হৃদম। নিজের বোকামির জন্য মাথায় চাটি মেরে দরজা খুলে সে। কিন্তু ভেতরের মানুষটাকে দেখেই সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানেই।
টুকটুকে লাল বেনারসি পড়ে আছে পূণম। তার ঠোঁটও টকটকে লাল। থুতনি, গলা, হাত.. সব লাল, একেবারে রক্ত লাল। না না, রক্ত লাল না। এটা তো রক্তই। ঐ তো! পূণমের কাটা আঙুল থেকে রক্ত ঝরছে। যেগুলো সে মুখে তুলে নিচ্ছে আলতো করে।
এটা কে? পূণম-ই তো? কিন্তু পূণম তো এমন নয়। তার পূণম তো সহজ-সরল, চঞ্চল আবেগী একটা মেয়ে। তাহলে কে ও? কে?
সমাপ্ত
#অপ্রত্যাশিত_বাসর
® নবনীতা নূর