অন্ধকারে এক চিলতে আলো পর্ব-১২

0
1598

#অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১২

তানভীরের দিকে জাহানার সুফিয়া সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর কিছুটা কঠোর গলায় বলল

– এভাবে সব লুকানো তোমার উচিত হয়নি।এর আগে এসব বিষয় নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে সেটা তুমি নিজেও জানো।তাহলে এ কাজ কেন করলে?

জাহানারা সুফিয়ার কথায় তানভীর নিশ্চুপ। কোনোরূপ উত্তর সে দিচ্ছে না।জাহানারা সুফিয়া তানভীরের উত্তরের তোয়াক্কা না করেই শায়ানের দিকে এগুতে লাগল।শায়ানের ঠিক কাছে গিয়ে বলল

– বোন আছে বাসায়?

শায়ান ভয়ার্ত গলায় উত্তর দিল

– হ্যাঁ।

জাহানারা সুফিয়া কথাটা শুনে শায়ানের গালে জোরে কষিয়ে একটা থাপ্পর দিয়ে বলল

– তোমার বোনের সাথে তানভীর এমন করলে কেমন লাগত? এত বেহায়া নির্লজ্জ হতে বিবেকে বাঁধল না।ঘরে তোমার মাকে দেখো না? নিজের বোন মায়ের সাথে এমন হলে কী করতে। বেয়াদব ছেলে নিজেকে শুধরাও। চাইলেই তোমাকে পুলিশে দিতে পারতাম। তবে তোমাকে কিছু না করে ছেড়ে দিলাম। একবার শুধরনোর সুযোগ দিলাম। আমার চোখের সামনে থেকে যাও।আর কোনোদিন যেন তোমাকে আমার সামনে না দেখি।আর তোমার পরিবারকে এ বিষয়ে আমি অবগত করব।যাতে করে তারা শাসন করতে পারে।

শায়ান ভয়ার্ত গলায় বলল

– আন্টি বাবা, মাকে বলবেন না দয়াকরে। আমি ভুল শুধরে নিব।

– আমি কী করব নাকি করব না সেটার পারমিশন তোমার কাছ থেকে নিব না।সুতরাং তুমি এখন যেতে পারো।নাহয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব।

শায়ান আর কোনো কথা বলল না।চুপচাপ মাথা নীচু করে যেতে নিল। এমন সময় জাহানারা সুফিয়া তানভীরের পিছু ডাকল। শায়ান ডাকে সাড়া দিয়ে উনার দিকে তাকাল। উনি শায়ানকে কঠোর গলায় বলল

– আলোর পায়ে ধরে মাফ চেয়ে তারপর যাও। নাহয় পুলিশল দিব তোমায়।

শায়ান উনার কথায় ভয় পেয়ে আলোর পায়ের উপর পড়ে বলল

– আমাকে ক্ষমা করে দিন।এমন করাটা উচিত হয়নি। আপনি আমার বোনের মতো।

আলো কোনো কথা বলল না।পা টা ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানার উপর উঠে গেল। আর শায়ান কোনো কিছু না বলে মাথা নীচু করে চলে গেল।এদিকে তানভীর বুঝছে না কী করবে। জাহানারা সুফিয়া তানভীরের দিকে এবার তাকিয়ে বলল

– আমাকে বলো কেন এমন মিথ্যা বললে? ফাবিহার ঘটনার পর, রুশির ঘটনার পরও কী তোমার টনক নড়ে নি।তাহলে এমনটা কেন করলে? আমার কাছে কেন লুকালে বলো?

– মা আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি বিষয়টা কীভাবে নাও তাই। আমাকে ক্ষমা করে দাও।ভুলটা আমার তবে কারও বিপদ দেখলে ভালো লাগে না । মনুষ্যত্ব বলি দিয়ে বিনা সাহায্যে থাকতে পারি না।

– আলো কে? আলোর পরিচয় দাও।সমস্ত কিছু আমাকে খুলে বলো।

তারপর তানভীর আলোর সব ঘটনা তার মাকে বলল। জাহানারা সুফিয়ার নরম মনটা বিগলিত হলেও সে নিজেকে শক্ত করে জবাব দিল

– এখন পুলিশকে বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আগে পুলিশকে সব বলতে হবে।তারপর আলোর বিষয়টা ভালো করে জানতে হবে সে সঠিক বলেছে কী না। যদি সে সঠিক বলে থাকে তাহলে তাকে সাহায্য করব। আর মিথ্যা বললে তো জেলে পঁচে মরবে। তবে এখন পুলিশের কাছে সব বলতে হবে।নাহয় হিতে বিপরীত হবে। সবাই ভাববে এসব সত্যি আর এসবের সাথে আমরা জড়িত।এর আগের বার রুশির ব্যাপারটা নিয়ে কী হয়েছিল তো দেখেছিলে তো।এবার আর কোনো ভুল পদক্ষেপ আমি নিতে চাই না।

– কিন্তু মা আলোর তো দোষ নেই। কেন সে শাস্তি পাবে।

– দোষ না করলে সে মুক্তি পাবে। আমি প্রমাণ জোগার করব। তবে এখন তাকে পুলিশে দিতে হবে এছাড়া উপায় নেই।

বলেই আলোর কাছে গেল জাহানারা সুফিয়া। আলোর হাতটা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। যাবার বেলায় আলো তার পলকহীন ভাবে তাকানো চোখটা দিয়ে তানভীরের দিকে তাকালো।তানভীর শুধু নীরব দর্শকদের মতো দেখতে লাগল। নিজেকে সে সামলাতে পারছিল না।তবুও সামলে নিল।কারণ এখন চুপ থেকে দাঁত কামড়ি দিয়ে থাকা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। জাহানারা সুফিয়া থানায় নিয়ে আলোর সব ঘটনা বলল। পুলিশ আলোকে আটক করে নিল।আর জাহানারা সুফিয়াকে বলল

– আমরা বিষয়টা তদন্ত করছি।সত্যি যেটা সেটাই বের করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

জাহানারা সুফিয়া আর কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ উঠে চলে গেল। তার মাথায় কী চলছে সেটা বুঝার উপায় নেই। এদিকে তানভীর চুপ হয়ে বসে আছে। শায়ান যে এমন স্বভাবের সেটা সে মানতে পারছে না
আর আলোর জীবনে সে বলেছিল অন্ধকার নামতে দিবে না আজকে সেই কাজটায় হলো। নিজেকে বেশ ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে। তানভীরের কাছে যদি একটা আলাদিনের চেরাগ থাকত তাহলে হয়তো সে দৈত্যের কাছে আলোর মুক্তি চাইতো। কিন্তু রূপকথার সে আলাদীনের প্রদীপ তো বাস্তবে আসবে না।

এদিকে আলোকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। মামলা টা কোর্ট পর্যন্ত চলে গেছে। নিজের সৎ মা,নীলা আর নিজের স্বামীকে হত্যার দায় চাইলেও সে এড়াতে পারছে না।যদিও সে নিজের স্বামীর খুন করেছিল পরিস্থিতির শিকার হয়ে আর বাকিগুলো কে করেছে জানে না।তবে দোষ তার ঘাড়ে।জেলের অন্ধকার রুমে বসে চোখ বন্ধ করে চোখের জল ফেলছে। দুবেলা শুকনো রুটি জুটছে। সে সাথে বকা তো আছে। আলোর এক চিলতে আলোর আশাটা নিভে গেল ধুম করে। জেলে বসে নিজের জীবনের সব ইতিবাচক আশা গুলো মাটিচাপা দিয়ে দিল। জেলের অন্ধকার গলিতে পার করলো তিনদিন। কোর্ট ছয়দিনের রিমান্ড মন্জুর করেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

আলোকে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসা বাদের জন্য। আলোর সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে আলোকে মৃদু গলায় একজন মহিলা বললেন

– বলেন খুন গুলো কেন করেছেন?

আলো মহিলাটাকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বলল।তবে মহিলাটা নীলা আর আলোর মায়ের খুনের ব্যপারে কে খুন করেছে স্বীকার করছিল না বলে একের পর এক শারিরীক আঘাত করতে লাগল। আর জিজ্ঞেস করতে লাগল বাকি খুনগুলো কেন করেছে আর তার সাথে কারা জড়িত।আলোর উত্তর প্রতিবারেই এক। মাইরের আঘাতে আলোর ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। সারা শরীর টিলার মতো উঁচু নীচু হয়ে লাল হয়ে আছে। মাঝে মাঝে গরম পানির স্প্রে করা হচ্ছে। অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়া হচ্ছে।আলো আর পারছে না সহ্য করতে। সত্য বললেও কেউ বিশ্বাস করছে না।আলো বুঝাতেই পারছে না সে যা বলছে সত্য। আলোর মনে হচ্ছে এ লোকগুলো আলোকে শারীরিক ভাবে আঘাত করে পুরোপুরি জোর পূর্বক স্বীকারোক্তি নিতে চাচ্ছে।এক দিকে আলো যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না।অন্য দিকে বিনা কারণে নিজের ঘাড়ে আরও মৃত্যুর ভার নিতে চাচ্ছে না। আস্তে আস্তে আলো নেতিয়ে পড়ল।আজকের মতো আলোকে জিজ্ঞাসাবাদ বন্ধ করা হলো। তবে কালকে আবার শুরু হবে আলোর উপর নতুন অত্যচার। তা হলো জোর পূর্বক মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের অত্যাচার।

এদিকে তানভীর ছটফট করতে লাগল। দুইবার থানায় গিয়েও আলোর সাথে দেখা করতে পারল না।কোর্ট আলোর সাথে কাউকে দেখা করার পারমিশন দেয়নি। সে জানে না তার মা কী করছে। মাকে কয়েকবার আলোর কথা জিজ্ঞেস করার পরও উনি তানভীরের কোনো জবাব না দিয়ে এড়িয়ে গেছেন। দিন কে দিন তানভীরের অস্থিরতা বাড়তে লাগল।

আর এদিকে আলোকে আজকে চতুর্থ দিনের মতো রিমান্ডে আনলো। আলোকে এবার ইলেকট্রিক শক দেওয়া হচ্ছে।যেভাবে পারছে যন্ত্রণা দেওয়া হচ্ছে। আলো কষ্টে একবার বলছে সে সবগুলো খুন করেছে তবে কারণ জিজ্ঞেস করলে কোনো কারণ বলতে না পারায় চলছে আরও অত্যাচার।আলোর বুকটা থরথর করে কাপঁছে। রিমান্ড শেষে আলো নীচে শুয়ে কাঁতরাতে লাগলো। হয়তো এর থেকে মরণ ভালো ছিল। আজকে আলোর ইচ্ছা করছে মরে যেতে তবে এখন যেন মরার উপায়ও এখানে পাচ্ছে না। ঠোঁট গাল কেটে আছে।সারা শরীর যন্ত্রণায় কাঁপছে। জীবনটা কেন এমন হলো কেন এত কষ্ট পাচ্ছে সে। সৃষ্টি কর্তার সাথে কথোপকথন করছে আর একের পর এক অভিযোগ দিচ্ছে। জীবনের কাঠ গড়ায় এসে সে নিঃশ্ব। এখনের জীবনের থেকে হয়তো আগের জীবনটা ভালো ছিল। দিনকে দিন যেন তার সুখের পাখি উড়ে গিয়ে অধঃপতন হচ্ছে। চোখটা লেগে এলো তার।

রাত তিনটায় যেন তার ঘুম ভাঙ্গলো।সে একটা আলোক রশ্নি দেখতে পেল। হাতটা দিয়ে যখনেই সে আলোক রশ্মিটা ধরতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই যেন সেটা মিলিয়ে যাচ্ছিল। অনেক চেষ্টা করছে সে আলোক রশ্নিটা ধরতে তবে সে পারছে না। একটা সময় সে অন্ধকারে তলিয়ে গেল।

তার ঘুমটা ভাঙ্গলো। তার মানে এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। তবে এখন তার সারা শরীর কাঁপছে। জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল। চোখগুলোতে অন্ধকারে ছেয়ে আসলো। নিস্তেজ হয়ে গেল একদম।

সকালে আলোকে দেখতে এসে আলোর অবস্থা দেখে একটু বিচলিত হলো পুলিশ। হাতটা ধরে দেখল ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাহলে কী আলো মারা গেল??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে