#অন্তরালের সত্যি
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-৪
দাদাকে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে জিহ্বার নিচে করার পর উনার বুকে ব্যাথা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। এরইমধ্যে আমার ছোট কাকা শাহিন এসে বড় কাকাকে ধা’ক্কিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। বড় কাকার সাথে আসা অর্পা নামের মেয়েটি এতোক্ষন যেনো একদম বোবার মতো ও অবুজ শিশুর মতো বসেছিল। বাড়ির সীমানা পার হবার পর বড় কাকা সরু রাস্তাতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন আর অর্পা নামক মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–কেনো আমার জীবনটা নষ্ট করলে? আমি কি ক্ষ’তি করেছিলাম? তোমাকে আমি চার বছর আগেই বুঝিয়ে তোমাদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম। তারপর তো তিন বছর তোমাদের বাড়ির সীমানাতেও যাইনি। কেনো আমার আব্বা-আম্মার চোখে আমাকে কু’লা’ঙ্গা’র বানালে? তাদের হৃদয় থেকে বিচ্ছিন্ন করালে কেনো? আমারই ভুল! সেদিন অনিকের (অর্পার বড় ভাই) কথায় তোমার ছোট ভাই হাফিজকে এডমিশন টেস্টের জন্য গাইডলাইন দিতে যাওয়াটা আমার সবচেয়ে বড় ভুল। আমি ভাবতেও পারিনি আমার বন্ধু, যার সাথে একসাথে পড়াশোনা করেছি। সে আমার সাথে বিশ্বাসঘা’ত’ক’তা করবে। আমি অজান্তে বন্ধুত্বের আবেগে তোমাদের ফাঁদা জ্বালে পা দিয়েছিলাম। আমি সবটা হারালাম ওই একটা ভুলে।
অর্পা মেয়েটা মুখের উপর থেকে নিকাব খুলে বললেন,
–কিচ্ছু হারাওনি তুমি। সব তোমার থাকবে একদিন। সম্পত্তি তোমার নামেও হবে। আরে তোমার আব্বা রাগের বশে বলেছেন। বললেই কি ত্যাজ্যপুত্র হয় নাকি! একদিন আমাদের মেনে নিবেই। আর তোমার প্রথম বউ সানজি মেয়েটা তো একটা স্বা’র্থ’প’র! তার প্রতি সবার চাঁপা অভিযোগ আছেই।
বড় কাকা তৎক্ষণাৎ থা’প্প”র মারলেন অর্পা নামের মেয়েটিকে। অর্পা সেটা স্বত্বেও চোখ-মুখে রা”গের আভাষ রেখে নিলজ্জের মতো হেঁসে বললেন,
–বাহ এতো প্রেম! কি আছে তোমার ওই বউয়ের? না আছে রূপ! না আছে গুণ! একটা অকর্মা সে। আর আমাকে দেখো। আমি সর্বগুণ সম্পূর্ণ। আমি তোমাকে বিয়ে করে বাঁচিয়ে দিয়েছি।
বড় কাকা অর্পা নামক মেয়েটিকে বললেন,
–এই পর্যন্ত সব তো জোর জবরদস্তি করেই করলে। কি লাভ হলো? পাবে না আমার বাবার সম্পত্তির কানা-কড়িও। আমার বাবার সব মিলিয়ে পাঁচ বিঘা জমির দেখেই তো লোভে পরলে তাইনা? তোমার বাবা-ভাইকে বলে দিও। এই রাশেদ তার আব্বার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর থেকে ত্যাজ্য! করো এবার তোমরা আয়েশ।
অর্পা নামের মেয়েটি বললেন,
–দেখবো কতোদিন এই রাগ থাকে। আর তুমি ভুলে যেওনা কিন্তু! তুমি কোনোদিনও আমাকে ডিভোর্স দিতে পারবে না আইন অনুসারে লিখিত। ৫০ লাখ টাকা কই থেকে জোগাড় করবা? আমি যদি তোমাকে ডিভোর্স দেই তবেই ডিভোর্স হবে। আমি তো দিবো না!
বড় কাকা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন বসে থেকে অর্পা নামের মেয়েটিকে ফেলে চলে গেলেন। আজ সে নিজের বাবা-মায়ের কাছেই ঘৃণিত। কেউ তাকে বুঝলো না। বড় কাকা অর্পাদের বাড়িতে যেদিন গিয়েছিলেন সেদিনই অর্পার সাথে তার বিয়ে হয়। বড় কাকা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি এই ষ’ড়’য’ন্ত্র। অর্পার ছোট ভাই হাফিজকে একদিনের জন্য গাইড করতে বড় কাকার স্কুলের বন্ধু অর্পার বড় ভাই অনিক বড় কাকাকে সপ্তাহ খানেক রিকুয়েস্ট করে তার ভাইকে একদিন ম্যাথ গাইড করাতে রাজী করিয়েছিলেন। হাফিজ নাকি বড় কাকাকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতেই পারছিল না। অতঃপর বড় কাকা এতো অনুরোধে বাধ্য হয়ে গিয়েছিলেন সেখানে কিন্তু সেটাই যে তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। অবশ্য তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হলেও এই ভুল করতো কিনা তা জানা নেই আমার। বড় কাকা মেধাবী ছিলেন তবে আমার দাদার মতো সহজ-সরল ছিলেন। আমার পরিবারে আমার বাবা ও ছোট কাকা বেশি রাগী আমার দাদীর মতো। দাদাও রাগী তবে তিনি রাগ তখন করেন যখন প্রতিপক্ষ তাকে রাগানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তাছাড়া স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন তিনি। ছাত্ররা তার নাম শুনলে ভয় পেতো।
বড় কাকা অর্পাদের বাড়িতে গেলেন ও হাফিজের ম্যাথের প্রবলেম সলভ করার চেষ্টা করছিলেন তখন অর্পা শাড়ি পরিহিত অবস্থায় হাতে করে চা ও সেমাই নিয়ে আসলেন। বড় কাকা তাকিয়েছিল অর্পার দিকে। অর্পা অনেকটা খোলাখুলি শাড়ি পরেছিল। পুরুষ মানুষকে আকৃষ্ট করতে যেরকম ভাবে শাড়ি পড়ে আরকি! বড় কাকা এর আগেও অর্পাকে শাড়ি পড়তে দেখেছিলেন আর সেইদিনের পর আর যাননি অর্পাদের বাড়িতে। আজকেও কি সেরকম অস্বস্তিকর অবস্থায় পরতে হবে কিনা সেটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। বড় কাকা দৃষ্টি সংযত করে চায়ের কাপ নিলেন। অর্পা চলে যায় সেখান থেকে। চায়ের পর বড় কাকা সেমাই খেলেন। কিন্তু চায়ের মধ্যে ও সেমাইয়ের মধ্যে ওভার দা কাউন্টার ড্রা*গ হিসেবে তখন কিছু ঘুমের ওষুধ পাওয়া যেতো। যা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াও কেনা যেতো। সেগুলো মেশানো ছিল সেটা বড় কাকা বোঝেননি।
বড় কাকার জ্ঞান ফেরে ১২ ঘন্টা পর। তাও কেউ যেনো তার উপর পানি ছুঁড়ে মেরেছেন এমনটা হওয়ায়। বড় কাকা চোখ মুখ মুছে আশেপাশের পরিবেশ বোঝার জন্য চেষ্টা করছিলেন। রুমের ভিতর সাত-আট জন মানুষের ভীর লেগে আছে। পাশে কে যেনো কাঁদছে। বড় কাকার মাথা ভার হয়ে আছে স্লিপিং পিলের এফেক্টের কারনে। একেকজন একেক রকম নোংরা মন্তব্য করছিলেন যার কোনো ধারনা বড় কাকার ছিল না। অর্পা পাশে এলোমেলো শাড়ীতে কাঁদছিলেন। এক পর্যায়ে অনিক এসে বড় কাকার গ*লা চেঁ*পে ধরে অকথ্য গা’লাগা*ল করতে থাকেন আর বড় কাকা ওই মূহুর্তে পুরোপুরি হ্যাং অবস্থায় ছিলেন। তিনি বুঝতেও পারেননি যে ঘরের ভিতর মানুষ গুলো অর্পারই আত্নীয়-স্বজন। তখন অর্পা একটা ব্লে*ড এনে আত্নহ*ত্যা করবেন বলছিলেন। পরিস্থিতি জঘন্য হয়ে যাওয়ায় সবার মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগে বড় কাকা বিয়ে করতে বাধ্য হোন। বিয়েটা না করলে তারা এলাকায় ছড়াতো যে,
“সৈয়দ রহিমউদ্দিনের মেঝো ছেলে, মোঃ হারুন মোল্লার ছোট মেয়েকে জোরপূর্বক ধ*র্ষন করেছেন।”
তখন কেউ এতো শান্ত ভাবে সহজে ভাবতেও পারেন না তারউপর বড় কাকার তখনো ঘুমের রেশ পুরো শেষ না হওয়ায় উনি কিছু চিন্তা করতে পারছিলেন না।
এরপর বড় কাকা টানা দুই মাস নোয়াখালীতে ছিলেন। নোয়াখালী পলিটেকনিক থেকে সে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন তাই সেখানকার বন্ধু তার ছিল। এমনকি আমার দাদা-দাদীও সপ্তাহ খানেক বড় কাকার খোঁজ পাননি। মোবাইলের সিম খুলে ফেলে দিয়েছিলেন। তারপর দুই মাস পর ঢাকা আসলে তিন দিনের মাথায় অর্পার বড় ভাই অনিক বড় কাকাকে রাস্তা থেকে জোর করে ধরে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। আশ্চর্য ছিল এটা যে, অর্পার পরিবার তখনো বিয়েটাকে এলাকায় ছড়িয়ে দেননি। সেটা যেইদিন আমার পরিবার জানতে পারে সেইদিনই এলাকায় ছড়ায়। অর্পাদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি এক এলাকায় না হলেও দাদার নাম-ডাক আশেপাশের অন্য এলাকাতেও ছিল। কি কারনে তখন বিষয়টা ছড়াননি তা পরে জানা গিয়েছিল। অর্পার বাবার শত্রুতা যেহেতু আমার দাদার সাথে তাই তিনি দাদার ও আমাদের পরিবারের মানহা*নি করতে এসব করেছিলেন। আমাদের বাড়িতে বড় কাকা অর্পাকে নিয়ে এসেছেন অর্পার করা ব্ল্যাকমেইল যে, অর্পা আত্নহ*ত্যা করবে আর নোটে বড় কাকার নাম ও আমাদের পরিবারের নাম লিখবে।
এইজন্য এসব কিছু হলো। দাদার পাঁচ বিঘা জমির মধ্যে দুই বিঘার একটা পুকুর ছিল। সেটা নিয়েই অর্পার বাবার সাথে ঝামেলা ছিল। দাদা ১৯৯৫ সালের দিকে খুব কম দামে আমাদের এলাকার ৫ বিঘা জমি কিনে ফেলেছিলেন। তখন পুরো এলাকা ছিল খাল, ক্ষেত ও নিরিবিলি। আশেপাশে ডাকাতের উপদ্রব ছিল বলে কেউ ওসব জায়গা কিনতে চাইতেন না। দাদা কিপটে স্বভাবের ছিলেন। তিনি নিজের বেতন তো জমাতেনই আবার দাদী গরু, হাঁস, মুরগী পালন করে যা আয় করতো সেগুলোও জমাতেন। আমার বাবা ও বড় কাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাকালীন যা টিউশন করিয়ে যা পেতেন তাও তিনি নিজের একাউন্টে জমাতেন। গ্রামে আমার দাদার নামে যা ছিল তার অর্ধেক বিক্রিও করেছিলেন। উনি আরো একটা জমি অন্য জায়গায় কিনেছিলেন। যেটা অমিমাংসিত।
আমার মা বা নানা বাড়ির কেউ জানতেন না দাদার কতোটুকু জমি ছিল। সানজি কাকির পরিবারের তো জানার কথাই না।
চলবে ইনশাআল্লাহ,