অনুভূতি পর্ব ৪২

0
1972

অনুভূতি
পর্ব ৪২
মিশু মনি

৬৬.
মিশুর চেঁচামেচিতে সায়ান ও আরাফও গাড়ির ছাদে উঠে বসলো। এখান থেকে দীঘিনালা অব্দি ছাদে করে যাওয়া যাবে। তারপর খুব সম্ভবত আর্মিরা আর ছাদে যেতে দেবেনা। এইটুকু সুযোগ মিস করবে কেন ওরা?
মিশু বসেছে সামনেই। মেঘালয় ওর পাশে বসে শক্ত করে হাত চেপে ধরেছে। গাড়ি ছুটছে দ্রুত গতিতে। চারিদিকের মনোরম সৌন্দর্য মুহুর্তেই গ্রাস করে ফেলতে চাইছে ওদেরকে। সায়ান ও আরাফ একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে আর প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। বাতাসে মিশুর নীল শাড়ির আঁচল উড়তে শুরু করেছে। মেঘালয় ওর শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আবার হাতের মুঠোয় করে মিশুর হাতে দিয়ে দিলো। মিশুর যে পরিমাণ আনন্দ হচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ও বারবার মেঘালয়কে জাপটে ধরছে খুশিতে।
বেশ কিছুদূর আসার পর ও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লো। চারিদিক এত বেশি সুন্দর! শুধু ঘন সবুজ আর সবুজ। অরণ্য’র মাঝখান দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে মনেহচ্ছে। মাথার উপর নীলাকাশ, গাড়ির ছাদে বাতাস এসে উড়ে নিয়ে যেতে চাইছে। মিশু বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে শুধু।
দীঘিনালা পৌছে গেলো তাড়াতাড়ি। মিশুকে হাত ধরে ছাদ থেকে নামানোর সময় ও উৎসুক চোখে আশেপাশে তাকালো। মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এটাই সাজেক?”
মেঘালয় হেসে বললো, “না রে পাগলী। আরো ঘন্টা তিনেক লাগতে পারে সাজেক যেতে।”
– “সত্যি! আবারো ছাদে উঠতে পারবো? ইস খুব মজা হবে!”
– “ছাদে আর নাও ওঠা হতে পারে। দেখা যাক কথা বলে অনুমতি নিতে পারি কিনা।”
– “কার সাথে কথা বলবা? কে অনুমতি দিবে?”
চুল উড়ে এসে মিশুর মুখের উপর পড়েছে। মেঘালয় হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো, “এখান থেকে আর্মির স্কটে যেতে হবে আমাদের পাগলীটা। এখানে কিছু কাজ সেরে তারপর যেতে হবে।”
মেঘালয় সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “হাতে আরো দেড় ঘন্টার মত সময় আছে। আমরা বরং হাজাছড়া ঝরনা থেকে ঘুরে আসি? কি বলিস?”
সায়ান উত্তর দেয়ার আগেই মিশু লাফিয়ে উঠলো, “তোমরা না গেলেও আমি যাবো। আমাকে নিয়ে চলোনা মেঘ। প্লিজ। আমরা ঝরনা স্নান করতে পারবো?”
মিশুকে লাফাতে দেখে মেঘালয় আর এক মুহুর্ত ও দেরি করলো না। আর্মিদের কাছ থেকে সমস্ত ফর্মালিটিজ শেষ করে এসে দ্রুত বেড়িয়ে গেলো হাজাছড়া ঝরণার দিকে। যেতে যেতে নানান বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিলো সবার মধ্যে। সায়ান বলল, “ম্যাশ ভাবি আমার গার্ল ফ্রেন্ড কই?”
মিশু হেসে জবাব দিলো, “সে তো পাবেই। সার্কুলার দিছি,দেখি কতজন এপ্লাই করে। তারপর ইন্টার্ভিউ।”
সায়ান হাসলো। মিশু গটগট করে এগিয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় ওর হাত ধরে রেখেছে। দুজনে এগোচ্ছে আর মেঘালয় বিভিন্ন বিষয় শিখিয়ে দিচ্ছে মিশুকে। গাইড হিসেবে মেঘালয়কে ১০০ তে ৯৮ দেয়া যায়। খুবই যত্নের সাথে নিয়ে যাচ্ছে মিশুকে। আর সবকিছু দেখিয়ে দিচ্ছে নিজ দায়িত্বে।
ঝরনার কাছে পৌছতে খুব বেশি সময় লাগলো না। মিশু শাড়ি এক হাতে উপরে তুলে ছপছপ করে এগিয়ে গেলো ঝরনার দিকে। শাড়ি পড়েও মেয়েটা কিভাবে ট্রেকিং করছে ভাবাই যায়না। অদ্ভুত একটা মেয়ে বাবাহ! সবাই ওর স্টামিনা দেখে অবাক হয়ে যায়। যেখানে ট্রেকিং শেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেখানে ও আনন্দে উল্লাস করে।
মিশু ঝরনায় গিয়ে দ্রুত পানি ছিটিয়ে খেলা করতে লাগলো। পানিতে বসে পা দুটো মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে লাগলো। পাহাড় থেকে শো শো শব্দ হচ্ছে। ঠিক শো শো শব্দও বলা যায়না। কেমন যেন ঝিরঝির একটা শব্দ। ঝরনার অন্যরকম একটা শব্দ আছে। মিশু চোখ বন্ধ করে ঝরনার জলে ভিজতে লাগলো। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে আর পানিতে নেমে বসে আছে। বরফ শীতল জলে পা কেটে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এত ঠাণ্ডা কেন এই জল! অবশ্য বেশ আরাম ও লাগছে। ঝরনার মাঝে কেমন একটা ভালোবাসা মিশে থাকে যেন।
মেঘালয়ের স্পর্শে চোখ খুললো মিশু। তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে আর কেউ নেই,শুধু মেঘালয়। বাকিরা সবাই অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছে। মিশু অবাক হয়ে বললো, “হোয়াটস আপ?”
মেঘালয় ওকে টেনে তুলে এনে ঝরনার নিচে দাড় করিয়ে দিলো। একসাথে খুব জোরে পানির ঢল মাথার উপর পড়ছে যেন। মাথার তালু ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু বেশ ভালো লাগছে। মেঘালয় মিশুকে জড়িয়ে ধরে দুহাতে ওর মুখটা ধরলো। তারপর ঝরনার মাঝেই চোখ মেলে ওকে দেখার চেষ্টা করলো। মিশুর গালে লেগে থাকা পানির বিন্দুগুলো দেখে আজকে ওর হিংসে হচ্ছে। ইস! মেঘালয় যদি জল হতো ঠিক এভাবেই ছুঁয়ে থাকতো ওর গাল, ঠোঁট, প্রতিটা চুল।
মেঘালয় আস্তে আস্তে মিশুর মুখটা এগিয়ে এনে ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। মিশু হারিয়ে যেতে লাগলো সুখের অন্য এক রাজ্যে। মেঘালয় হেচকা টানে ওকে বুকে টেনে নিলো। ঝরনার নিচে ভিজতে ভিজতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রইলো।
অনেক্ষণ সময় নিয়ে ঝরনায় ভিজলো ওরা। গোসল শেষ করে পানিতে বসে অনেক্ষণ পানি ছিটিয়ে খেলা করলো মিশু। তারপর আবার ঝরনা থেকে ফিরে আসার জন্য বের হলো। প্রতিদিন সকাল ১১ টায় আর্মির স্কটে যেতে হয় সাজেকে। সকালে কোনোভাবে বহর মিস করলে সারাদিন অপেক্ষা করে তারপর আবার বিকেলে সাড়ে তিনটায় যেতে হয়। বিকেলে মিস করে ফেললে পরেরদিন সকাল অব্দি অপেক্ষা করতে হয় সাজেক যাওয়ার জন্য।একবার মিস হয়ে গেলে আসাটাই তো বৃথা। এজন্যই কোনোভাবে স্কট মিস করা যাবেনা। সবাই দ্রুত চলে আসলো।
সাড়ে দশটার পরপরই আবারো চান্দের গাড়ি ছেড়ে গেলো দীঘিনালা হতে। মেঘালয় আর্মির সাথে কথা বলে মিশুকে নিয়ে ছাদে ওঠার অনুমতি নিয়েছে। একদম ভেজা শরীর,তার উপর ভেজা শাড়ি। এ অবস্থায় ভেতরে বসে গেলে মিশুর জ্বর এসে যাবে। এমনিতেই মেয়েটা ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারেনা। আজকে অনেক্ষণ ঝরনায় ভিজেছে। ছাদে গেলে রোদ ও বাতাসে শুকিয়ে যাবে শাড়ি। দুজনে ছাদে বসে একে অপরকে জড়াজড়ি হয়ে রইলো। গাড়ি খুব দ্রুত ছুটতে লাগলো।
মিশু ক্রমশই উৎফুল্ল হয়ে উঠছে। আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তা। ঠিক যেন সাপের মত এঁকেবেঁকে চলেছে। কখনো উঁচু,কখনো নিঁচু। কখনো ঘন সবুজ অরণ্য আবার কখনো স্বচ্ছ নীলাকাশ চোখে পড়ে। খুব কাছ থেকে মেঘের ভেলা ভেসে যেতেও দেখা যায়। গাড়ি এগিয়ে চলেছে এঁকেবেঁকে। একদম রোলার কোস্টারের মত। মিশু আনন্দে কথাই বলতে পারছে না। বারবার কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। যত এগিয়ে যাচ্ছে,পাহাড়ি এলাকার মনোরম সৌন্দর্য ভেতরটাকে কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে। দুমড়ে মুচড়ে যেতে চাইছে। এত সুন্দর কেন সবকিছু! একদম ছবির মত সুন্দর! ইচ্ছে করছে মেঘগুলো হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখি। ইস! কখন যে মেঘ ছুতে পারবো!
মেঘালয়ের আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে মিশু চোখ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে ভেতর থেকে। আর কোনো কিছুই শুনতে চায়না ও। শুধু হৃদয় ভরে স্বাদ নিতে চায় এ প্রকৃতির সবটুকু সৌন্দর্যের। দুচোখ ভরে দেখতে চায় সমস্ত নীল, মেঘ, সবুজ, সব সবকিছু।
মিশুর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে এত সুন্দর দেখতে দেখতে। সাজেকের কাছাকাছি চলে আসার পর ও কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। মেঘালয় খেয়াল করে দেখলো মিশু কাঁদছে। ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে রেখে সমানে কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা। আর এত সুন্দর দেখলে কাঁদবে না ই বা কেন? সর্পিলাকার এই রোলার কোস্টারের মতন রাস্তাটার দুধার বেয়ে সুন্দর ঝাউ জংগল। দূরে দেখা যায় বিস্তৃত পাহাড়। কখনো আবার পাহাড়ের গা ঘেষে গাড়ি চলে যায়। ধীরেধীরে যত কাছে আসছে, প্রকৃতি তত বেশি মুগ্ধ করে দিচ্ছে। রুইলুই পাড়ার কাছাকাছি চলে এসেছে। দুপাশে সুন্দর লাল সবুজ রঙের বাড়ি। সবকিছু একদম ছবির মতন সাজানো গুছানো আর সুন্দর। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘ জমে আছে, মেঘ আটকে আটকে আছে সবখানে। কিছু মেঘ আবার ধীরেধীরে উড়ে চলে যাচ্ছে এক পাহাড়ের উপর দিয়ে আরেক পাহাড়ে। দূর থেকে এসব দেখেই প্রাণ জুড়িয়ে যেতে চায়। চোখে আপনা আপনি পানি চলে আসে!
সাজেকে পৌছে গেলো ওরা। আগে থেকেই কটেজ ঠিক করা ছিলো। ভেতরে এসে মিশুকে তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলাতে বললো মেঘালয়। মিশু কিছুতেই ভেতরে আসতে চাইছিলো না। ওর ছুটে গিয়ে পাহাড় আর আকাশের বিশালতা অনুভব করতে ইচ্ছে করছিলো। মেঘ পাহাড়ের ভাজে ভাজে আটকে আছে,দেখতে কি যে সুখ লাগে! কখন চোখ ভরে দেখতে পারবে সমস্ত সৌন্দর্য? ও একদম অস্থির হয়ে উঠলো।
রুমে ঢুকেই মেঘালয় ভেজা কাপড় ছেড়ে তোয়ালে গায়ে পেঁচালো। মিশুর শাড়ি খুলে ফেলে দিয়ে ওর তোয়ালের ভেতরে টেনে নিলো মিশুকে। মিশুর ভালো লাগছে না মেঘালয়ের সাথে থাকতে। ছুটে বাইরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। মেঘালয় একটা তোয়ালের ভেতরে দুজনের শরীর ভালমতো পেঁচিয়ে নিলো। মিশু ওর উষ্ণ স্পর্শে আরো অস্থির হয়ে উঠলো। দুহাতে মেঘালয়ের গলা জাপটে ধরে বললো, “তাড়াতাড়ি চলোনা বাইরে যাই। প্লিজ?”
– “যাবো তো পাগলী টা। এখন বের হয়ে কোথায় যাবা? এতটা পথ জার্নি করে আসলাম। এখন ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে একেবারে বের হবো।”
– “এখানে মেঘ কোথায় ছোঁয়া যাবে?”
– “পাহাড়ের উপর। আমি নিয়ে যাবো তো পাগলী, এত অস্থির হচ্ছো কেন?”
– “আমার যে আর তর সইছে না। সবকিছু এত সুন্দর কেন!”
– “তোমার মেঘ কি সুন্দর নয়?”
মিশু একবার তাকালো মেঘালয়ের শরীরের দিকে। গলা থেকে বুক অব্দি দারুণ ফর্সা, আর বুক থেকে শুরু করে নাভি পর্যন্ত লোমে আবৃত। মিশু আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “তোমার মত সুন্দর জিনিস আমি আর একটাও দেখিনি লাইফে।”
– “হা হা, জিনিস বলছো কেন?”
– “তুমি সবকিছুর চেয়েও সুন্দর। তোমার চোখের মাঝে ডুব দিলেই মনেহয় স্বর্গ খুঁজে পাবো। তোমার ঠোঁটের ভেতরে রাজ্যের সমস্ত রূপকথা লুকিয়ে থাকে। তোমার শরীরের গন্ধে আমি উন্মাদ হয়ে যাই।”
– “আর?”
মেঘালয় মিশুর চোখে চোখ রেখেছে। একই তোয়ালের ভেতরে দুজনের উষ্ণ শরীর মিশে যাচ্ছে ধীরেধীরে। মিশু কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছে আস্তে আস্তে। মেঘালয়ের চোখের তীব্রতার কাছে হার মেনে যাচ্ছে ওর মুগ্ধ চোখ। এভাবে তাকায় কেউ! খুন হয়ে যাবো তো! মিশু চোখ নামিয়ে নিয়েও থাকতে পারেনা। মেঘালয়ের কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দুটো আলতো করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। ছেলেটা এত্ত মিষ্টি কেন!
মেঘালয় বললো, “মেঘ ছোঁবেনা?”
– “ছুঁয়েই তো আছি।”
– “মেঘ তোমার গাল,মুখ, ঠোঁট সব ভিজিয়ে দেবেনা?”
মিশু শিউড়ে উঠে বললো, “এভাবে বলতে হয়না মেঘ। আমিতো পাগল হয়েই যাবো।”
– “আর আমিতো হয়েই আছি। কতবার কতরকম ভাবে কাছে পেয়েছি তোমায়। তবুও কেবলই মনেহয়, এই বুঝি প্রথম স্পর্শ করছি। এমন হয় কেন মিশু?”
মিশু মেঘালয়কে জরিয়ে ধরে বললো, “জানিনা। কিচ্ছু জানিনা। শুধু জানি, ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।”
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে