অনুভূতি
পর্ব ১৪
মিশু মনি
.
২৩.
মেঘালয় আর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। এবার ঘুমানো দরকার। জেগে থাকলে মাথায় ভূত চাপবে এসে।
কিন্তু ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কিছুতেই ঘুম আসছে না। বারবার চোখ খুলে যাচ্ছে আপনা আপনি। খুলে অন্যদিকে না তাকিয়ে সোজা মিশুর দিকে চলে যাচ্ছে। মিশুও বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে মেঘালয়ের দিকে। এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়? কেমন যেন অসহ্য লাগছে। একদিকে বুকের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নিজেকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। একবার ইচ্ছে করছে মিশুকে ভালোবাসি বলতে, একবার মন সায় দিচ্ছে না। খুব খারাপ একটা অবস্থায় পড়ে গেছে মেঘালয়।
মেঘালয়ের হঠাৎ কি হলো নিজেই জানেনা। ঘোর ঘোর লাগছে বড্ড। ঘোরের মাঝেই মিশুকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “আমি কি তোমার কোলে মাথা রেখে শুতে পারি?”
অদ্ভুত প্রস্তাব! এরকম প্রস্তাব জীবনেও কখনো শোনেনি মিশু। আর মেঘালয়ের মুখ থেকে এটা শুনছে সেটাও আশ্চর্যের ব্যাপার। কিন্তু না বলতে পারলো না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “আচ্ছা।”
মেঘালয় অপ্রকৃতস্থের মত উঠে মিশুর সিটে গিয়ে বসলো। বেশ লম্বা সিট। অনায়াসে শোয়া যায়। যদিও সিটের উপরে বালিশ রাখা তবুও মেঘালয় মিশুর কোলেই মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। কোনোদিনো কেউ এভাবে কোলে মাথা রেখে শোয় নি, মিশুর কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগছে।
মেঘালয়ের এখন একটু শান্তি লাগছে ভেতরে। মিশু আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মিশুর হাতের স্পর্শে ঘুম এসে যাচ্ছে। চোখ বুজতেই ঘুমিয়ে পড়লো মেঘালয়।
জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে দেখে মিশুর বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে মেঘ ঘুমিয়ে পড়েছে। ও আস্তে আস্তে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অনেক সুন্দর মেঘালয়ের চুলগুলো। যেমনি সিল্কি, তেমনি সুন্দর ঘ্রাণ! মিশুর হঠাৎ চোখ চলে গেলো মেঘালয়ের বুকের দিকে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। সেখান দিয়ে ওর ফর্সা বুকে কিছু লোম উঁকি দিচ্ছে। এত সুন্দর লোভনীয় কারো বুক হতে পারে সেটা ভাবতেও পারছে না মিশু। কেমন ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে। ছেলেদের বুকের লোম এত সুন্দর হয়? মেঘালয়ের হাতের লোমগুলোও ভারী সুন্দর দেখতে। মিশু একবার ওর হাতের দিকে তাকাচ্ছে, একবার বুকের দিকে তাকাচ্ছে। মাঝেমাঝে পলকহীন ভাবে ওর মুখের দিক তাকিয়ে থাকে। কেমন ঘোর ঘোর লাগে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর ওর মুখটা সবসময় ই হাসি হাসি জন্য একটা অন্যরকম স্নিগ্ধতা ছেঁয়ে থাকে। সত্যিই মেঘ অনেক বেশি সুন্দর!
ফ্যালফ্যাল করে ওর ঘুমন্ত মুখের দিয়ে চেয়ে চেয়ে নানান আঁকিবুঁকি স্বপ্ন দেখছে মিশু। নিজেও ঘুমিয়ে পড়তে ঘুম বেশি সময় লাগলো না। চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
কতক্ষণ ঘুমালো বলতে পারেনা কেউ। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানোর আগ মুহুর্তে ট্রেন থামার ধাক্কায় মিশুর মাথাটা ঢলে পড়ে গেলো মেঘালয়ের মুখের উপর। ঠক করে দুজনের কপালের সাথে কপাল লেগে একটা আওয়াজ হলো। আঁৎকে উঠে ঘুম ভেঙে গেলো মেঘালয়ের। মিশু নিচু হয়েই আছে। একদম কাছাকাছি চলে এসেছে দুটো মুখ। একে অপরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। এত কাছ থেকে কখনোই কোনো পুরুষের চোখ দেখেনি মিশু। হার্টবিট রকেট গতিতে ছোটার মত দ্রুত বেড়ে গেলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। দৃষ্টি যত গভীর হচ্ছে হার্টবিট তত বেশি বাড়ছে। মিশুর সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেঘালয়ের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এ কেমন অনুভূতি! মিশু ওর মুখের কাছে ঝুঁকে চোখে চোখ রেখে চেয়ে আছে। মাথা তুলতেই ভূলে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। এভাবে কতক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো বোঝা গেলো না। মিশু মেঘের চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে, আর মেঘ ও। দৃষ্টির গভীরতা বাড়ছে, যেন একে অপরের ভেতরটাও পরিষ্কার বুঝতে পারছে। মিশু অনুধাবন করতে পারছে মেঘের ভেতরে কি তুমুল ঝড় চলছে। ও ধীরেধীরে একদম ঝুঁকে পড়লো মেঘের মুখের কাছে। দুজনের নাকের সাথে নাক লেগে গেলো। ঘোরের মধ্যে চলে গেছে দুজনেই। মেঘালয় মিশুর মাথাটা চেপে ধরে ওর ঠোঁট স্পর্শ করলো।
কেঁপে উঠলো মিশু। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। বুক ফেটে কান্না এসে যাচ্ছে ওর। এটা কি হয়ে গেলো? চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মেঘালয় মিশুর মাথাটা ছেড়ে দিতেই ও সোজা হয়ে বসলো। কিন্তু চোখ খুলতে পারলো না। মেঘালয় ও উঠে ওর পাশে বসে বিভ্রান্তের মত ভাবতে লাগলো শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে ও? মিশুর কোলে মাথা রেখে শুয়েছে কখন? ও তো পাশের সিটে বসে ছিলো। এখানে কখন আর কিভাবেই বা এলো? কি থেকে কি হয়ে গেলো মাথায় ঢুকছে না।
মিশুর দিকে তাকিয়ে দেখলো ও একদম সোজা হয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ কিন্তু দুই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে মেঘালয়ের। মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত কষ্ট দিয়ে ফেললো? ওর জন্য এতকিছু ভেবেও শেষ রক্ষা হলো না? মেয়েটা যে বড্ড ইনোসেন্ট, ওকে কিভাবে কি বোঝাবে মেঘালয়? মাথায় কিছুই আসছে না।
মেঘ একবার ডাকলো, “মিশু।”
মিশু চোখ খুললো না। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে ধরলো আর কান্নার গতিটা আরো বেড়ে গেলো। মেঘালয় আবারো বললো, “মিশু, আমি সরি।”
মিশু কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেঘালয় কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। তবুও হয়ত রাগ কমবে না।
মেঘালয় আরেকবার বললো, “মিশু সরি, বুঝতে পারিনি এমন হবে। তুমি প্লিজ…”
আর কিছু বলতে পারলো না।মিশু ওর বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো। দুহাতে খামচে ধরলো মেঘালয়ের শার্ট। ওর কান্নার গতি যত বাড়ছে, হাতের শক্তিও যেন তত বাড়ছে। দুহাতে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে মেঘালয়ের বুকে খামচে ধরছে ও। মেঘালয়ের খুব লাগছে কিন্তু টু শব্দটিও করলো না। মিশুকে ছুঁয়ে ও দেখলো না। মিশু একাই ওর বুকে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদে চলেছে আর সমানে খামচে যাচ্ছে ওর বুক আর গলা। হাতটা উপরে তুলে গলায় কতগুলা যে খামচি দিলো কোনো হিসেব নেই। গলা থেকে কাঁধে, ঘাড়েও অজস্র আচড় দিয়ে তারপর ক্ষান্ত হয়ে ওর গলা জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
যেসব জায়গায় ও খামচি দিয়েছে কয়েক জায়গায় বোধহয় ক্ষত হয়ে গেছে। জ্বালা করছে অনেক। তবুও কোনো শব্দ করলো না মেঘ। এমনকি একটু নড়লো ও না। মিশু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে একসময় সেটাও থেমে গেলো। স্তব্ধ হয়ে রইলো একদম। মেঘালয় নিজেও স্তব্ধ। নিশ্বাস পড়ছে খুবই আস্তে। মিশুর কান্না থেমেছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। চোখের পানিতে বুক ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মিশুর কোনো নড়াচড়া নেই। মেঘালয় ডাকতে গিয়েও গলায় জোর পাচ্ছেনা। চুপ করে রইল একদম, যতক্ষণ খুশি এভাবেই থাকুক মেয়েটা।
বেশ কিছুক্ষণ পর হাতটা মেঘের গলা থেকে সরিয়ে সামনে নিয়ে এলো মিশু। চোখ মুছলো এক হাতে। তারপর উঠে বসলো। দুহাতে বারকয়েক চোখ ও গাল মুছলো। তারপর একবার আড়চোখে মেঘালয়ের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশু আচমকা ওর গলা টিপে ধরে বললো, “খুন করে ফেলবো, খুন করে ফেলবো। এভাবে তাকান কেন? মেরে ফেলবো আপনাকে।”
মেঘালয় অনেক চেষ্টা করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাতে মিশুর মুখটা ধরে ফেললো। মিশু চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। চোখে পানি। মেঘালয় এক হাতে মুছে দিয়ে আলতো করে ওর মুখটা ধরলো দুহাত দিয়ে। তারপর খুব নরম গলায় বললো, “বিয়ে করবা আমায়?”
২৪.
খুব তাড়াতাড়ি ই বিছানা ছেড়ে নিচে নামলো দুপুর ও অরণ্য। দুজনের মাঝে এখন অনেকটাই সহজ ভাব চলে এসেছে। দুপুর ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে চুল আড়চাচ্ছে। হঠাৎ বাথরুমের খোলা দরজার দিকে চোখ চলে যাওয়ায় দেখলো অরণ্য ওর ব্রাশ টা দিয়েই দাঁত মাজছে। আশ্চর্য হওয়ার মত ব্যাপার! একজনের ব্রাশ অন্যজন কখনো ব্যবহার করে?
ছুটে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে দুপুর বললো, “আপনি আমার ব্রাশ নিয়েছেন কেন? আপনার ব্রাশ নেই?”
– “নাহ নেই।”
– “আপনার গায়ে হলুদের তত্ত্বের সাথে ব্রাশ পাঠিয়েছিলো আমাদের বাড়ি থেকে। সেটা কি করেছেন?”
– “জানিনা, কোথায় যে রেখেছে।”
– “আপনার আগে ব্রাশ ছিলোনা? সেটা?”
– “হারিয়ে গেছে।”
– “বিয়েতে আপনাকে নতুন ব্রাশ কিনে দেয়নি?”
– “না, দেয়নি।”
দুপুর বিরক্ত হয়ে বললো, “সেজন্য আপনি আমার ব্রাশ ব্যবহার করবেন?”
– “হুম, এ যাবত চারবার এটা দিয়েই দাঁত মেজেছি। তুমি ব্রাশ করার পর।”
– “ছি, এটা কেমন বিশ্রী ব্যাপার।”
– “বিশ্রী মনে হবে কেন? যদি একটা ব্রাশই দুজনে শেয়ার করতে না পারি তাহলে কিসের স্বামী স্ত্রী?”
প্রশ্নটা যথাযথ ছিলো। এর কোনো উত্তর দুপুরের জানা নেই। নিখিলের সাথে কথা হয়েছিলো, বিয়ের পর দুজনের একটাই ব্রাশ থাকবে। অরণ্য’র ক্ষেত্রে এর উলটা হবে কেন?
ও আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলো।
শাড়ি বদলে সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে নিলো। চোখে কাজল ও কপালে একটা কালো টিপ দিলো। অরণ্য বাইরে আসার পর কেউ কারো সাথে কোনো কথাই বললো না।
আজ বাসায় তেমন কোনো কাজ নেই। বিয়েতে আসা অতিথি রা সবাই চলে যাচ্ছেন। সকালের নাস্তা খাওয়ার পর ব্যাগ গুছিয়ে নিতে আরম্ভ করলো ওরা। অরণ্য নিজেই ব্যাগ গুছাচ্ছে আর দুপুর বসে আছে। একটুও দেরি করতে চায়না ছেলেটা। ব্যাগ গুছানো শেষ হতেই দুপুরকে রেডি হতে বলে সে বাবাকে বলতে গেলো যে এখনি বেড়িয়ে পড়তে চায়। দুপুর থতমত খেয়ে রেডি হতে লাগলো। ছেলেটার সবকিছু তে এত চঞ্চলতা কেন বোঝেনা ও। মাঝেমাঝে খুব বিরক্ত লাগে ওকে। কিছু বলাও যায়না।
রেডি হতে হতে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো দুপুরের। এখন একটা লম্বা জার্নি দেয়া হবে। সুন্দর করে সেজেগুজে বসে রইলো। অরণ্য আসলেই বেড়িয়ে পড়তে হবে।
এমন সময় দুপুরের ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো নিখিলের নাম্বার থেকে কল। বুকটা কেমন ধক করে উঠলো ওর।
চলবে..