অনুভূতি
পর্ব ১২
মিশু মনি
.
১৯.
অরণ্য পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো দুপুরকে। একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো দুপুর। এই কাজটির জন্য ও প্রস্তুত ছিলোনা। অরণ্য এভাবে কেন কাছে টানছে ওকে? ও যে কিছুতেই অরণ্য কে মেনে নিতে পারছে না। বলাও যায়না, সহ্য করাও যায়না। শুধু নিরবে যন্ত্রণা টুকু হজম করে ফেলতে হয়।
অরণ্য দুপুরের কাঁধের উপর নিজের মাথাটা রাখলো। দুপুর একদম স্পন্দনহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্য ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে গতরাতে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিলো দুপুর।”
দুপুর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে ভাবছে, অরণ্য ভাইয়ার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো আপুর সাথে। আমার সাথে হয়েছে এতে ভাইয়ার খুব অস্বস্তি হওয়ার কথা, এত সহজে আর এত অনায়াসে কিভাবে মিশে যেতে পারছে? ছেলেরা সবই পারে। খুব দ্রুত একজন অচেনা মানুষ কে ভালোবাসতেও পারে, ভূলে যেতেও পারে। রৌদ্রময়ীর মত মেয়েরাও পারে। কিন্তু দুপুর পারবে না। দুপুরের মন থেকে নিখিলকে সরাতে না জানি আরো কষ্ট মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে হবে!
অরণ্য বললো, “মন খারাপ করে থেকো না দুপুরবেলা আমার। দুপুরে সবসময় রোদ ঝলমল করার কথা।”
– “রোদ ই তো নেই, ঝলমল করবে কোথ থেকে?”
– “উফফ দুপুর, তুমি প্লিজ ওর নামটা আমার সামনে উচ্চারক করবে না। সে আমাদের সবার সাথে যেরকম টা করেছে, তাকে কি বলা উচিৎ আমার জানা নেই। তুমি আর কক্ষনো ওর কথা বলবে না। প্লিজ আমার সাথে একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করো।”
দুপুর কিছুই বললো না। নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো। অরণ্য শক্ত করে চেপে ধরলো ওকে। কাঁধের উপর মাথাটা রেখে বাম গালটা দুপুরের ডান গালের সাথে একবার ঘষে দিলো। শিউরে উঠলো দুপুর! সমস্ত শরীর ঝনঝন করে উঠলো। অরণ্য’র দাড়ির খোঁচায় গা শিরশির করে উঠছে ওর। ভিতরে দহন হচ্ছে, নিখিলকে মন থেকে জোর করে সরানোর দহন। এদিকে নতুন মানুষ কে জোর করে মনে জায়গা দেয়ার দহন। দুটো আগুন একসাথে হয়ে দাউদাউ করে জ্বলছে, কাউকে বলা যায়না, কাউকে বোঝানো ও সম্ভব না। একদম ই বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না ওর। তবুও মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে সবকিছু।
অরণ্য ওকে শক্ত করে ধরেই রইলো। এভাবে অনেক্ষণ কেটে যাওয়ার পর শ্বাশুরি মায়ের ডাকে ছাড়া পেলো দুপুর। প্রতিবেশী রা নতুন বউকে দেখতা এসেছেন। বাইরে তাদের সামনে বসে থাকতে হলো। বারান্দায় চেয়ারে বসে থাকার সময় দুপুর অরণ্য’র উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো। অরণ্য আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। বউকে চোখের সামনে রাখাতেও ওর বোধহয় তর সইছে না, সবসময় ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। বুকটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে দুপুরের। গতরাতে তো ছাড়া পাওয়া গেছেক্স আজকে রাতে অরণ্য কত রকমের অধিকার খাটাতে আসবে কে জানে! আবারো একটা ভয়ংকর বেদনা ছুঁয়ে গেলো দুপুরকে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও।
সারাদিন অনেক ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই কাটলো। বাসায় অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছেন। সবার সাথে কথা বয়াল্র মাধ্যমে বেশ সহজ হয়ে গেলো দুপুর। একসাথে খাওয়া দাওয়া করলো, বৌভাতের মেহমান দের সাথে বসে আড্ডা দিতে হলো। অরণ্য’র বন্ধুদের সাথেও অনেক কথা বলতে হলো। রাত নেমে আসতে আসতে মনটা অনেকটাই হালকা হয়ে গেলো দুপুরের। তবুও মাঝেমাঝে কেমন একটা অন্যরকম বেদনা এসে বুকে ভর করে। কিন্তু হুটহাট অরণ্য কোথ থেকে যেন দুটো ছোট বাচ্চাকে পাঠিয়ে দেয়, নয়ত কোনো বন্ধুকে পাঠিয়ে দেয়। তারা এসে দুপুরের সাথে কথা বলার মাধ্যমে ব্যস্ত রাখে ওকে। অরণ্য নিজেও সারাদিন নানান ভাবে ফাজলামো করে মাতিয়ে রেখেছিলো দুপুরকে। দুপুর বেশ বুঝতে পারে অরণ্য অনেক খেয়াল রাখছে ওর প্রতি। নয়ত এভাবে এত করে ওর মন ভালো করার জন্য পিছনে লেগে থাকতো না। অরণ্য ছেলেটা অনেক ভালো! যদি আগের জীবনে নিখিল নামে কেউ না থাকতো, তবে অনায়াসে ভালোবাসতে পারতো এই ছেলেটাকে। নিখিল যে অরণ্য’র চেয়েও বেশি খেয়াল রাখতো ওর, নিখিলকে কিভাবে ভূলে যাবে ও?
রাত হয়ে এলো। ভাবি ও ননদরা দুপুরকে ঘরে রেখে বিদায় নিলেন। আজ বুকটা কেমন ধুকপুক করছে ওর। গতরাতে অন্যদিকে কোনো খেয়াল ছিলোনা, কোনো অনুভূতি কাজ করছিলো না। কিন্তু আজকে রাতে অরণ্য’র আগমনের কথা ভেবেই গায়ে কাটা দিচ্ছে। না জানি আজ কি আছে কপালে!
জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো দুপুর। অরণ্য এসে দরজা লাগিয়ে বিছানার উপর বসলো। বুকের ভেতরে দুম দুম করে যেন হাতুরি পড়ছে। কষ্টের মাত্রাটা বেড়েই যাচ্ছে দুপুরের। অরণ্য একটু এগিয়ে এসে দুপুরের হাত ধরলো। এবার আরো কষ্ট হতে লাগলো দুপুরের। এ কেমন নিদারুণ কষ্ট! ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। বুকটা ভেঙে যাচ্ছে, একটা বিশাল ঝড় দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে সব। দুপুর দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো।
অরণ্য এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বললো, “আমার বউটাকে এখন একদম পুতুলের মত লাগছে। দুপুর সোনা, তুমি কি আমার কাছে কিছু চাও?”
দুপুর দুদিকে মাথা নাড়লো। অরণ্য বললো, “ভালোবাসাও না?”
বুকটা আরো একবার কেঁপে গেলো দুপুরের। যেন রিখটার মানের ভূমিকম্প বয়ে গেলো। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড কান্না পেয়ে গেলো ওর। এতবেশি কান্না পাচ্ছে যে নিজেকে সামলাতেই পারলো না। দুম করেই অরণ্য’র বুকের উপর পড়ে গিয়ে দুহাতে অরণ্য’র টি শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে লাগলো। ও শুধু কেঁদে কেঁদে নিজেকে হালকা করাতেই ব্যস্ত। এদিকে যে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সেটা খেয়ালেই রইলো না। অরণ্য ওর মাথায় হাত বুলাতে গিয়েও আর স্পর্শ করলো না। মেয়েটাকে এখন কাঁদতে দেয়াই উচিৎ, কেঁদে বুক ভিজিয়ে দিক।
২০.
মিশু ঘুমাচ্ছে মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে। আর ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মেঘালয়ের মুগ্ধ দুটি চোখ! একটা মেয়ে এতটা ইনোসেন্ট স্বভাবের কিভাবে হতে পারে! ঘুম থেকে উঠেই বলে, “আমার খিদে পেয়েছে। হাঁসের গোশত দিয়ে ভাত খাবো।”
কথাটা মনে করেই হাসলো মেঘালয়। মিশু ঘুমে ঢলে পড়ে যাচ্ছে ওর বুকে। মেঘালয়ের বুকটা কেমন ছ্যাত করে উঠলো। মিশুর গরম নিঃশ্বাস পড়ছে মেঘালয়ের বুকের উপর। স্তব্ধ হয়ে ফিল করছে মেঘালয়। মেয়েটাকে এখান বড্ড বেশি আপন মনেহচ্ছে। কেন যেন মনেহচ্ছে বহুদিনের সম্পর্ক ওর সাথে। যুগ যুগ ধরে একে অপরকে চেনে! একসাথে কত পথ চলে এসেছি!
কথাগুলো ভেবে আপন মনেই আবারো বললো, “ধ্যাত কি সব ভাবছি। এসব ভাবা যাবেনা। ভাবা ঠিক না। মেয়েটা অনেক বাচ্চা স্বভাবের। বুঝতে পেলে কেঁদে ফেলবে।”
মুখ টিপে হাসলো মেঘালয়। মিশু ঘুমাচ্ছে, যেন ঘুমিয়ে কত শান্তি পাচ্ছে মেয়েটা। একবার রৌদ্রময়ীর দিকে তাকালো মেঘালয়। কনের সাজে বসে থাকা মেয়েটার গাল বেয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে। কি এমন দুঃখ আছে ওই সুন্দর মেয়েটার? জানতে বড্ড ইচ্ছে হয়। কিন্তু এখন কিছুতেই উঠে যাওয়ার সুযোগ নেই, মিশু এক হাতে মেঘালয়ের এক বাহু জাপটে ধরে ঘুমাচ্ছে। ভাবলেই কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে মেঘালয়।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো কেউই বলতে পারেনা। ঘুম থেকে উঠে একবার মেঘালয়ের দিকে তাকালো মিশু। আড়মোড়া ভেঙে বললো, “এখন কোথায় আমরা?”
– “ট্রেনে।”
– “ট্রেনটা কোথায়?”
– “রেল লাইনের উপর।”
– “রেল লাইনটা কোথায়?”
– “ভূ পৃষ্ঠের উপর।”
মিশু ক্ষেপে গিয়ে বললো, “একদম মাইর দিবো। এরকম দুষ্টুমি করছেন কেন?”
– “বাচ্চাদের সাথে তো দুষ্টুমি ই করতে হয়।”
– “আমি বাচ্চা? বাচ্চামির কি দেখালাম শুনি?”
– “কিছুই তো দেখিনি। দেখলে নাহয় বুঝতে পারতাম বাচ্চা নাকি বাচ্চার মা।”
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো মেঘালয়। সর্বনাশ! খুবই লেইম টাইপের ডায়ালগ দিয়ে ফেলেছে ও। মিশু যদি অন্যকিছু বুঝে নেয় তাহলে তো খুবই রাগ করবে। কিন্তু মিশু মেঘালয়ের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি। ও অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “এখন মনেহয় আমরা ঈশ্বরদীর ওদিকে আছি।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “বাঁচলাম বাবা।”
– “বাঁচলাম মানে?”
– “না কিছুনা। কিছু খাবা?”
– “না, খিদে পায়নি। আচ্ছা ওই নতুন বউটা কোথায়?”
মেঘালয় রৌদ্রময়ীর সিটের দিকে তাকিয়ে বললো, “জানিনা তো। এখানেই তো ছিলো মেয়েটা। বোধহয় নেমে গেছে।”
-“মরে টরে যায়নি তো?”
– “মরলে আগেই মরতো, ট্রেনে উঠে বসে থাকতো না।”
– “হুম তাও ঠিক। সে যাই হোক, এরপর যেখানে ক্রসিং হবে আমরা সেখানেই নেমে পড়বো আচ্ছা?”
– “নেমে কি করবা?”
– “কি আবার? ওই ট্রেনে উঠে পড়বো। ঢাকায় ফিরে যাবো। কালকে আমাকে আপনার বাবার অফিসে যেতে হবেনা?”
– “ওহ আচ্ছা। ঠিকাছে তাই হোক। কিন্তু এটাতে তো পুলিশকে বলে সিট নিয়েছি, ওটায় দাঁড়িয়ে থেকে যেতে হবে।”
– “যাবো, সমস্যা কি?”
মেঘালয় হেসে বললো, “পুরো জার্নিতে ঘুমালে সমস্যা না থাকার ই কথা।”
– “আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না?”
– “আবার জিজ্ঞেস ও করে!”
দাঁত বের করে হাসলো মেঘালয়। মিশুর ও হাসি পেয়ে গেলো। মেঘালয় একটু মিশুর দিকে এগিয়ে আসতেই মিশু বললো, “এই এই দূরে থাকুন, দূরে থাকুন।”
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, “কেন?”
– “বারে, ঘুম থেকা উঠলাম না? এখন আমার মুখে গন্ধ, ওয়্যাক….”
মিশু মুখের ভঙ্গিটা এমন করলো যে হাসি পেয়ে গেলো মেঘালয়ের। নিজের মুখের গন্ধের কথা কেউ কখনো এভাবে বলেছিলো কিনা ওর জানা নেই। হাসত হাসতে সিটের পিছনে হেলান দিয়ে মিশুর দিকে চেয়ে রইলো মেঘালয়। আর মিশু তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের হাতের দিকে। গরমে ঘেমে গেছে মেঘালয়ের শরীর। হাত ঘামে ভিজে গেছে, হাতের উপরের ঘন লোমগুলো একদম গায়ের সাথে লেগে গেছে। দেখলেই কেমন যেন অনুভূতি কাজ করে, মিশু তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের হাতের দিকে! একদম অপলক ভাবে!
চলবে…