#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
পর্ব: ১৬ [ শাওনের অতীত উন্মোচন]
.
সকালে একটা মিষ্টি রোদের প্রতিফলনে আড়মুড়িয়ে মেহের ঘুম থেকে উঠে পড়ে। একপাশে সোফায় আধশোয়া অবস্থায় ঘুমন্ত আদ্রাফকে দেখে ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলে একচিলতে হাসি।আদ্রাফের চুলগুলো জুবুথুবু হয়ে পড়ে আছে পেছনের দিকে। শার্টের উপরের বোতাম দুটো খুলে রাখার কারনে ওর লোমহীন বুকের আংশিক স্পষ্ট দেখতে পারছে । আর সে দৃশ্য দেখেই মেহের ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। তার স্নায়ু কাজ করা যেন বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও আদ্রাফের গায়ের রং ওর থেকে একটু চাপা তবুও মনেমনে সে হাসফাস করে যে , ”এই ছেলেটা এতো সুন্দর কেন?”
.
আদ্রাফকে মিহি কন্ঠে ডাক দিতেই সে উঠে যায়। চোখে ঘুমের রেশ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি সে। মেহেরের কাছে গিয়ে সে নরম কন্ঠে বললো……..
.
—-রাতে ঘুম ঠিকমতো হয়েছে তো?
.
আদ্রাফের ঘুমুঘুমু মৃদু কন্ঠে যেন অন্য এক ভালোলাগা কাছ করছে মেহেরের । কেবিনের খাটে বসেই আনমনে আদ্রাফের দাঁড়ানো অবস্থাতেই ওর পেটের কাছে মুখ গুজে দেয়। কিঞ্চিত আদুরে কন্ঠে বলে……
.
—-হুম। মোটামোটি ভালো ঘুম হয়েছে। আমি এখানে আর কতদিন থাকবো আদ্রাফ? আমি এখন ঠিক আছি তো। বাসায় গেলে হবে না?
.
—–হ্যাঁ হবে। ডাক্তার বলেছে আজ চাইলে ডিসচার্জ করতে পারবো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
.
শর্তের কথা শুনেই মুখ মলিন করে ফেলে মেহের। সামান্য আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করে যে…..
.
—-কি শর্ত?
.
—-আমার সব কথা শুনতে হবে। যেমন: আমি যা খেতে বলবো তাই খাবে , সম্পূর্ণ রেস্টে থাকবে , ওষুধ নিয়ে কোনো হেলফেল করবে না and most important……..বাদরামি করবে না।তাহলেই বাসায় যাবো।
.
আদ্রাফের মুখের দিকে এবার মেহের তাকায়। ভ্রু কুচকে বলে ওঠে……….
.
—–আমি কি বাদরামি করার মতো মেয়ে? তুমি জানো না , আমি আদ্রাফ এহসানের একটা কিউট, ইনোসেন্ট, গুবলু-বুবলু বউ?
.
একথা শুনে আদ্রাফ সশব্দে হেসে দেয়। মাঝে মাঝে মেহেরের এসব বাচ্চামি আদ্রাফের কাছে অনেক ভালোলাগার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
.
—–আদ্রাফ?
.
—-হুম !
.
—-একটু আমার স্যালাইনের পাইপটা খুলে দাও। আমি ওয়াশরুমে যাবো।
.
আদ্রাফ মেহেরের স্যালাইনের ক্যানোলা খুলে দেওয়ার পরই মেহের ওয়াশরুমে যেতে নিয় আর আদ্রাফ সাথে সাথে কোলে তুলে নেয় মেহেরকে। ঘটনার তৎক্ষণাৎ প্রবাহে মেহের কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছে। আদ্রাফের দিকে ডাগর ডাগর চাহিনী দিয়ে বললো.
.
—কি হলো? কোলে তুললে কেন?
.
— ভাবলাম তুমি অসুস্থ মেয়ে। একা ওয়াশরুমে যেতে পারবে কিনা তাই ভাবলাম একটু company দেই। (চোখ টিপ দিয়ে)
.
আদ্রাফের চোখ টিপ দেওয়াতে মেহেরের হার্টবিট যেন একটা মিস হয়ে গেল। এমনিতেও এই এলোমেলো চুলে আদ্রাফকে দেখতে পুরোই অন্যরকম লাগছে আবার এমন দুষ্টু চোখের চাহিনীতে মেহেরের এখন যেন অজ্ঞান হওয়ার মতো উপক্রম। আদ্রাফের বুকে হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে আমতা আমতা করে সে বললো……..
.
—-মমমটোও না। আমি একাই যেতে পারবো?
.
—Sure?
.
আদ্রাফ ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে মেহেরকে। মেহেরের এবার সাথে সাথেই যেন আরেকটা হার্টবিট মিস হয়ে গেলো। এই ছেলেটার চোখে কি কোনো জাদু আছে যে না চাইতেও বারবার মাতাল হয়ে পড়ে এই চোখজোড়ার নজরকাড়া চাহিনীতে? মেহের শুকনো গলায় প্রতিউত্তরে বলে………
.
—-হুম।
.
আদ্রাফ এবার মেহেরকে নিচে নামিয়ে দিতেই মেহের দুর্বল পায়ে ওয়াশরুমে পা বাড়ায়। দরজাটা লাগিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে । আদ্রাফের চোখের চাহিনী, কথা প্রকাশের ভাবভঙ্গি সবকিছুই বুকে গিয়ে লাগে মেহেরের। এখন তো মনে হয় যেন সবসময়ই নিজের সাথে আদ্রাফ নামের এই মায়াবী অস্তিত্বটাকে মিশিয়ে রাখতে। সে জানে না এই অনুভূতির কোনো প্রত্যক্ষ নাম আছে কি না।
.
.
.
.
প্রায় সকাল সাড়ে আটটার দিকে শাওন হেলতে-দুলতে অবস্থায় চৌধুরী মেনশনে প্রবেশ করে। গতরাতের আ্যলকোহলের নেশাটা এখনও ঠিকমতো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। হায়াৎ সাহেব ডায়নিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করছিলেন। শাওনকে এভাবে হেলতে-দুলতে আসতে দেখে বুঝতে আপত্তি হলো না যে এই ছেলে সারারাত বারে আ্যলকোহলের নেশার সাথে ফূর্তি করেছে।
ক্রোধের গলায় তিনি বললেন………..
.
—–এসে পড়েছে নওয়াবের ছেলে? আমি তো ওয়েট করছিলাম কখন পুলিশ যেন তোমায় তুলে নিয়ে আসে। তো কয় বোতল খেয়ে আসলে?
.
এতটুকু শুনেই শাওনের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। গর্জে সে বলে……
.
—-আ্যলকোহলের নেশাটাই just করেছি । আপনার মতো বউ-বাচ্চাকে ছেড়ে রাত বিরাতে মেয়েদের সাথে ফূর্তি করিনি।
.
—–মুখ সামলে কথা বলো শাওন !
.
ক্রুব্ধ হয়ে বলে হায়াৎ চৌধুরি। আশেপাশের সার্ভেন্টও নীরবে যে যার জায়গা মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেননা এ আর নতুন কোনো দৃশ্য না। শাওন এবার হায়াৎ সাহেবের কাছে গিয়ে বলে…….
.
—–ভুল বললাম নাকি মিঃ হায়াৎ চৌধুরি ওরফে আমার so called dad? আপনার জঘণ্য চরিত্র থেকে আমার চরিত্র লক্ষ গুণে ভালো। হ্যাঁ ! আমি হয়তো হৃদয়হীন মানুষ , বাট কেউ কখনও আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলতে পারবে না। আর আমি যা-ই করি না কেন , আপনার কোনো রাইট নাই। You have no right to control me……
.
শেষের কথাটা শাওন চিল্লিয়ে বলে ওঠে । পুরো ডাইনিং রুমে বিরাজ করছে পিনপন নিস্তব্ধতা। হায়াৎ সাহেব নীরব গলায় বলে ওঠে……….
.
——কখনও কোনো কিছুর কমতি রাখিনি তোমার। তাহলে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার তুমি কে? বাবা হই আমি তোমায়।
.
শাওন এবার হো হো করে হেসে ওঠে। যেন দুনিয়ার সবচেয়ে মজার কৌতুক শুনলো সে। কিছুক্ষণ পর হায়াৎ সাহেবের দিকে ক্রোধের গলায় বলে ওঠে……..
.
——-সে right তুমি অনেক আগেই তুমি হারিয়ে ফেলেছো যখন তুমি রাইতা আর মাকে মেরে ফেলেছিলে। মা নাহয় তোমার ফূর্তিতে বাধা দিয়েছিলো কিন্ত রাইতা? ৭ বছরের বাচ্চা ছিলো সে। তোমার আপন মেয়ে হয়েও তুমি ওকে মেরে ফেলতে পারলে?
.
নিশ্চুপ হয়ে যায় হায়াৎ সাহেব। হ্যা শাওনের মাকে এক্সিডেন্ট করিয়ে সে মেরে ফেলেছিলো ঠিকই তবে তার সঙ্গে যে রাইতাও থাকবে এটা সে জানতো না। গাড়িটা সরাসরি খাদে পরে গেলে শাওনের মা আর রাইতা দুজনেই মারা যায়। দুদিন পর শাওনের মার বিভৎস লাশ পাওয়া যায় পাহাড়ের ঢালে । তবে রাইতার আর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে সে যে বেঁচে নেই এ ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিলো।
শাওনের বয়স তখন ছিলো মাত্র ১৪ বছর। এ ব্যাপারে যে ওর বাবার হাত ছিলো এটা সে জানতে পারে আরও দুইবছর পরে। তখন থেকেই পরিবর্তন হয়ে যায় শাওন। বাবা হয়ে ওঠে তার জীবনের সবচেয়ে ঘৃণিত বস্ত। এমনকি কিছু দুশ্চরিত্রা মেয়ের জন্য মেয়েজাতিকেও। সবাইকে না।
কারন শাওন জানে সবাই একরকম না। হয়তো পরোক্ষভাবে কিছু মেয়ের জন্যই তার মা-বোনকে হারাতে হয়েছে তবে সবাই তো এক না। ওর ফ্রেন্ডসার্কেলে রাতুল , রাহাতের সাথে তার শুভাকাঙ্খী হিসেবে নিশা আর শোভাও ছিলো।
.
হায়াৎ সাহেবকে চুপ থাকতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে শাওন। টেবিলে থাকা গ্লাসটা সশব্দে ফেলে দিয়ে গজগজ করতে করতে চলে যায় সেখান থেকে।
.
.
.
নিচে হসপিটালের রিসেপশনের সামনে মেহের আড়চোখে একবার দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মেডিকেল স্টুডেন্টের দিকে দেখছে তো একবার আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফ রিসেপশনে থাকা লোকটির সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলাপনে ব্যস্ত। আর মেহের পাশের সোফাটিতে বসে ওই তিনটি মেয়েকে দেখে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তার কাছে ওই মেয়ে তিনটিকে নিজের থেকেও চরম লেভেলের অসভ্য মনে হচ্ছে।
কেননা মেয়ে তিনটি শুধু পারছে না চোখ দিয়েই আদ্রাফকে গিলে খেয়ে ফেলতে। তাছাড়া আদ্রাফের প্রতিটা কাজই সবসময় হয় চোখ ধাধানোর মতো। পরনে গ্রে শার্ট , ব্ল্যাক প্যান্ট , পায়ে হোয়াইট কেডস সব মিলিয়ে শ্যামবর্ণের এই আদ্রাফকে বেশ চার্মিং লাগছে। শার্টের হাতাটি কিছুটা গুটিয়ে রাখার কারনে হাতের নীল রগগুলো বেশ সুন্দরভাবেই বোঝা যাচ্ছে। চুলগুলো হালকা স্পাইক করা আর ওর দুহাত ব্যস্ত হসপিটালের কাগজপত্র দেখতে।
মেহেরের ওই তিনটা বদ মেয়ের ফিসফিসানি দেখে মাথায় যেন রক্ত উঠে গিয়েছে। মনে মনে অসংখ্য গালাগাল করে যাচ্ছে মেয়ে তিনটিকে। আদ্রাফ সব কাজ শেষ করে এবার মেহেরের দিকে এগিয়ে আসতেই মেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আদ্রাফকে আদুরে গলায় বলে ওঠে………..
.
—–আমায় কোলে নাও।
আদ্রাফ কিছুটা হতভম্ব। হঠাৎ মেহের কেনই বা ওর কোলে উঠতে চাচ্ছে বিষয়টা ওর মাথায় আসছে না। মেহেরের গাছে হাটু গেড়ে বসে সে। নিজের হালকা গোলাপি ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে বলে ওঠে………
.
—–বেশি খারাপ লাগছে মেহু?
.
আদ্রাফের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। মেহের তা দেখে ফিক করে হেসে দেয়। ওর সাজানো গোছানো চুলগুলোকে এলোমেলো করে বলে ওঠে……..
.
—-অন্য মেয়েরা আমার বরকে দেখবে এটা আমার ভালো লাগে না। তাই এখান থেকে গাড়ি পর্যন্ত আমায় কোলে নিয়ে যাবে।
.
আদ্রাফ এভার কিছু না বলে কোলে তুলে নেয় মেহেরকে। তা দেখে সবার মনে প্রশ্ন জাগলেও এগোনোর মতো মনমানসিকতা কারও নেই। একজন ওয়ার্ডবয় উদ্যত হয়ে বলে……..
.
—–স্যার……ম্যামের কি হুইল চেয়ার লাগবে?
.
—–না রে ভাই। ম্যামের জন্য তার হাজবেন্টই হুইলচেয়ার।
.
মেয়ে তিনটিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহের মনে মনে যেন পৈশাচিক আনন্দ পায়। আদ্রাফের গলা জড়িয়ে ওই তিনটা মেয়েকে চোখ টিপ মারতেই মেয়ে তিনজন বিব্রত হয়ে পড়ে। মনে মনে মেহের বলে উঠে………
.
—-এই মেহের থাকতে তার কিউট বরের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারবে না।🙂
.
.
.
.
.
~চলবে