অনুভূতির সুপ্ত কোণে পর্ব-১৪

0
2311

#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন(মাইশা)
পর্ব : ১৪
.
সময়ের প্রবাহ কেমন যেন থমকে গিয়েছে। বাইরে চলছে মুষলধারে বৃষ্টি। ভার্সিটির অডিটরিয়ামে অনেকেই আহত হয়েছে আগুনের দুর্ঘটনার কারনে। ওটির সামনে গুমশুম মেরে বসে আছে শাওন। পাশেই দাঁড়ানো সাদাত আর নাদিয়া। আদ্রাফকে এখনও কিছুই জানায়নি দুজনে। তবে মাকে জানিয়ে দিয়েছে। মা আদ্রাফকে বলেছে কি-না নাদিয়ার কাছে তা অজানা।
শাওনকে যেন নতুনভাবে দেখছে সবাই। নিজেকে যতটা খারাপ প্রমাণ করতে চায় সে ততটাও খারাপ না। তবে শাওন যে মনে মনে কি ভাবছে তার পাশে বসে থাকা নিশা , রাহাত, রাতুল , কেউই বুঝতে পারছে না।
.
প্রায় আধাঘন্টা ঘনিয়ে এসেছে কিন্ত অপারেশন থিয়েটার থেকে কেউই বের হচ্ছে না। শাওনের মাথাটা জুবুথুবু হয়ে আছে দুশ্চিন্তার কারনে। জানেনা , কেন এত দুশ্চিন্তা ওই মেয়েটার জন্য যে ওকে সবার সামনে থাপ্পড় মেরেছে। তার ঘৃণাটা সে প্রকাশ করতে পারছে না এটা ভাবতেই অবাক লাগছে শাওনের। এটা কি কখনো সম্ভব ?
যে শাওন চৌধুরি শুধু মারপিট-খুন খারাপি……বার-নাইট ক্লাব , হুইস্কি-আ্যলকোহল ছাড়া কিছুই বুঝতো না সে কি-না একটি সামান্য মেয়ের জন্য হসপিটালে বসে আছে, তাও আবার নিজের বোনের পরিচয় দিয়ে…..?
.
আর কিছু ভাবতে চাচ্ছে না সে। কেননা সে তার মনস্থির করে রেখেছে যে ; ”যে ভাবেই হোক , মেহেরকে বাঁচতে হবে।”
.
.
অগোছালোভাবে আদ্রাফ এসেছে ওটির সামনে। নাদিয়া আর সাদাতকে একপাশে দেখতে পেয়ে মস্তিষ্কের নিউরন যেন ওর সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মায়ের কল পেতেই যখন মেহেরের দুরবস্থার কথা শুনলো সাথে সাথেই অফিসের কাজ ফেলে মা-বাবার সাথে এখানে এসে পড়ে।
মেহেরর এ অবস্থা যেন কিছুতেই আদ্রাফ মানতে পারছে না। শাওন এবার চোখ তুলে তাকায় আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফের দৃষ্টি বিধ্ধস্ত। মলিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ওটির দরজার সামনে। গ্লাস ভেদ করে মেহেরের অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুখ দেখে আদ্রাফের নিঃশ্বাসও যেন সে পর্যায়ে আটকে গিয়েছে।
.
——আল্লাহর উপর ভরসা রাখো বাবা ! মেহেরের কিছুই হবে না।
.
আদ্রাফকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করে তার বাবা। আদ্রাফ বিনিময়ে কিছু বলে না। কি বলবে সে? যেই মেহের সবসময় দুষ্টুমিতে মেতে থাকতো তার এ অবস্থা কোন আপনজনই বা সহ্য করতে পারবে? হ্যাঁ রেগে ছিলো সে মেহেরের ওপর। তাই বলে মেহেরকে এত দূর করতে চায়নি সে।
.
হঠাৎ ওটির থেকে ডাক্তার বের হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তারকে ঘিরে সবাই জড়ো হয়ে দাঁড়ায়। আদ্রাফ একরাশ আশা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করে……….
.
—-Doctor? How about she?
.
—-খুব একটা ভালো না। পেশেন্টের maybe কোনো ফোবিয়া আছে যার জন্য লাগামহীনভাবে নাক ও কান থেকে রক্ত পড়ছে যেদিকে এটা burn case…… We need O+ blood in emergency….
.
—-I have O+ blood…….
তাদের কথার মাঝে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে ওঠে শাওন। সবার দৃষ্টি পড়েছে এবার শাওনের দিকে। ডাক্তার একথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। শাওন চৌধুরি কখনোই কাউকে ব্লাড দেয়নি সেখানে এখন ব্লাড দিলে ডাক্তারের ওপর কোনো উপর থেকে চাপ প্রয়োগ করবে এটা ভেবেই ডাক্তার ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে…
.
—-Sorry Sir ! আপনার ব্লাড আমরা নিতে পারবো না। আপনার বাবা তাহলে আমাদের জানে মেরেও ফেলতে পারে।
.
এ কথা শুনে পাশের টেবিলে থাকা স্যাভলনের কাচের কৌটোটি সজোরে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে শাওন।
.
—-আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে। আমার কথা না শুনলে আমি তোমাদের শেষ করে ফেলবো। সো আমার কথা শুনবে নাকি আমার so called dad এর কথা শুনবে?
.
শাওনের হঠাৎ রাগাত্নক আক্রমণে ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়েছে ডাক্তারসহ বাকি নার্সরা। এখন শাওনের কথা না মানা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের কাছে। অগত্যাই তারা নিজেদের কাজে লেগে পড়ে।
.
.
.
.
সকল ক্রিয়া শেষ করার পর নিজের জায়গায় বসে আছে শাওন। নিশা শাওনের কাধে হাত রাখতেই শাওন নিশার দিকে তাকায়।
.
—-রিলেক্স শাওন ! মেয়েটার কিছুই হবে না।
.
আদ্রাফ শক্ত রেখেছে নিজেকে। মেহেরকে হারানোর কথা কিছুতেই সে কল্পনা করতে পারবে না। মেহের নিজের দুষ্টুমি দিয়েই আদ্রাফের মনে জায়গা করে নিয়েছে নিজের। এক অবাধ্য অনুভূতির। মেহেরের মুখ ফুলানো ; কথা আটকিয়ে যাওয়া , তার ঠোঁটের স্পর্শ সবকিছুই পাগল করে দিতো আদ্রাফকে। তবে কি আদ্রাফ কখনোই অনুভব করতে পারবে তার মেহুর অবচেতন সেই স্পর্শ?
.
ওটির লাইট অফ হতেই সবার ধ্যান পুনরায় সেদিকে মনোনিবেশ করে। আদ্রাফ উঠে আকুলকন্ঠে ডাক্তারকে প্রশ্ন করে……..
.
—What happend ? মেহু……….ঠিকাছে তো?
.
শেষ কথাটুকু বলতে গিয়ে দম আটকে আসে আদ্রাফের। যেন মেহুর অন্তিম পরিণতি নিজের চোখে কখনোই সে সয্য করতে পারবে না। ডাক্তার তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে ওঠে…..
.
—-yeah youngman ! আল্লাহ তোমার কথা শুনেছে। She is absolutely fine……
.
আদ্রাফের বুকের থেকে যেন একটা চাপা পাথর সরে আসে । স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সবাই। ডাক্তার এবার বলে ওঠে……
.
—-তবে ধোয়ার মুখোমুখি হওয়াতে ফুসফুসে কিছু প্রবলেম আছে। Patient কে always air pollution থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাকে কেবিনে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
.
নিশা, রাহাত, রাতুল সকলের মুখেই এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে শুধুমাত্র শাওন ছাড়া। তার চেহারা বরাবরের মতোই প্রতিক্রিয়াহীন। চোখের সামনে বারবার তার ভেসে আসছে কিছু করুন দৃশ্য। সবার চোখের অগোচরে নীরবেই হসপিটাল থেকে চলে আসে সে।
.
.
.
দুপুরের প্রহর পেরিয়ে বাইরে এখন দৃশ্যমান বিকেলের মৃদু আলোর খেলা। পিটপিট করে চোখ খুলতেই মেহেরের চোখ প্রথমে কেবিনের জানালার দিকে যায়। সারা পরিবেশ নিস্তব্ধ। মেহের মনে করার চেষ্টা করছে তার জ্ঞান হারাবার আগের ঘটনাগুলো। কিন্ত অজানাভাবে শাওনের বিবর্ণ মুখ ছাড়া আর কিছুই কল্পনা করতে পারছে না। তাকে চোখ খুলতে দেখে আদ্রাফ সোফা থেকে উঠে মেহেরের কাছে গিয়ে বসে।
.
আদ্রাফের চোখযুগল বলতে গেলে একেবারেই মলিন হয়ে আছে। মেহেরের চোখ ছলছল করে ওঠে আদ্রাফের এ অবস্থা দেখে। কেননা ওর মনে হয়েছিলো যে ও হয়তো কখনোই আদ্রাফকে তার মনের কথা বলতে পারবে না।
নিজের দুহাতে মেহেরের মুখ আগলে নিয়ে আদ্রাফ মেহেরের সারামুখে পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে। মেহের আনমনে আদ্রাফের এক হাত দুরবলধাবে খামচে ধরেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্রাফ মেহেরে কপালের সাথে নিজের কপাল লাগিয়ে দেয়।
সারাঘরে বিরাজ করছে কেমন যেন এক নিস্তব্দ্ধতা। দুজনের নিঃশ্বাস একে অপরের সাথে খেলা করতে মগ্ন। আদ্রাফ চোখ বন্ধ করে উদাসীন গলায় বলে ওঠে………
.
—–আজ তুমি হারিয়ে গেলে আমি নিজেও হারিয়ে যেতাম মেহু। এই মেহেরহীন আদ্রাফ একেবারে বিলীন হয়ে যেতাম। I can’t live anymore Mehu without you……Because you are my lifeline……
.
.
.
.
.
~চলবে
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে