#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ত্রয়শ্চত্বারিংশ পর্ব (৪৩ পর্ব)
কোনো বস্তু পড়ার শব্দে ঘুম ভা°ঙে মৃত্তিকার। ইমতিয়াজ আলমারিতে কিছু একটা রাখছে। মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে দেখে মাত্র সাড়ে তিনটা বেজেছে৷ ইমতিয়াজ এখনো ওকে খেয়াল করেনি, সে মনোযোগ দিয়ে পড়ে যাওয়া কিছু তুলছে।
“কি করছেন?”
ইমতিয়াজ একপ্রকার চমকে উঠে বলল,
“ডিস্টার্ব হলো?”
“না না, তেমন কিছু না।”
মৃত্তিকা উঠে বসে। অনেকগুলো কাগজ ইমতিয়াজ নিজের ড্রয়ারে রেখে আলমারি বন্ধ করে। তারপর বিছানায় বসে বলে,
“এখনো ফজরের আজান দেয়নি। তুমি ঘুমাও।”
মৃত্তিকা কপালে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো গুছিয়ে বলল,
“আর ঘুমাবো না। এই সময় ঘুম যখন ভে°ঙেছে, তখন তাহাজ্জুদ পড়াই ভালো।”
ইমতিয়াজ আলতো হাসে,
“ওকে, পড়ো তবে।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলে,
“আপনি পড়বেন না?”
“হ্যাঁ পড়া যায়।”
“তবে আপনি আগে অযু করে আসেন।”
ইমতিয়াজ মাথানেড়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। মৃত্তিকা দ্রুত উঠে আলমারি খুলে। ড্রয়ার থেকে অনেকগুলো কাগজ পায় সে, একটা ফিতা দিয়ে হালকা করে বাধা আছে৷ ফিতা খুলে কাগজগুলো বের করে মৃত্তিকা একটু অবাক হয়। তাহমিনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা একেকটা চিঠি, হাতের লেখা যতদূর বুঝলো ইমতিয়াজের। এ চিঠি কোন অজানায় যাবে তা সেই জানে।
মৃত্তিকা একে একে সবগুলো চিঠি দেখতে লাগলো। কয়েকদিন পর পর হয়তো চিঠি লিখে। আজও একটা চিঠি লিখেছে,
“আজ হয়তো অন্যকারো হাতের পায়েস খেতে হবে। তোমাকে তো প্রতিদিন মিস করছি, আজ বোধহয় বেশি করবো। ইদ মোবারক মিনা, ভালো থেকো তুমি।”
অন্য একটা চিঠিতে লেখা,
“তুমি রাগ করেছো জানি, তবে জেনে রাখো তোমার স্থান কারো নয়। অলিন্দের ছন্দে মিশে গেছো তুমি। অন্যকেউ চাইলেও এ পর্যন্ত আসবে না।”
মৃত্তিকা জানে ইমতিয়াজ তাহমিনাকে আজও ভালোবাসে, তাহমিনার স্মৃ°তি হাতরে বেড়ায় আজও। তবুও মৃত্তিকার হিং°সা হলো। তাহমিনার স্থান সে পাবে না, চায় না সে স্থান। তাই বলে অন্যকারো হাতের পায়েস খেতে হবে, এভাবে তো না বললেও হতো।
মৃত্তিকা দ্রুত কাগজগুলো রেখে আলমারি বন্ধ করে৷ ইমতিয়াজ বেরিয়ে এসে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,
“যাও, অযু করে নাও।”
মৃত্তিকা মাথানিচু করে চলে যায়। কান্না পাচ্ছে তার প্রচুর। সে কেঁদেছে, নামাজে বসেই কেঁদেছে সে। ঠিক যে ভালোবাসা পেতে রিপা বেগম সারাজীবন কেঁদেছিলেন, আজ তার মেয়েও একইভাবে কাঁদছে। কিস°মত বড়ই কঠিন, মা-মেয়েকে একই সুতায় বেঁধে দিয়েছে। মা না জেনে অ°নলে পড়েছিল আর মেয়ে তো জেনেবুঝে পড়েছে৷
______________________________________
ফজরের আযানের আগেই উঠেছে সারাহ্। ড্রিম লাইটের আলোয় আহনাফের উ°ন্মু°ক্ত বুকে মেহেদীর আঁকিবুঁকি দেখে সারাহ্ হেসে উঠে। হাতের মেহেদী কিছু আহনাফের বুকেও লেগে গেছে, আবার তার রঙ হয়েছে।
সারাহ্ আহনাফের বুকে হাত দেয়, মাথানিচু করে চুম্বন দেয়। মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে থাকে, একসময় ঘুমিয়ে যায়। আযানের ধ্বনি শুনে আহনাফ উঠতে নিয়ে বুঝে সারাহ্ ওর বুকেই শুয়ে আছে৷
আহনাফ ওর মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মুখে ধীরে ধীরে আযানের জবাব দিচ্ছে সে। আযান শেষ হলে সারাহ্-কে ডাকে,
“ঐশী, উঠো।”
সারাহ্ চোখ পিটপিট করে উঠে৷ সরে আসতে চেয়েও আসতে পারলো না। আহনাফ ওর মাথাটা আবারো বুকে রেখে বলে,
“কখন দখল করে নিছো?”
সারাহ্ কিছু বলে না। আহনাফ ওর গাল টে°নে বলল,
“কি হলো? কথা বলো।”
“মেহেদী লেগেছে এখানে।”
আহনাফ মাথা উঠিয়ে দেখে হেসে দিলো। বলল,
“বিয়ের পর এমন একটু আধটু লাগতে পারে৷”
সারাহ্ হেসে উঠে বসে। আহনাফও উঠে বসে সারাহ্-র কাছে এসে বলল,
“তারমানে সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলে? একটু সরে টরেও তো থাকা যায়৷ (বড় নিশ্বাস নিয়ে) না, তোমার লজ্জা শরম কিচ্ছু নাই।”
সারাহ্ ওর বুকে ধা°ক্কা দিয়ে উঠে চলে যায়৷ মুখে লাজুক হাসি লেগে থাকে। আহনাফ হেসে নিজের বুকে মেহেদীর রঙ দেখে।
______________________________________
“আমি পাহাড় ভাই°ঙ্গা জাইগ্যা উঠা চান্দেরও বুড়ি
অন্ধকারের মেঘলা মনে জোছনা-পরি।
আমি পাহাড় ভাই°ঙ্গা জাইগ্যা উঠা চান্দেরও বুড়ি
অন্ধকারের মেঘলা মনে জোছনা-পরি।
না বা°ন্ধিলি তুই আমারে মনেরও ঘরে
না ভা°সা°ইলি তুই আমারে প্রেমের জো°য়ারে।
আমি নিশি রাইতের জংলা ফুল
ভা°ঙা নদীর ভাঙা কূল
মইধ্যেখানে জাইগা থাকা চর।”
সকালের নাস্তা সাজাতে সাজাতে গান গাইছে মৃত্তিকা। মনের সুখে না দুঃখে তা তো জানে না, তবে গতকাল থেকেই এই গান তার মনে বেজে যাচ্ছে। মৃত্তিকা তো গান তেমন শুনে না, তবে বাসার পাশে সাউন্ড বক্সে কাল এই গান বেজেছে৷ তার ভালো লেগেছে লিরিক্সটা।
তার জীবনের সাথে সে মিল পেয়েছে। সেও ইমতিয়াজের জীবনে একটা নিশি রাতের জংলা ফুল হয়েই এসেছে আর নাহয় কোনো একটা চর, রাত ফুরিয়ে গেলে ফুল ঝরবে আর জো°য়া°র আসলে চর ডুববে।
ইমতিয়াজ ইদের জামাতে যেতে তৈরি হয়ে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
“কখন করলে এতোকিছু?”
সেমাই, পায়েস, হোয়াইট পাস্তা, ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর কফি। বেশ ভারি নাস্তা।
মৃত্তিকা জবাব না দিয়ে সুরভির রুমে নক করে বলল,
“আপু, খেতে আসো। মামানী আসেন।”
“আসছি।”
সুরভির উত্তর পেয়ে মৃত্তিকা নিজে চেয়ার টে°নে বসে পড়ে। ইমতিয়াজের খাবার ওর সামনে সাজিয়ে দেয়, তবে তাকে খাইয়ে দেয় না।
ইমতিয়াজ একচামচ পায়েস নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“খাও।”
“আমার জন্য আছে এখানে।”
“আমি দিচ্ছি তো।”
মৃত্তিকা অল্প একটু মুখে নেয়, ইমতিয়াজ বাকিটুকু খেয়ে ফেলে। মৃত্তিকার চেয়ার টে°নে কাছে এনে বলল,
“এড়িয়ে যাচ্ছো কেন?”
মৃত্তিকা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“কোথায়? না তো।”
ইমতিয়াজ ওর গালে হাত দিয়ে বলল,
“আমি তো বুঝি না, তাই মনে করো?”
মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“অন্যকাউকে কেন বুঝতে যাবেন আপনি?”
অভিমানের সুর, প্রচন্ড অভিমান। একগাদা অভিযোগ নেই, তবে অভিমান মেখেঝেখে আছে। ইমতিয়াজ বলে,
“চিঠিগুলো পেয়ে গেছো? (একটু থেমে) আমার পারমিশন ছাড়া ড্রয়ারে হাত দিয়েছো?”
মৃত্তিকা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। ইমতিয়াজ বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ওর কপালে, গালে স্পর্শ করে বলল,
“অভিমান হয়েছে খুব?”
মৃত্তিকা চোখ নামিয়ে নেয়৷ ইমতিয়াজ বলে,
“অভিমান করো না প্লিজ। সবটা আমার জন্য এতো সহজ নয়।”
মৃত্তিকা একটু এগিয়ে এসে ইমতিয়াজের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করায়। মৃত্তিকা সরে আসতেই ইমতিয়াজ হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়৷ বলে,
“নামাজে যাবো আমি, দেরি হচ্ছে।”
সুরভি ও দেলোয়ারা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সকলে একসাথে নাস্তা করে৷ নাস্তা শেষে ইমতিয়াজ উঠে রুমে গিয়ে চুল আঁচড়ে আবারো ঠিক হচ্ছে। মৃত্তিকা পিছুপিছু আসে। আতরের শিশি নিয়ে ওর গলার কাছে, হাতে লাগিয়ে দেয়৷
“এখনো রেগে আছো?”
ইমতিয়াজের কথার জবাব মৃত্তিকা দিলো না। ইমতিয়াজ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কথা তো বলো।”
মৃত্তিকা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তাহমিনার স্থান আমি কোনোদিন চাইনি আর চাইবোও না।”
ওকে পাশ কা°টিয়ে চলে যায়। মৃত্তিকার চোখের পানি সকলের অগোচরে ঝ°রে পড়ে৷ কেন কাঁদছে সে? কার জন্য?
______________________________________
আহনাফ আর আব্বাস সাহেব নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ব্যস্ততা যাচ্ছে সারাহ্-র। আহনাফকে খাইয়ে দিয়েছে, এখন আবার তৈরি হতেও সাহায্য করতে হচ্ছে।
আহনাফ পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে সারাহ্ ওকে লম্বা করে একটা সালাম দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”
আহনাফ হেসে বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”
আহনাফের সালাম পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই সারাহ্ হাত বাড়িয়ে বলে,
“সালামি দেন।”
আহনাফ ওয়ালেট বের করতে করতে বলল,
“সালামের জবাব পুরো শুনতে হয়৷ সূরা আন নিসায় বলা আছে, আর যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয় (সালাম দেওয়া হয়), তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন কর অথবা ওরই অনুরূপ কর। (আল-নিসা ৪:৮৬)”
সারাহ্ একটু নিচুস্বরে বলল,
“আচ্ছা, এরপর থেকে খেয়াল রাখবো।”
আহনাফ ওর গাল টেনে দিয়ে হাতে দুইশত টাকার দশটা নোট ধরিয়ে দিলো। এমনভাবে নোটগুলো বের করলো যেন সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। সারাহ্ মুচকি হাসে৷
আহনাফ ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুম্বন করে বলল,
“ইদ মোবারক, অনেক ভালো দিন কাটুক।”
“আপনাকেও ইদ মোবারক, সাইদার পাপা।”
“সাইদা?”
আহনাফ চমকে উঠে ওর দিকে তাকায়। সারাহ্ হেসে বলল,
“আন্দাজ, সাদাবও আসতে পারে।”
______________________________________
“মৃত্তিকার কাছে ধরা দিও না, ইমতিয়াজও তোমাকে খুঁজছে হয়তো৷ শরীফ অস্ট্রেলিয়া যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো, খেলা তারপর শুরু হবে।”
“আর কি করবে তুমি? তিন আঙ্গুল দিয়েই মেয়েটা তোমার কপাল ফা°টিয়েছে, সুযোগে ধরলে মে°রে ফেলবে।”
“এই শাফিনকে মা°রা এতো সহজ নয়। আরে আমাকে এখনো খুঁজেই পায়নি।”
“কিন্তু তুমি ধরা পড়েছো। অতিরিক্ত চ°তু°রতা করতে গিয়ে ধরা পড়েছো।”
শাফিন হাসলো। হো হো করে বেশ কিছুক্ষণ হাসার পর শান্ত হলো। মাথার উপরের চুলগুলো সরিয়ে বলল,
“অভিজ্ঞতায় আমি তাদের চারগুণ, অথচ মাথার একটা চুলও পড়েনি। আমাকে গ্রে হেয়ার হ্যান্ডসাম বললেও অবাক হবো না।”
“ভাব কম নেও।”
ধম°ক দিয়েই ফোন রাখে মমতাজ বেগম। ফোনটা খাটে ফেলে রান্নাঘরে যায়৷ সবকিছু গুছিয়ে রেখে এসে রুমে বসে মৃত্তিকাকে কল দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম, ইদ মোবারক বড়মণি।”
মৃত্তিকার মিষ্টি কথায় মমতাজ বেগম হেসে বলল,
“ইদ মোবারক৷ আজকে কাকরাইল আসো।”
“ইমতিয়াজ ফিরলে আসবো।”
“হ্যাঁ, আসো। (একটু থেমে) কোথাও যাবে নাকি বেড়াতে?”
মৃত্তিকা একটু ভাবে। কোথায় যাবে ওরা? ইদে তো লোকে গ্রামে যায়। ইমতিয়াজের গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই, মৃত্তিকার কেউ থেকেও নেই। মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“না, কোথাও যাবো না।”
বেশ কিছুক্ষণ দুজনের কথা হয়। ফোন রাখারা কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীফের নাম্বার থেকে কল আসে৷ মৃত্তিকা রিসিভ করে,
“হ্যালো।”
নি°ষ্প্রাণ একটা কন্ঠ পাওয়া গেল,
“ইদ মোবারক মা। কেমন আছো?”
“ভালো।”
“আজকে কি আমরা একসাথে লাঞ্চ করতে পারি?”
“না, দাওয়াত আছে।”
ঠা°স ঠা°স করে জবাব দিচ্ছে মৃত্তিকা। শরীফ একটু মন খারাপ করলো। মেয়ের এমন আচরণ মেনে নেয়া কষ্ট, যদিও দোষটা তো ওরই।
“আগামী সপ্তাহে আমি চলে যাবো, তাই চাচ্ছিলাম…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্তিকা কল কে°টে দেয়৷ এতো এতো চিন্তায় কেউ ভালো থাকতে পারে না। মৃত্তিকাও ভালো নেই, আবার নতুন চিন্তা সে আনতে চায় না।
ইমতিয়াজ ফিরে এসে জানালো ওরা কাকরাইল যাচ্ছে না, বরং কাকরাইলের সবাই এখানে আসবে। রান্নার জোগাড় শুরু হলো।
______________________________________
বেশ সুন্দর করে সেজেছে সামিহা। খয়েরী গাউন আর হালকা মেকআপে অসাধারণ লাগছে ওকে। তানজিম চোখ ফেরাতে পারবে না, ও তো এতে একদম শিউর।
টিএসসিতে এসেই তানজিমের সঙ্গে দেখা হলো৷ ঘুরতে যাবো দুজনে, তাইতো এখানে এসেছে।
ওর পা থেকে মাথা অব্দি দেখে তানজিম। সামিহা মুচকি হেসে গাউনটা ধরে দুদিকে মেলে দিয়ে বলল,
“কেমন লাগছে আমাকে?”
“ডার্ক ব্রাউন চকলেট কেকের উপর হোয়াইট গার্নিস, ওসাম।”
সামিহা চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। বলল,
“এ কেমন প্রশংসা?”
“আমি তো তোর প্রশংসা করিনি।”
“যা, তোর সাথে কোথাও যাচ্ছি না।”
সামিহা চলে যেতে নিলে তানজিম ওর হাত ধরে একটা°নে কাছে নিয়ে আসে। সামিহা চোখ বড় করে একবার তানজিমের দিকে তাকায়, আরেকবার তাকায় হাতের দিকে৷
তানজিম বহুবার ওর হাত ধরেছে, তবে স্পর্শে পার্থক্য করতে সামিহা শিখে গেছে। তানজিম দুচোখ ভরে ওকে দেখে, প্রশংসা বাক্য ছুঁড়ে ফেলতে না পারলেও প্রতি পলকে ভালোবাসা ছুঁড়ে দিলো।
দূর থেকে ওদের দেখে অপরূপা। ডানকানে থাকা ব্লুটুথ নামক ডিভাইসে হাত দিকে বলল,
“তানজিম-সামিহা একত্রেই আছে।”
অপরদিক থেকে মমতাজ বেগম বলেন,
“শুধু নজর রাখো। সামিহাকে শুধু তানজিমের দিকেই ঠে°লে দাও, বাকিটা তানজিম বুঝে নিবে।”
চলবে…..
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
চতুঃচত্বারিংশ পর্ব (৪৪ পর্ব)
লুৎফর রহমান ও মমতাজ বেগম ইমতিয়াজের বাসায় এসেছে, তানজিম আসেনি। এটুকু পর্যন্ত মৃত্তিকা খুশি থাকলেও শরীফ বাসায় আসার সে আর খুশি থাকতে পারলো না।
ড্রইংরুমে সকলের সাথে শরীফ বসেছে। মৃত্তিকা সকলের হাতে শরবত দিয়ে শরীফের গ্লাসটা টেবিলে রেখে চলে আসে।
রুমে এসেই ইমতিয়াজকে বলে,
“এই লোকটাকে খবর না দিলে হতো না?”
ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে জবাব দেয়,
“আরে, আজ ঈদের দিন। শশুর উনি, তো দাওয়াত দিতে হবে না?”
মৃত্তিকা কি°ড়মি°ড় করে উঠে,
“আপনার এসব শশুর-জামাই নাটক বন্ধ করেন।”
ইমতিয়াজ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,
“কিসের নাটক? আমার কথাবার্তা কাজকর্ম কি তোমার কাছে নাটক মনে হয়?”
“এরচেয়ে কম কি?”
ইমতিয়াজের পা থেকে মাথা অব্দি দেখে বেশ গরম সুরে কথাটা বলে মৃত্তিকা চলে যায়। ইমতিয়াজ বুঝতে পারে চিঠির বিষয়টা নিয়ে মৃত্তিকার আচরণে পরিবর্তন এসেছে।
সুরভির ছেলের নাম রাখা হয়েছে রাইদ। সুরভি ছেলেকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে আসে। সুরভির থেকে চেয়ে রাইদকে কোলে নেয় শরীফ।
মৃত্তিকা তা দেখে সুরভিকে বলে,
“এই মানুষের কাছ থেকে ছেলেকে দূরে রাখো। না হলে তার মতই হয়ে যাবে।”
শরীফ মৃত্তিকার দিকে তাকায়। মৃত্তিকার তেমন একটা হেলদুল হলো না। সে কথা শেষ করে চুপচাপ চলে গেল। শরীফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
______________________________________
“চল আজ আমাদের বাসায় লাঞ্চ করবি।”
সামিহার কথায় তানজিম অল্প হেসে বলে,
“আজ না, আজ ইমতিয়াজ ভাইয়ার বাসায় যেতে হবে।”
সামিহার একটু মন খারাপ হলো।
“ওহ, কখনো তো আসিস না। ভাবলাম আজ আসবি।”
“আসবো একদিন, তবে আজ না।”
“ওকে, দেখব কবে আসিস।”
সামিহাকে বিদায় জানিয়ে তানজিম ফিরে হাঁটতে শুরু করার সময় রাস্তার অপরপাশে ওর সাথে সাথে হাঁটতে থাকা অপরূপার দিকে নজর যায়। টিএসসি থেকে মেয়েটা তাদেরকে অনুসরণ করছে। তানজিম খেয়াল করেছে, তবে নিশ্চুপ ছিল। তবে এবারে আর সে শান্ত থাকতে পারেনা।
রাস্তা পেরিয়ে অপরপাশে গিয়ে অপরূপা হাত ধরে বলে,
“কি সমস্যা? আপনি কখন থেকে আমাদের অনুসরণ করছেন, আবার আমাদের ছবিও তুলেছেন। কেন?”
তানজিমের গ°মগ°মে সুরের কথা শুনে অপরূপা ঘাবড়ে যায় না, বরং হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেশ শান্ত সুরে বলল,
“ওমা, আমি কেন আপনাদের ফলো করবো? আমি তো ঘুরতে বেরিয়েছি।”
“তাই বলে আমাদের পিছুপিছু?”
অপরূপা মৃদু হাসে। কপালের চুলগুলো সরিয়ে বেশ ভাব রেখে বলল,
“আমার ঘুরা আমি ঘুরছি। এখন তা যদি আপনার পিছুপিছু হয়ে যায়, তাতে তো আমার কোনো দোষ নেই।”
তানজিম রেগে গিয়ে অপরূপার গালে একটা চ°ড় বসিয়ে দেয়। হাত সরানোর আগে অপরূপা কান থেকে ব্লুটুথ খুলে নিয়ে নেয়। আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে গেল। লোকজন দেখেছে একটা ছেলে একটা মেয়েকে মে°রেছে। খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় যে সবাই মেয়েটার পক্ষ নিবে। বিষয়টা হলোও তাই।
তানজিম লোকের কথায় খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে স্থান ত্যাগ করে। একটু সরে এসে কানে ব্লুটুথটা লাগাতেই অপর পাশের মমতাজ বেগমের কন্ঠ শুনতে পায়। বেশ শান্ত শুনে উনি বলেন,
“তানজিম কি আছে না চলে গেছে? এত শো°রগো°ল কেন? অপরূপা?”
মায়ের কন্ঠ একবারেই বুঝে যায় তানজিম। দাঁতে দাঁত ঘ°ষে নিজেকে শান্ত রাখে। জবাব না পেয়ে মমতাজ বেগম বলেন,
“আমি মৃত্তিকার বাসায় আছি৷ বেশি কথা বলতে পারব না। জলদি বলো তানজিম গিয়েছে কিনা?”
“আমাকে কেন ফলো করছে মেয়েটা? মা, তাও তুমি তা আমাকে জানতে দিতে চাচ্ছো না।”
“তানজিম?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন মমতাজ বেগম।
তানজিম নির্বিকার ভাবে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, আমি তানজিম।”
একটু দূরে দাঁড়ানো অপরূপা কল কেটে দেয়৷ দৌড়ে এসে তানজিমের কাছ থেকে ব্লুটুথটা নিয়ে বলে,
“মামাকে চিনেছো, মাকে না।”
তানজিম কপাল কুঁচকায়, তবে কি মাও একই কাজে জড়িত। বুকে হাত দেয় তানজিম। অস্ফুট স্বরে বলল,
“মা, এসব সত্যি করো না।”
অপরূপা চলে যেতে নিলে তানজিম তাকে বলে,
“আমাকে কি বলা যাবে পুরো ঘটনা?”
অপরূপা হেসে বলল,
“অবশ্যই, তবে তোমার মা বলবে। আমি শুধু ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”
“তবে তাই করুন।”
অপরূপা রহস্যজনকভাবে হাসলো। তারপর বলল,
“এসো।”
তানজিম সরল মনে ভেবেছে অপরূপা সত্যি ব্যবস্থা করবে৷ অথচ বিষয়টি তা হলোই না। অপরূপা তাকে গলির ভিতরে নিয়ে এলো, এরপর নিজের লোকজন দিয়ে তানজিমকে আচমকা মা°রতে শুরু করলো। তানজিম চারজন বিশালদেহী লোকের সাথে পেরে উঠে না, তা সম্ভবও নয়।
আহত তানজিম রাস্তায় মুখ থু°ব°ড়ে পড়লে অপরূপা ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“দোয়া করো তানজিম, দোয়া করো। এমন মা যেন তোমার শত্রুরও না জোটে। (একটু হেসে) তোমার ভালোবাসা কাজে লাগিয়ে সামিহার ক্ষতি করতে চেয়েছিল। মায়ের নিরীহ মুখের আড়ালের শ°য়°তানকে তুমি চেনোই না।”
তানজিম রাগে রাস্তায় হাত দিয়ে দুইটা চা°প°ড় দেয়৷ ধুলো উড়ে, কিন্তু তানজিম উঠতে পারে না। অপরূপা তানজিমের পকেট থেকে ফোন বের করে তানজিমের হাত টেনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে আনলক করলো। তার কল লাগায় মৃত্তিকাকে৷
মৃত্তিকা রিসিভ করেই ধম°ক দেয়,
“কিরে তানজিম? কই তুই?”
অপরূপা ভ্রূ উঁচিয়ে তানজিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সামিহার বাসার কাছে রাস্তায় পড়ে আছে, এসে নিয়ে যাও।”
“তুমি কে?”
মৃত্তিকা ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো।
অপরূপা হেসে বলল,
“এক রহস্যে ভরা রূপকথা আমি।”
কল কে°টে ফোন ফেলে দিয়ে অপরূপা উঠে চলে যায়। যেতে যেতে বলে,
“মাকে বলে দিও, অপরূপাকে একটা চ°ড় মা°রায় অপরূপা তোমার এই হাল করেছে।”
তানজিম ধীরে ধীরে এগিয়ে বসতে চেয়ে আবারো পড়ে যায়। পায়ের দিকে আর হাতে বেশি মেরেছে। মনে সাহস এনে আবারো উঠতে চায়, পারে না। উপায় না পেয়ে ফোন বের করে সামিহাকে কল দেয়।
“হ্যালো।”
“সামি, তোদের বাসার পাশে যে ছোট গলিটা ওখানে একটু আয়।”
তানজিমের কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে ভালো নেই। ফোন ফেলে ছুটে যায় সামিহা। গলির ভিতর এসেই তানজিমকে দেখে সে।
“তানজিম, কি হয়েছে তোর?”
ওকে ধরে টেনে তুলে সামিহা। তানজিমের শরীরের ভার নিতে কষ্ট হয় সামিহার৷ তবুও চেষ্টা করে প্রাণপণে।
তানজিমকে নিয়ে বাসার গ্যারেজে বসিয়ে দারোয়ান সজীবকে বলে,
“আংকেল, একটু পানি আনেন প্লিজ।”
“হ্যাঁ মা, আনছি।”
তানজিম সামিহার দিকে তাকায়। সেই ওকে সামিহার সাহায্যেই প্রয়োজন হলো, আর ওকে দিয়েই সামিহার ক্ষতি করাতে চেয়েছে মমতাজ বেগম।
______________________________________
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বাইরে বের হয়েছে সারাহ্, আহনাফ ও আব্বাস সাহেব। গন্তব্য খুব একটা দূরে নয়, আহনাফদের গ্রামের বাড়ি। কুমিল্লা শহর থেকে একটু দূরে সাহেবাবাদে৷
সিএনজি একদম বাড়ির উঠান পর্যন্ত গেল। সারাহ্ নেমে দাঁড়িয়ে আশপাশটা দেখে। একটা একতলা ছাদ করা বাড়ি, মোটামুটি পুরোনো বাড়িটা৷ বাড়ি সামনে উঠান আর ডানদিকে ছোট বাগান। পাতা জমে পড়ে আছে একপাশে৷ কাকে দিয়ে যেন আব্বাস সাহেব এটা পরিষ্কার করিয়েছেন।
আব্বাস সাহেব আহনাফকে বলেন,
“তোমার ঝুমা চাচী আছে না? উনাকে বলেছিলাম কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করাতে, করিয়ে রেখেছে।”
আহনাফ হাসি হাসি মুখে বলল,
“ভালো হয়েছে। চলো।”
সবাই ভিতরে গেল। আহনাফ ব্যাগগুলো রেখে সারাহ্-কে বলে,
“এইতো বাড়ি, সুন্দর না? এই গ্রামের ফার্স্ট বিল্ডিং তুলেছিলো বাবা। এযুগের নয়।”
সারাহ্ আলতো করে হাসে। আব্বাস সাহেব হাসতে হাসতে অন্যমনস্ক হয়ে যান, উনার মনে পড়ে স্ত্রী রোজার স্মৃ°তি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরে নিজের রুমে চলে যায়। উনার মন খারাপ বা দীর্ঘশ্বাস কেউ খেয়াল করে না, উনি চায় না কেউ দেখুক। উনার রোজাকে উনি মনে করবেন, কষ্ট পাবেন, হাসবেন, স্মৃ°তির পাতায় দৌড়ে বেড়াবেন। এসব উনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, কেউ এসব জানবে না।
সারাহ্ ঘুরে ঘুরে প্রতিটা রুম দেখছে৷ আহনাফ ওর কৌতুহলটা দেখে হাসে।
“ঐশী?”
“জি।”
সারাহ্ না তাকিয়েই জবাব দেয়। আহনাফ বলে,
“ছাদে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
আহনাফ ওকে সিঁড়ির কাছে নিয়ে যায়। সারাহ্ পা বাড়ালে ওকে পাঁজা কোলে তুলে ছাদে নিয়ে আসে। সারাহ্ চুপটি করে গলা জড়িয়ে থাকে।
ছাদে পুরো ময়লা রয়েছে। আহনাফ আফসোস করে বলে,
“এটা কি কেউ পরিষ্কার করতে পারেনি? ওফ।”
“হইছে।”
সারাহ্ ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আহনাফ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সারাহ্-কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে সারাহ্ ওর বুকে মাথা রেখে বলে,
“আমরা এখানে কিছুদিন থাকি, কলেজ খুললেও এখানে থাকি প্লিজ৷ এখান থেকে গিয়ে ক্লাস করবেন।”
আহনাফ ওর মাথায় চুম্বন করে বলল,
“আচ্ছা থাকো। তোমার যতদিন ইচ্ছা থাকো।”
______________________________________
তানজিমকে বাসায় নিয়ে এসেছে মৃত্তিকা আর ইমতিয়াজ। এখন তানজিমের একপাশে মৃত্তিকা বসে আছে, অন্যপাশে সামিহা। তানজিম অপরূপার কথাটা দুজনকে জানালেও কৌশলে মায়ের কথাটা এড়িয়ে যায়। একটা মেয়ে তাদের ফলো করেছে এবং কোনো কারণ ছাড়াই তাকে লোক দিয়ে মে°রেছে, ব্যস এটুকুই বলেছে।
মৃত্তিকা একটু চিন্তায় পড়ে। শাফিন এসব করাচ্ছে এতে সে শিউর, তবে এখন তানজিমের পিছু পড়েছে। মৃত্তিকার মনে পড়ে স্টোররুম থেকে পাওয়া সামিহার ফ্যামিলি ফটোর কথা, তবে কি সামিহার জন্য কোনো বিপদ? মৃত্তিকা তাকায় সামিহার দিকে।
সামিহা খুব শান্ত হয়ে তানজিমের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি বোঝাচ্ছে এই মানুষটা তানজিমকে কতটা চায়, কতটা ভালোবাসে৷ মৃত্তিকা মুখ টি°পে হাসে, সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ ভালোবাসাই না সামিহার জীবনের কাল হয়।
“সামিহাকে চলে যেতে বলো আপু। আংকেল চিন্তা করবে।”
মৃত্তিকা ঘড়ি দেখে বলল,
“হ্যাঁ, সামিহা৷ তুমি চলে যাও বরং। ইমতিয়াজ পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
সামিহা গাল ফুলিয়ে বলল,
“কারো যাওয়া লাগবে না। যখন প্রয়োজন হয়, তখন (ব্য°ঙ্গ করে) সামি একটু আয়। আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে ফুড়ুৎ।”
সামিহা হনহনিয়ে চলে যায়। তানজিম হেসে মাথা নাড়ে৷ সামিহার এই বাচ্চামোগুলো তার ভালো লাগে। তবে মায়ের বিষয়টা মনে পড়তেই গম্ভীর হয়ে যায় সে।
দুইদিন পার হয়, তানজিম শারীরিকভাবে কিছুটা ভালো হলেও মানসিক অবস্থা একেবারেই খারাপ। মায়ের সাথে কোনো কথা নেই তার। কেমন যেন গু°মরে আছে।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মমতাজ বেগম ওকে ডেকে বলে,
“খেয়ে যাও।”
তানজিম কিছু না বলে বেরিয়ে যায়৷ মৃত্তিকার সাথে দেখা করতে এসেছে। অপরূপার সেই কথা মামাকে চিনেছো, মাকে নয়। এর ব্যাখ্যা ওর চাই। ভ°য়ং°কর এক বাক্য।
বেইলি রোডের কাছে এক রেস্টুরেন্টে বসে মৃত্তিকাকে সেদিনের পুরো ঘটনা খুলে বলে তানজিম। সব শুনে মৃত্তিকা বলে,
“অনেক হয়েছে, এবারে আর নয়।”
“করবে কি তুমি?”
মৃত্তিকা তাকায় তানজিমের দিকে৷ তার মনে তো অন্যকিছুই চলছে। শাফিনকে শাফিনের টো°পেই ধরতে হবে৷
মৃত্তিকা হেসে বলল,
“যখন করবো তখন দেখবে৷ বড়মণিকে তুমি চোখে চোখে রাখো আর বেশি কথা বলো না। যে মা মেয়েদের মা°রতে পারে সে ছেলেকেও মা°রতে পারবে।”
এরমাঝেই মৃত্তিকার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে৷ ফোন কেঁপে উঠায় হাতে নিয়ে দেখে বাবার ম্যাসেজ,
“কাল সকালে আমার ফ্লাইট, মিটিং এর সিদ্ধান্ত আগে ভাগেই যেতে হবে। ভালো থেকো মা।”
মৃত্তিকা ম্যাসেজটা দেখে রেখে দেয়। বাবার প্রতি তার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা নেই, এসবে তার কিছু যায় আসে না।
সে তানজিমকে জিজ্ঞাসা করে,
“মেয়েটার নাম কি?”
“অপরূপা।”
______________________________________
এখনো গ্রামের বাড়িতেই আছে সারাহ্, আহনাফ আর আব্বাস সাহেব। আনন্দ এখানেই সবচেয়ে বেশি। ভোরে মোরগের ডাকে ঘুম ভা°ঙা, নামাজের পর বাগানে ঘুরে বেড়ানো, পাখি দেখা। রাতে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর ব্যাঙের ঘ্যাঙরঘ্যাঙ শব্দ। পুকুরে বর্শি ফেলে মাছ ধরা, কিংবা পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে হাঁস গোনা। আনন্দ আছে সবকিছুতেই।
সারাহ্ খুশি, সারাদিন সে হাসতে থাকে। আহনাফ দেখে মুগ্ধ হয়ে।
সন্ধ্যায় আহনাফ বেরিয়ে গেছে নাস্তা কিনতে। সারাহ্-র ইচ্ছা হয়েছে বাইরের নাস্তা খাবে৷ আব্বাস সাহেব ঘরে নেই। সারাহ্ টেবিল সাজাচ্ছে।
দরজায় নক হয়। সারাহ্ জোরে বলল,
“খোলা আছে।”
“আমি জানি।”
দরজা ঠেলে ভিতরে আসে জামিল। সারাহ্ কন্ঠ শুনে ফিরে তাকিয়ে জামিলকে দেখে সরে যায়। পরিকল্পিত বিয়ের পিছনে জামিল আছে, শাফিনের সাথে জামিল মিলে ছিল। ছোট ছোট এই কয়েকটা কথা সারাহ্ জানে।
জামিল ভালো উদ্দেশ্যে এখানে আসেনি। মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে। শাফিন কেমন মানুষ আর জামিল কেমন মানুষ তা ওর বোঝা হয়েছে। আর কোনো প্রশ্রয় শ°য়°তানকে দিবে না সে।
জামিল কিছু বলার আগেই চিনামাটির ফুলদানিটা নিয়ে তার মাথায় আ°ছ°ড়ে ফেলে সারাহ্। ভে°ঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সেটা। জামিল ওকে ধরতে গেলে ধা°ক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয়। সারাহ্ জোরে নিশ্বাস ফেলে মাটিতে পড়ে যাওয়া জামিলের গ°লায় নিজের সর্বশক্তি দিয়ে পা ফেলে। জামিলের শ্বাস ব°ন্ধ হওয়ার জোগাড়।
সারাহ্ জোরে চেঁচিয়ে বলে,
“ইয়া আল্লাহ্।”
এমনসময়ই আহনাফ এসে ঘরে ঢুকে। সারাহ্ দৌড়ে এসে আহনাফের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ে। শার্টের হাতা খা°ম°চে ধরে লুকিয়ে যায়৷ এতোক্ষণের সাহসীকতাকে ব°লি দিয়েছে সে, এখন তাকে আহনাফ র°ক্ষা করবে।
আহনাফ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“পীপিলিকার পাখা গজায় ম°রি°বার তরে। বাসনা আজ তোমার নয়, আমার পূর্ণ হবে।”
“ওকে শাফিনের কাছেই নিয়ে যেতে এসেছি।”
আহনাফ ফিক করে হাসে। বলে,
“মেয়েটা একা ছিল, তাতেই টাচ অব্দি করতে পারোনি আর এখন তো আমি আছি।”
আহনাফ হুট করে চেঁচিয়ে বলে,
“আসতে বলো তোমার শাফিনকে। আমিও দেখবো সে আমার ঐশীর কি করতে পারে।”
সারাহ্ আহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে তার গলার পাশটা ঘনঘন কাঁপছে। সারাহ্ আহনাফের হাতটা জড়িয়ে ধরে। আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে জামিলের দিকে এগিয়ে যায়।
চলবে…..
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
পঞ্চচত্বারিংশ পর্ব (৪৫ পর্ব)
জামিলকে চেয়ারে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আব্বাস সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছে আহনাফ৷ সারাহ্ শোবার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার আহনাফে নিবদ্ধ৷ আহনাফ জামিলের সামনে সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন তার একটাই,
“শাফিন কেন সারাহ্-কে চায়? শুধুই কি নার্গিস পারভিনের সাথে পুরোনো শ°ত্রু°তা?”
জামিল কোনো উত্তর দিচ্ছে না। কথাই বলছে না সে। আহনাফ থেমে থেমে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
আব্বাস সাহেবকে খবর দেওয়া হয়েছে। উনি যথাসম্ভব দ্রুত চলে আসেন। ঘরে ঢুকেই আহনাফকে প্রশ্ন করেন,
“কি হয়েছে? সারাহ্ ঠিক আছে?”
আহনাফ একবার সারাহ্-র দিকে তাকায়। তারপর মাথা হেলিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, সে ঠিক আছে।”
আব্বাস সাহেব জামিলের সামনে গিয়ে বলেন,
“কি চাও? কেন এত বড় বড় পরিকল্পনা করছো তোমরা?”
জামিল হেসে অন্যদিকে তাকায়।
আহনাফ চেয়ার টে°নে তার মুখোমুখি বসে বলে,
“দেখো যত তাড়াতাড়ি তুমি মুখ খুলবে তত তোমার ভালো, আর যত দেরি করবে (একটু থেমে) ততই খারাপ হবে।”
জামিল এবারে বলে,
“খারাপের কি হবে? কোন পর্যায়ে যাবে? বড়জোর মা°রবে এরচেয়ে বেশি তো কিছু না।”
আহনাফ কপাল কুঁচকায়। “বড়জোর মা°রবে” কথাটা বলতে বুঝায় যে মা°র তার কাছে কোনো ব্যাপারই না।
আহনাফ জামিলের দিকে ঝুঁকে বলল,
“শুধু মা°র নয়, ট°র্চা°র করব। মা°র আর ট°র্চা°রের পার্থক্য বোঝো? না বুঝলে সমস্যা নেই, ফিজিক্সের মতো এই সূত্রটাও আমি ভালোই বুঝাই।”
আহনাফ আব্বাস সাহেবের দিকে তাকালে উনি মাথা নাড়িয়ে ওকে অনুমতি দিলো। মুখে বললো,
“মেইন গেট অফ করে দিও।”
আব্বাস সাহেব রুমে চলে গেলেন। সারাহ্ বাপ-বেটার কথোপকথন বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো এবং যা বুঝলো তার অর্থ দাঁড়ায় দুজনেই শান্ত স্বভাবের, কিন্তু হিং°স্র। চুপি চুপি এসে বাঘের মতো ঝাঁ°পিয়ে পড়াই এদের স্বভাব।
জামিলের মুখে মোটা লাল স্কচটেপ লাগিয়ে দিলো আহনাফ। তারপর দুইহাতের বাঁধন হালকা করে চেয়ার থেকে উঠিয়ে আবারো দুইহাত শক্ত করে বেঁধে দিলো।
সারাহ্-কে বলল,
“ঐশী, নিজের রুমে থাকবে।”
জামিলকে টে°নে°হিঁ°চ°ড়ে ডাইনিং এর পাশের খালি রুমে নিয়ে যায় সে। সারাহ্ রুমে যায় না, বরং ধীর পায়ে গিয়ে সে রুমের দরজায় দাঁড়ায়। আহনাফ ওকে পাশ কা°টিয়ে বেরিয়ে এসে বাড়ির সব দরজা-জানলা লাগিয়ে দেয়।
রুমে আবারো প্রবেশের সময় সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে বলল,
“রুমে যেতে বলেছি তোমাকে।”
“আমি একটু থাকি?”
“না।”
আহনাফ সারাহ্-কে সরিয়ে দিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। পিনপতন নিরবতা চলে এসেছে পুরো ঘরে। সারাহ্ চলে যায় না, দেয়ালে হেলান দিয়ে এখানেই বসে থাকে। একসময় ঘুমিয়ে যায়।
সময় কা°টে, সন্ধ্যারাত পেরিয়ে মধ্যরাতে প্রবেশ করলো পৃথিবীর এ প্রান্তটা। ঘড়িটা জানান দিচ্ছে রাত একটা বেজেছে।
হঠাৎ সারাহ্-র ঘুম ভা°ঙে, কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে৷ সারাহ্ কোনোমতে মাথা তুলে অন্ধকার রুম দেখে চেঁচিয়ে উঠে,
“এই কে?”
আহনাফ চমকে উঠে ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
“কে হবে? আমি। আস্তে চেঁচাও, বাইরে থেকে লোকে শুনলে খারাপ ভাববে।”
সারাহ্-র ঠোঁট কাঁপে, আহনাফ হাত সরায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সারাহ্ বলে,
“আমরা কোথায় আছি? রুমে?”
“না, আমরা মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছি। স্পেসশিপে আছি।”
সারাহ্ আহনাফের হাতে একটু চিমটি কে°টে বলে,
“ধুর, কি বলেন এসব? (একটু থেমে) ওই লোকটার কি হলো?”
“কিছু না।”
“মে°রেছেন?”
আহনাফ উত্তর দেয় না। রুমের ঘুটঘুটে অন্ধকারে আহনাফের চেহারাও সারাহ্-র দেখা হয় না। সারাহ্ হাত বাড়িয়ে আহনাফের চোখেমুখে হাত দিতেই সে বলে,
“কি হচ্ছে, ঐশী?”
সারাহ্ মুচকি হাসে। সে অনুভব করছে তার আহনাফকে। আহনাফের গালে হাত দিয়ে বলল,
“এতো ঘটা করে রুমে নিয়ে গিয়ে মা°রে°ননি?”
আহনাফ সারাহ্-র আরো কাছে নিয়ে এসে বলল,
“তাকে মে°রেছি কিনা সেটা তার বিষয়, তোমার বিষয় হলো তোমাকে এখন আদর করবো।”
“সরুন।”
সারাহ্ জানে আহনাফ সরবে না আর আহনাফও জানে সারাহ্-র এই সরুন কথার অর্থটা উলটো। ভালোবাসার নৌকার পালে হাওয়া লাগে জোরে, তড়তড় করে নৌকা এগিয়ে যায়। সাথে একটা সুর বেজে উঠে, এ কি ভাটিয়ালি গান?
______________________________________
সকাল সকাল ইমতিয়াজের সাথে এয়ারপোর্টে আসে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ কোনোদিন ভাবেনি বাবাকে বিদায় দিতে মৃত্তিকা আসবে।
শরীফের সাথে দেখা হলো, পল্লবীও সাথে এসেছে। শরীফ ইমতিয়াজের সাথে কুশল বিনিময় শেষে বলল,
“মিউকোর খেয়াল রেখো।”
ইমতিয়াজ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ইনশাআল্লাহ, আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।”
মৃত্তিকা কয়েকবার শরীফের দিকে তাকায়। শরীফ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“ভালো থেকো মিউকো।”
মৃত্তিকা এগিয়ে এসে ইমতিয়াজকে পিছনে সরিয়ে নিজে সামনে এসে শরীফকে বলল,
“আপনার সাথে আমি একটু আলাদা কথা বলতে চাই, পাঁচ মিনিট সময় হবে?”
“অবশ্যই।”
ইমতিয়াজ দুজনকে বলল,
“তবে কথা বলো।”
ইমতিয়াজ সরে যায়। মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর শরীফকে বলে,
“আপনার বাসা এখন পুরো খালি?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি ফিরে না আসা পর্যন্ত ওখানে আমি (একটু থেমে) মানে আমরা কি থাকতে পারবো?”
শরীফ হেসে মৃত্তিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কেন পারবে না?”
পকেট থেকে চাবি বের করে মৃত্তিকার হাতে দিয়ে বলে,
“এইযে বাসার চাবি।”
মৃত্তিকা বাসার চাবি হাতে নিয়ে বলল,
“আরেকটা জিনিস চাই।”
“কি?”
“স্পা°ইদের সরিয়ে দেন আমার পিছন থেকে।”
শরীফ একটু ভেবে বলল,
“আমি যদি না সরাই তবুও তুমি টের পাবে না।”
শরীফ চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা বলে,
“ভুলে যাবেন না আমি আপনারই মেয়ে, আমি ঠিকই বুঝে যাবো।”
শরীফ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“মেয়ে হলে তো আমাকে বাবা বলেই ডাকতে, কই ডাকতে তো শুনিনি।”
মৃত্তিকা আর কিছু না বলে অন্যদিকে চলে যায়৷ শরীফ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ নিয়ে ভিতরে চলে যায়।
ইমতিয়াজ পল্লবীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“মৃত্তিকা আপনাকে চেনে?”
“এখন চিনবে। আমি তার ফুপ্পি হই।”
ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“শরীফ সাহেবকে শশুর ডাকলে যে মেয়ে রেগে যায়, সে আপনাকে ফুপ্পি ডাকবে?”
পল্লবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্তিকাকে ডাকে,
“মিউকো?”
মৃত্তিকা পল্লবীর কাছে এগিয়ে আসে। ধীর পায়ে আসতে আসতে ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ ওকে বলে,
“আমার ফুফু শাশুড়ী।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলল,
“আপনি কে?”
“শরীফের বোন মানে তোমার..”
কথার মাঝেই মৃত্তিকা বলে,
“কেউ না।”
মৃত্তিকা চলে যাওয়ার সময় একটু দূরে অপরূপাকে দেখে। নজর যাওয়ার কারণ বারবার সে মৃত্তিকার দিকে তাকাচ্ছে।
“বাবার নতুন স্পা°ই?”
কথাটা ভেবে পরক্ষণেই মনে হলো,
“না, একে আমি জে°লে দেখেছিলাম।”
মৃত্তিকা আর তাকায় না, সে যে অপরূপাকে দেখেছে তাই বুঝতে দেয় না। ইমতিয়াজ একটু দৌড়ে এসে ওর পাশাপাশি হয়৷
এয়ারপোর্ট থেকে বাসা পর্যন্ত গাড়ি ঠিক করে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি একটু ফ্যাক্টরিতে যাবো, আজ জরুরি শিপমেন্ট আছে।”
“আচ্ছা, যান। সাবধানে যাবেন।”
“তুমিও।”
ইমতিয়াজ মৃত্তিকার কপালে চুম্বন করে৷ চলে আসার সময় মৃত্তিকা ওকে কাছে টে°নে এসে সেও ইমতিয়াজের কপালে চুম্বন করে দেয়। ইমতিয়াজ মুচকি হেসে চলে যায়। মৃত্তিকা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অপরূপাকে দেখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে। সন্দেহ আরো তীব্র হয় মৃত্তিকার।
______________________________________
সকাল সকাল ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে পা দিতেই কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে দৌড়ে আবারো ঘরে ফিরে আসে সারাহ্। উঠানে একটা দেশি কুকুর ওকে দেখেই ঘেউ করা শুরু করেছে।
আহনাফ ডাইনিং এ বসে ফোনে কিছু একটা দেখছে আর চা পান করছে। সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে বলল,
“দেখেন না আহনাফ, ওখানে একটা কুকুর।”
আহনাফ ওকে টে°নে কোলে বসিয়ে বলে,
“আহনাফ বলে না।”
সারাহ্ রেগে ধম°ক দেয়,
“আমি কুকুরের ভ°য়ে আছি আর আপনি আছেন আহনাফ বলা নিয়ে।”
আহনাফ হাসতে হাসতে বলে,
“জামিলকে ভ°য় পাওনি আর কুকুরকে ভ°য় পাচ্ছো?”
সারাহ্ মাথা নাড়ে। আহনাফ ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“ওকে, দেখি কি করা যায়। (একটু থেমে) ওমা ঐশী, তুমি আমার কোলে বসেছো কেন? ভেরি ব্যাড।”
সারাহ্ লাফিয়ে উঠে সরে যায়। আহনাফ হেসে একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে বাইরে আসে৷ সারাহ্ও সাথে সাথে এসে একটু পিছনে দাঁড়ায়। আহনাফকে দেখেই কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসে।
“আপনি এটার আমদানি করেছেন?”
আহনাফ কপাল কুঁচকে বলে,
“আমদানি? (একটু থেমে) সেফটির কথা ভেবে এনেছি।”
আহনাফ ওর হাতে বিস্কুট দিয়ে বলল,
“খেতে দাও।”
সারাহ্ কুকুরটার দিকে বিস্কুট ছুড়ে ফেলে সরে যায়। আহনাফ বলে,
“একটু ভদ্রভাবে দাও।”
“পারবো না।”
“ঘরে আসো।”
আহনাফের সাথেই ঘরে আসে সারাহ্। আহনাফ চারটা রুটি আর এক লিটার পানি নিয়ে পাশের রুমে যেতে নিলে সারাহ্ বলে,
“একজন মানুষ চারটা রুটি খাবে, তাও খালি খালি?”
আহনাফ যেতে যেতে বলে,
“একজন না চারজন।”
“চারজন?”
সারাহ্ চমকে উঠে। জামিল ছাড়া আর কে আছে ওখানে?
সারাহ্ দ্রুত ওইরুমে যায়। আহনাফ দরজা লাগিয়ে দিয়েছে, সে ভিতরে যেতে পারে না। তবে কান পাতে, ওইরুমের শব্দ মোটামুটিভাবে বাইরে থেকে শোনা যায়।
চারজন মানুষ রুমে বসে আছে। একজন জামিল আর বাকি তিনজন ওকে সাহায্য করতে এসেছিল। জামিলের দেরি হওয়ায় রাতে এরা বাড়িতে ঢুকলে আহনাফ একে একে তিনজনকেই পা°কড়াও করেছে।
আহনাফ রুটিগুলো সামনে রেখে বলল,
“কাল শুধুই ট্রেইলার দিয়েছি, আজ কিন্তু মেইন মুভি হবে। সো আগে আগে বলে দাও।”
কালরাত থেকে জামিলের সামনে বাকি তিনজনকে বেল্ট দিয়ে পাগলের মতো পিটি°য়েছে আহনাফ। শরীরের এমন কোনো অংশ নেই যেখানে সে মা°রেনি। একপর্যায়ে দেহের সমস্ত পোশাক খুলে পিটিয়েছে সে। একেকজন ব্য°থায় কুঁ°ক°ড়েছে কিন্তু হাতমুখ বাধা থাকায় চিৎকার করতে পারেনি। জামিল এসব দেখেছে, ছটফট করেছে।
চারজনের সামনে ছুড়ে ছুড়ে রুটি ফেলে আহনাফ। মুখে বলে,
“তুলে খাও।”
ওদের মুখ বাধা দেখে হাসে সে। তিনজনের মুখ খুলে দেয়, তবে জামিলের মুখ খুলেনি। তিনজন খুবই ক্লান্ত, সাথে ক্ষুধার্ত থাকায় চার পায়ের প্রাণীর মতোই মুখ দিয়ে খেতে শুরু করে। আহনাফের একটু খারাপ লাগলেও শক্ত থাকে সে। যেমন করেছে, তার চেয়ে কমই তো ফেরত পাচ্ছে।
জামিল “উম, উম” করে শব্দ করে। আহনাফ ওর মুখ খুলে দেয়। জামিল বলে,
“কথা বলতে হলে তো মুখ খুলতে হবে, নাকি?”
আহনাফ চেয়ার টে°নে বসে একটু হেসে বলে,
“হ্যাঁ, বলো।”
জামিল একটা ঢোক গিলে বলল,
“একটু পানি..”
কথা শেষ হওয়ার আগেই আহনাফ চোখ রা°ঙিয়ে বলে,
“বলো।”
“শাফিনের সব কুকর্মে আমার নব্বই শতাংশ অংশ আছে। সে নারী পা°চা°রে যুক্ত, আমি সেখানে শেয়ার রেখেছি৷ সে যখন তাহমিনাকে (একটু থেমে) রে°প করেছিল, আমি দেখেছি। তাহসিনাকে পি°টি°য়ে হাতপা ভে°ঙেছিলাম আমি।”
আহনাফ চোখ বন্ধ করে। তাহসিনাকে কবরে নামানোর সময় কেউ কি বুঝেনি তার হাতপা ভা°ঙা? কষ্ট কি পরিমাণ পেয়েছিল সে?
“রিপার চিৎকার শুনে শাফিনের সাথেই হেসেছিলাম আমি। তাহমিনা মা°রা গেলে তিনজনকে গাড়িতে আ°টকাতে আমি সাহায্য করেছিলাম। রিপা অনুরোধ করছিলো বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দাও। শাফিন আর দুলালের মতো আমিও সেদিন হেসেছিলাম।”
আহনাফ চোখ বন্ধ করেই বলে,
“নব্বই নয়, একশ শতাংশই অংশ রেখেছো।”
“একশ নয়, শাফিনের মতো প্রেগন্যান্ট নারীদের প্রতি আমার লো°ভ হয়না। হলে সারাহ্-কে..”
কথা শেষ করার আগেই জামিলের গলা চে°পে ফ্লোরে ফেলে দেয় আহনাফ। দাঁতে দাঁত ঘ°ষে বলল,
“খু°ন করে ফেলবো, এই ঘরে মে°রে এখানেই পুঁ°তে রেখে দিবো।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ছেড়ে দিয়ে টে°নে তুলে আহনাফ। তারপর বলে,
“আমার সাথে আর কি সমস্যা হয়েছে তোমার?”
জামিল মাথা নাড়িয়ে হেসে বলে,
“তোমার বাবার সাথে হয়েছিল। তোমার ফুফুর বিয়েতে যা যা দেয়ার কথা ছিল তা তো দেয়নি আবার বারবার অপমান করেছে। আফরোজার বিয়ে আমার পছন্দের ছেলের সাথে করাতে চেয়ে পারিনি। তবে যখন শাফিন নার্গিসের বিষয়টা বলে তখন ভাবলাম এক ঢি°লে দুই পাখি মা°রলে মন্দ হয় না।”
আহনাফ চেয়ার সরিয়ে নিচে জামিলের মুখোমুখি বসে বলল,
“কয়টা পাখি ম°রেছে?”
“একটা, (একটু থেমে) নার্গিস ঘাবড়ে আছে, এটাই কম কি?”
জামিল ঘাড়টা দুদিকে হালকা ঝাঁ°কিয়ে বলল,
“আর শাফিন সারাহ্-কে সহজে ছাড়বে না। তাহমিনার মতো চিৎকার করবে সারাহ্ও, বলবে আহনাফ আ…”
জামিলের নাকেমুখে ঘু°ষি দেয় আহনাফ। তারপর বলে,
“ওহ, এসব তো খুব সাধারণ ব্যাপার।”
আহনাফ উঠে গিয়ে একটা বক্স আনে আর একটা ছু°ড়ি। জামিলের শার্ট খুলে ফ্লোরে ফেলে ছু°ড়ি দিয়ে আঁকিবুঁকি দাগ কা°টে৷ রাগে ক্ষো°ভে দ্রুত হাত চালাচ্ছে আহনাফ। র°ক্ত পড়ছে, ক্ষ°ত হচ্ছে, মাংস বের হয়ে থাকছে। আহনাফ থামে না, জামিল দাঁতে দাঁত চেপে চুপ থাকে।
বাকি তিনজন চেঁ°চানোর আগেই আহনাফ গিয়ে তাদের মুখ আবারো বেঁধে দেয়। জামিলের সামনে এসে বক্সটা খুলে তার মুখের সামনে ধরে বক্সে মরিচের গুড়া দেখে চোখ বড় করে জামিল। কিছু বলতে নিলে মুখে শার্টটা ঠু°সে দেয় আহনাফ। তারপর পিঠে মরিচের গুড়া ঘ°ষে ঘষে লাগায়। ব্য°থায় চিৎকার করতে চেয়েও চিৎকার না করতে পারার য°ন্ত্র°ণায় ছ°টফ°ট করতে থাকে জামিল।
আহনাফ বক্সটা রেখে বলে,
“এটা লেভেল ওয়ান, ওয়েটিং ফর নেক্সট।”
______________________________________
“জামিলের কোনো খোঁজখবর নেই, কালরাতে সারাহ্-কে আনতে গিয়েই লাপাত্তা হয়েছে৷”
“ধরা পড়েছে নাকি?”
অপরূপার কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে শাফিন বলে,
“আরে না।”
অপরূপা কান থেকে ফোন সরিয়ে চুল ঠিক করে আবারো ফোন কানে রেখে বলল,
“শরীফ চলে গেছে। আমি এয়ারপোর্টে এসেছিলাম দেখেছি।”
শাফিন শব্দ করে হেসে বলল,
“খুব ভালো কথা। এখন মৃত্তিকার পালা।”
“তানজিম কিন্তু কোনো দিক দিয়ে কম যায় না। সৎ হলে কি হবে? বোনের দিকেই গেছে।”
শাফিন ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“র°ক্ত তো লুৎফরেরই। মা আলাদা হলে কি হবে?”
“তানজিম জানে এসব?”
“না, বোনদের মা ম°রেছে, সব লুকিয়েছে। লুৎফর তো ভাবে তার অন্য স্ত্রীর মেয়েদের মমতাজ নিজের মেয়ের মতো পেলেপু°ষে বড় করেছে। (একটু থেমে) আচ্ছা রাখো এখন।”
অপরূপা ফোন রাখে। একটা মানুষ নি°কৃ°ষ্টতার কোন ধাপে পৌঁছালে হতে পারে তা ভাবা কষ্টকর।
অপরূপা নিজের সাথে আনা কালো গাড়িটাতে উঠে পড়ে। গাড়ি চলতে শুরু করে। পেছনে থাকা ধূসর রঙের গাড়ি থেকে মৃত্তিকা বলে,
“আংকেল, ওই গাড়িটার পিছু পিছু যান।”
চলবে….