#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
একষষ্টি পর্ব (৬১ পর্ব)
ফজরের পর পরই আহনাফ বেরিয়ে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারাহ্ নামাজ শেষ করে খুব তাড়াহুড়ো করে বলে,
“এতো ভোরে যাচ্ছেন কোথায়? এখনো তো ঠিক করে সূর্যই উঠলো না।”
আহনাফ শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,
“মেয়ে দেখতে যাচ্ছি।”
“মেয়ে?”
সারাহ্ কপাল কুঁচকায়।
আহনাফ হাসি চেপে বেশ সিরিয়াস ভাব করে বলল,
“হুম, মেয়ে। এক চেহারা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত, তাই নতুন মুখ দেখতে হবে।”
সারাহ্ এগিয়ে এসে ওর শার্ট খুলে ফ্লোরে ফেলে দেয়। রাগ দেখিয়ে বলে,
“আজকালের বেডা জাত, অ°জাত, কু°জাত, বদ°জাত।”
“গা°লি দেও কেন?”
সারাহ্ শার্ট তুলে ফার্নিচার মুছতে মুছতে বলে,
“না, আপনাকে আমি আদর করবো? অসভ্য লোক, ঘরে প্রেগন্যান্ট বউ রেখে বাইরে যাচ্ছে মেয়ে দেখতে।”
আহনাফ তড়িঘড়ি করে বলল,
“আমার শার্ট?”
“এটা আজকে থেকে তেনা।”
সারাহ্ হিজাব খুলে গিয়ে বসে। এখনো সে রাগে ফোঁ°সফোঁ°স করছে। আহনাফ ওর কোলে শুয়ে বলল,
“ঘরে বউ কোথায় দেখতেছো? (একটু থেমে) হ্যাঁ, মানছি একটা বেডি আছে। সে আমার সাইদার আম্মু, বউ তো না।”
সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। কপাল কুঁচকে বলল,
“কবুল পড়েন নাই? এখন অস্বীকার করেন কেন?”
আহনাফ মাথার নিচে দুইহাত দিয়ে বলল,
“একদিন এই বাসায় খাইতে আসছিলাম। একবার খাইলাম একটা বেডি দিয়া দিলো। এখন মনে হইতেছে দুইবার খাওয়া দরকার ছিল, দুইটা বেডি পাইতাম।”
সারাহ্ চোখ রাঙিয়ে বলে,
“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না, আহনাফ।”
আহনাফ হাসিমুখে ধমক দেয়,
“ওই, আহনাফ কেন? কল মি সাদাবের পাপা।”
“আহনাফই বলবো, দুই বেডি মানে কি হ্যাঁ? আমার বোনের দিকে নজর? চোখ খুঁ°চিয়ে তুলে দিবো।”
আহনাফ উঠে বসতে বসতে বলল,
“আস্তাগফিরুল্লাহ। আল্লাহ মাফ করুক, এসব চিন্তা আমার নাই।”
সারাহ্ কিছু বলে না। আহনাফ আবারো বলে,
“বেডি দিলেও একটু ভালো একটা দিতো। কি খেঁ°কখেঁ°কানি দিছে একটা।”
“বেডি কি? কল মি সাইদার আম্মু।”
ভাব নিয়ে কথাটা বলে সারাহ্।
আহনাফ উঠে গিয়ে আরেকটা শার্ট বের করে পড়তে শুরু করে। সারাহ্ আবারো এসে বোতামে হাত দিলে আহনাফ বলে,
“ভেরি ব্যাড ঐশী, তুমি আমার লজ্জাহরণ করছো।”
সারাহ্ সরে যায়। আহনাফ মুচকি হেসে ঠিকঠাক হয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে সারাহ্-র কপালে গভীরভাবে চুম্বন করে বলল,
“চিন্তা করো না, তুমি ছাড়া..”
কথার মাঝেই থেমে যায় সে। দ্রুত পায়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারো বলে,
“বেডি শুধু দেখবো, ঘরে আনবো না।”
সারাহ্ রাগ দেখিয়ে বলে,
“আর ঘরে আসতেও হবে না। ভাগেন।”
সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে বের করে দেয়। আহনাফ হাসতে হাসতে চলে যায়। সারাহ্ সেদিকে চেয়ে থেকে মনে মনে একটা অদ্ভুত কথা ভাবছে,
“লোকটা এতো এতো কথা বলে অথচ ওকে ভালোবাসিটা আজও বলে না, কেন? সেই ভালোবাসা কি তাহসিনার জন্য কেবল প্রযোজ্য?”
হঠাৎ করে সারাহ্-র মনে পড়ে আহনাফের কাছে তো ফোন নেই। নিজের ফোন নিয়ে সে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে। লিফট থেকে নেমে আহনাফকে গেইটের কাছে দেখে জোরে ডাকে,
“আহনাফ, দাঁড়ান।”
আহনাফ ফিরে আসে। সারাহ্ জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে। একটু দ্রুত হাঁটাহাঁটি করায় তার নিশ্বাস ভারি হয়ে এসেছে।
আহনাফ ওকে ধরে বলে,
“কি হলো?”
“ফোন নিয়ে যান।”
আহনাফ ফোনটা পকেটে নিয়ে কঠোরভাবে বলল,
“তোমাকে আমি যত সাবধানে থাকতে বলি, ততই তুমি এসব উল্টাপাল্টা কাজ করে বসো।”
“সরি।”
“বাসায় যাও।”
সারাহ্ যায় না। বলে,
“নাস্তা করে যান, আসেন।”
“বাইরে খেয়ে নিবো, দেরি হচ্ছে।”
______________________________________
“এখন তুমি কি করতে চাও?”
নিয়াজীর কথা ইমতিয়াজ খুব একটা মাথা ঘামায় না। সকালের নাস্তার জন্য রুটি বানাতে বানাতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“কি করার কথা বলো? শাফিনকে মে°রে দেই আর তার আগে তোমাকে।”
মিউকো মিউ মিউ শব্দে এসে ইমতিয়াজের পায়ের কাছে দাঁড়ালে, ইমতিয়াজ তাকে কোলে তুলে নেয়। নিয়াজী বুঝে এই ছেলেটার অন্তত ওকে নিয়ে খুব একটা মাথাব্য°থা নেই।
“তোমার মনে হচ্ছে না শাফিন ওখান বেরিয়ে এলে তোমার স্ত্রীকে মে°রে ফেলবে?”
“ভ°য় দেখাচ্ছো?”
“তুমি কি ভ°য় পাচ্ছো?”
ইমতিয়াজ একটু হেসে একমুঠো ক্যাটফুড নিয়াজীর উপর ছুঁড়ে ফেলে। মিউকো গিয়ে নিয়াজীর শরীরের উপর-নিচে বেয়ে বেয়ে খেতে লাগলো।
নিয়াজী কিড়মিড়িয়ে বলল,
“তোমার বিড়াল তোমার মতোই নিশ্চিন্ত।”
ইমতিয়াজ আবারো হেসে রুটি নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। নাস্তা তৈরি করে টেবিলে রেখে এসে মিউকোকে কোলে নেয়।
ইমতিয়াজ বলে,
“তোমাকে মাসের পর মাস পুষে আমার লাভ নেই।”
“ওয়াদা ভঙ্গ করো না, তুমি তো মুসলিম। আমি সত্য বলেছি, তাই আমাকে ছেড়ে দিতে হবে।”
“তুমি যে সত্য বলেছো তা আগে প্রুভ হোক।”
ইমতিয়াজ রুমে চলে যায়। মিউকোকে চেয়ারে বসিয়ে নিজে গিয়ে মৃত্তিকাকে ডাকে। ফজরের পর থেকে মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারারাত তার দুচোখের পাতা এক হয়নি। কোনো কারণে সে ঘুমাতে পারেনি, কারণ সে নিজেও নির্দিষ্ট করতে পারেনি।
ইমতিয়াজ আধশোয়া হয়ে ওর মাথায় হাত বুলায়।
“মৃত্তিকা?”
মৃত্তিকা ওর গা ঘেষে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ঘড়ি দেখে বলে,
“সাতটা বেজে গেছে, উঠে পড়ো। হাসপাতালে যেতে হবে।”
“উম, উম।”
ঘুমের মধ্যেই মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ ওকে কপালে চুম্বন করে। মৃত্তিকা ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলে,
“ঘুম পাচ্ছে।”
“হাসপাতালে যাবে না?”
মৃত্তিকা চোখ কচলে উঠে বসে। ইমতিয়াজের পায়ের কথা স্মরণে আসলে বলে,
“পায়ের কি অবস্থা দেখি?”
ইমতিয়াজ টাউজার উপরে উঠায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ক্ষ°তগুলো দেখে মৃত্তিকা বলে,
“এখন আবার ওষুধ লাগাতে হবে তো? আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”
“ওষুধ খেতেও হবে।”
“খাবারের পর।”
“হুম।”
মৃত্তিকা জলদি জলদি ওষুধ এনে পায়ে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,
“তবে আমি নাস্তা বানাতে বানাতে আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।”
“নাস্তা তৈরি আছে।”
মৃত্তিকা ওষুধ লাগানো থামিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ শার্ট সরিয়ে ঘাড়ের কাছে আঁ°চড়ের দাগ দেখিয়ে বলে,
“দুইটা মিউকো ঘরে আছে, দুজনের আর্ট অসাধারণ। এখানেও একটু লাগিয়ে দাও।”
মৃত্তিকা উঠে চলে যায়। কাল ম°র্গে ওর নখ দিয়েই এই দাগের উৎপত্তি হয়েছে। ইমতিয়াজ সামনাসামনি কথাটা বলে ফেলায় বেচারী বেশ লজ্জায়ও পড়ে গেছে।
ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“নাস্তা করে বের হতে হবে।”
“আপনিও যাবেন?”
মৃত্তিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে শুরু করে। ইমতিয়াজ ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“উহু, আমি বাসায় থাকবো। তুমি শিল্পাকে নিয়ে যাবে, আহনাফ থাকবে।”
“এখনো কেন নিজেকে লুকাচ্ছেন? যেহেতু আপনি শাফিনকে নিজে মা°রবেন না বলেছেন, তবে কেন বাসায় থাকবেন?”
“বিনা প্রয়োজনে নিশ্চয়ই করছি না।”
“হ্যাঁ, তা করছেন না মানলাম। তবে মি°থ্যা বলায় কি গু°নাহ হচ্ছে না?”
ইমতিয়াজ একটু মলিন মুখে বলল,
“হচ্ছে তো অবশ্যই, ক্ষমা করার মালিক আল্লাহ্।”
ইমতিয়াজ আয়নায় মৃত্তিকার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে আজকের জন্য হলেও লুকাতে হবে।”
মৃত্তিকা ওর দিকে ফিরে বলে,
“কি ভাবছেন আপনি?”
ইমতিয়াজ মাথানেড়ে বলল,
“যা ভাবছি, ভাবতে দাও। কালকের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি বলেই ভাবছি। সময় হলে সব জেনে যাবে। শরীফ সাহেবকে আজকে বাসায় আসতে বলো।”
মৃত্তিকা আর কিছু বলে না। এখন যে জানতে চেয়েও লাভ নেই। মৃত্তিকা ওর শার্ট সরিয়ে আঁ°চড়ের জায়গায় হাত বুলিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসতে লাগলো।
______________________________________
গালিব শাফিনের শাস্তির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ওর বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠার কারণ একমাত্র এই শাফিনই ছিল। শাফিন ওকে অপমান করেছে, শাফিনকে শাস্তি দেয়ার কারণ হিসেবে তার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট।
সকাল দশটা, কাগজপত্র খুঁজে সে পাকাপোক্ত কোনো প্রমাণ পায় না। শেষবার যখন শাফিনের ফাঁ°সির জন্য উকিল এসব নিয়ে গেছিলো, তারপর এগুলোর হদিস আর কারো কাছে আছে কিনা জানা নেই।
বাধ্য হয়ে আহনাফকে কল দেয় গালিব। মৃত্তিকার কাছে বিথী অনেকদিন থাকায় সে মৃত্তিকার সাথে দেখা করতে চায়, যদি বিথীর কোনো কাগজপত্র মৃত্তিকার কাছে থাকে। তবে ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর খবর পেয়ে সরাসরি মৃত্তিকাকে কল দেয়া তার কাছে অদ্ভুত ঠেকলো।
“হ্যালো?”
গালিবের কথায় অপরদিক থেকে অচেনা একটা নারী কন্ঠ বলে,
“জি।”
গালিব মনে করে, এটা হয়তো আহনাফের স্ত্রী। খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন করে,
“মিস্টার আহনাফকে দেয়া যাবে? কিছু জরুরি কথা ছিল।”
“আহনাফ? উনি তো এখানে নেই।”
“কখন আসবেন জানেন?”
“উনি আসবে না, আমি যাবো।”
গালিব কপাল কুঁচকে বলল,
“আচ্ছা বুঝলাম, কখন যাবেন?”
“তা তো আমি জানি না। আজও যেতে পারি, আবার চারদিন পর।”
বির°ক্ত হয়ে গালিব ফোন রেখে দেয়। আহনাফের ফোন হাতে নিয়ে হেসে উঠে অপরূপা। কাল যখন আহনাফ হন্যে হয়ে নিয়াজীকে খুঁজছিলো, তখন সে এই ফোনটা নিয়েছে। ঠিক যেভাবে একজন পকেটমা°র পকেট থেকে ফোন নেয়।
ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর খবর সে পেয়েছে, তবে তার পরপরই মৃত্তিকার বাসায় চলে আসাটা ওর সন্দেহের কারণ হয়েছে। তবুও সে চায় সংবাদটা সত্য হোক, ইমতিয়াজ সত্যিই মা°রা যাক।
এবারে সে আহনাফের নাম্বার থেকে মৃত্তিকাকে ম্যাসেজ দেয়,
“ম্যাডাম মিউকো, মমতাজ বেগম আইসিইউতে নেই। উনি পল্টন আছেন, একটা বাসায় অপরূপার সাথে। আপনি জলদি আসুন।”
ম্যাসেজ সেন্ড করে অপরূপা অপেক্ষা করতে থাকে। ওর উপর করা মৃত্তিকার প্রতিটা আঘাতের বদলা সে নিবে।
ফোন কেঁপে উঠলো। মৃত্তিকা ম্যাসেজটা দেখে চোখ কুঁচকে তাকায়। আহনাফ মাত্রই ওর সামনে থেকে গেল। ওরা আছে ঢাকা মেডিকেলে, তবে পল্টন কখন গেল?
“আহনাফ ফয়েজ?”
মৃত্তিকার ডাকে ফিরে দাঁড়ায় আহনাফ। মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে ম্যাসেজটা দেখিয়ে বলে,
“আপনার ফোন খুঁজে পাননি?”
“না তো। আমার কাছে ঐশীর ফোন।”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“চলুন, আগে আপনার ফোনটা নেয়া যাক। আর এই ব্যক্তিকেও।”
মৃত্তিকা কথা শেষ করে আহনাফের ডাক না শুনেই তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে, আইসিইউতে থাকা মমতাজ বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে আহনাফও বেরিয়ে যায়। মৃত্তিকা এক কাজে এসে আরেক কাজে কেন যাচ্ছে।
এরমধ্যে আবারো মৃত্তিকার ফোন কেঁপে ওঠে। এবারে তানজিম কল করেছে।
“হ্যাঁ, তানজিম।”
“আপু, কাল থেকে কোথায় আছো তুমি? ঠিক আছো?”
তানজিমের কন্ঠে উৎকন্ঠা বোঝা যাচ্ছে। অনেক ভ°য়ে ঘাবড়ে আছে সে। ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুতে যদি শো°কের বশে মৃত্তিকা কিছু করে বসে, বেচারা ভয় পাচ্ছে।
মৃত্তিকা ওর অবস্থা বুঝেও চুপ থাকে। ইমতিয়াজ ওকে এটাই বলেছে, ওর জীবিত থাকার খবর এখনই কাউকে দেয়ার দরকার নেই।
“হাসপাতাল থেকে সব ব্যবস্থা করবে তানজিম। তবে যেহেতু এখানে পুলিশ কে°ইস আছে, তাই আমাদের ইমতিয়াজের কাছে যেতে দিচ্ছে না।”
“এ কেমন কথা? (একটু থেমে) কিন্তু তুমি কোথায়?”
“রাখছি তানজিম, কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।”
ফোন রেখে মৃত্তিকা দেখে আহনাফের নাম্বার থেকে আরো একটা ম্যাসেজ এসেছে। সেখানে একটা বাসার ঠিকানা দেয়া আছে।
আহনাফ বাইরে আসলে মৃত্তিকা ওকে ম্যাসেজটা দেখালে আহনাফ একটু জোর গলায় বলল,
“আপনার মনে হচ্ছে না, আপনি বাঘের গুহায় যেতে চাচ্ছেন? (একটু থেমে) এটা জামিল ফুপার এপার্টমেন্টের ঠিকানা।”
মৃত্তিকাও পালটা জবাব দেয়।
“তো? ওখানে যে আছে, সে শাফিনেরই কেউ আর আমি ভুল না করলে অপরূপা। এই মেয়েটা প্রতি°শোধের আ°গুনে জ্ব°লছে। একটা চড়ের জন্য তানজিমকে কি মা°র মে°রেছিল জানেন?”
আহনাফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
“আপনি বারবার অতিরিক্ত বুঝেন। ইমতিয়াজ আপনাকে এসব কিছুই করতে বলেনি। সো, যা করতে এসেছেন তাই করেন, আপনার বড়মণির সাথে থাকেন। এছাড়া আমি আপনার সাথে কোথাও যাচ্ছি না।”
“আশ্চর্য ব্যবহার তো আপনার।”
আহনাফ ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে হাসপাতালে ফিরে আসে। সুস্মিতার সাথে দেখা করে। মৃত্তিকাও এসেছে।
সুস্মিতা ওদেরকে বসতে ইশারা করে। তারপর শাফিনের ফাইলটা বের করে বলল,
“গতরাতে শাফিনের অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে মনে হয়েছিল, তবে এখন আবারো ওর অবস্থার অবনতি হয়েছে।”
আহনাফ মাথা নেড়ে বলল,
“বাঁচবে না মনে হচ্ছে?”
“বেঁচে যাবে, তবে সুস্থ হতে সময় লাগবে। ডা: মাহিন আজকে দেখবে, তারপর আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে।”
“আচ্ছা, ধন্যবাদ। আর মমতাজ বেগমকে আইসিইউতেই আটকে রাখতে হবে। বাইরের সাথে যোগাযোগ উনার যত কম থাকবে, ততই ভালো।”
“সবটা তো আমার হাতে নেই, পুলিশ যাকে অনুমতি দেয় সেই ভিতরে যায়। উনাকে আমি ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখছি।”
“ঠিক আছে।”
আহনাফ চলে যেতে নিলে সুস্মিতা বলল,
“তবে মমতাজ বেগম প্রায়ই জেগে থাকেন। ঘুমের ওষুধ উনার খুব একটা কাজ করে না।”
মৃত্তিকা মুখ কুঁচকে ফেলে। অনেকদিন উনাকে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করেছে সে, এজন্য উনার শরীর এটা সয়ে নিয়েছে।
এখন আবারো মৃত্তিকার ফোনে ম্যাসেজ আসে,
“আপনি এখনো আসলেন না যে।”
মৃত্তিকা বারবার ম্যাসেজ দেখেও কোনো রিপ্লাই না দেয়ায় অপরূপা ধরে নেয় মৃত্তিকা ইমতিয়াজের শো°ক পালনে ব্যস্ত। তার মুখের চওড়া হাসি জানান দেয় সে খুব খুশি।
সামনে থাকা দুজনকে বলে,
“শাফিন বের হোক বা না হোক, আমরা আমাদের ইনতেকাম নিবোই নিবো। মৃত্তিকা বাসায় আছে, আমরা ওখানেই যাবো।”
______________________________________
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আহনাফ সোজা বাসায় এসেছে। সারাহ্-র সাথে দেখা করে আজই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। দুদিন ধরে ক্লাস করাতে পারেনি, নিজের দায়িত্বে অবহেলা সে পছন্দ করে না। তবুও এখন নিরুপায়।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজেছে বাসায় আসতে আসতে। রাস্তায় বেশ ভালোই জ্যাম ছিল।
বেল বাজালে জাহাঙ্গীর সাহেব দরজা খুলেন। আহনাফ বেশ লম্বা একটা সালাম দিয়ে ভিতরে আসে। জাহাঙ্গীর সাহেব সালামের জবাব দেন।
“বাবা, আসলে আমি চলে যাবো এখন। ক্লাস মিস হচ্ছে।”
নার্গিস পারভিন ভিতরের রুম থেকে এসে বলল,
“এখন যাবে কেন? সকালে যেও। কুমিল্লা যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
“তবুও যদি এখন যাই..”
ইতস্তত করে কথা থামায় আহনাফ।
জাহাঙ্গীর সাহেব বললেন,
“আচ্ছা, তুমি ফ্রেশ হও। (নার্গিস পারভিনকে বলেন) নাস্তা রেডি করো।”
আহনাফ রুমে আসলে সারাহ্ বলে,
“সকালে গেলে হয় না?”
আহনাফ হেসে বলল,
“কেন? আসতেই তো বারণ করেছিলে।”
“আহা, সকালে গেলেই হবে।”
আহনাফ ওর কাছে এসে বলল,
“বলো যে, আমাকে তোমার জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছা করে। এটা বললে থাকবো।”
সারাহ্ চোখ পাকিয়ে সরে গেল। এই লোকটার কি লজ্জাশরম বলে কিছুই নাই। বেহায়া-বেশরম লোক।
“তুমি বলতে পারবে না, আমিও থাকতে পারবো না।”
সারাহ্ কোনো প্রতি°বাদ করে না। ইচ্ছা কি শুধু ওর করে, তার কি কোনো ইচ্ছা নেই? সারাহ্-কে আগলে রাখতে ইচ্ছা করে না তার?
______________________________________
মিউকোকে নিয়ে ডাইনিং এ বসে আছে ইমতিয়াজ। সন্ধ্যা থেকে নিয়াজী ইমতিয়াজ আর মিউকোর এসব রঙ-তামাশা দেখে যাচ্ছে। মুখে ক্রচটেপ থাকায় সে কিছুই বলতে পারছে না।
মৃত্তিকা এখনো বাসায় আসেনি। সে কোথায় গেছে তা ইমতিয়াজকে জানায়নি। অপরূপার পাঠানো ঠিকানায় সে চলে গেছে অপরূপারই খোঁজে। একা কাজে ঝুঁকি বেশি, অথচ তার একা কাজই বেশি পছন্দ।
দরজার লকটা ঘুরছে, মানে কেউ ভিতরে আসার চেষ্টা করছে। ইমতিয়াজ সেদিকে তাকিয়ে মিউকোকে ফ্লোর থেকে টেবিলে তুলে দেয়।
অপরূপা ভিতরে আসে। ইমতিয়াজকে দেখে ভূ°ত দেখার মতো চমকে উঠে সে। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে বাইরে আর কাউকে না দেখে শব্দ করে দরজা লাগায়।
অপরূপার দিকে ফিরে বলে,
“সারপ্রাইজ, ভাবোনি কখনো এভাবে মৃ°ত কারো সাথে দেখা হবে? ম°র্গের লা°শ তোমার সামনে স্থির। আমি জানতাম তুমি আসবে।”
চলবে……
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দ্বিষষ্টি পর্ব (পর্ব ৬২)
জামিলের এপার্টমেন্টে গিয়ে মৃত্তিকা দেখে গ্যারেজে কোনো একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, মনে হলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।
মৃত্তিকা এখানে দাঁড়িয়ে যায়। ছয়তলায় যাওয়ার কথা ভুলে সে অনুষ্ঠান দেখতে শুরু করে। মেয়েগুলো সব হলুদ, সবুজ শাড়ি পড়েছে। ফুলের সাজে সবাইকে খুব সুন্দর লাগছে। স্টেজে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়া মেয়েটা বউ।
পেছনে লেখা ‘মেহজাবিনের হলুদ সন্ধ্যা’। অজান্তেই হাসতে থাকে মৃত্তিকা। ওর নামও তো মেহজাবিন, মৃত্তিকা মেহজাবিন মিউকো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে লিফটের দিকে পা বাড়ায়। লিফটেও কিছু মানুষ উপরে উঠছে, সবাই সেজেগুজে আছে।
মৃত্তিকা লিফটে উঠে ছয়তলার সুইচ চাপলে একটা মেয়ে বলল,
“আপনি ছয়তলায় থাকতেন?”
মৃত্তিকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“না, একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“কার সাথে দেখা করবেন? ছয়তলার তিনটা ফ্ল্যাটই তো খালি।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে ফেললে আরেকটা মেয়ে বলে,
“হ্যাঁ, ওখানে তো অনেকদিন ধরে কিসের যেন কাজ হচ্ছে। সব টাইলস উঠিয়ে ফেলেছে। দিনের বেলা মাঝে মাঝে দুইটা লোক আসে, এখন কেউ আছে কিনা জানা নেই।”
মৃত্তিকা কপালের ভাঁজ গাঢ় করে ছয়তলায় নামে। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আশেপাশে দেখতে শুরু করে।
রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে, এখন কি আদৌ এখানে কেউ থাকার কথা। আবারো লিফটের সাইরেনের শব্দ হয়৷ মৃত্তিকা বুঝতে পারে এই ফ্লোরে কেউ এসেছে।
একটা ফ্ল্যাটে ঢুকে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“কেউ আছেন? মৃত্তিকা, আপনি কি এখানে?”
কন্ঠটা আহনাফের, মৃত্তিকা চিনে যায়। সে বেরিয়ে এসে আহনাফকে মারতে উ°দ্ধত হলে আহনাফ সরে দাঁড়িয়ে ধ°মক দিয়ে বলে,
“আমি না করার পরেও কেন এখানে এসেছেন? ইমতিয়াজ জানলে কি ভাববে?”
মৃত্তিকাও পালটা ধ°মক দেয়,
“আমার ইচ্ছা, আমি এসেছি। আপনার কি সমস্যা?”
“গলা নামিয়ে কথা বলুন, মিউকো ম্যাডাম। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে।”
“রাগ একা আপনার আছে? আমার নেই? বাচ্চা আমি?”
“বাচ্চা হবেন কেন? সবকিছুর জ্ঞান তো টনটনা। এটা বুঝেন না যে, এখানে আপনার কোনো সমস্যা হলে দায়ভার আমার উপরেও যাবে।”
“আপনি কিন্তু আমার বিষয়ে বেশি নাক গলাচ্ছেন?”
“ইমতিয়াজ থাকলে নাক গলাতাম না। যেহেতু সে নেই, তাই গলানো লাগতেছে।”
“এই ফ্ল্যাটের এ অবস্থা কেন, এখানে সকালে কোন লোক আসে, খবর আছে? আমি খবর নিবো।”
“ওরে সাংবাদিক এলেন?”
“আমার ইচ্ছা, আমি যাবো কি থাকবো?”
আহনাফ গিয়ে সিঁড়িতে বসে পড়ে। মৃত্তিকা আবারো আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকে। একটা রুমে গিয়ে সে অবাক হয়। এ রুমে খাট আছে, লাইট-ফ্যান লাগানো, কয়েকটা ব্যাগ রাখা।
“আহনাফ ফয়েজ, এখানে আসবেন একটু প্লিজ।”
আহনাফ বির°ক্তি নিয়ে উঠে এসে বলে,
“জীবনে কতটা দুঃখ থাকলে আরেক লোকের বউ পাহারা দেয়া লাগতেছে।”
আহনাফ রুমে এসেই হা করে তাকিয়ে থাকে। মৃত্তিকা ব্যাগগুলো ঘাটাঘাটি করে মেয়েদের জামাকাপড় পায়। আরেকটা ব্যাগে ছেলেদের পোশাক।
“এখানে ছেলে-মেয়ে উভয়ই থাকে। এই মেয়ে অপরূপা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।”
আহনাফ ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“তা হবে কেমনে? অপরূপা ছাড়া আর কোনো মেয়ে তো দুনিয়ায় নাই।”
মৃত্তিকা ফিরে তাকিয়ে বলল,
“দেখেন, আপনি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতেছেন। বাচ্চাদের মতো আচরণ করেন কেন?”
আহনাফ উত্তর না দিয়ে আশেপাশের জিনিসপত্র দেখতে শুরু করে। সি°গা°রেট, ম°দের বোতল, শুকনো কিছু খাবার পায়। কয়েকটা ছেঁড়া কাগজের সাথে আহনাফের ফোনের কাভারটাও পায়।
আহনাফ মৃত্তিকার দিকে তাকালে মৃত্তিকা একটা বি°চ্ছি°রি হাসি দিয়ে বলে,
“আগে এলে ফোনটাও পেয়ে যেতে পারতেন। এখন কোনো ক্রা°ইম করে আপনাকে ফাঁসিয়ে দিলে আপনার আম, ছালা দুটোই যাবে।”
______________________________________
ইমতিয়াজের মুখোমুখি অপরূপা বসে আছে। বাঁধা নয়, একদম স্বাভাবিকভাবে বসে আছে সে। আহনাফের ফোনটা অপরূপার থেকে নিয়ে নিয়েছে ইমতিয়াজ।
ইমতিয়াজ পায়ের ব্য°থায় একটু কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু তবুও সে যথেষ্ট শান্ত আছে। বাইরে শান্ত থাকলেও ভেতরটা তার অস্থির। রাত হয়ে গেল, অথচ মৃত্তিকা আসলো না।
বাসায় নিয়াজীর সাথে মৃত্তিকাকে রেখে যাওয়া কিংবা নিয়াজীকে একা রেখে যাওয়া খুবই অনিরাপদ, আবার মৃত্তিকাকে একা ছেড়েও যেন ভুল করেছে।
“আমার লোকজন নিচে আছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা আসলেই কিন্তু ধরা পড়বে।”
অপরূপার কথায় ইমতিয়াজ হেসে দেয়। বলে,
“ওই নারীকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। তোমার শাফিনকে যে নারী বিবির বাজার থেকে ঢাকায় আনতে পারে, তার পক্ষে তোমার দুই-চারজন লোক কোনো ব্যাপার না।”
বেল বাজলে ইমতিয়াজ দ্রুত দরজা খুলে দেখে শরীফ এসেছে। ইমতিয়াজকে দেখে ঠেলেঠুলে কোনোমতে ভিতরে এসে বলল,
“তুমি ঠিক আছো? আমি তো অন্য কিছু শুনেছিলাম।”
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“কি শুনেছিলেন?”
“বাদ দাও।”
শরীফ নিয়াজীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ও কে?”
“চেনেন না? নিয়াজী।”
শরীফ ইমতিয়াজের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“ও এখানে কেন?”
“আমি এনেছি। আর উনি (অপরূপাকে দেখিয়ে) নিজে নিজে এসে হাজির হয়েছে।”
শরীফ আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“মিউকো নেই?”
“চলে আসবে।”
নিয়াজী আর অপরূপার কথা বলতে বলতে সময় পার হয়ে যায়। রাত দশটার দিকে মৃত্তিকা আসে। বাসায় এসে শরীফকে দেখে অবাক না হলেও অপরূপাকে দেখে সে প্রচন্ড অবাক হয়।
ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে বলে,
“খাচ্ছিলো তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হলো তার এঁড়ে গরু কিনে। অপরূপাকে তোমাকে মা°রতে এসেছে।”
ইমতিয়াজের কথায় মৃত্তিকা হেসে বলে,
“বাহ, এখন নিজেই ধরা পড়েছে।”
আহনাফের ফোনটা দেখিয়ে ইমতিয়াজ বলে,
“আহনাফ ফয়েজের ফোন। (একটু থেমে) তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?”
“গিয়েছিলাম আহনাফের ফয়েজের নাম্বার থেকে অপরূপার পাঠানো ঠিকানায়।”
ইমতিয়াজ চোখ রা°ঙিয়ে বলে,
“না গেলে হতো না? আমি তোমাকে বারবার নিষেধ করেছি অতিরিক্ত কিছুই করবে না। আমি তো আগেই বুঝেছিলাম ও আসবে।”
মৃত্তিকা রুমে চলে যায়। ইমতিয়াজ শরীফকে বলে,
“এখন আপনি বলেন আপনি আগে আগে সব কিভাবে জেনে যান? মৃত্তিকাকে কে, কবে, কখন মারতে চেয়েছিল। মৃত্তিকার মামা ওকে একা করতে চায় কি চায় না। (একটু থেমে) ইভেন, যে কথা আমি মনে মনে ভাবিনি তাও জেনে গেছে। হাউ?”
“দেখো রিপা মা°রা যাওয়ার পর মিউকো ইতালি চলে গেছিল। এরপরই আমি জানতে পারি এসব কিছু সাজানো ছিল।”
“কিভাবে জেনেছেন? কার মাধ্যমে?”
শরীফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সেদিন চারটা খু°ন হয়েছিল। একটা ছেলে মা°রা গেছিলো, ওর ফোনে ভিডিও করছিল। ওই ভিডিওতে আমি কলরবের বাবা দুলালকে দেখেছিলাম।”
“ভিডিও কোথায় পেয়েছেন আপনি?”
“ওর ভাইয়ের ফোন আর ওর ফোনের জিমেইল একাউন্ট একটাই ছিল। ভিডিও জিমেইল রিস্টোর করে নেয়। সেখান থেকে পেয়েছি, মানে ওর ভাইয়ের ফোন থেকে।”
“ওর ভাইকে কোথায় পেয়েছেন?”
“বিষয়টা আমি বলবো কাকতালীয়। ওর ভাই ওকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল। সেখান থেকে আবার থানায় গিয়ে মা°মলা করেছিল। সেই মা°মলা নিয়ে হাসপাতালে তার বাবার সাথে হওয়া কথোপকথন শুনে আমার সন্দেহ হয়। বিশেষ করে স্থান আর সময় একই হওয়ায় এই সন্দেহের উৎপত্তি। তারপর কথা।”
ইমতিয়াজ ভ্রূ উঁচিয়ে বলে,
“তা আপনার গ্যাং কবে তৈরি করেছেন?”
“এ গ্যাং আরো আগে থেকেই তৈরি হয়েছে। রিপার সাথে ছাড়াছাড়ির পর থেকেই গ্যাং তৈরি করেছি।”
“কি কি করেছে এই গ্যাং?”
“তেমন কিছু না, আগে গ্যাং ছোট ছিল। শক্তিশালী টিম আমি আরো পরে তৈরি করেছি।”
ইমতিয়াজ শরীফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“করতোটা কি এরা তখন?”
“রিপার উপর নজর রেখেছে। যেভাবে আমি মৃত্তিকার জন্য স্পা°ই রেখেছিলাম সেভাবে রিপার জন্যও ছিল।”
ইমতিয়াজ এবারে জোরে চেঁচিয়ে উঠে,
“তো সেদিন ওই স্পা°ই গুলো কোথায় ছিল? রিপা বেগমকে সেদিন কেন ওরা বাঁচাতে পারেনি?”
শরীফ মাথানিচু করে ঠোঁট চেপে নিজের কান্না লুকিয়ে বলে,
“আমার বিশ্বস্ত তিনজনের লা°শ পেয়েছিলাম আমি, শাফিন হয়তো বুঝে গিয়েছিল ওরা নজর রাখছে।”
ইমতিয়াজ নিয়াজীকে বলে,
“এ কথা তো তুমি বলোনি?”
“আমি জানি না এ ব্যাপারে। শাফিন আর দুলালের কাছে যে ধরনের মানুষ ছিল, তার কাছে শরীফের এদেরকে আমার চুনোপুঁটি লাগে।”
টেবিলের উপর থেকে কাচের জগটা নিয়ে নিয়াজীর মাথায় আ°ছড়ে ফেলে ইমতিয়াজ। জগ ভে°ঙে কাচের টুকরো তার মুখে মাথা লাগে। গলার আশেপাশেও কয়েক টুকরো লেগেছে। র°ক্ত ঝরা শুরু হয়েছে।
মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে বেরিয়ে এসে ইমতিয়াজকে টে°নে সরিয়ে নেয়। রাগে এখনো জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে।
শরীফ নিয়াজীকে ধরে ইমতিয়াজকে ধমক দেয়,
“কি করছো তুমি এসব? মে°রে ফেলবে নাকি?”
“ম°রে যাক।”
ইমতিয়াজ রুমে চলে যায়। হুটহাট রাগের উপর তার নিয়ন্ত্রণ কম।
শরীফ কাউকে কল করে। কয়েক মিনিট পর দুজন লোক এসে নিয়াজীকে নিয়ে যায়।
মৃত্তিকা রুম থেকে বলে,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে?”
“ইমতিয়াজের হাতে যেন কারো মৃ°ত্যু না হয়, সে ব্যবস্থা করছি। দরজা লাগিয়ে দাও।”
মৃত্তিকা দরজা লাগাতে গেলে অপরূপা ওকে বলে,
“ভাবো নিয়াজী মা°রা গেল আর ইমতিয়াজের ফাঁ°সি হলো বা যাবজ্জীবন সাজা, শাফিনের মতো সে কিন্তু বের হতে পারবে না।”
অপরূপা কথা শেষে হেসে দেয়। মৃত্তিকা জবাব না দিয়ে অপরূপাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রুমে চলে আসে।
ইমতিয়াজের কাছে গিয়ে বসে বলল,
“এই পাগলামিগুলো কেন করেন আপনি?”
ইমতিয়াজের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর কপালে-গালে চুম্বন করে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ ওকে টে°নে কাছে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে ঝাপটে ধরে বলল,
“হয়তো আমার রাগের জন্যই আমরা আলাদা হয়ে যাবো।”
“প্লিজ, এভাবে বলো না। আমার সহ্য…”
মৃত্তিকার কথা মাঝপথে থেমে যায়। অপরূপার শ°কুনি দৃষ্টি ওদের রুমের দিকেই। দরজা অর্ধেক খোলা থাকায় এখান দিয়েই সে দেখছে স্বামী-স্ত্রীর একান্ত কাটানো সময়টুকু।
মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে সরিয়ে উঠে যায়। অপরূপার দিকে একবার পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে সে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।
______________________________________
আহনাফকে আবারো বাসায় আসতে দেখে সারাহ্ মুখ ভেংচিয়ে ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“বড়বড় কথা বলে কে যেন বেরিয়ে গেছিলো? কোথায় তাহার বড়বড় কথা?”
আহনাফ উত্তর দেয় না। নার্গিস পারভিনের ডাকে সারা দিয়ে ডাইনিং এ যায়। নিরবে রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসতেই আবারো সারাহ্-র ভাষণ শুরু হয়,
“সাইদা মা, তোমার আব্বা কি বলছিলো?”
কথাটা বলে সারাহ্ নিজের পেটে হাত দিয়ে আবারো বলে,
“একদম তাই, আমি চলে যাবো।”
সারাহ্ বিছানায় বসে হাসতে লাগলে আহনাফ বলে,
“হু, একটা গান আছে, কি যেন এখন মনে পড়তেছে না। (একটু ভেবে) হ্যাঁ মনে পড়ছে।
আমার ঘরেরও রমনী
যেন কাল না°গিনী।
একদম তাই, এমন বাচ্চার মায়ের জন্যই বলছিলো।”
সারাহ্ রেগেমেগে উঠে,
“কি? আমি কাল না°গিনী? আমি কাল সা°প, রাসেল ভাই°পার।”
আহনাফ হেসে বিছানায় ওর পাশে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোমার জন্য ফিরে আসিনি, আমি আমার সাদাব-সাইদার জন্য আছি।”
সারাহ্ও আহনাফকে জড়িয়ে ধরে,
“আমি জানি, আমার জন্য জীবনেও থাকবেন না।”
“একদম ঠিক। কাল সকালে কিন্তু যেতেই হবে।”
______________________________________
তিনদিন পর, শাফিনের অবস্থা আজ অনেক খারাপ হয়ে গেছে। হাত আর পায়ে যেখানে যেখানে পে°রেক ঠু°কে দেয়া হয়েছিল, সেখানে পঁচন ধরতে শুরু করেছে।
য°ন্ত্র°ণায় থেমে থেমে চিৎকার করে শাফিন। এমনকি ওর অবস্থা দেখে সহজে কোনো নার্সও ওর কাছে ঘেষতে চায় না।
ডা: মাহিন আর সুস্মিতা এসেছে ওকে দেখতে। একজন নার্স ওয়াশ করতে শুরু করলে আবারো সে চিৎকার করতে থাকে,
“বাঁচাও আমাকে, ও আল্লাহ্, ম°রে গেলাম, কি ব্য°থা।”
মুখ দিয়ে যে যে শব্দ বের হচ্ছে, সে তাই উচ্চারণ করছে।
সুস্মিতা ক্ষ°তস্থান দেখে মুখভঙ্গি পালটে ফেলে। এমনিতেই সে শাফিনকে ঘৃ°ণা করে আর ওর এসব ক্ষ°ত দেখে সুস্মিতা বুঝতে পারে প্রকৃতির প্রতি°শোধ বলে আসলেও কিছু আছে।
“আমি কি ভিতরে যেতে পারি?”
বাইরে কেউ অনুমতি চাচ্ছে। সুস্মিতা দরজার কাছে গিয়ে সুরভিকে দেখে। পুলিশরা ওকে অনুমতি দিচ্ছে না।
সুস্মিতা বলে,
“আসতে দিন, শাফিনের মেয়ে।”
সুরভি মাথানিচু করে ভিতরে এসে বলল,
“পরিচয়টা না দিলেও হতো।”
শাফিনের পরিচয় দিতে সুরভির লজ্জা হয়, ঘৃ°ণা হয়। বিতৃষ্ণা চলে এসেছে তার জীবনের প্রতি।
শাফিনের কাছে গিয়ে ওর এ অবস্থা দেখে সুরভির চোখে পানি চলে আসে। যতই হোক সে তার বাবা।
“নিজের এ হাল করে ছেড়েছো তুমি? আরশে গিয়ে যে চিৎকারগুলো ঠেকেছে, আরশের মালিক কি তার বিচার করবে না ভেবেছো? তুমি ওই আল্লাহ্-কে সেদিন ভুলে গেছিলে আর আজ ডাকছো?”
মনের কষ্টে কথাগুলো বলতে থাকে সুরভি। শাফিনের কানে হয়তো সবগুলো কথা পৌঁছায়নি। সে তো পৃথিবীতে ভোগ করছে তার পা°পের এক ক্ষুদ্রাংশের শা°স্তি।
‘নিশ্চয়ই যারা জা°লেম, তাদের জন্যে রয়েছে য°ন্ত্র°ণাদায়ক শা°স্তি।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ২২)
চলবে……
(সতর্কতা- নৃ°শং°স খু°নের বর্ণনা আছে, নিজ দায়িত্বে পড়বেন।)
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
পর্ব ৬৩
নিয়াজী এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ শরীফের চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়েছে। এখন সে বাসায় যাওয়ার জন্য একদম ঠিকঠাক আছে। আর কোনোভাবে সে আহনাফ কিংবা ইমতিয়াজের হাতে পড়তে চায় না।
ঘড়ি দেখাচ্ছে সকাল সাতটা বেজেছে, নিয়াজী হাসপাতালের ছোট বিছানা থেকে উঠে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু একটা খুঁজতে, খুব স্বভাবতই তা ফোন। তবে পায় না।
“কিছু খুঁজছো নাকি?”
শরীফ এসে রুমে প্রবেশ করে। নিয়াজী ওকে দেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আমি আসলে বাসায় যেতে চাই।”
“আসল ঠিকানায় যাবে? চলো, পৌঁছে দেই।”
নিয়াজী সরতে পারে না, শরীফ ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলে,
“রিপাকে মা°রধর করেছি এটাই পৃথিবী দেখেছে, কিন্তু ওকে যে আমি ভালোবেসেছি সেটা কেউ দেখেনি। ওকে মা°রা তোমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”
নিয়াজী শরীফকে ধা°ক্কা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু এবারে সে চির ব্যর্থ হলো। ব্যর্থতাকে আর টপকাতে পারে না।
পি°স্তলে সাইল্যান্সার লাগানো থাকায় শব্দ হয় না, তবে গু°লি চলে। কপাল ভেদ করে চলে যায় গু°লিটি। সাদা বিছানা, সাদা টাইলসের মেঝেতে যেন কেউ আলপনা এঁকেছে। র°ক্তের আলপনা। শেষ নিশ্বাস বের হয়েছে নিয়াজীর।
নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা সেও করেছে। তাহসিনা, তাহমিনা বা রিপা বেগমের মতো সেও বেঁচে থাকার আকুতি ছিল তার চোখেমুখে, কিন্তু বাঁচতে পারেনা।
কপালে একটা গোলাকার গু°লির চিহ্ন, র°ক্তে মাখোমাখো হয়ে আছে। সেই ছিদ্র দিয়ে এখনো বের হচ্ছে টাটকা র°ক্ত।
শরীফ বাইরে এসে ইশারা করলে চারজন লোক নিয়াজীর দেহ নিয়ে ম°র্গে চলে যায়। শরীফ শান্তভাবে হেঁটে নিজের চেম্বারে চলে আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরোনো কথা।
“আমাদের মেয়ের নাম হবে মৃত্তিকা। সুন্দর না নামটা? আমি আগে থেকেই এটা ভেবে রেখেছিলাম।”
মেয়েকে কোলে নিয়ে কথাটা বলে রিপা।
“কি করে বুঝেছিলে মেয়ে হবে?”
“মায়েরা বুঝতে পারে।”
রিপার কথা মনে করে কান্না পায় শরীফের। চোখের পানি বাঁধনহারা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে৷ বয়সের এই প্রান্তে এসে ডি°ভোর্স হয়ে যাওয়া স্ত্রীর জন্য কান্না করাটা বেমানান। কিন্তু ভালোবাসা যে বাধা মানে না।
______________________________________
এলার্জি হয়ে মৃত্তিকার হাত-মুখ-গলা লাল হয়ে আছে। আয়নার সামনে নিজের এ অবস্থা দেখে বলে,
“কি হয়েছে দেখেছেন?”
ইমতিয়াজ অফিসে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর কথায় ভালো করে দেখে বলল,
“আজকে বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। হঠাৎ এমন হলো কেন?”
“জানি না।”
মৃত্তিকা ছোট করে জবাব দিয়ে নাস্তা তৈরি করতে চলে যায়। টেবিলে নাস্তা রেখে অপরূপার দিকে আড়চোখে কয়েকবার তাকালো।
অপরূপা মৃদু হেসে বলল,
“সকালে অন্য মেয়েদের গায়ে লাভ বাইট থাকে আর তোমার এলার্জি? বাহ, বাহ।”
ঘর থেকে ইমতিয়াজ কথাটা শুনে। সে বেরিয়ে এসে বলল,
“আমার স্ত্রীর লাভ বাইট দেখার শখ তোমার জাগে কেন? এধরনের ফালতু কথা আরেকবার শুনলে খুব খারাপ হবে।”
মৃত্তিকা নাস্তা নিয়ে রুমে চলে যায়। বিছানায় খাবার রেখে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। ইমতিয়াজ ওর মুখোমুখি বসে ওর মুখের সামনে খাবার তুলে বলল,
“খাবে না?”
মৃত্তিকা খাবার মুখে নিয়ে বলে,
“কি করবেন ওকে দিয়ে?”
“অফিসারদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করবো।”
“যদি শাফিনের আরো লোক থাকে? আর ওকে আর শাফিনকে বাঁচিয়ে নেয়।”
“সম্ভাবনা কম, শাফিনের অবস্থা এমনিতেই খুব খারাপ। ওর লোকেরা ওর সাহায্য আর করবে বলে মনে হয় না।”
“আপনি যে বলেছিলেন এবারে শাফিনকে অন্য ফাঁ°দে ফেলবেন। ওর এ অবস্থায় কিভাবে সম্ভব?”
ইমতিয়াজ মাথানেড়ে খেতে থাকে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে বলল,
“চাইলে এ অবস্থায়ও সম্ভব। অফিসার গালিব চেষ্টা করছে, অফিসার রিজভি চেষ্টা চালাচ্ছে। সবাই তো আর শাফিনের পক্ষে না। তবে ফাঁ°দে তাকে পড়তেই হবে।”
“ফাঁ°দটা কি?”
ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি শাফিন এবারেও বেঁচে ফিরে, তবে বুঝতে পারবে।”
মৃত্তিকা উঠে এসে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সব ভালো থাকুক। ফে°তনা দূর হোক।”
ইমতিয়াজ ওর গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,
“অফিস যেতে হবে তো।”
মৃত্তিকা সরে যায়। গত পরশুদিন তানজিম আর সুরভি বাসায় এসে ইমতিয়াজকে দেখে যে ভয়টা পেয়েছে, সেটা ভেবে এখন আবারো মৃত্তিকার হাসি পায়।
“নিজে নিজে হাসছো কেন?”
“এমনিতেই, রেডি হয়ে নিন।”
______________________________________
সুরভি শাফিনের কাছেই আছে। মমতাজের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। মমতাজ বেগম উঠতে পারে না, নিজে নিজে খেতে পারে না। সামান্য পানিটুকু চাইলেও সুরভি তা দেয় না। ঘৃ°ণার পরিমান এতো বেশি হয়েছে যে সে ওদেরকে মে°রে ফেলতে পারলে বাঁচে।
অপরূপার উপরেও তার রাগ আছে। অপরূপার সত্যটা জানতে পেরে সুরভি বাবাকে আরো বেশি ঘৃ°ণা করছে। পরশু যখন অপরূপাকে মৃত্তিকার বাসায় দেখেছে, তখন থেকে সে আরো চুপ আছে।
ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন শান্তরূপে নিজেকে পরিবেশন করে, সুরভিও তেমনি আছে।
“সুরভি, মা আমার, একটু পানি দাও।”
মমতাজ বেগমের কথা উপেক্ষা করে নিজেকে শান্ত রেখে সে বেরিয়ে আসে। মৃত্তিকার বাসায় চলে এসেছে সে।
সকাল সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। মৃত্তিকা মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে আর মিউকোর গায়ে হাত বুলাচ্ছে। বেল বাজায় চমকে উঠে।
মৃত্তিকা ধীরপায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সুরভি ভিতরে এসে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইমতিয়াজ বাসায়?”
“না, অফিসে গেছে।”
সুরভি মাথানেড়ে অপরূপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃত্তিকাকে বলে,
“বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে, মিউকো। দেখা করবে?”
নিজের থেকে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে দেয় সুরভি। মৃত্তিকা একটু চমকে উঠে। আবার শাফিনের কুৎসিত অবস্থা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছাও জাগে। ইমতিয়াজ জানলে ওকে যেতে দিবে না, তাই না জানিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
“আমি যাবো, আপু।”
“ঠিক আছে, তুমি তৈরি হয়ে বের হও। আমি ওকে পাহারা দিচ্ছি।”
মৃত্তিকা অপরূপার দিকে ইশারা করে বলল,
“ও কিন্তু অনেক বিপজ্জনক।”
“ও কতটা খাতারনাক, আমি তার চেয়ে বেশি খাতারনাক।”
মৃত্তিকা মৃদু হাসে। দ্রুত তৈরি হয়ে সে বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ও চলে গেছে সুরভি অপরূপার কাছে এসে বলে,
“এখন যদি তোমাকে ছেড়ে দিই, কোথায় যাবে?”
অপরূপা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“আগে তোমাকে মা°রবো আর তারপর মৃত্তিকাকে। ইমতিয়াজকে একা করবো আমি।”
“তোমার কি সমস্যা ইমতিয়াজের সাথে?”
“মৃত্তিকাকে এতো ভালোবাসে কেন? এতো আদর কিসের জন্য?”
হিং°সার অনলে জ্ব°লছে অপরূপা। সুরভি সোজা হয়ে বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“চলো তবে, মা°রবে মৃত্তিকাকে।”
প্রায় আধঘন্টা পর সুরভি অপরূপাকে নিয়ে বের হয়। কোনো জোরাজুরি না করেই অপরূপা ওর সাথে আসছে। সিএনজি করে হাসপাতালে পৌঁছায় ওরা।
এদিকে মৃত্তিকা শাফিনের সাথে দেখার করার অনুমতি পেয়ে ভিতরে এসে শাফিনের অবস্থা দেখে।
পঁ°চা অংশ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সময়মতো পরিষ্কার করা হয়নি বলে এ অবস্থা হয়েছে। মৃত্তিকার গা গু°লিয়ে আসে।
মমতাজ বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
“বড়মণি?”
দুবারের ডাকে মমতাজ বেগম চোখ খুলেন। হাত উঠিয়ে বলে,
“এসেছো মা? একটু পানি দিবে।”
দুর্ঘটনায় উনার বুকে ব্য°থা পেয়েছিল। থেকে থেকে সে ব্যথায় কাতরে ওঠে। মৃত্তিকা উনাকে ধরে উঠিয়ে পানি পান করিয়ে দেয়।
মমতাজ বেগম আবারো শুয়ে বলে,
“আমি তোমাকে মা°রার জন্য শাফিনের ঠিকানা বলিনি, তোমাকে আমি এখন আর মা°রতে চাই না মা।”
মৃত্তিকা অপলক তাকিয়ে বলল,
“মাম একটা কথা বলতো, খালা নাকি মায়ের চেয়ে ভালা। আর আমার খালা আমার মাকেই মে°রেছে।”
মৃত্তিকা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখের পানি লুকাতে ব্যস্ত হয় সে।
শাফিনের কাছে গিয়ে বলে,
“তোমার মনের মতো তোমার শরীরটাও পঁচতে শুরু করেছে। এই হাত দিয়ে মেয়েগুলোকে স্পর্শ করেছিলে, তাই না? মজলুমের অভিশাপ বিফলে যায় না মামা।”
কঠিন প্রশ্নে চেয়ে থাকে শাফিন। মৃত্তিকা আবারো বলে,
“কেন ডেকেছো তাই বলো? কেন দেখা করতে চেয়েছো?”
শাফিন নিচুস্বরে বলল,
“তোমাকে আমি আসতে বলিনি।”
শাফিনের বামহাতে হাতকড়া লাগানো আছে। লোহার ভারি কড়াটা শব্দ করে নাড়িয়ে বলে,
“এই হাত খোলা থাকলে এখনই তোমাকে মে°রে দিতাম। তোমার জন্য আমি মৃ°ত্যু য°ন্ত্রণা সহ্য করছি।”
“এগুলো কর্মফল।”
শাফিন আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলে। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো তার নড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে, যেন সে হাত নাড়াতে চাচ্ছে। মৃত্তিকা সেদিকে তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর অপরূপাকে টে°নে ভিতরে এনে ফেলে সুরভি। মৃত্তিকা চমকে উঠে বাইরে তাকায়। দুজন পুলিশ তাদের জায়গায় নেই। আইসিইউর সামনে পুরো স্থান ফাঁকা।
“আপু?”
মৃত্তিকার ডাকে সুরভি উত্তর দেয়,
“চুপ করো, বাধা দিও না।”
সুরভি শাফিনকে ডেকে বলে,
“বাবা, তোমার সুন্দরী, যুবতী, সুনয়না স্ত্রী দেখা করতে এসেছে। যার রূপে পাগল হয়ে তুমি আমার মায়ের সাথে প্র°তা°রণা করেছো, সেই অপরূপা এসেছে। দেখো তুমি।”
শাফিন ধীরে ধীরে চোখ খুলে। সুরভি অপরূপার চুলের মুঠি ধরে ওকে শাফিনের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,
“সবাই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, শুধু আমার বাবা আর আমি ছাড়া।”
অপরূপার মাথাটা বিছানায় চেপে ধরে ওড়নার নিচ থেকে বড় ছু°ড়িটা বের করে অপরূপার গলায় গভীর করে চালিয়ে দেয় সুরভি। চিৎকার দেয়ার সময়টুকু অপরূপা পায় না। ছু°ড়ি দিয়ে খুঁচিয়ে র°ক্ত আরো বের করে সুরভি।
মৃত্তিকা ধরতে আসতে নিলে সুরভি ধমক দেয়,
“খবরদার কাছে আসবে না। এখানে তোমার কিছু নেই। চলে যাও।”
সে নিজেও কান্না করে দিয়েছে। র°ক্তে মাখোমাখো হয়েছে তার শরীরের পোশাক। ছটফট করতে থাকা অপরূপাকে ধরে রাখতে রাখতে মুখে-গলায়-হাতে র°ক্ত মেখে ভ°য়ং°কর রূপ এসেছে সুরভির।
“সন্তানের হাতের মৃ°ত্যুর চেয়ে তোমার জন্য কোনো বড় শাস্তি নেই বাবা।”
মমতাজ বেগম এসব দেখে চিৎকারে করে উঠে। শব্দ শুনে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ভিতরে চলে আসে।
সুরভি শাফিনের উপর ছু°ড়ি চালাতে নিলে দুজন মহিলা কন্সটেবল জোরপূর্বক সুরভিকে ধরে ফেলে। সরিয়ে আনে শাফিনের কাছ থেকে। তবুও শাফিনের হাতে ছুড়ির আঁ°চড় পড়ে, কে°টে র°ক্ত ঝরা শুরু হয়েছে।
সুরভি এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাফিনের দিকে। বাবার প্রতি তার চরম ঘৃ°ণা, এতোটাই ঘৃ°ণা যে বাবাকে মে°রে ফেলতেও সে দ্বিধা করবে না।
মৃত্তিকা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আকস্মিক ঘটনায় মানসিকভাবে বিপ°র্য°স্ত হয়ে পড়েছে সে। এই পরিবারের কেউ আবারো খু°ন করলো। তানজিম ঠিক বলেছিল এ র°ক্তে খু°ন ঘুরছে।
______________________________________
দশদিন পেরিয়ে যায়। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সারাহ্ নিজের রুমে শুয়ে আছে। আহনাফ গতকাল আসেনি, সেই যে শুক্রবারে গেল তারপর যেন বাসার পথই ভুলে গেছে। সারাহ্ও অভিমান করেছে, কোনো কল দেয়নি।
কলিং বেল বাজলে সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে অপরিচিত কয়েকজন মেয়ে এসেছে, হাতে একটা দানবাক্স।
“আসসালামু আলাইকুম।”
এক মেয়ের সালামের জবাব দেয় সারাহ্।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। জি বলুন।”
“আমরা একটা বৃদ্ধাশ্রমের জন্য টাকা সংগ্রহ করছি।”
মেয়েগুলোর পিছন থেকে “টুকি” বলে বেরিয়ে আসে সামিহা। তাড়াহুড়ো করে বলে,
“আমি ওদেরকে নিয়ে এসেছি, জলদি জলদি টাকা বের করো।”
সারাহ্ পুরো দরজা আগলিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এ টাকা কোথায় যাবে?”
“বৃদ্ধাশ্রমে, সত্যি বলছি। আমরা মিথ্যা বলি না, আমি তো না-ই।”
সারাহ্ কপাল কুঁচকে গিয়ে পার্স থেকে দুইশ টাকার নোট দিয়ে বলে,
“যাবো একদিন ওই বৃদ্ধাশ্রমে, দেখবো টাকার কি হচ্ছে।”
মেয়েগুলো চলে যায়। সামিহা ভিতরে এসে হেলেদুলে হেঁটে হেঁটে বলছে,
“আপু, তুমি সোজা হবা কবে?”
“কেন? আমি কি বাঁকা?”
“না, কোমড়ে হাত দিয়ে এমন সাপের মতো হাঁটা থামাবা কবে তাই বলো।”
“তবে রে।”
সারাহ্ ওর দিকে কুশন ছুঁড়ে দিলে সামিহা দৌড়ে পালায়। তারপর আবার রুম থেকে উঁকি দিয়ে বলে,
“আমিও ইমতিয়াজ ভাইয়ার মতো একদিন ম°রার ভাণ ধরে থাকবো। তখন দেখবো তুমি কেমনে কা°ন্দো।”
সারাহ্ কপাল কুঁচকে ফেলে। সামিহা রুমে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। তানজিমের কাছ থেকে ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর অভিনয়ের কথা শুনেছে সামিহা।
সারাহ্ রুমে চলে এসেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলল,
“কোলে কবে আসবি, সোনা? আমার যে আর ধৈর্য থাকছে না।”
______________________________________
সুরভিকে জে°লে নেয়া হয়েছে আজ দশদিন। রাইদ মাকে ছাড়া খুবই কান্নাকাটি করে। সুরভি ছেলেকে দেখে না, দেখা করতে আসলেও কাছে যায় না।
অপরূপার দা°ফনের কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে৷ নিয়াজীর খু°নের কথাও এখন ওপেন সিক্রেট বলা যায়, তবে শরীফকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দেলোয়ারা তো আগে থেকেই নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। স্বামীর এ অবস্থার পর মেয়ের জেল, উনি যে বেঁচে আছেন সেটাই বেশি।
রাইদকে মৃত্তিকা কোলে নিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করছে। দেলোয়ারা এখন মৃত্তিকার বাসায়, ওর সাথেই আছে।
“বাবা আমার, সোনা আমার, আর কাঁদে না। একটু খাও।”
ফিডার দিয়ে অল্প অল্প করে দুধ খাওয়াচ্ছে ওকে মৃত্তিকা। ছোট মানুষ, মা ছাড়া বুঝেটা কি? বাবা তো মাকে ছেড়েই দিয়েছে।
সমস্তটা দিন মৃত্তিকা ওকে নিয়েই কা°টিয়েছে। রাতে ইমতিয়াজ বাসায় এসে দেখে ক্লান্ত মৃত্তিকা রাইদের পাশে আরামে ঘুমাচ্ছে। ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে কপালে চুম্বন করে দেয়।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রাতের খাবার প্রস্তুত।
ইমতিয়াজ নিজে নিজেই বলে,
“গিন্নি তবে পারফেক্ট হচ্ছে।”
পেছন থেকে দেলোয়ারার কন্ঠ পাওয়া যায়।
“আরে ইমতিয়াজ, এসে গেছো। ফ্রেশ হয়ে নাও, আজ আমি রান্না করেছি।”
ইমতিয়াজের মুখটা শুকিয়ে যায়। তবে এসব রান্না দেলোয়ারা করেছে। পরক্ষণেই হাসে সে, সবসময় স্ত্রীরা রান্না করবে কেন? মাঝে মাঝে স্বামী তাকে রেঁধে খাওয়াতে নিষেধ নেই। ওদের সম্পর্ক না হয় উল্টোই হোক।
______________________________________
মধ্যরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্ব°র এসেছে শাফিনের। জ্ব°রে কাঁপছে, ব্য°থায় চিৎকার করছে আর মনে মনে আফসোস করছে সে।
যদি জামিল, দুলাল বেঁচে থাকতো, তবে সে ঠিকই বেঁচে যেতো। আজ তার খারাপ সময়ে বিশ্বস্ত লোকগুলোও যেন পালিয়েছে। কারো কোনো খোঁজখবর নেই।
মমতাজ বেগম অনেকটাই সুস্থ, তবে বয়সের তুলনায় দুর্ঘটনার ভারটা সে নিতে পারছে না। শাফিন জানে মমতাজ পালাবে না, তবে তাকেও যে পালাতে দিবে না।
পা তার সম্পূর্ণ অবশ, হাত একটু নাড়াতে পারে। নাড়ালেই পঁ°চা-গলা মাংস খুলে পড়তে শুরু করেছে। শাফিন চিৎকার করে। একজন কর্তব্যরত ডাক্তার ভিতরে আসলে মমতাজ বলে,
“ওকে দূরে সরাও, না হয় আমাকে সরাও। ওর চিৎকার আমার ভালো লাগে না।”
ডাক্তার শাফিনকে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করে। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। ক্ষ°ত সারানোর ওষুধ ওর উপর কেন যেন কাজ করছে না। ক্ষ°ত শুকাচ্ছে না, বরং আরো বাড়ছে। ভ°য়ং°কর রকম দূ°র্গন্ধ আসছে তার থেকে।
“আমাকে সুস্থ করো, নাহয় মে°রে ফেলো। সহ্য হচ্ছে না আমার। মিউকো, ছাড়বো না আমি তোমাকে।”
চলবে….