#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
অষ্টপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৮ পর্ব)
“জানেন আজ একটা ঘটনা ঘটেছে।”
রাতের খাবার শেষে একটু গল্পগুজব শেষ করে মাত্রই ঘুমাতে এসেছে আহনাফ। বিছানায় শোয়া মাত্রই উপরোক্ত কথাটা বলে সারাহ্।
“কি ঘটেছে?”
সারাহ্ খুব আগ্রহ নিয়ে বিছানায় বসে বলল,
“একটা চেনা কন্ঠ শুনেছি। যে কন্ঠের মালিক আমাকে বাঁচিয়েছে, তাকে দেখেছি।”
এবারে আহনাফ উঠে বসে। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। মাথা নেড়ে বলল,
“মানে কি?”
সারাহ্ সকালের পুরো ঘটনা খুলে বলে। আহনাফ আবারো খানিক চিন্তায় পড়ে যায়। এ আবার কেমন সমস্যা আসলো?
আর সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে যায়, সারাহ্ উঠে দরজা পর্যন্ত আসে। আহনাফের সাথে বের হওয়ার সাহস ওর হয়ে উঠে না।
আহনাফ এসে হাজির হয়েছে পাঁচতলায়। চারটা ফ্ল্যাটের মাঝে কোনটাতে থাকে সে ব্যক্তি, তা নিয়ে বি°ব্রত হলেও সারাহ্-র কথা অনুযায়ী ফ্ল্যাট ফোর-বি তে বেল বাজায়। তবে বেল বাজে না। বাজবে কিভাবে? এখানে তো বেল লাগানোই নেই।
দরজায় নক করে আহনাফ। জোরে জোরে কয়েকবার নক করলে শরীফ ভিতর থেকে বলে,
“কে?”
আহনাফ গলা ঝেরে বলল,
“নিচের ফ্ল্যাট থেকে এসেছি, এখানে শব্দ হচ্ছে তাই।”
“এখন কোনো শব্দ নেই, যেতে পারেন।”
শরীফ দরজা খুলে না। আহনাফ আরেকবার দরজায় নক করে বলে,
“একটু বাইরে আসবেন কথা আছে।”
লুকিং হোলে আহনাফকে দেখে শরীফ আর বের হয় না, ভিতর থেকে বলে,
“যা বলবেন ওখান থেকেই বলুন, আমি জবাব দিবো।”
আহনাফ নিশব্দে চলে যায়। লোকটাকে দেখার অনেক বেশি ইচ্ছে তার, তবে সে ইচ্ছে অপূর্ণ থাকে।
এদিকে মৃত্তিকার ফোনে ইমতিয়াজ অনবরত কল করছে। একই স্থানে স্থির মৃত্তিকা কান্না ভরা চোখে কম্পনরত ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ঘূর্ণায়মান পৃথিবী তার জন্য বোধহয় থেমে গেছে। এদিন কাটবে না, এ মাস শেষ হবে না, সুন্দর একটা সকাল হয়তো তার দেখা হবে না। এমনটাই মনে হচ্ছে মৃত্তিকার।
শরীফ এসে তানজিমকে বলল,
“আহনাফ এখানে?”
“হয়তো আপুর সাথে দেখা করতে এসেছে।”
“কোন আপু?”
কপাল কুঁচকায় শরীফ।
“উনার ওয়াইফ, সারাহ্। চারতলায় থাকে।”
শরীফ মাথা নেড়ে ভিতরে যায়। সে জানে সারাহ্ এখানে থাকে, তার সাথে দেখা হয়েছিল তো।
মৃত্তিকা ওকে দেখেও একইভাবে বসে থাকে। শরীফ মৃত্তিকার ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“ইমতিয়াজ বারবার কল করছে।”
মৃত্তিকা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“অপরূপা ইমতিয়াজের কথা বলেছে, বড়মণি পঞ্চম ব্যক্তিকে চেনে না, শাফিন ও ইমতিয়াজের কথাই বলেছে। এর অর্থ কি দাঁড়ায়?”
শরীফ চুপ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃত্তিকা আবারো বলে,
“অপরূপা অনেকদিন থেকে আমার কাছে জি°ম্মি। তাই শাফিন আর ওর পরিকল্পনা করার কোনো সুযোগ হয়নি, তবে একই কথা কেন দুজনে বলেছে?”
শরীফ ওর মুখোমুখি বসে।
“দেখো, আমি বুঝতে পারছি, ইমতিয়াজ নামটা শুনে তোমার কেমন লাগছে? তবে একটা বিষয় মাথায় রেখো এই শাফিন তোমার মায়ের নামেও আমার কাছে অনেক কথা বলেছে, পথ°ভ্র°ষ্ট করেছে আমাকে। (একটু থেমে) বুদ্ধিমানের জন্য ইশারা যথেষ্ট।”
হ্যাঁ, মৃত্তিকার জন্য ইশারা যথেষ্ট হলো। সে বুঝতে পারলো এমনও হতে পারে যে শুধুমাত্র ওর সংসার ভা°ঙার জন্য ইমতিয়াজের উপর জোর করে দোষ চাপানো হচ্ছে।
“আমাকে সকালে বাসায় দিয়ে আসবেন?”
মৃত্তিকার কথায় শরীফ চলে যেতে নিয়েও থেমে দাঁড়িয়ে বলে,
“ঠিক আছে, রেডি থেকো।”
______________________________________
সকাল সকাল মৃত্তিকা ঠিকই এসে বাসায় হাজির হয়। কলিং বেল বাজাতে না বাজাতেই ইমতিয়াজ দরজা খোলে। শরীফ উপরে আসেনি, তানজিমকে বাসায় একা রেখে এসেছে বলে দ্রুত চলে যায়।
দরজা খুলে দেয় ইমতিয়াজ ঠিকই, কিন্তু ওকে ভেতরে ঢোকার জায়গা দেয় না। মৃত্তিকা ওকে পাশ কাটিয়ে ঢুকতে নিলে ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে বাইরে বের করা দেয়।
“ভিতরে যাই, আমি বলছি সব কথা।”
মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ জবাব দেয়,
“তুমি যেটা বলবে মি°থ্যাই বলবে।”
মৃত্তিকার সেই এক মিথ্যার রেশ ধরে, ওকে আর বিশ্বাস করে না ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা ওকে ধা°ক্কা দিয়ে ভিতরে চলে আসে।
“বাবার সাথে ছিলাম, এই কথাটা কি বিশ্বাস হচ্ছে না?”
ইমতিয়াজ শব্দ করে দরজা বন্ধ করে বলে,
“তুমি তোমার বাবার সাথে ছিলে, তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি ফোন কেন রিসিভ করোনি? কাল যখন বাসায় আসতে বলেছি তখন কেন আসনি?”
“ইচ্ছে হয়নি, তাই আসিনি।”
“তো এখন কেন এসেছো? রাতে কোন মেয়ে নিয়ে ছিলাম কিনা সেটা দেখতে?”
ইমতিয়াজ শোবার রুমের দরজা খুলে বলে, “দেখো, কে আছে দেখো। ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন, এখানে দেখো।”
মৃত্তিকা রেগেমেগে বলে,
“চিৎকার করবেন না আর ভদ্রতা বজায় রাখুন।”
“এখন আমি চিৎকার করছি? দু দুটো রাত তুমি বাসার বাইরে ছিলে। কোথায় ছিলে, কি করছো, কোনো কিছু জানাওনি। ফোন বন্ধ রেখেছিলে, যাও কল রিসিভ করলে কথা শেষ না করে কে°টে দিলে, তারপর সারাদিনে আর কোনো যোগাযোগ নেই।”
ইমতিয়াজ ওর কাছে এসে বলে,
“তোমার কি মনে হয় আমি তোমার বাবার বাসায় যাইনি? ওখানে তুমি ছিলে না, অপরূপাও ছিল না। হাসপাতালে গিয়েছিলাম, উনি ছিল না। কোথায় ছিলে তোমরা?”
মৃত্তিকা রুমে চলে যায়। হিজাব খুলে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে,
“আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন, তাই না?”
“না, এটা সন্দেহ না, তবে জবাবদিহিতা তোমাকে করতে হবে।”
একটু থেমে ইমতিয়াজ বলে,
“বিবির বাজার কেন গিয়েছিলে তোমরা?”
মৃত্তিকা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকায়। এমনিতেই মৃত্তিকা ওকে সন্দেহ করে, তার ওপর বিবির বাজার যাওয়ার খবর সে কোথায় পেল? আরো একটা প্রশ্ন এসে দানা বাঁধে মৃত্তিকার মনে।
মৃত্তিকা কিছু বলার আগেই ইমতিয়াজ বলে,
“থাক, তোমাকে আর কোনো কথা বানাতে হবে না। কারণ সত্যটা তুমি আমাকে বলছো না।”
______________________________________
শুক্রবার দিন পুরো পরিবার একসাথে নাস্তা করবে। সামিহা টেবিল সাজাচ্ছে। সারাহ্ বেশ আরাম করে বসে বলে,
“মা, তোমার মেয়ে কিন্তু বেশ কাজের হচ্ছে।”
নার্গিস পারভিন হাসলেন, নিচুস্বরে সারাহ্-কে বলেন,
“আহনাফকে ডেকে আনো।”
সারাহ্ উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আহনাফ সবে মাত্র উঠে ফ্রেশ হয়েছে। সারাহ্ ন্যাকাসুরে ডাকে,
“সোয়ামি।”
আহনাফ যেন ভী°ম°ড়ি খেয়ে উঠে। চোখে চঞ্চলতা রেখে বলে,
“কিসব বলছো?”
“ওমা, কি বললাম? আপনাকে নাম ধরে তো ডাকা যাবেনা, তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করা আরকি। আমি আবার খুব বুদ্ধিমান (একটু থেমে) সরি, বুদ্ধিমতী।”
আহনাফ কিছু বলার আগেই নার্গিস পারভীন ওদেরকে ডেকে বলে,
“এসো তোমরা, সারাহ্ এসো। আহনাফ এসো, বাবা।”
আহনাফ একটু উঁচু গলায় বলে,
“আসছি।”
রাস্তার টেবিলের খাবারের চেয়ে গল্প বেশি জমে উঠে। একপ্রকার হাসি তামাশায় মেতে উঠেছে সবাই। নাস্তা শেষে ড্রয়িং রুমে বসে জাহাঙ্গীর সাহেব ও আহনাফ এটা সেটা নিয়ে কথা বলছে। এর মাঝে সামিহা এসে পুরনো পত্রিকার শেলফটা ঘাটাঘাটি শুরু করেছে।
জাহাঙ্গীর সাহেব বলে,
“কি খুঁজছো?”
“একটা কাগজ, বাবা। এখানে রেখেছিলাম।”
একটা ছবি এসে আহনাফের পায়ের কাছে পড়ে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়, এ যে ইমতিয়াজ।
“উনি কে সামিহা?”
আগে পিছে তেমন কিছু না ভেবেই আহনাফ সামিহাকে প্রশ্ন করে বসে।
সামিহা সরল জবাব দেয়,
“মিউকো আপুর হাজব্যান্ড।”
“উনার ছবি তোমার শেলফে কেন?”
সামিহা হেসে বলে,
“শুধু ছবি না সিভিও আছে। আপু যখন মাস্টার্সে, তখন প্রস্তাব এসেছিল বিয়ের।”
আহনাফ আর কিছু না বলে নিরবে উঠে চলে যায়। তার মানে ইমতিয়াজকে উনারা সবাই চেনে। যদিও ঘটনা অনেক আগের তাই এটা নিয়ে আহনাফের কোনো মাথাব্য°থা নেই।
রুমে বসে সে গালিবকে ফোন দেয়। শাফিনের আপডেট জানতে ফোন দিলেও, সে আপডেট পায় ডাক্তার আরিফার। আরিফা হঠাৎ করেই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে গেছে এবং তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে, অবস্থা খুবই শোচনীয়।
এদিকে আরিফা হাসপাতালে আসার খবরে শরীফ ঢাকা মেডিকেলে এসেছে। অন্যান্য ডাক্তারদের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকায় শরীফ খুব সহজেই আইসিইউতে প্রবেশ করে ফেলে।
আরিফার কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে খুব ধীরে ধীরে বলে,
“কাল রাতে একটা গ্যাস ছড়িয়েছিল নাকি?”
আরিফা চোখ বড় বড় করে তাকায়। সত্যিই কাল সেলের ভিতরে একটা গ্যাস ছড়িয়েছিল এবং এই গ্যাসের জন্য সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
শরীফ আবারো বলে,
“পঞ্চম ব্যক্তি কে? এটা বললেই বেঁচে যাবে।”
আরিফা জোরে শ্বাস টে°নে নেয়। মিনমিনে কন্ঠে বলে,
“ইমতিয়াজ।”
যেন সকলের এই নামটা মুখস্থ করে বসে আছে। যাকে জিজ্ঞাসা করছে, একই নাম জবানে আসছে।
শরীফ আবারো জিজ্ঞাসা করে,
“কোন ইমতিয়াজ? সৌরভ?”
আরিফা ডানে বামে মাথা নেড়ে না বুঝায় অর্থাৎ এই ইমতিয়াজ, সৈয়দ ইমতিয়াজ সৌরভ না।
“তবে কোন ইমতিয়াজ?”
আরিফা আঙ্গুল উঠিয়ে কিছু একটা ইশারা করে। শরীফ কপাল কুঁচকে এদিক ওদিক তাকায়।
ডা. দীপ এসে বলে,
“শরীফ সাহেব বাইরে চলে আসুন। আইসিইউতে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না।”
“হুম।”
বলে বেরিয়ে আসে শরীফ।
তী°ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরো ফ্লোরে সে তাকাতে থাকে। আরো একজন ইমতিয়াজের খোঁজে ব্যস্ত সে। এই ইমতিয়াজ সৌরভ নয়, এইটুকু কথা ওর স্বস্তির জন্য যথেষ্ট ছিল। এর মধ্যে একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে, আরিফা মা°রা গেছে।
শরীফ চমকে উঠে। আরিফার থেকে কথা নেয়ার জন্য, ওকে সেল থেকে বের করা জরুরী ছিল। তাই ওর লোকের মাধ্যমে অল্প কিছু কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস সেখানে দেওয়া হয়, তবে তার মাত্রা এত বেশি ছিল না যে আরিফা মরে যাবে।
শরীফ দ্রুত পায়ে আইসিইউর কাছে এসে দেখে সাদা কাপড়ে ঢেকে আরিফাকে বের করে নিয়ে আসছে। আরিফাকে নিয়ে গেলে শরীফ ভিতরে আসে অক্সিজেন সিলিন্ডারে ফু°টো, এখান থেকে গ্যাস লিক হয়েছে আর অক্সিজেনের অভাবে সে মা°রা গেছে।
কে এই ইমতিয়াজ? প্রশ্নটা রয়ে যায়।
______________________________________
আজকের দিনটুকু পেরিয়ে যায়। রাতে মৃত্তিকা শরীফের থেকে আরিফার ঘটনা শুনে আবারো আত°ঙ্কি°ত হয়ে যায়। আরো একজন মানুষ বাইরে ঘুরঘুর করছে, অথচ কেউ বুঝতেও পারলো না।
ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ আগে বাসায় এসেছে। এসেই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে রাতে সে খাবে না।
শরীফের থেকে সবটা জেনেও মৃত্তিকার নজর ইমতিয়াজের উপর থেকে সরে না। বিশ্বাস নামক শব্দটা এখন শুধুই একটা শব্দ, বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই।
যে মমতাজ বেগম দুই বছরের বেশি সময় মেয়েদের শো°কে মানসিক রোগীর অভিনয় করেছে, সে নাকি তার মেয়েদের খু°নি। যে মামা ভাগ্নির জন্য এত ভালবাসা দেখিয়েছে, সে নাকি তার ভাগ্নিকে নোংরাভাবে ছুঁয়েছে। এত কিছু হওয়ার পর ইমতিয়াজকেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
মৃত্তিকা শরীফকে বলে,
“শাফিনকে রাতভর পি°টিয়েও কোনো লাভ হবে না। তার যদি বিবেকবোধ থাকতো, তবে সে এসব করতোই না। আর ওদেরকে জানে মে°রে ফেলো না। ওরা ঠিক সেই ভাবে ম°রবে, যেভাবে ওরা মামকে মে°রেছে।”
“তবে তার আগে সেই ইমতিয়াজকে আমি চাই। হাসপাতালে খুঁজলে পেতে পারি।”
কথা শেষে ফোন রেখে মৃত্তিকা ঘরে যায়। ইমতিয়াজ ওর কথা সবই শুনেছে, কিন্তু সে এখন ঘুমের ভান ধরে শুয়ে আছে। মৃত্তিকা ওর গা ঘেষে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ বাধা দেয় না, আবার ওকে জড়িয়েও নেয় না।
ইমতিয়াজের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে মৃত্তিকা। দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে, ওরা জানে ওরা একে অপরকে কষ্ট দিচ্ছে। ইচ্ছা করে আরো জ°ঘ°ন্য কথা বলে বলে কষ্ট বাড়িয়েছে। কিন্তু কেউই হার মানতে রাজি নয়, আবার দূরে যেতেও রাজি নয়। শারিরীকভাবে একই স্থানে থেকেও মনটা যোজন যোজন দূরে তো কত আগেই চলে গেছে।
______________________________________
শনিবার সকাল, আজও আহনাফ বাসায় থাকবে। তাই সকালেই সামিহা ওর সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। সামিহা একটু আগে আগে হাঁটছে আর আহনাফ একটু পিছনে।
সামনে দিয়ে একটা বড় লা°শবাহী গাড়ি যায়। ফ্রিজিং গাড়ি নয়, খোলা বড় গাড়ি। রাস্তার কুকুরগুলো গাড়িটাকে দেখেই চিৎকার করে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে। সামিহা দাঁড়িয়ে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আহনাফ ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,
“কি? ভ°য় পেলে?”
“না, দেখে একটু চমকে গেছি। এতো সকালে লা°শবাহী গাড়ি কেন? তাও এতো বড়।”
“হয়তো কোনো দু°র্ঘ°টনা হয়েছে।”
“হতে পারে।”
এরমধ্যে পর পর চারটা গু°লি চলে। সামিহাকে নিয়ে সরে যায় আহনাফ। সামিহা প্রচুর ভ°য় পেয়েছে। কয়েকজন অচেনা লোক গাড়িটার পিছু করতে করতে গু°লি চালিয়েছে।
একজন বলে,
“সরে যান।”
আহনাফ ওদের কোমড়ে লাগানো আইডি কার্ড দেখে তাদেরকে পুলিশ বলেই শনাক্ত করে। লা°শবাহী গাড়ি থেকে তিনজন লোক নেমে ওদের বাসায়ই ঢুকে যায়।
আহনাফও সামিহাকে নিয়ে দ্রুত বাসায় ঢুকে। লোকগুলো সিঁড়ি দিয়ে উঠেছে আর ওরা উঠে লিফটে। চারতলায় নেমে সামিহাকে ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে আহনাফ দাঁড়িয়ে থাকে।
লোকগুলো চারতলা পেরিয়ে পাঁচতলায় যেতে নিলেই আহনাফ একজনকে টে°নে জোরে দেয়ালের দিকে আছড়ে ফেলে, আরেকজনের গলা হাতের বাঁধনে চেপে ধরে। সামিহা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে।
উপর থেকে তানজিমও নেমে আসে। সামিহা ওকে দেখে কপাল কুঁচকে বলে,
“তানজিম?”
তৃতীয় জনকে তানজিম ধরে ফেলে। তিনজনই এখানে আটকা পড়ে যায়। লিফট খুলে বেরিয়ে আসে পাঁচ ছয়জন লোক। একজন আইডি কার্ড ফেলে দিয়ে বলে,
“এসবই মি°থ্যা, উনাদের ধরার জন্য থ্যাংকস।”
শরীফ পিছন থেকে এসে তিনজনের উদ্দেশ্যে বলে,
“তোমাদের মধ্যে ইমতিয়াজ কে?”
আহনাফও অবাক হয়। তিনজনের একজনকেও সে চেনে না।
“কতটা নি°র্ল°জ্জ হলে লা°শবাহী গাড়িতে করে পালাতে পারো।”
শরীফের ইশারায় বাকিরা এসে ওদেরকে ধরে ফেলে। আহনাফ জিজ্ঞাসা করে,
“কারা ওরা?”
শরীফ আড়চোখে তিনজনকে দেখে বলে,
“একজন রাঘব বোয়াল এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।”
আহনাফ কপাল কুঁচকে তাকালে শরীফ বলে,
“আসো, তোমাকে বলছি।”
আহনাফ গতরাতের কন্ঠ এটাই ছিল বুঝে যায়, সামিহাকে দরজা বন্ধ করার ইশারা করে শরীফের সাথে উপরে আসে।
সামিহার পিছন থেকে উঁকি দিয়ে এতোক্ষণ শরীফকে দেখেছে সারাহ্। এই লোক সবকিছু জেনে যায় কোথা থেকে? সব জায়গায় কিভাবে হাজির হয়? লোকটা ভালো নাকি খারাপ? কোনো হিসাবই সারাহ্-র মিলে না।
চলবে…..
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ঊনষষ্টি পর্ব (৫৯ পর্ব)
“আরিফার ডে°ডবডি ডিএমসির ম°র্গে রেখেছিল, ওরা তিনজন সেই লা°শ বের করার চেষ্টা করেছে। আজ ভোরে এই কাজ করার সময় আমার কাছে ধরা পড়ে পালিয়ে যায়।”
শরীফ আহনাফ সকল ঘটনাই বলেছে। ইমতিয়াজকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও বলা হয়েছে। তবে শরীফের কথা আহনাফের পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না। যদি ওরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পালায়, তবে এখানে কেন?
প্রশ্নটা করে বসতেই শরীফ জবাব দেয়,
“হুম, ওরা এখানে কেন এসেছে তা আমিও সঠিক জানি না। তবে গাড়ি নিয়ে ওরা এখানেই এসেছে। সম্ভবত শাফিনকে নিতে।”
আহনাফ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি সবকিছু এমন আগে আগে কিভাবে জেনে যান?”
শরীফ ওর কথায় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“বুদ্ধি থাকলেই হয়। কাল আরিফা মা°রা যাওয়ার পর, আমি আশপাশ নজরে রেখেছিলাম।”
আহনাফ মাথানেড়ে পাশে বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা শাফিনের দিকে তাকায়। বলে,
“সারাহ্-র উপরেও নজর ছিল নাকি?”
শরীফ উঠে শাফিনের কাছে গিয়ে বলে,
“না, তবে শাফিনের উপর ছিল। (একটু থেমে) আর নজর ছিল বলেই তোমার সারাহ্ বেঁচে আছে।”
আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ওহ, আচ্ছা। তবে সেদিন আপনার হাতে পি°স্ত°ল থেকেও এই শাফিন কিভাবে বেঁচে গেল?”
শরীফ অনেকটা রেগে যায়। শাফিনের ডানকাঁধ আহনাফের থেকে ঘুরিয়ে বলে,
“এখানে ক্ষ°তটা দেখছো? আমার গু°লি থেকে এটা হয়েছে।”
আহনাফ দুহাত বুকে বেঁধে বলে,
“ওকে বুঝলাম, কিন্তু কে ওই ইমতিয়াজ তা কিভাবে বের করবেন? এমনও হতে পারে ইমতিয়াজ বলে আসলে কেউ নেই, সেটা একটা ছদ্মনাম।”
শরীফ চিন্তায় পড়ে, আহনাফের কথা অবশ্যই সঠিক হতেই পারে। সেটা একটা ছদ্মনাম তবে কার? ডা. দীপের দিকে সন্দেহের তীর যায়, আবার সামনে বসে থাকা তিন বান্দার দিকেও চোখ পড়ে।
শাফিন ফ্লোরে শুয়ে হাসতে হাসতে বলে,
“ইমতিয়াজদের বের করা তোমার কাজ নয়। যে ইমতিয়াজকে চিনো তাকেই নাহয় পাকড়াও করো।”
আহনাফ প্রথম তার কথা গুরুত্ব না দিলেও পরক্ষণেই মনে হয় ইমতিয়াজদের মানে কি? সে উঠে শাফিনের কাছে গিয়ে বসে বলে,
“ইমতিয়াজ একজন নয়?”
শাফিনের মুখটা চুপসে গেল। বোঝা যাচ্ছে সে ভুলবশত কথাটা বলে ফেলেছে। আহনাফ একটু হেসে বলে,
“মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে? আহারে, বেচারার চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে।”
আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে একটু জোরেশোরে বলল,
“একে বাঁচিয়ে রেখে কি করবেন? এমনিতেও সে কিছুই বলবে না, মে°রে ফেলেন।”
শরীফ সোফায় বসে বলে,
“থাকুক কিছুক্ষণ বেঁচে, এতো জলদি ম°রলে হবে। যদি আবার মুখ ফসকায়।”
আহনাফ রাগে গজগজ করতে করতে পা দিয়ে শাফিনের চোখ চেপে ধরে বলে,
“যে মেয়েটা আমার সামনে লজ্জায় নুয়ে পড়ে তার গায়ে হাত দেয়ার চিন্তা কিভাবে করেছো? কিভাবে ওর দিকে দৃষ্টি দিয়েছো?”
শাফিন চিৎকার করতে শুরু করে। পায়ের আঙুল চোখসহ ভিতরে দিয়ে রাগে শরীরের শক্তি সেখানে প্রয়োগ করে আহনাফ। শাফিন পুরো শরীর নাড়াচাড়া শুরু করে। সাথে চলে আ°র্ত°নাদ,
“ছাড়ো আমাকে।”
চোখ থেকে র°ক্ত পড়া শুরু হয়। আহনাফ সরে আসে। মনে হয় না, এ চোখ আর ঠিক হবে। অপরূপা শাফিনের অবস্থা দেখে পিছনে যেতে শুরু করে, ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কোনোরকমে সে সরতে থাকে। এদিকে শাফিন চিৎকার শুরু করেছে।
“আপনি ঠিক কে? তা আমি এখনো বুঝিনি।”
শরীফকে কথাটা বলে আহনাফ দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
______________________________________
ফজরের পর ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দশটা প্রায় বাজতে চলল, অথচ ওদের ঘুম এখনো ভা°ঙলো না।
ঘুমের ঘোরে দুজনে কাছাকাছি চলে এসেছে। মৃত্তিকা সেই ইমতিয়াজের বুকেই মাথা গুজে ঘুমাচ্ছে। মৃত্তিকার উন্মুক্ত উদরে ইমতিয়াজের হাত লাগতেই ওর ঘুম হালকা হয়ে যায়।
চোখ খুলে ইমতিয়াজের এতো কাছে বুঝতে পেরে মাথা তুলে তাকায় সে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইমতিয়াজের চেহারার দিকে, তারপর তার গালে হাত দিয়ে কপালে, ঠোঁটে চুম্বন করে উঠে যায়।
মৃত্তিকা রুম থেকে বেরিয়ে গেলে ইমতিয়াজ চোখ খুলে। এতোক্ষণ সে জেগেই ছিল। উঠে বসে ঘড়ি দেখে চমকে উঠে। অফিসে তো যাওয়া দরকার ছিল।
মৃত্তিকা আবারো রুমে এসে ওকে দেখেও কথা না বলে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। নিজের মতো ফ্রেশ হয়ে সে নাস্তা তৈরি করে নেয়।
ইমতিয়াজ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এসে নাস্তার টেবিলে বসে। মৃত্তিকা চুপচাপ ওকে নাস্তা দিয়ে নিজের খাবার খেতে মনোযোগ দেয়। খাওয়া শেষে ইমতিয়াজ বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবারো ফিরে আসে।
মৃত্তিকাকে জোর করেই নিজের দিকে ঘুরিয়ে কাছে আনে। মৃত্তিকা আর কোনো জোরাজুরি করছে না। ইমতিয়াজ ওর কাছে এসেও আবারো চলে যায়। তার মন যে এখনো জমে আছে, কারণটা মৃত্তিকার করা অপমান।
______________________________________
সন্ধ্যা সাতটা, আহনাফের কাল চলে যেতে হবে। আবার শাফিন ওদের উপরের তলায় আছে, এটা জেনে তো যেতেও ইচ্ছা করছে না। কোনোভাবে যদি শাফিন ছাড়া পায় তবে সকালে ওর করা আচরণের বদলা নার্গিস পারভিন অথবা সারাহ্-র উপর দিয়ে যাবে।
সামিহার সাথে রান্নার কাজ করছে সারাহ্। রান্নাঘর থেকেই বেরিয়ে আহনাফকে বাইরে যেতে দেখে সারাহ্ বলে,
“এই সময় কোথায় যাচ্ছেন?”
আহনাফ হাত দিয়ে বাইরের দিকে ইশারা করে বলল,
“এখানেই, চলে আসবো।”
সারাহ্ মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। আহনাফ হেসে বেরিয়ে যায়। সে নিচে না গিয়ে পাঁচতলায় শরীফের ফ্ল্যাটে এসেছে। দরজায় নক করলে শরীফ খুলে দেয়। সকালের পর তানজিম আর বাসায় নেই।
আহনাফ ভিতরে সে সকালের তিনজন ছেলেকে র°ক্তা°ক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বলে,
“আপনি কি আদৌতে ডাক্তার? আমার তো বিশ্বাস হয় না। কোনো ডাক্তার একজন মানুষকে এভাবে মা°রতে পারে?”
শরীফ সি°গা°রেটে টা°ন দিয়ে বেশ আরামে ধোঁয়া ছেড়ে বলে,
“ডাক্তার তোমার একটা পরিচয়। যখন রিপা ছিল, তখন এটা আমার আসল পরিচয় ছিল। এখন রিপা নেই, তাই এখন আমার আসল পরিচয় একজন মা°ফিয়া লিডার।”
আহনাফ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“মা°ফিয়ার লিডার? ভদ্রতা সব ক্ষেত্রে চলে না, মা°ফিয়া ড°ন বলে।”
শাফিনের এক চোখে ভারী ব্যা°ন্ডে°জের পট্টি, করে শুয়ে সে এখনো কিছু ছটফট করছে৷ আহনাফের ক্ষো°ভে ওর অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ হয়েছে তা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷
“নাম কি এদের?”
আহনাফের কথায় শরীফ জবাব দেয়।
“তকী, মনসুর আর ইমন।”
“এখানে কেন এসেছিল বলেছে?”
শরীফ একটু হেসে বলে,
“শাফিন এখানে তা জানতো না। তবে আমার বাসায় এসেছিল, আমাকে ধরতে।”
তিনজনের নামগুলো কয়েকবার জপে আহনাফ বলে,
“ইমন, মনসুর আর তকী৷ একটা ক্লু দেন তো।”
“ক্লু? কিসের ক্লু?”
“এদের নাম মিলিয়ে নিলে ইমতি হয়।”
পেছন থেকে কথাটা বলে ইমতিয়াজ নিজেই। দরজা খোলা থাকায় অনুমতি না নিয়ে সে ভিতরে প্রবেশ করেছে।
আহনাফ ওর দিকে ফিরে বলে,
“কারেক্ট, ইমতি।”
শরীফ কপাল কুঁচকে বলল,
“তার মানে ইমতিয়াজ কোনো একজন লোক না, কয়েকজন মিলে।”
“ইয়েস।”
শাফিন চিৎকার করে বলে,
“তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ। মা°রো এখন।”
কেউ শাফিনের কথায় তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। ইমতিয়াজ শরীফকে বলে,
“আপনি মৃত্তিকাকে নিয়ে বিবির বাজার গিয়েছিলেন। আমাকে সন্দেহ করেন ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে মৃত্তিকাকে নিয়ে এদিক-সেদিক চলে যাবেন, সেটা তো আমি এলাউ করব না।”
শরীফ ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“তুমি কি করে জেনেছো আমরা বিবির বাজার গিয়েছিলাম?”
“পেছনে যে একটা অফিসের গাড়ি গেছে তা হয়তো খেয়াল করেননি।”
“তারমানে আমাদের ফলো করেছো?”
“না, করিয়েছি। মৃত্তিকার পিএ শিল্পা গিয়েছিল।”
ওদের কথার মাঝেই দরজায় দুবার নক পড়ে। ইমতিয়াজ জোর গলায় বলে,
“কে?”
আরেকবার ধাক্কা দিয়ে জবাব আসে,
“দরজা খুলেন নাহয় ভে°ঙে প্রবেশ হবে।”
ইমতিয়াজ দরজা খুলে দেয়। গালিব তার পুরো টিম নিয়ে এবং সাথে র্যাবের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে বাসায় প্রবেশ করে।
একজন অফিসার বলেন,
“শাফিনকে এখানে আ°টকে রেখেছেন কেন? এই তথ্য লুকানোর জন্য আপনাদের জে°ল জরিমানা হতে পারে, জানেন সেটা?”
আহনাফ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আইন সেটাতে আসবেন না, অফিসার। আইনের জ্ঞান ভালোই আছে। আমাদের অন্তত আছে, আপনার নেই বা আপনাদের নেই। যদি থাকতো, তবে ওই আইনের ফাঁক গলে বারবার এরকম কেউ বাইরে আসতে পারতো না।”
অফিসার উত্তর দেয়,
“শাফিনকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে, তুলে না দিলেও আমরা নিয়ে যাবো।”
“শাফিনকে ক্র°স°ফায়ারের কথা বলেছিল?”
ইমতিয়াজের কথায় গালিব বলে,
“উপরতলা থেকে আদেশ এসেছে, তাকে জীবিত ধরতে হবে।”
ইমতিয়াজ হাত নেড়ে রাগিস্বরে বলল,
“তবে সে আবারো পালাবে। নিয়ে যান, সে পালাবে, আবারো খু°ন করবে, আবারো কোন নারীর শ্লীলতাহানি হবে।”
ওদের সামনে দিয়ে শাফিনকে নিয়ে যাওয়া হয়। ইমন, মনসুর, তকী- এই তিনজনকেও নিয়ে যায়। ঘর থেকে অপরূপা আর মমতাজ বেগমকেও নিয়ে যায়। শরীফ সকলের পিছু পিছু বের হয়ে যায়।
ইমতিয়াজ বলে,
“আমি বলেছিলাম শাফিনের মৃ°ত্যু আমার হাতে হবে। আমি এতো সহজে কথার খেলাপ করবো না, ও আজ ম°রবে আর না হলে কাল এর বেশি দেরি হবে না।”
রাস্তায় গাড়িতে তোলার সময় ইমন, মনসুর ও তকী- তিনজনকে নিশানা করে মোট ছয়টা গু°লি চালায় শরীফ, তারপর পালিয়ে যায়। ওকে ধরা সহজ নয়, সত্যিই পালিয়ে গেল।
নিচে এসে এই ঘটনা দেখে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছে আহনাফ ও ইমতিয়াজ। এতটা ওরা কখনোই আশা করেনি। এখানে, বাসার সামনে, এভাবে শরীফ কাউকে মে°রে দিয়ে চলে যাবে, এটা সত্যিই ওদের কল্পনাতীত।
তবুও ওদের লা°শ নিয়ে যাওয়া হয়। শাফিন, অপরূপা আর মমতাজ বেগমকে দ্রুত গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
ইমতিয়াজ অফিসের গাড়িতে উঠে আহনাফকে বলে,
“তুমি বাসায় থাকো। বলা যায় না, এখানে আর কখন, কি হয়?”
“হুম, শরীফ সাহেব কি পাগল হয়ে গেলেন?”
“হয়তো।”
ইমতিয়াজ ওদের পিছু নেয়।
আহনাফও এখন এখান থেকে চলে যাওয়াটা নিরাপদ মনে করছে না, তাই সে বাসায় থাকে। শাফিনের আরো লোকজন বাইরে আছে, পাছে কখন হা°মলা হয় তার ভ°য় আছে।
বাসায় আসতেই দেখে সবাই ভী°ত। গু°লির শব্দ ওরা পেয়েছে। আহনাফ সকলকে কোনোমতে বুঝিয়ে তুমি এসে দেখে সারাহ্ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
বারান্দা থেকে রাস্তার দৃশ্য দেখা যায়, সে সবটাই দেখেছে। আহনাফ রুমে আসতেই দূরে গিয়ে থাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।
“তুমি না এতো সাহসী মেয়ে, তবে কেন কাঁদছো?”
সারাহ্-র কান্না থামে না। থামার কথাও নয়, চোখের সামনে তিন-তিনজন মানুষ, একই সাথে মৃ°ত লা°শে পরিণত হয়েছে। বিষয়টা চোখে দেখার পর শান্ত থাকা কঠিন।
______________________________________
সকাল আটটা চল্লিশ মিনিট, হাসপাতালে এসে দীপের চেম্বারে যায় শরীফ। চেম্বারে ঢোকার সময় সে শুনতে পায়, দীপ কারো সাথে কথা বলছে,
“শাফিনকে এনি হাও বের করে আনো। শরীফ ওকেও মা°রার চেষ্টা করবে।”
শরীফ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বলে,
“আর তোমাকেও।”
চমকে উঠে পিছনে ফিরে দীপ। ফোন লাইনে রেখেই বলে,
“কি বলছেন?”
“যা শুনেছো।”
শরীফ আর সময় নষ্ট করে না। ছু°ড়ি বের করে দীপের গলায় ধরে ফোনে দেখে নিয়াজী নামে কারো সাথে সে কথা বলছিলো।
শরীফ জিজ্ঞাসা করে,
“কে এই নিয়াজী?”
“এডভোকেট বিথীর ভাই।”
“আরিফার অক্সিজেন সিলিন্ডার ফু°টো করেছে কে?”
“সিলিন্ডার ফু°টোই ছিল, গ্যাস বের হতে যা সময় লাগে তাই লেগেছে।”
ব্যস, আর কোনো কথা শুনতে শরীফ প্রস্তুত নয়। ছবিটা বেশ গভীর করে দীপের গলায় চালিয়ে নিয়ে। কা°টা মুরগির মতো ছটফট করে তার চোখদুটো অজানার পানে স্থির হলো।
তারপর ফোন হাতে নিয়ে নিয়াজীর উদ্দেশ্যে বলে,
“শাফিনকে আজ কোর্টে আনবে, চলে এসো।”
আহনাফের মতো সূত্র মিলিয়ে শরীফ বুঝে ফেলে নিয়াজীর নাম থেকেই ‘ইমতিয়াজ’ নামক গুচ্ছ নামটা এসেছে।
______________________________________
“আপনাদের চোখের সামনে দিয়ে শাফিনকে নিয়ে গেল। আপনারা শুধুই কি করলেন? চেয়ে চেয়ে দেখলেন। আমি চেয়েছিলাম, তার সামনে অপরূপাকে মে°রে তারপর তাকে মা°রতে। ঠিক যেভাবে মামকে মেরেছিল, সেভাবে সে ম°রতো।”
মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ কোনো জবাব দেয় না। দুজনেই কোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে৷ গতরাতে এই ঘটনা শোনার পর মৃত্তিকা অনবরত একই কথা বলে যাচ্ছে। মৃত্তিকা এখনো ইমতিয়াজের নাম নিয়ে বানানো গুচ্ছের কথা জানে না, তাই সে এখনো একে রহস্যই মনে করছে।
এদিকে বুলেট প্রুফ কালো গাড়িতে করে শাফিন ও মমতাজকে কোর্টে নিয়ে আসা হয়েছে। গাড়ির কাচগুলোও কালো, বাইরে থেকে ভিতরের কিছু দেখার উপায় নেই।
গালিব এসবে আর তুমি রাজি ছিল না। কিন্তু নিজের চাকরির খাতিরে, তাকে রাজি হতে হয়েছে। কিন্তু তার মনে এখনো একটাই প্রশ্ন ঘুরছে, ওর এই চাকরিটা কেন? অপরাধীদের শা°স্তি দেওয়ার জন্যই তো, তবে সে কেন জেনেবুঝে অপ°রাধীদের ছেড়ে দিচ্ছে?
অবশেষে ওরা কোর্টে পৌঁছায়। মৃত্তিকাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে ইমতিয়াজ হেঁটে একটু দূরে এসে দাঁড়ায়। কালো গাড়িতে শাফিন আছে, এটাই ওর টার্গেট।
শরীফ সকলের মাঝে লুকিয়ে আছে। কালো গাড়িটাকে সেও নিশানাতে রেখেছে।
আহনাফও এখানে এসেছে। গালিবের উপর তার প্রচুর রাগ, সাথে প্রশ্ন জমে আছে। শাফিনের খোঁজ ওরা কি করে পেল? এতোদিন না পেয়ে কাল হঠাৎ কিভাবে?
এরমধ্যে তানজিম এসে হাজির হয়।
“কি অবস্থা ভাইয়া?”
আহনাফ মাথা নাড়ে। মেজাজ যে গরম আছে তা বোঝা যাচ্ছে। আহনাফ বলে,
“কি হলো এতদিন এত কিছু করে? সেই উপরতলার লোকজন শাফিনের সঙ্গই দিচ্ছে।”
“তুমি এ কথা বলছো। তবুও তো শাফিন ধরা পড়েছে। দেশে এমন অনেক কে°ইস আছে, যেখানে আ°সামি কে তাই জানা নেই।”
“গালিব জানলো কি করে শাফিনের খোঁজ?”
তানজিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমার মাধ্যমে জেনেছে। কাল ওরা হাসপাতাল থেকে লোকগুলোকে অনুসরণ করেছে। আর তাতেই ধরে ফেলেছে। (একটু থেমে) আরিফা একজন যাবজ্জীবন দ°ণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল। ওর যেহেতু মৃ°ত্যু হয়েছে, তবে ওখানে অনেক পুলিশের লোকজন ছিল। এইটুকু তো বোঝা উচিত ছিল শরীফ আংকেলের।”
“তুমি কেন বলেছো?”
আহনাফের কথায় রাগ স্পষ্ট। তানজিম জবাব দেয়,
“উপায় ছিল না। ধরে নিয়ে গিয়েছিল।”
হঠাৎ করে শোরগোল বেড়ে যায়। শাফিনের গাড়িটা বে°প°রোয়া ভাবে ছুঁটে চলছে। সকলের মাঝ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভারকে বাইরে ফেলে গাড়িতে উঠে বসেছে ইমতিয়াজ। দ্রুত গতিতে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে আঁকাবাঁকা পথে সে গাড়ি নিয়ে পালায়।
“তোমাকে বলেছিলাম শাফিন, মৃ°ত্যু তোমার আমার হাতে। মৃত্তিকার ইচ্ছানুযায়ী ওর মামের মতোই ম°রবে তুমি।”
ডানহাতে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ রেখে, বামহাতে ছু°ড়িটা নিয়ে শাফিনের দিকে ছুঁ°ড়ে মা°রে। মমতাজ বেগম চিৎকার করে উঠে, হাত বাঁধা তার, কিছুই করতে পারে না। শাফিনের বুকে ছু°ড়িটা লেগে যায়।
সামনে একটা চৌরাস্তা দেখে ইমতিয়াজ দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে। পিচঢালা রাস্তায় পড়ে বেশ অনেকটা পথ গড়িয়ে যায় সে। তার র°ক্তে পুরো রাস্তা রঞ্জিত হয়ে পড়ে। দূর থেকে ভেসে আসা সবগুলো চেঁচামেচির মাঝে সে মৃত্তিকাকে খুঁজতে খুঁজতে জ্ঞান হারায়।
গাড়িটা রাস্তার ব্যবধায়ক পেরিয়ে অপরপাশে গিয়ে আ°ছড়ে পড়ে। ধোঁয়া উঠা শুরু হয়েছে। ভিতরে কেউ বেঁচে আছে কিনা বোঝা মুশকিল। তবে ভিতরের দুজনের মধ্যেই প্রাণের অস্তিত্ব খানিকটা এখনো রয়েছে।
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ষষ্টি পর্ব (৬০ পর্ব)
রাত অনেক হয়েছে। ঘরের সব কাজ সেরে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে শারমিলি। ছোট বাচ্চাটা এখনো কাঁদছে। তাকে কোলে তুলে শান্ত করে, শারমিলি তার কপালে চুমো দেয়।
দেড় বছরের মেয়ে তাহমিনা এখনো টিভি দেখছে। বাসায় নতুন রঙিন টিভি এসেছে। এসব তো এখনো বড়লোকদের জিনিসপত্র, কিন্তু লুৎফর তার মেয়ের জন্য নিয়ে এসেছে।
বাচ্চাকে দুগ্ধ পান করানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গলা ছেড়ে বড় মেয়েকে ডাকে শারমিলি,
“তাহমিনা মা, ঘুমাতে এসো।”
ওদিক থেকে কোনো জবাব আসে না। তবে দরজা খুলে ভিতরে আসে মমতাজ বেগম।
তাহসিনাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে শারমিলি। বেশ আরামেই তাহসিনা মাতৃদুগ্ধ পান করছে।
“আরে, মমতাজ যে। বসো, উনি এখনো আসেনি?”
মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে বলল,
“না, লুৎফরের আসতে আজ দেরি হবে।”
“ওহ, জেগে থাকবে তুমি?”
“তুমি যেহেতু শান্তিতে ঘুমাবে, তাই আমাকে জেগে থাকতেই হবে।”
শারমিলি মুচকি হেসে বলে,
“আরে না, আমিও জেগে থাকতে পারবো।”
“কিন্তু আমি তোমাকে জেগে থাকতে দেবো না।”
মমতাজ বেগমের চোখের চাহনি শারমিলির খুব একটা সুবিধাজনক লাগে না। তাহসিনাকে সে আগলে নেয়। সরে যাওয়ার সুযোগ না দিয়েই মমতাজ বালিশ নিয়ে শারমিলির নাকে মুখে চেপে ধরে। দুইহাতে তাহসিনাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় পা আ°ছড়াতে আ°ছড়াতে শান্ত হয় সে।
বালিশ সরিয়ে খোলা চোখদুটো বন্ধ করে মমতাজ। তাহসিনাকে নিজে নেড়েচেড়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। শারমিলিকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে যায়, যেন মনে হয় সে ঘুমাচ্ছে।
নিরবে একটা খু°ন করে মমতাজ বেগম। ভাবখানা এমন যেন কেউ কিছুই দেখেনি, তবে দেখেছে একজন। সেই আল্লাহ্, তিনি সর্ব বিষয়েই অবগত।
কোরআনের আয়াত কি একবারও তার মনে হয়নি?
“তোমরা কি মনে করো যে,
(হিসাব-নিকাশ ছাড়াই) তোমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে?” (সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ৩৬)
মমতাজ বেগম চমকে উঠে চোখ খুলেন। নিজেকে তিনি হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করেছেন। এতক্ষণ তবে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, নিজের পা°পের স্বপ্ন। কতটা ভ°য়াবহ হতে পারে, যদি আমরা নিজের সামনে নিজের করা পাপগুলোকে দেখতে পাই? এইটুকু চিন্তা করার মত সময় কি হবে?
শাফিন ও মমতাজকে একটা আইসিইউতে রাখা হয়েছে। একটা ক°ড়াকড়ি নিরাপত্তা চাদরে শাফিনকে আবৃত করে রাখা হয়েছে। সে এমন একজন আসামী, যাকে যেকোনো সময় যেকোনো কেউ মে°রে ফেলতে পারে।
ইমতিয়াজকে কেবিনে রেখেছে, অবস্থা গুরুতর নয় আবার খুব একটা ভালোও নয়। কাচের জানলা থেকে মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে দেখে। নিজের জীবনের এতোবড় ঝুঁকি সে কেন নিলো? চোখদুটো কেঁপে উঠলো মৃত্তিকার, সেখানের সমুদ্র থেকে কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো।
নার্স এসে মৃত্তিকাকে বলল,
“আপনার হাসবেন্ড আপনার সাথে দেখা করতে চায়। খুব ধীরে উনার সাথে কথা বলবে।”
ইমতিয়াজের জ্ঞান ফিরেছে, সঙ্গে সঙ্গেই সে মৃত্তিকার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। দ্রুত পায়ে ভিতরে আসে মৃত্তিকা।
ইমতিয়াজের কাছে যেতেই ইমতিয়াজ ওকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ইমতিয়াজকে একদম স্বাভাবিক লাগছে।
ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“শাফিন কি জীবিত?”
মৃত্তিকা প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“আপনি ঠিক আছেন?”
“হুম, শাফিনের খবর কি?”
“বেঁচে আছে আর ক°ড়া নিরাপত্তায় আছে।”
ইমতিয়াজ কিড়মিড়িয়ে উঠে,
“ইশ, আবারো বেঁচে বেরিয়ে গেল। একটা কাজ করতে পারবে?”
“কি?”
আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে দাও, আমি মা°রা গেছি।”
মৃত্তিকা অবাক হয়। এতক্ষণ ধরে তবে ইমতিয়াজ অসুস্থতার নাটক করেছে।
“আমি এতটা আহত হইনি যতটা হলে আমাকে আইসিউতে থাকতে হবে।”
মৃত্তিকা ওর গালে হাত দেয়।
“নিজেকে মৃ°ত কেন প্রুভ করতে চাইছেন?”
“কারণ জীবিত কেউ এখন শাফিনকে আর মা°রতে পারবে না, মৃ°ত কেউ পারবে।”
এমন মুহূর্তে ডাক্তার সুস্মিতা ভিতরে আসে, উনার সাথে পল্লবীও আছে। পল্লবী এসেছে ইমতিয়াজকে দেখতে।
“আপনি এখানে কি করছেন?”
মৃত্তিকাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে সুস্মিতা। ইমতিয়াজ হাতের ইশারায় উনাদেরকে চুপ থাকতে বলে। তারপর নিজের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বললে দুজনেই তাতে রাজি হয়।
সুস্মিতার রাজি হওয়ার কারণ একজন জেল পলাতক আ°সামিকে সে কখনোই চিকিৎসা করতে রাজি নয়। শাফিনের নি°কৃষ্টতা সম্পর্কে সে পুরোপুরিভাবে অবগত আছে।
পল্লবী একটু ইতস্তত করেই রাজি হয়। ইমতিয়াজকে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করে সাদা চাদরে ঢেকে দেয়া হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের বেগে একটা কথা ছড়িয়ে গেল,
“ইমতিয়াজ মা°রা গেছে।”
শো°কে কাতর হওয়ার নাটকটা মৃত্তিকা ভালোই সামলে নিয়েছে। ইমতিয়াজকে নিয়ে যাওয়া হলো মর্গে। স্থবির হয়ে থাকা মৃত্তিকার পাশে এসে দাঁড়ায় সুরভি।
“একজন লোকের কারণে আর কতজন মা°রা যাবে? আর কতটা মন ভা°ঙবে?”
সুরভির কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্তিকা। তারপর সে বেরিয়ে যায়। এখন ইমতিয়াজের কথা মতো কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে ইমতিয়াজকে সেই অন্ধকার লা°শঘরে রাখতেও তার মন মানে না।
আসরের নামাজ পড়ে হাসপাতালে ফিরে এসেই ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর সংবাদ পায় আহনাফ। লুৎফর রহমান, তানজিম এখানে থাকলেও মৃত্তিকা নেই।
আহনাফের কপাল কুঁচকে গেল, স্বামী মা°রা গেছে স্ত্রী কোথায়। আর তাছাড়া ইমতিয়াজের অবস্থা এমন কোনো খারাপ হয়নি যে সে মা°রা যাবে। তবুও যদি ধরে নেয় মা°রা গেছে, তবে এতো দ্রুত কেন ম°র্গে নিয়ে গেল।
______________________________________
শরীফের ধানমন্ডির বাসায় এসেছে মৃত্তিকা। বিথীর কাছ থেকে পাওয়া সকল কাগজপত্র সে ভালো করে দেখছে। ঠিকই এসব ঘেটেঘুটে সে কিছু নাম পেল, সাথে ফোন নাম্বার, ঠিকানা ও ছবি।
জামিল, কবির, দুলাল, হুমায়ুন, ইমন, তকী, মনসুর- এরা সবাই মা°রা গেছে। মৃ°তের তালিকা এতোই বড় যে জীবিত কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। অবশেষে পেল ডা: দীপের নাম্বার। কল দিয়ে জানতে পারলো, তাকেও আজ সকালে তারই চেম্বারে কেউ মে°রে ফেলেছে।
অবশেষে পেল আরো একটা নাম্বার নিয়াজী। কল করতে রিসিভ করে এক পুরুষ। মৃত্তিকা গলা ঝেড়ে বলল,
“মিস্টার নিয়াজী সাহেব বলছেন?”
“জি, বলছি।”
“আপনি ফ্রি থাকলে কিছু কথা বলতাম।”
“আমি ব্যস্ত।”
কল কে°টে গেল। মৃত্তিকা ঘেটেঘুটে আর কোনো নাম্বার পেল না। এরমধ্যে ইমতিয়াজ কল দেয়।
“ইমতিয়াজ? আপনি ঠিক আছেন?”
“হ্যাঁ, ঘুম ভাঙলো। পেলে কিছু?”
“হুম।”
“জলদি এসো, এতো এতো লা°শের মাঝে আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”
ইমতিয়াজ ফোন রাখার সাথে সাথেই মৃত্তিকা নিয়াজীর তথ্যগুলো সংগ্রহ করে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে নিয়ে অপরূপার সামনে পড়ে, সাথে দুজন অচেনা লোক। এতো লোকের মাঝ থেকে অপরূপার উধাও হওয়াটা কি কেউ খেয়াল করেনি?
দরজা লাগিয়ে ঘুরতেই অপরূপাকে দেখে সে। কোনোরকমে ওদের ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে মৃত্তিকা পালিয়ে যায়। দ্রুত বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে। পেছনে হয়তো অপরূপা আছে।
তবুও সে হাসপাতালে ফিরে আসে। সুস্মিতার সাহায্য নিয়ে ম°র্গে এসে পৌঁছায়। ওকে পৌঁছে দিয়ে সুস্মিতা অন্যদিকে যায়।
দরজা লাগিয়ে ভিতরে এসে এতোগুলো লা°শ দেখে সে ঘাবড়ে যায়। সারি সারি ফ্রিজ আর তার উপর লাগানো নাম্বার আর নাম। সামনে কয়েকটা নতুন লা°শ, এরা হয়তো ফ্রিজে জায়গা হয়নি।
নিচুস্বরে ডাকে,
“ইমতিয়াজ।”
ইমতিয়াজের সারাশব্দ না পেয়ে মৃত্তিকা একে একে লা°শগুলো দেখতে শুরু করে। হঠাৎ হাতে টা°ন পড়ার লাফিয়ে সরে যেতে নিলে ইমতিয়াজ মুখের কাপড় সরিয়ে বলে,
“জোরে ডাকবে তো, ঘুমিয়ে গেছিলাম।”
মৃত্তিকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“পাগল আপনি? এভাবে কেউ হাত ধরে?”
ইমতিয়াজ উঠে বসে। বলে,
“বেশ ঠান্ডা লাগছে। (একটু থেমে) কি পেয়েছো তাই বলো।”
কাগজগুলো দিয়ে বলে,
“একজনই জীবিত আছে, নিয়াজী। ডা: দীপও আজ মা°রা গেছে।”
“তোমার বাবাই বোধহয় মে°রেছে, লোকটা পাগল হয়ে গেছে এক কথায়।”
মৃত্তিকা ওর হাত টে°নে বলে,
“বাইরে চলুন, আমার এখানে ভালো লাগছে না।”
ইমতিয়াজ শরীরের উপর থেকে চাদর সরায়। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ করা। চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গড়িয়ে গেছে, পায়ের উপর দিয়েই পুরো ধকল গেছে তার। হাতের অবস্থাও খুব একটা ভালো না।
“আমি হাঁটতে পারবো না, তোমাকে যেতে হবে।”
“এখানে আপনাকে রেখে আমি যাবো না।”
“বোঝার চেষ্টা করো, আমি বের হবো কি করে এখান থেকে?”
“যেভাবে ডেডবডি বের হয়।”
ইমতিয়াজ আবারো ধপাস করে শুয়ে পড়ে। মৃদু হেসে বলল,
“কি দিনকাল পড়লো? আমার বউ নাকি আমাকে কা°ফন পড়াবে?”
“এখনো আপনি মজা করছেন?”
ইমতিয়াজ ওকে টা°ন দিয়ে নিজের উপরে ফেলে বলে,
“একটু মজা করলেও দোষ?”
“এটা ম°র্গ ইমতিয়াজ।”
“আমি জানি।”
মাথা একটু উঁচু করে মৃত্তিকার নরম ঠোঁটে অধিকার বসায় ইমতিয়াজ। শীতল কক্ষে এমন উষ্ণ ছোঁয়ায় মৃত্তিকা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইমতিয়াজের শরীরে থাকা নরম কাপড়টা খা°মচে ধরে সে, ওর নখের আঁ°চড় ইমতিয়াজের গায়েও খানিক পড়ে।
কিছুক্ষণ পর সুস্মিতা ভিতরে আসে। শব্দ শুনে দুজনে সরে যায়। বিষয়টা বুঝেও সুস্মিতা এড়িয়ে গেল, সবকিছু তো আর পাত্তা দিতে নেই।
সুস্মিতা ইমতিয়াজের সামনে একটা ব্যাগ রেখে বলে,
“তুমি এই পোশাক পড়ে নাও, তারপর বেরিয়ে যাও। মাস্ক দেওয়া থাকলে কেউ সহজে চিনতে পারবে না। আর এটা রেখো, হাঁটতে সুবিধা হবে।”
একটা ক্রাচ ওয়াকিং স্টিক ওকে দিয়ে শেষের কথাটা বলে।
ইমতিয়াজ তৈরি হয়ে নিলো। সাদা এপ্রোন, সার্জিক্যাল মাস্ক- সবকিছু মিলিয়ে তাকে একজন পারফেক্ট ডাক্তারের মত লাগছে। মৃত্তিকা আগে আগে বের হয়ে যায়।
পল্লবী এসে ইমতিয়াজকে বলে,
“বাস্তবতা বোঝার বয়স তোমার হয়েছে, এমন কিছু করো না যাতে সারাজীবন পস্তাতে হয়।”
ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। পল্লবী আবারো বলে,
“দেখো, শরীফ ভাইয়ের অবস্থা। উনার রাগের বশবর্তী হয়েই আজ তার এ অবস্থা হয়েছে। পাগল প্রায় হয়ে আছে সে। একের পর এক খু°ন করছে, নিজের জীবন ধ্বং°স করছে সে। জেনেবুঝে ধ্বং°স করছে। (একটু থেমে) তুমি এমনটা করো না, মৃত্তিকার জন্য ধৈর্য ধরো। আর তা নাহয়, নিজের সন্তানের জন্য তো করো।”
ইমতিয়াজ শক্ত কন্ঠে বলে,
“আমি জানি, আমি কি করছি। আমাকে বাচ্চা মনে করবেন না। আপনারা সাবধানে থাকবেন।”
ইমতিয়াজ হনহনিয়ে বের হয়ে যায়। চতুর্থ তলায় আহনাফকে দেখে তার সামনে গিয়ে বলে,
“নিচে আসো।”
চট করে কন্ঠটা ধরে ফেলে আহনাফ। এটা ইমতিয়াজ ছাড়া কেউ নয়। কথামতো নিচে চলে যায় সে।
অফিসের গাড়ি তৈরি আছে, আহনাফ আসলে ইমতিয়াজ জানলা থেকে ওকে বলে,
“বসো।”
শিল্পা ইউনুস গাড়ি চালানো শুরু করে। আহনাফ অবাক হয়, ভিতরে সে এক কথা শুনলো আর এখন অন্যকিছু দেখছে।
ইমতিয়াজ তাকে বলে,
“তুমি মৃত্তিকাকে নিয়ে নিয়াজীর এড্রেসে যাবে। নিয়াজী সেখানে আছে কিনা শুধু সেটাই দেখবে। আমি যেতে পারবো না, কারণ সবার চোখে আমি মৃ°ত। নিয়াজী তোমরা তিন জায়গায় খুঁজবে, এক তার বাসা, দুই অফিস আর শিল্পা হাসপাতালে থাকবে।”
আহনাফ কপাল কুঁচকে বলল,
“কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে না এটা অসম্ভব একটা কাজ।”
“হতে পারে, তবে আমি একটা পরিকল্পনা করেছি।”
“কি?”
“তোমরা দুজন নিয়াজীর খোঁজ বের করবে, নিয়াজীর থেকেই জানা যাবে এখানে আর কেউ যুক্ত আছে কিনা। না থাকলে ভালো আর থাকলে তাদেরকেও ধরতে হবে। তবে চিন্তার কারণ শাফিন।”
ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ একটা মৃত্তিকার দিক তাকিয়ে বলে,
“শাফিনের বুকের ডানপাশে ছু°ড়ি লেগেছে, বামদিকে লাগলে তখনই মা°রা যেতো।”
“সেটাই বলছি, ও যেন কোনোভাবেই বেঁচে না বের হয়।”
মৃত্তিকা ওদের কথা মাঝে বলল,
“অপরূপা তো পালিয়েছে। আমার পিছু পিছু বাসায়ও গিয়েছিল।”
“ওই মেয়ে যেভাবেই হোক পালাবে, এটা জানা ছিল। কিন্তু সে শাফিনের কাছে যাবেই যাবে।”
পরিকল্পনা এবারে কিছুটা পাকাপোক্ত, তবে কতটুকু কাজ করবে সেটাই দেখার পালা।
______________________________________
নিয়াজীর বাসায় সে নেই, তার অফিসেও তাকে পাওয়া যায়নি আর নাম্বারটাও বন্ধ। রাতে হতাশা নিয়েই আহনাফ ও মৃত্তিকা হাসপাতালে আসে। তবে এখানে ওরা নিয়াজীকে খুঁজে পায়।
শাফিনের আইসিইউর সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের মাঝ থেকে ওকে নেয়া যাবে না। ওরা একটা দূরত্বে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পরই নিয়াজী ভিতরে যায়। ইমতিয়াজকে কল করে গাড়ি তৈরি রাখতে বলে মৃত্তিকা।
শাফিনকে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। মমতাজ বেগম নিজের বিছানায় আছে। নিয়াজী তাকে বলে,
“কি হলো আপা? কিছু না। তোমার ভাই এবারে ফেল, কতগুলো বাচ্চার কাছে ফেল। কি ভাবছো? আমি তোমাদের বাঁচাবো? আমার নিজের প্রাণের ভ°য় আছে।”
মমতাজ নিষ্প্রাণ হয়ে তাকিয়ে বলল,
“তোমরা যে স্বার্থপর তা আমি জানি।”
“এতোকিছু কি স্বার্থের জন্য করোনি?”
“আমরা প্রতি°শোধ নিতে চেয়েছি আর তোমরা ধনী হতে চেয়েছো।”
নিয়াজী শাফিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“শাফিনকে কে বাঁচায় তা আমিও দেখবো।”
নিয়াজী বেরিয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে বাইরে আসতেই আহনাফ হেসে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
“রেগে আছেন আংকেল?”
নিয়াজী ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কে আপনি? কি সমস্যা?”
“কোনো সমস্যা না, তবে ভাবছিলাম একটু ফিজিক্স পড়ানো যেতেই পারে।”
“মানে?”
“এই যেমন আপেল কেন মাটিতে পড়ে? কিন্তু চাঁদ কেন পড়ে না?”
“আজাইরা পেঁচাল।”
নিয়াজী চলে যাওয়ার আগেই মৃত্তিকা গাড়ি নিয়ে আসে। দরজা খুললে তাকে জোর করে ভিতরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়া হয়। সুঠাম দেহী আহনাফ আর ইমতিয়াজের মাঝে তাকে বসানো হয়েছে।
নিয়াজীকে ইমতিয়াজের বাসায় আনা হয়েছে। এমনকি শিল্পাকেও বাসায় পাঠানো হয়নি, কাউকে একা ছাড়া যাবে না। বিশ্বাস নেই কারো উপর।
নিয়াজীর চেহারা আর শারিরীক ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে ধরা পড়েও কোনো চিন্তা নেই, সে হয়তো ধরেই রেখেছিল সে ধরা পড়বে।
“কি জানতে চাও তোমরা? একে একে অনেককেই তো ধরেছো, সবাই ছাড়া পেয়েছে।”
নিয়াজীর কথায় ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“কেউ কেউ চিরস্থায়ী ছাড়া পেয়ে উপরে চলে গেছে। মানুষের জীবনের মূল্য তোমাদের কাছে এতোই কম যে চাইলে কাউকে মে°রে ফেলতে পারো?”
নিয়াজী সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“শরীফও বহু মানুষকে মে°রেছে। মা°স্তানি তো সেও করছে।”
আহনাফ দুই পকেটে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে নিয়াজীর পেছনে গিয়ে তার ঘাড়ে পা দিয়ে মাথা নিচু করিয়ে বলল,
“ওসব বাদ দাও, আগে বলো তোমরা ছাড়া আর কে কে এখানে আছে।”
“ইমতিয়াজ আছে আর ইমতিয়াজ।”
“ঠিক ঠিক করে বলো।”
নিয়াজী হেসে বলল,
“ইমন, মনসুরকে মে°রেছে, তকীকেও মে°রেছে। বাকি আছি আমি, আমাকেও মা°রবে। মুখ খুললেও মা°রবে আর না খুললেও।”
ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে বলল,
“সত্য বললে কেউ মা°রবে না। প্রাণে বেঁচে যাবে।”
আহনাফ চিৎকার করে আরেকটু জোরে পা দিয়ে চেপে বলল,
“বলো, কে ওই পঞ্চম ব্যক্তি?”
মৃত্তিকা পাশের রুমে চলে যায়। নিরবে সে শিল্পার সাথে বসে থাকে, শরীর এখন আবারো খারাপ লাগছে।
নিয়াজী শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
“এখনো বুঝোনি, কে পঞ্চম ব্যক্তি? পঞ্চম বলে কেউ আসলে নেই। আমরা পাঁচজন মিলে ইমতিয়াজ নাম তৈরি করেছি, তাই পঞ্চম বলা হয়।”
ইমতিয়াজ আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাঁচজন মানে? আর কে আছে?”
“দীপ।”
নিয়াজীর কথায় আবারো ইমতিয়াজের প্রশ্ন,
“আমার নাম কেন ব্যবহার করা হয়েছে?”
“নামটা মিউকোর বিয়ের পর হয়েছে। শাফিন চেয়েছিল মিউকো তোমাকে মে°রে ফেলুক। এতোদিনে তা হয়েও যেতো যদি শরীফ বাধা না দিতো।”
আহনাফ চোখ ছোট করে বলে,
“ওর কথা বিশ্বাস করবো?”
“পুরোপুরি তো কখনোই না, তবে শোনা যায়।”
নিয়াজী আবারো হেসে উঠে। বলে,
“শরীফকে আগে থামাও, তোমরা না মা°রলেও সে আমাকে মা°রবে।”
আহনাফ পা সরিয়ে নেয়। ইমতিয়াজ দেয়ালের সাথে ধা°ক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যতই সে ভালো থাকার চেষ্টা করুক, সে তো ভালো নেই। শরীরে অসংখ্য স্থান কেটেছে, ধীরে ধীরে য°ন্ত্র°ণা বাড়ছে।
পুরো রুম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। পিনপতন নিরবতা ছিন্ন করে নিয়াজী বলল,
“রিপার মৃ°ত্যুর কয়েকদিন পরই শরীফ জানতে পারে রিপা স্বাভাবিকভাবে মা°রা যায়নি, এটা দু°র্ঘ°টনা নয়। সে তখন থেকেই নিজের লোকজন যোগাড় করেছে। একে একে অনেক ছেলেপুলে তার সাথে কাজ শুরু করেছে। সবাই কি ডাকাত, মা°স্তান? না, বেশিরভাগ সাধারণ স্টুডেন্ট।”
দুজনে চোখ কুঁচকে তাকায়। এ কি শুনছে ওরা?
“শরীফ শাফিনকে সন্দেহ করছিল, তাই তো সে মিউকোকে মামার থেকে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করেছে। যখন মিউকো রাজি হয়নি, তখন সে তোমাকে (ইমতিয়াজকে ইশারা করে বলে) চিঠি দিয়েছিল। সে জেনে গিয়েছিল ওরা মিউকোকে মা°রতে চায়।”
ওদের অবাক মুখে আরেকটা কথা ছুঁ°ড়ে নিয়াজী,
“সারাহ্-র বাসায় ইমতিয়াজের সাথে বিয়ের প্রস্তাব কে নিয়ে গিয়েছিল? আমি নিয়েছিলাম। জাহাঙ্গীর সাহেব রাজি হয়নি, কিন্তু শাফিন চেয়েছিল সারাহ্-র বিয়ে ইমতিয়াজের সাথে হোক। (একটু থেমে) ভেবেছিল, ইমতিয়াজকে অনুরোধ করবে বউ নিয়ে শাফিনের সাথে থাকার জন্য, এতে নার্গিসকে ব°শ করা সহজ হতো।”
ইমতিয়াজ চোখ কুঁচকে বলল,
“উনার সাথে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, তুমি তো মেয়ের ছবিই দেখোনি। সারাহ্ দুইবছর পর তোমাকে দেখেই চিনে নিলো, অবাক হওনি সেদিন বাসে। পরে অবশ্য জামিলের কথায় আহনাফের সাথে বিয়ে হয়, কিন্তু এতে শাফিনের উদ্দেশ্য হাসিল হয় না।”
কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসার পথে সারাহ্-র সাথে দেখা হওয়ার খবর নিয়াজী কি করে জানে। সবকিছু খুলতে খুলতেও যেন পেঁচিয়ে যাচ্ছে।
নিয়াজী দাঁত কেলিয়ে বলল,
“বাসের একদম পিছনের সিটে দীপ আর ইমন ছিল। সেদিন সারাহ্-কে কি°ড°ন্যাপ করতে সেখানে ছিল ওরা, তোমার জন্য পারেনি।”
নিয়াজী কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে বলে,
“রোমির মেয়েকে কে মে°রেছে? শাফিন? উহু, দীপ মেরেছে। সম্পর্ক ছিল ওদের, মে°রে সম্পর্ক ভে°ঙেছে। মৃ°ত্যু কঠিন নয়, খুব সহজ।”
ইমতিয়াজ ফ্লোরে বসে পড়ে। এতো এতো ঘটনা ওদের জীবনে মিশেছে, অথচ সে এসব পাত্তাই দেয়নি।
“শাফিনের মৃ°ত্যু তোমাদের সবার মতো আমিও চাই। ওকে আমিই দোকানের কর্মচারী উমারকে দিয়ে হ°ত্যা করতে চেয়েছিলাম, পারিনি।”
আহনাফ ওর কাছে এসে বলল,
“শাফিনকে তুমি কেন মা°রতে চাও?”
নিয়াজী অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“কারণ শাফিন আমার সাথে বিশ্বাস°ঘা°তকতা করেছে।”
“কিভাবে?”
নিয়াজী জোরে জোরে বলে,
“কিভাবে আবার? আমি ওকে বিথীর খোঁজ দিয়েছিলাম, সব ধরনের সাহায্য করে রিপার করা কে°ইস থেকে বের করে এনেছিলাম আর সে কি করেছে? নিজে বের হয়ে আমাকে ফাঁ°সিয়ে জে°লে দিয়ে দিলো আর প্রাণের ভ°য়ে বিথী, আমার বোন, আমাকে বের করেনি। দুইবছর আমাকে জে°লে থাকতে হয়েছিল।”
ইমতিয়াজ আহনাফকে বলে,
“চিন্তা করো আহনাফ, দুইবছর জে°ল খাটার পরও ওই মানুষটার সাথে গিয়েই মিললো, আবার তিন তিনটা খু°নও করলো।”
“তিনটা না চারটা।”
ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আর কে?”
“একটা ছেলে, যখন ওদেরকে দুলালের রিসোর্টের রুমে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন সে পিছু ধরেছিল।”
দুজনে আবারো চুপ হয়ে যায়। কে জানে ওই ছেলেটা কে ছিল? তার কি বা দোষ ছিল?
“শাফিনের সাথে না মিললে হুমায়ুন, দুলাল আর জামিলের মতো সে আমাকেও মে°রে দিতো। এখন দীপ আবার ওকে বাঁচাতে বলে। পারলে ওকে আইসিইউর ভিতরেই মে°রে দিবো।”
“তবে সেটাই করো, যাও আর ওকে মে°রে দাও।”
ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ ওর দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ আবারো বলে,
“আমি চাই না, আমার সন্তানকে কেউ খু°নির সন্তান বলুক। যেমনটা এখন সুরভির সাথে হচ্ছে।”
ইমতিয়াজ আস্তেধীরে হেঁটে রুমে চলে যায়। আহনাফ নিয়াজীকে বলে,
“ইমতিয়াজ চাইলেও আমি তা চাই না। তোমাকে ছাড়লে তুমি শাফিনকে বাঁচিয়েও নিতে পারো।”
ইমতিয়াজ মৃত্তিকার কাছে এসে বলে,
“কাল তোমার বাবাকে খবর দাও, উনি সবকিছু এতো আগে আগে কিভাবে জানে তা আমাকে একটু শিখাবে।”
মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছু বলছে না সে। ক্ষ°তবিক্ষ°ত একটা দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। এতো কষ্ট কি তার সত্যিই প্রাপ্য ছিল?
______________________________________
রাত সাড়ে বারোটায় বাসায় এসেছে আহনাফ। বারবার ওর ফোনে কল করে ফোন বন্ধ পাওয়া সারাহ্-র মন অস্থির হয়ে আছে। আহনাফ বেল বাজানোর সাথে সাথে সে দরজা খুলে দেয়।
আহনাফকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। আহনাফ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“কি হলো? আবার সাইদার আম্মু এমন করছে কেন?”
“সাদাবের আব্বু ফোন বন্ধ রেখেছে তাই।”
সারাহ্ সরে দাঁড়িয়ে ওকে ভিতরে আসতে দেয়। আহনাফ ড্রইংরুমে বসে পকেটে হাত দিয়ে টের পায় ফোন এখানে নেই।
“আমার ফোন কোথায় গেল?”
সারাহ্ এসে বলে,
“কোথায় গেল মানে?”
“নেই। একটু তোমার ফোনটা আনো তো।”
“আনছি।”
সারাহ্ ফোন নিয়ে আসলে আহনাফ বলে,
“ইমতিয়াজ বা মৃত্তিকার নাম্বার আছে তোমার কাছে?”
“মৃত্তিকার আছে।”
আহনাফ মৃত্তিকার নাম্বারে কল দেয়। ফোনের খোঁজ জানতে চাইলে মৃত্তিকা জানায় বাসায় দেখে জানানো হবে। পকেট থেকে এভাবে কেউ ফোন নিয়ে গেল আর ও টের পেল না।
সারাহ্ ওর পাশে বসে বলে,
“কি হয়েছে কো°র্টে আমি টিভিতে দেখেছি। এখন ইমতিয়াজ সাহেব কেমন আছেন?”
আহনাফ ওর দিকে তাকায়। মাথা নেড়ে বলে,
“হাঁটাচলা করতে পারতেছে। বেশি গু°রুতর কিছু না।”
“যাক, ভালোই। শাফিনের?”
“আইসিইউ, ইমতিয়াজ ছু°ড়ি চালিয়েছিল।”
“কই মাছের জান, সহজে ম°রে না।”
সারাহ্ উঠে রুমে চলে আসে। আহনাফ পিছুপিছু এসে বলে,
“তো সাইদার আম্মু সাদাবের আব্বুর জন্য এতো চিন্তা কেন করেছে? আর ঘুমায়নি কেন?”
“ঘুম আসেনা আমার..”
কথার মাঝে হুট করে সারাহ্ থেমে যায়। আহনাফ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কেন?”
সারাহ্ উত্তর না দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলে,
“খেয়ে নিবেন, আমি খাবার আনছি।”
______________________________________
মৃত্তিকা আহনাফের ফোন খুঁজছে। ডাইনিং-এ থাকা নিয়াজীর আশেপাশে ভালো করে খুঁজে। তারপর যায় গেস্টরুমে, যেখানে শিল্পা আছে। সেখানেও পায় না।
রুমে এসে দেখে ইমতিয়াজ পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে কা°টা জায়গায় ওষুধ লাগাচ্ছে। সুস্মিতা ওকে ওষুধ দিয়ে দিয়েছিল।
ক্ষ°তস্থান দেখেই মৃত্তিকার গা গু°লিয়ে উঠে। ইমতিয়াজ ওকে বলে,
“চেয়ে চেয়ে কি দেখো? যা খুঁজতেছো, তাই খুঁজো।”
মৃত্তিকা এসে পাশে বসে। আলতো হাতে তুলা দিয়ে নিজের ক্ষ°তস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। বলে,
“আমি ভেবেছিলাম আপনার পা হয়তো ভে°ঙেছে, যেভাবে বলেছিলেন হাঁটতে পারবেন না।”
“না, ভা°ঙলে হাঁটতে পারতাম না।”
ওষুধ লাগিয়ে মৃত্তিকা সব সরিয়ে রাখে।
“খাবেন কিছু?”
“না, এখন আর ইচ্ছা নেই। তোমার কোনো কাজ না থাকলে শুয়ে পড়ো।”
“আপনি ঘুমাবেন না?”
“না, নিয়াজীকে পাহারা দিতে হবে। আহনাফ হয়তো ঠিক, ও ছাড়া পেলে শাফিনকে বাঁচাতেও পারে।”
মৃত্তিকা আলো নিভিয়ে মিউকোকে নিয়ে অন্যদিক ফিরে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওর উপর দিয়ে গিয়ে মিউকোকে আদর করে।
মৃত্তিকা বলে,
“অপরূপার কি হবে?”
“শাফিনের ব্যবস্থা হলো, সব ব্যবস্থাই হয়ে যাবে। তবে তুমি নিজের হাত রাঙিয়ে ফেলবে না। বেবির জন্য হলেও খু°ন করবে না তুমি।”
মৃত্তিকা ফিরে ওর দিকে। বাইরে থেকে আসা মৃদু আলোয় ইমতিয়াজকে দেখে সে।
“এতোদিন আমি শাফিনকে মা°রতে চাইলেও আজ সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি। ওকে আমি নিজ হাতে মা°রবো না। কিন্তু সে ম°রবে।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইমতিয়াজ ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“ঘুমাও।”
জানলার পর্দা টেনে ইমতিয়াজ ডাইনিং এ চলে গেল।
চলবে……