#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
পঞ্চপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৫ পর্ব)
“তাহসিনার সিলেট যাওয়ার আবদারটা মূলত শাফিনের কারণেই হয়েছিল। শাফিন ওকে কিছু ভিডিও দেখায়। তাহসিনা একটু বিলাসিতা পছন্দ করতো, তার ভালো লাগে এসব। তাই একপ্রকার জে°দ ধরেই সে সিলেট যায়।
রিসোর্টে বিয়ের আগের দিন খুব ঝা°মেলা করে তাহমিনা। শাফিনের সাথে দু°র্ব্যবহার করে, আবার ওকে চ°ড় মা°রে। সত্যি বলতে ওদেরকে মা°রার ইচ্ছা তখনও আমার ছিল না। তবে নিজেকে বাঁচাতে আমি শাফিনের প্রস্তাবে রাজি হই।
পার্লার থেকে বের হওয়ার আগে রিপা আমাকে কল দিয়েছিল। বলেছিল, তাহসিনাকে নাকি খুব সুন্দর লাগছে। ওরা খুব আনন্দে আছে, কিছুক্ষণ পরই চলে আসবে।
ওরা যে আসতে পারবে না তা আমি জানতাম। রাস্তা থেকে ওদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ দুইবোনকে মা°রার পরও রিপা অনেকক্ষণ বেঁচে ছিল। শাফিনরা পাঁচজন ছিল। শাফিন, জামিল, দুলাল, কবির, আরেকজন কে ছিল আমি জানি না। রিপা নিজের হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছিল, কবিরকে ওখানেই মে°রে ফেলে সে।
তবে তারপর আর রিপা বাঁচে না। তিনজনকে আবারো গাড়িতে তুলে দেয়। কবিরকে উল্টোদিকের গাড়ির ড্রাইভার সাজিয়ে দেয়, একদম পারফেক্ট এ°ক্সি°ডেন্ট লুক আসে৷ কেউ তোমরা বুঝতে পারোনি।”
মৃত্তিকাকে রোমি খন্দকার ও নার্গিস পারভিনের সাথে শাফিনে শ°ত্রু°তা নিয়েও সবটা বলেছে মমতাজ বেগম। তিনটা খু°নের বর্ণনাও করে। মৃত্তিকা শুধু শুনছে আর থেমে থেমে ছোট ছোট প্রশ্ন করছে।
“পঞ্চম মানুষটা কে?”
“জানা নেই আমার।”
মৃত্তিকা আর কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও মমতাজ বেগম বলে,
“আমি কখনো চাইনি তাহমিনার ভালো কোথাও বিয়ে হোক। তাইতো ইমতিয়াজের মতো ছেলেকে আমি পছন্দ করেছিলাম। মূলত শাফিন আমাকে ওর খোঁজ দিয়েছিল।”
মৃত্তিকার কপাল কুঁচকে যায়। বলে,
“ইমতিয়াজকে শাফিন আগে থেকে চেনে?”
“হ্যাঁ চেনে। আমি লুৎফরকে রাজি করেছিলাম। ইমতিয়াজের সম্পর্কে অনেক খোঁজখবর নিয়ে যখন দেখলেন ছেলেটা ভালো, তখন উনি তাহমিনা সাথে কথা বলে। তাহমিনারও পছন্দ হয়, তবে ফ্যামিলি না থাকায় তাহমিনা একটু ইতস্তত করে। তবে বিয়ের পর ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে।”
মৃত্তিকা ভ°য়ে একটা ঢোক গিলে। ইমতিয়াজ কি শাফিনের সাথে জড়িত? এমন একটা ভ°য়ং°কর প্রশ্ন মৃত্তিকার মনে ঘুরছে।
“তাহমিনার মৃ°ত্যুর পর ইমতিয়াজকে আবারও বিয়ে দিতে চেয়েছিল শাফিন। মেয়েও নাকি দেখেছিল, তবে ইমতিয়াজ রাজি হয়নি। শাফিন কেন এটা চেয়েছিল তা আমাকে জানায়নি।”
মমতাজের কথায় মৃত্তিকা আবারো একটু হকচকিয়ে গেল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“শাফিন এখন কোথায়?”
মমতাজ বেগম একটু হাসলেন, বলেন,
“ওকে তোমরা পাবে না। ওর জে°দের কাছে সবাইকে হার মানতে হবে। ও যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে রোমি আর নার্গিসকে মা°রবে, তারমানে ওরা ম°রবেই। তোমাকে শেষ করার কথা তো আরো আগেই বাবাকে দিয়েছিলাম।”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা জীবনেও শুধরাবে না?”
মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে অন্যদিকে তাকায়। তারপর বলে,
“তোমার প্রেগন্যান্সির কথাও জানিয়ে দিয়েছি। তোমার অবস্থাও তাহমিনার মতো হবে।”
“আমি প্রেগন্যান্ট নই বড়মণি, শাফিনকে ধরার এটাই বড় সুযোগ।”
মৃত্তিকা বেরিয়ে যেতে নিলে মমতাজ বেগম আবারো বলেন,
“কেন? ইমতিয়াজ কি ভালোবেসে স্পর্শ করেনি? মিথ্যা কেন বলতে হলো?”
মৃত্তিকা কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। ইমতিয়াজ ওকে ভালোবাসুক কিংবা না বাসুক, ও ইমতিয়াজকে ভালোবাসে। কিন্তু শাফিনের সাথে যুক্ত থাকলে, ওকেও শেষ করতে এক মিনিটও ভাববে না সে।
______________________________________
আজ বৃহস্পতিবার হওয়ায় কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে, এখন মাত্র বারোটা বেজেছে।
বাসায় যাওয়ার পথে সারাহ্ বলে,
“আপনি বলেছিলেন আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন, কিন্তু গেলেন না।”
আহনাফ একটু হেসে বলল,
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক, আমরা যাবো।”
“জীবনে তো এমন সময় বহু আসবে, তাই বলে কি ঘরব°ন্দী থাকবো নাকি?”
“ঐশী, জে°দ করো না।”
সারাহ্ মুখ ভে°ঙচিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আহনাফ হেসে বলে,
“আজকের আকাশটা দেখেছো? সুন্দর না?”
“কোথায় সুন্দর?”
ধ°মক দিয়ে বলে সারাহ্।
“আহা, দেখছো না মেঘলা আকাশ, কি রকম কালো কালো মেঘ থরে বিথরে সেজে আছে? আবার কি মৃদুমন্দ একটা বাতাস বইছে? তোমার মনে হচ্ছে না, আজকের দিনটা খিচুড়ি খেয়ে আরামে ঘুমানোর দিন?”
“ওই আপনি দুইটা কাজই পারেন। কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই।”
আহনাফ হো হো করে হেসে উঠে, তারপর বলে,
“আজকের দিনটা ঘুমানোর দিন, ঘুরাঘুরি নয়। ঘুরাঘুরির জন্য রোদ ঝলমলে দিনের দরকার।”
সারাহ্-র রাগ তবুও ভা°ঙে না। আহনাফ সিএনজি চালককে বলে,
“মামা, একটু রসমালাইয়ের দোকানের সামনে দাঁড় করিয়েন তো।”
চালক ওর কথা মত একটা মিষ্টির দোকানের সামনে সিএনজি থামায়। আহনাফ নেমে দোকানের ভিতরে যায়, উদ্দেশ্য সারাহ্-র পছন্দের কিছু মিষ্টি কেনা। আজকাল সে মিষ্টি খুব খাচ্ছে।
এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়, একদম হুট করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। সিএনজির পর্দা নামিয়ে দেয়া হয়। সারাহ্ অপেক্ষা করছে আহনাফের জন্য।
হুট করে একজন মাস্ক পরা লোক এসে সিএনজিতে উঠে বসে। সারাহ্ চমকে উঠে বলে,
“পুরো সিএনজি রিজার্ভ করা, আপনি নেমে যান।”
“নামার জন্য তো আমি আসিনি।”
বলেই সারাহ্-র গলার কাছে পি°স্ত°ল ধরে লোকটি।
চালককে বলে,
“সিএনজি চালাও। না হলে তোমার যাত্রী যাবে আর তুমিও।”
প্রাণের ভয়ে সিএনজি চালানো শুরু করে দেয় চালক। আহনাফ দৌড়ে বেরিয়ে আসলো। পেছন থেকে আহনাফ চেঁচিয়ে বলছে,
“থামাও।”
সিএনজি থামলো না, চলে গেল। আহনাফও অন্য আরেকটি সিএনজি নিয়ে পিছু ধরলো, সাথে গাড়ির নাম্বারটাই দেখে রেখেছে।
বৃষ্টি পড়ছে, কুমিল্লা শহর, জ্যাম থাকাটাই স্বাভাবিক। সব সিএনজিতে পর্দা দেয়া, সবই দেখতে একরকম। খুব স্বাভাবিকভাবে সারাহ্-র সিএনজি কিছুক্ষণ পর আহনাফ আর খুঁজে পেল না। কিন্তু সে হাল ছাড়েনি, এদিকওদিক ঠিকই খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এদিকে সারাহ্ স্থির হয়ে বসে আছে, যেন কিছুই হয়নি। ওর পাশে থাকা লোকটি বলে,
“তুমি ভ°য় পাচ্ছ না।”
“না তো, এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে ভ°য় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট।”
পি°স্ত°ল দিয়ে সারাহ্-র গলায় খোঁ°চা দিয়ে লোকটি বলে,
“খুব তো বড় বড় কথা বলছো। এখন মে°রে এখান থেকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে দেই, কে বাঁচাবে তোমাকে? তোমার আহনাফ?”
সারাহ্ মুচকি হেসে বলে,
“আমাকে ওই আল্লাহ বাঁচাবে যে ইউসুফ (আঃ)-কে কুয়া থেকে আর ইউনুস (আঃ)-কে মাছের পেট থেকে রক্ষা করেছিল। আমাকে ওই আল্লাহ বাঁচাবে যে ইব্রাহিম (আঃ)-কে অ°গ্নি°কু°ন্ড থেকে আর ইসমাইল (আঃ)-কে ধা°রালো ছু°রি নিচ থেকে রক্ষা করেছিল। আমাকে ওই আল্লাহ বাঁচাবে যে মক্কার কা°ফের মুশ°রিকদের থেকে আমার নবী মুহাম্মদ (সঃ) কে বাঁচিয়েছিল।”
লোকটি ধ°মক দিয়ে উঠে,
“ভ°য় পাও আমাকে, আমি শাফিন।”
সারাহ্ আবারও হাসে। বলে,
“ফে°রা°উন, নম°রুদ অনেক ক্ষমতাধর ছিল, কিন্তু আজ তারা কোথায়? সুতরাং তোমার মত একটা না, হাজার জন শাফিনও যদি আসে, তবেও আমি ভ°য় পাই না।”
শাফিনের রাগ তড়তড় করে বাড়ে। মাস্ক খুলে বাইরে ফেলে দিয়ে চালককে বলে,
“দ্রুত চালাও, সামনে গিয়ে ডানে যাবে।”
সারাহ্ আড়চোখে এদিক-সেদিক দেখতে লাগলো, সে কোথায় আছে আপাতত বুঝতে পারলো না। শাফিন ওর পাশে বসা, ও জানে শাফিন ওকে গু°লি করে কখনোই মা°রবে না।
“কি চাও আমার কাছে, তাই বলো।”
সারাহ্-র শান্ত কথা শুনে শাফিন পি°স্ত°ল দিয়ে আবারো ওর গলায় খোঁ°চা দেয়। তারপর বলে,
“তোমার মাধ্যমে আমি নার্গিস আর আহনাফকে মা°রবো, সাথে পালাবোও। আমি এতোদিন যেহেতু ধরা পড়িনি, তাই আহনাফের মতো কুঁচো চিংড়ির হাতে ধরা দিবো না।”
সারাহ্ আর কোনো জবাব দেয় না। সে ক্রমাগত দুরুদ শরীফ পড়তে থাকে। তার বিশ্বাস আল্লাহ তাকে এতোটা কষ্ট দিবে না, যা সে সহ্য করতে না পারে।
______________________________________
“ভাইয়া, আম্মুকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।”
তানজিমের ভ°য়ার্ত কণ্ঠ শুনে ইমতিয়াজ চমকে উঠে বলে,
“কোথায় যেতে পারে?”
“কাল রাতেও ছিল না, আজও বাসায় নেই। বাবা খুঁজতে গেছে। আম্মুর সব আত্মীয়-স্বজনের বাসায় ফোনও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোথাও নেই।”
ইমতিয়াজ একটু ভেবে বলে,
“মামানিকে কল দিয়েছিলে?”
“দিয়েছিলাম, ওখানেও যায়নি। মিউকোপুকে জানিয়েছে, আপুও তাকে খুঁজছে।”
ইমতিয়াজ জমিদার বাড়ির ওই ঘটনার পর থেকে মমতাজ বেগমকে সন্দেহ চোখে দেখে, আবার মৃত্তিকাও নিজের সন্দেহের কথা ইমতিয়াজকে জানিয়েছিল।
“শাফিনের কাছে যায়নি তো?”
ইমতিয়াজের কথায় তানজিম চুপ হয়ে যায়। ইমতিয়াজ আবারো বলে,
“আমার তো তাই মনে হচ্ছে।”
তানজিম সাতপাঁচ না ভেবে সরাসরি ওর সাথে ওর মায়ের কথোপকথন ও অপরূপার যোগাযোগ সম্পর্কে সব বলে দেয়। সব শুনে ইমতিয়াজ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়,
“তবে উনি শাফিনের কাছেই গেছে, আমি নিশ্চিত।”
ফোন রেখে আবারো অফিসের কাজে মন দেয় ইমতিয়াজ। ঠিক এমনসময় ওর পিএ এসে জানায় কোনো একজন সিআইডি অফিসার ওর সাথে দেখা করতে এসেছে।
অনুমতি নিয়ে ভিতরে আসে অফিসার নাইমা। ইমতিয়াজের মুখোমুখি রাখার চেয়ারে বসে বলল,
“বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তবে আশা করি আপনি আমাদের সাহায্য করবেন।”
ইমতিয়াজ একটু নড়ে চড়ে বসে বলল,
“আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।”
অফিসের নাইমা ইন্সপেক্টর রাব্বি ও জেলার বিল্লাল হোসেনের গ্রে°ফ°তার হওয়ার কথাটি জানিয়ে বলে,
“ওরা দুজন বলেছে ওরা একটা গ্রুপ হয়ে কাজ করেছে। সেই গ্রুপের সবাই মূলত নিজেদের পজিশন নিচ থেকে উপরের দিকে আনার জন্য শাফিনের সাথে যুক্ত ছিল। দুজনের বক্তব্য ছিল এমন যে, টাকা ছাড়া বাংলাদেশে মেধার কোনো দাম নেই, তাই টাকার জন্য ওরা শাফিনকে সাহায্য করেছে। বিনিময়ে টাকা পেয়েছে এবং নিজেদের অবস্থান উঁচু করেছে।”
ইমতিয়াজ মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে আর ঘন ঘন ঘাড় নাড়ায়। নাইমা বলে,
“ওদের মধ্যে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল অ্যাডভোকেট বিথী, যে এখন লা°পাত্তা এবং শেষবার অ্যাডভোকেট বিথীর মোবাইলের অবস্থান ও আপনার মোবাইলের অবস্থান একই ছিল।”
এখানে অ°স্বীকার করার উপায় নেই। ইমতিয়াজ বাম হাতে ভ্রূ চুলকে বলে,
“হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। সে আমার কাছেই আছে। আমি তুলে এনেছি।”
“কেন?”
ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“কারন আমি ভেবেছিলাম সে জানে শাফিন কোথায়।”
অফিসার নাইমাও উঠে দাঁড়ায়। বলে,
“ঠিক আছে, আমাকে এখন তার কাছে নিয়ে চলুন। আমরা তাকে নিয়ে যাবো এবং আমাদের মতো করে জিজ্ঞাসাবাদ করবো।”
ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে বলে,
“অবশ্যই তবে তার আগে আপনাদের আরেকটা কাজ করতে হবে।”
“আপনি আমাদের অর্ডার দিবেন?”
“নো, আমি তো অর্ডার দিচ্ছি না, এডভাইস দিচ্ছি।”
নাইমা কপাল কুঁচকে তাকালে, ইমতিয়াজ হাসি হাসি মুখ করে ফাহাদকে ডাকে। ফাহাদ আসলে নাইমাকে বলে,
“আগে আপনারা যাত্রাবাড়ী যাবেন, সেখানে শাফিনের গোপন ঠিকানা আছে। বাসাটা ফাহাদ আপনাদের চিনিয়ে দেবে।”
নাইমা ফাহাদকে জিজ্ঞাসা করে,
“তুমি কি করে ওই ঠিকানা জানো?”
“অপরূপার পিছুপিছু গিয়েছিলাম।”
“অপরূপা কে?”
পাশ থেকে ইমতিয়াজ বলে উঠে,
“শাফিনের দ্বিতীয় স্ত্রী। এতোদিনে এইটুকুও বের করতে পারেননি?”
নাইমা রাগি চোখে একবার ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“ফাইন, আমাদের একটা টিম ফাহাদের সাথে যাত্রাবাড়ী যাবে আর আমি যাবো এডভোকেট বিথীকে আনতে।”
“ওকে।”
ইমতিয়াজ প্রস্তাবে রাজি হয়।
নাইমা বেরিয়ে যায়। নিজের টিমকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয় সে। আর এদিকে ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে ফোন দিয়ে নাইমার বাসায় আসার কথাটা জানিয়ে দেয়।
______________________________________
দুজন পুলিশ সদস্যের সহায়তায় সেই সিএনজিটি খুঁজে পায় আহনাফ। তবে সেখানে কেউ ছিল না, সিএনজির চালকও আশেপাশে নেই। তাই যেখানে এটি পাওয়া গেছে অর্থাৎ পালপাড়ার পুরো অংশ খুঁজে দেখা হচ্ছে। এমনকি পালপাড়া ব্রিজের নিচেও খোঁজা হচ্ছে।
এটা যে শাফিনের কাজ তা তো আর বলার অবকাশ নেই। আহনাফ জানে শাফিন এতদিন অনেক প্রকারে সারাহ্-কে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তবে পারেনি। তাই আজ হয়তো নিজে এসেছে।
দুপুর যায়, বিকেল যায়, সন্ধ্যা যায়, তবে সারাহ্-কে খুঁজে পাওয়া যায় না। আব্বাস সাহেব বাসা থেকে চলে এসেছেন। উনিও দুশ্চিন্তায় ক্রমাগত ছটফট করে যাচ্ছেন।
তবে আহনাফ এখনো নিজের ধৈর্য ধরে রেখেছে। আশেপাশের প্রতিটা ঘর খুঁজে দেখছে কয়েকবার করে। এমন কোনো জায়গা বাকি রাখেনি, যেখানে সে দেখেনি।
অবশেষে গ্রামের শেষাংশে সারাহ্-র চশমা খুঁজে পায় আহনাফ। সারাহ্ তো চশমা ছাড়া ঠিকমতো রাস্তা দেখে চলতেও পারে না।
ভ°য় পেলেও একটুখানি আশা খুঁজে পায় আহনাফ। সে আরো ভিতরে যেতে থাকে। গাছপালার আড়ালে থাকা একটা নিচু ঘর দেখে আহনাফ থামে।
দরজা খোলা দেখে ভিতরে যায় আহনাফ। ঘর পুরো অন্ধকার। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে আশেপাশে দেখতে দেখতে একজায়গায় একটা লা°শ দেখে সে। হঠাৎ করে চমকে উঠে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবারো লাইট ঘুরায়।
ঘরের এক কোণায় সারাহ্-কে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। আহনাফ ছুঁটে গিয়ে ওকে টে°নে নিজের কোলে আনে।
“ঐশী।”
অপরপাশ থেকে কোনো সারাশব্দ আসলো না। সারাহ্-র নাকের কাছে র°ক্ত, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মুখ থেকে র°ক্ত বেরিয়ে আসছে।
আহনাফ যেন দেখছে সেদিনের নিস্তব্ধতা, একটা শান্ত মুখ, চিরদিনের মতো চুপ হয়ে যাওয়া একটা মানুষ।
সারাহ্-র গালে হাত দিয়ে কাঁপা কন্ঠে আলতো করে আবারো ডাকে,
“ঐশী?”
সারাহ্-র নাকের কাছে হাত দেয় আহনাফ। চোখ তার বড় হয়ে আসে। মৃ°ত্যু°পুরীর নিস্তব্ধতা ভে°দ করে একটা চিৎকার রুমে প্রতিফলিত হয়,
“ঐশী।”
পেছন থেকে একটা কন্ঠ আসে,
“তবে এসেই পড়েছো, আহনাফ? তাহসিনার পর তোমার ঐশীও আর নেই।”
চলবে…..
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ষট্ পঞ্চাশৎ পর্ব (৫৬ পর্ব)
পরপর দুইটা গু°লির শব্দ হলো। আহনাফ চমকে উঠে। একটা ধপ করে শব্দ হয়, হয়তো লোকটা পড়ে গেছে।
অনেকগুলো লাইট একসাথে ভিতরে আসে। গালিব আর আব্বাস সাহেব সামনে, পেছনে পুলিশের পোশাকে কিছু লোক।
আব্বাস সাহেব এসে সারাহ্-র অপরদিকে বসে আহনাফকে বলে,
“সারাহ্-র কি হয়েছে?”
আব্বাস সাহেব যেন ভ°য় পাচ্ছেন৷ গালিব আহনাফকে বলে,
“গাড়ি রাস্তায় আছে, উনাকে হসপিটালে নিয়ে চলুন।”
আহনাফ নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে বলল,
“ঐশী নিশ্বাস ফেলছে না।”
গালিব শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“বেশি ক্রি°টিক্যাল অবস্থায় নিশ্বাস ধীরে পড়ে, বোঝা যায় না। গলার পাশে হাত দিয়ে দেখুন বা পার্লস চেইক করুন।”
চিন্তায় এতোক্ষণ আহনাফের মাথায় এসব আসেনি। পার্লস চেইক করে যখন বুঝতে পারে এ দেহে এখনো প্রাণ আছে, সঙ্গে সঙ্গেই ওকে কোলে তুলে নেয়।
গাড়ি রাস্তায় তৈরিই ছিল, উঁচু রাস্তায় সারাহ্-কে কোলে করে উঠাতেও একটু কষ্ট হয় আহনাফের। অবশেষে সারাহ্-কে সেখানে নিয়ে গাড়িতে তোলা হলো।
ঘরে থাকা সেই লা°শ কিংবা একটু আগের লোকটার চেহারা আহনাফের দেখা হয় না। গাড়ি বসে সারাহ্-র হাত ধরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে, সারাহ্-র মাথা ওর কোলে নিয়ে রেখেছে।
আব্বাস সাহেব পাশেই বসেছেন। উনি পকেট থেকে টিস্যু বের করে সারাহ্-র নাকমুখের র°ক্ত মুছে দেন৷
আহনাফের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে সারাহ্-র হাতের উপর পড়ে। আব্বাস সাহেব ছেলের দিকে তাকায়। তাহসিনার মৃ°ত্যুর পর ওর অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছিল উনি দেখেছেন। আজ এতোদিন পর আবারো তার জীবনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
“আল্লাহ্, সারাহ্-কে সুস্থ করে দাও, আমার ছেলেটার জীবনের জন্য হলেও সুস্থ করে দাও।”
একটা দোয়াই আছে আব্বাস সাহেবের মনে।
বাকিরাতটুকু ওরা হাসপাতালে কাটায়। ফজরের সময় ডাক্তার এসে সারাহ্-কে দেখে জানালো বেবি সুস্থ আছে, যদিও সাথে কতগুলো টেস্টের লিস্ট ধরিয়ে দিলো। তবুও আহনাফের জান ফিরে এসেছে।
নামাজ পড়ে এসে আহনাফ জানতে পারলো সারাহ্-র জ্ঞান ফিরেছে। নার্স ওকে বলে,
“আপনার স্ত্রী দেখা করতে চাচ্ছে। দেখা করেন, তবে উনার সাথে জোরে কোনো কথা বলবেন না। উনি এখনো একটু ট্র°মায় আছেন, আর শারিরীকভাবে পুরোপুরি ঠিক নেই।”
আহনাফ উনার কথা শুনেনি, তার শোনার প্রয়োজন নেই। তার ঐশীর সাথে সে যেভাবে ইচ্ছা কথা বলবে।
সারাহ্ আশেপাশে তাকিয়ে কোনো চেনা মুখ দেখেনা, একটা চেনা মুখ খুঁজতে খুঁজতে আহনাফ এসে হাজির। সোজা এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। সারাহ্ও দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।
“জানেন ওরা..”
সারাহ্-র কথা আহনাফ শুনেনা, মাঝপথেই তা আটকে যায়। ওর গলায় গভীরভাবে স্পর্শ করে আহনাফ। অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে সে, দুজন দুজনকে দেখছে।
সারাহ্ আহনাফের গালে হাত দিয়ে বলে,
“ওরা আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। মে°রে দিয়েছে।”
“রুমে পড়ে থাকা লোকটাকে তুমি মে°রেছো?”
সারাহ্ মাথা নেড়ে বলল,
“না, কেউ একজন গু°লি চালিয়েছিল, জ্ঞান হারানোর আগে একটা কন্ঠ আমি শুনেছিলাম। শাফিন আপনাকেও মে°রে ফেলতে চেয়েছিল, মাকেও।”
সারাহ্ কান্না করে দিলে আহনাফ একটু কড়া গলায় বলে,
“তোমার সামনে জীবিত, আস্ত আহনাফ আছি। তবে কাঁদছো কেন?”
সারাহ্ নাক টা°নলে আহনাফ ওর নাকে নাক ঘ°ষে দিয়ে বলে,
“ওরা নিজেরাই বেঁচে নেই। তবে শাফিনের বিষয়টা শিউর নই।”
“আহনাফ, আম্মুকে কিছু জানিয়েছেন?”
“না।”
“জানানোর দরকার নেই। জানালে এখানে আসতে চাইবে আর ওরা এটাই চেয়েছিল। শাফিন তো ওখান থেকে পালিয়েছিল, গু°লি চলার সাথে সাথেই সে বেরিয়ে গিয়েছিল।”
আহনাফ কপাল কুঁচকায়। গালিবকে কথাটা জানানো দরকার। আহনাফ উঠে বসে ফোন বের করে গালিবকে কল দেয়। গালিব ওর কথা শুনে জানায়, যাকে গু°লি করেছে বা যে রুমে পড়ে ছিল, তাদের কেউই শাফিন না। বোঝা যাচ্ছে শাফিনের অনেক লোকজন এখনো বাইরে ঘুরছে। কিন্তু সারাহ্-কে বাঁচালো কে? তার হদিস পাওয়া গেল না।
“চোখ ধুলা ছিটিয়ে এভাবে পালালো। আমাদেরকে একদিকে ব্যস্ত রেখে সে হাতছাড়া হলো।”
আহনাফ কথাটা বলে ফোন রাখে।
সারাহ্ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে রুমে থাকা দুজন নার্স বেরিয়ে গেছে। আহনাফকে বলে,
“আপনার কৃতকর্মে নার্সরাও ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি করে পালিয়েছে।”
আহনাফ আবারো ওর কাছে যায়। তর্জনী আঙুল দিয়ে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,
“ওদেরকে ধরিই নাই, ছাড়ার তো প্রশ্নই উঠে না। যাকে ধরছি সেই..”
কথা শেষ না করেই দুজনের ওষ্টোধর একত্র করে আহনাফ। সারাহ্ চোখ বন্ধ করে আহনাফের শার্ট খা°মচে ধরে। সে আর নিজের ভিতরে নেই। আগের ভী°তি, সংশয় সব যেন দূর হয়ে গেছে।
______________________________________
এডভোকেট বিথীকেই শুধুমাত্র তুলে দিয়েছে মৃত্তিকা। অপরূপাকে সে আগেই সরিয়ে রেখেছে। বিথীকেও সে দিতে চায়নি, ইমতিয়াজের জোরাজুরিতে দিতে হয়েছে।
ফজরের পর ইমতিয়াজ বাসায় এসে আবারো শুয়ে পড়ে। মৃত্তিকা এসে পাশে বসে বলল,
“একটা প্রশ্ন করি?”
“হুম।”
চোখ বন্ধ করে জবাব দেয় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা ঢোক গিলে বলল,
“শাফিনকে আপনি আগে থেকে চেনেন?”
ইমতিয়াজ এবারে ওর দিকে ফিরে তাকায়। বলে,
“আগে থেকে বলতে?”
“তাহমিনার সাথে বিয়ের আগে থেকে।”
ইমতিয়াজ উঠে বসে খুব স্বাভাবিকভাবে বলে,
“হ্যাঁ, চিনতাম। ওর বাসায় ভাড়া থেকেছি।”
“আমার প্রেগন্যান্সির কথাও কি শাফিনই আপনাকে জানিয়েছে?”
ইমতিয়াজ উঠে বসে বলল,
“কিসব বলছো তুমি? শাফিনের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।”
“সত্য বলুন ইমতিয়াজ। আমি সরাসরি জিজ্ঞাসা করছি।”
“সত্যই বলছি।”
মৃত্তিকা জোর গলায় বলল,
“মি°থ্যা, সেই পঞ্চম ব্যক্তি আপনি। তাহমিনার জন্য যত অনুভূতি দেখিয়েছেন সব আপনার নাটক। তাহমিনা যখন চিৎকার করেছে তখন আপনি তাহসিনাকে..”
মৃত্তিকার গালে একটা চ°ড় বসায় ইমতিয়াজ, মৃত্তিকা হঠাৎ থেমে যায়।
ইমতিয়াজ রাগ দেখিয়ে বলে,
“যা মুখে আসছে, বলে যাচ্ছো।”
মৃত্তিকা দাঁতে দাঁত ঘ°ষে বলল,
“অপরূপা আমাকে এসব জানিয়েছে।”
সত্যি সত্যিই অপরূপা ওকে এসব বলেছে। যখন অপরূপাকে সরিয়ে ছাদে নিয়ে গেছিলো, তখনই অপরূপাকে সে ইমতিয়াজের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। অপরূপা বলে দেয়, ইমতিয়াজ শাফিনের সাথে প্রতিক্ষেত্রেই যুক্ত আছে।
ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকায়,
“অপরূপা?”
“হুম।”
ইমতিয়াজ বিছানায় বসে বলে,
“দেখো, অপরূপা মি°থ্যা বলেছে। তুমি আমাকে একটু বিশ্বাস করো।”
মৃত্তিকা আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওর বিশ্বাস আসছে না। ঘোরতর অবিশ্বাসে ডুবেছে সে। দুনিয়ায় সবাইকে সে বিশ্বাস করতে পারছে, কিন্তু ইমতিয়াজকে না।
ইমতিয়াজ পিছুপিছু বেরিয়ে আসে।
“মৃত্তিকা, এমন কেন করছো? একজন কিছু একটা বলে দিবে আর তুমি বিশ্বাস করবে?”
মৃত্তিকা ফিরে ইমতিয়াজকে একটা ধা°ক্কা দিয়ে বলে,
“খবরদার আমাকে মৃত্তিকা ডেকেছেন তো।”
ইমতিয়াজ ওকে জোর করে কাছে নিয়ে আসে। বলে,
“দেখো, মেজাজ দেখাবে না। বেবির কথাটা তানজিম আমাকে বলেছে। শাফিনের বাসায় আমি ভাড়া থাকতাম, এরচেয়ে বেশি কিছু না।”
মৃত্তিকা নিজেকে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। বি°চ্ছি°রি একটা অনুভূতি নিয়ে সে ছাদের হলরুমে আসে।
অপরূপার মুখের কচটেপ খুলে বলে,
“ইমতিয়াজকে নিয়ে সত্য বলেছো নাকি মিথ্যা?”
“যাকে ভালোবাসো তাকে বিশ্বাস করো না?”
অপরূপা হো হো করে হেসে উঠে। তারপর বলে,
“বিশ্বাস না করলে আর কিসের ভালোবাসা? শেষ, তোমার আর ইমতিয়াজের সম্পর্ক শেষ। এই বাচ্চার কি হবে? তোমার মতো করে বড় হবে।”
অপরূপার হাসিতে মৃত্তিকার রাগ বাড়ে। মৃত্তিকা জিজ্ঞাসা করে,
“মি°থ্যা বলেছো?”
অপরূপা চোখ টি°পে দিয়ে বলে,
“সে তুমি বের করে নাও।”
মৃত্তিকা বের হয়ে যায়। নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে। অপরূপার কথা শুনে কেন সে ইমতিয়াজকে ব্লেইম করলো। আবার মমতাজ বেগমের কথাগুলোর সাথে মিলালে ইমতিয়াজকে পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না।
বাসায় ঢুকতেই মৃত্তিকার শরীর খারাপ লাগা শুরু হলো। সোফায় বসে পড়ে। ইমতিয়াজ ডাইনিং এ বসে আছে, ওকে দেখেও কিছুই বলে না। শরীফ তো গতকাল থেকে বাসায় নেই।
“ইমতিয়াজ।”
মৃদু ডাকে ইমতিয়াজ তাকায়, কিন্তু জবাব দেয় না। মৃত্তিকা ঢোক গিলে বলে,
“ভ°য়া°নক একটা সময় যাচ্ছে আমাদের, সব কিছু সাজাতে চেয়েও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”
“তুমি সাজাতে চাচ্ছো, মিউকো?”
মৃত্তিকা উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি পাগল হয়ে যাবো, এমন ছিন্নভিন্ন পরিবার আগে কখনো দেখেছেন? এরা নিজেরাই নিজেদের শ°ত্রু।”
ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি করে ভাবতে পারলে তাহমিনাকে আমি ওই লোকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছি? কি করে ভাবলে তাহসিনাকে আমি নোংরা হাতে ছুঁয়েছি? তোমার চিন্তাভাবনায় পচন ধরেছে মিউকো।”
ইমতিয়াজ চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওর হাত টে°নে ধরে। ওর বাহুতে মাথা রেখে বলল,
“একটা সত্যি বললে কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”
“কি?”
ইমতিয়াজের সোজা প্রশ্নে মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে দুহাতে বালা খুলে ওর হাতে দিয়ে বলল,
“এগুলো নেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। মি°থ্যা বলেছি আমি, শাফিনকে ধরতে এই মি°থ্যা আমাকে সাজাতে হয়েছে।”
ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে। চোখ ছোট করে তাকায় ওর দিকে। বালা দুটো ছুঁড়ে ফেলে ইমতিয়াজ বেরিয়ে যায়।
______________________________________
রাত আটটা, সব ধরনের চেকআপ শেষে সারাহ্-কে ভর্তি করানো হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে শয্যাশায়ী থাকতে হবে তাকে, কমপক্ষে সপ্তাহখানেক ওকে আরাম করতে হবে। তার আগে দুইদিন ওকে ভর্তি থাকতে হবে।
উপুড় হয়ে পড়লেও ও নিজের শরীরের ব্যালেন্স ধরে রেখেছিল, তাইতো নাকমুখ আর পায়ে ব্য°থা পেলেও নিজের সন্তানকে সে ঠিকই ভালো রেখেছে।
আব্বাস সাহেব বাসায় চলে গেছে। আহনাফ ফোন মাধ্যমে ইমতিয়াজকে সব ঘটনা জানায় এবং অপরূপাকে যেকোনো মূল্যে আটকে রাখতে বলে। কারণ আহনাফ নিজেও এখন পিবিআইয়ের উপর ভরসা করছে না।
“সারাহ্-কে বাঁচিয়েছে যে ব্যক্তি সে হয়তো শাফিনের খোঁজ পেতে পারে।”
ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ জবাব দেয়,
“হয়তো শাফিনও আহত। র°ক্তের দাগ দেখে অনুসরণ করা হয়েছিল, কিন্তু একটা দূরত্বে গিয়ে দাগ আর পাওয়া যায়নি।”
ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“শাফিন কি এখনো কুমিল্লাতে আছে? আমার তো মনে হয় না, সে অবশ্যই পালিয়েছে।”
“হতে পারে, কিন্তু সে পালিয়ে হলেও ঢাকায়ই যাবে।”
এদিকে মৃত্তিকা পাশে বসে ঠিকই ওদের কথোপকথন শুনছে। ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। বরং নিরবে এড়িয়ে যাচ্ছে ওকে।
কথা শেষে ফোন রাখে আহনাফ। তারপর খাবার নিয়ে কেবিনে এসে দেখে সারাহ্ বিছানায় শুয়ে ফোনে সামিহার সাথে কথা বলছে।
আহনাফ গিয়ে পাশে বসে একটু জোরে বলল,
“ওহো, শ্যালিকা যে, কি অবস্থা?”
“ভালো ভাইয়া।”
অপরপাশ থেকে জবাব দেয় সামিহা।
“দিনকাল যাচ্ছে ভালো?”
“মোটামুটি ভাইয়া, তানজিমের আম্মুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই একটু আপসেট।”
আহনাফ কপাল কুঁচকায়, একটু আগে ইমতিয়াজের সাথে কথা হয়েছে। সে কিছু বলল না কেন?
আহনাফ কথা ঘুরাতে বলল,
“সামিহা, পরে কথা বলো, এখন তোমার আপু খাবে।”
সামিহা আফসোসের রেখা টে°নে বলে,
“আহ, এশা, আহ। আজ একটা জামাই থাকলে তোর কথাও এমনে কেউ ভাবতো। (একটু থেমে) আচ্ছা, ভাইয়া রাখছি।”
সারাহ্ উঠে বসে ওকে ধ°মক দিয়ে কল কেটে দেয়। আহনাফ ওকে খাইয়ে দিতে দিতে বলে,
“এখনো শরীর খারাপ লাগছে?”
“একটু।”
আহনাফ জানে এই একটুর অর্থ আসলে অনেক বেশি।
“কাল বাকি রিপোর্ট আসবে, আশা করি সব ঠিক থাকবে।”
“হুম।”
“ভ°য় পাচ্ছো নাকি?”
সারাহ্ ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“আপনি যেহেতু আছেন, তাই ভ°য়ের কিছু নেই।”
আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“খেয়ে নাও।”
______________________________________
সারাদিন মৃত্তিকার শরীর খারাপ লাগছে। শাফিনের ওই ঘটনা শুনে সে স্থিরও থাকতে পারছে না, আবার শরীরে কোনো শক্তিও পাচ্ছে না।
রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়ে রুমে এসে ইমতিয়াজকে ডাকে, কিন্তু ইমতিয়াজ সারা দেয় না। আলো নিভিয়ে মিউকোকে কোলে নিয়ে সে ফ্লোরে বসে আছে।
“ইমতিয়াজ, আপনি কি আছেন?”
ইমতিয়াজের শব্দ না পেলেও মিউকোর মিউ মিউ শব্দ মৃত্তিকা পায়। লাইট জ্বা°লিয়ে দেখে ইমতিয়াজ এক কোণায় বসে আছে। কেমন যেন হতাশায় সে ঘিরে গেছে।
মৃত্তিকা নিরবে গিয়ে ওর পাশে বসে। ইমতিয়াজ মুখ ফিরিয়ে নেয়। মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“খাওয়ার সাথে কি? চলুন না, খেয়ে নিবেন।”
ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তাহমিনা আমাকে বলেছিল তোমাকে ভালোবাসার আরেকজন আসছে, সে আসেনি। যখন ওই কষ্টটুকু আমি কা°টাতে চাইলাম, তখনই তোমার একটা মি°থ্যা নাটক সাজাতে হলো?”
ইমতিয়াজ বেরিয়ে চলে যায়, একদম বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। মৃত্তিকা চুপ থাকে। ওর কষ্টের কারণ নির্দিষ্ট নয়। সে এখনো ইমতিয়াজকে সন্দেহ করছে, ভ°য় পাচ্ছে সে ইমতিয়াজকে হারানোর। আবার নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসবে ইমতিয়াজ যুক্ত থাকলে নিজেই তাকে হ°ত্যা করবে।
ব্যস, ইমতিয়াজের সাথে ওর দূরত্ব বেড়ে যায়। একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে সাতদিন পার হয়। ওরা নিজেদের বাসায় চলে এসেছে। হাতে গুণে দুই একটা কথা ছাড়া তাদের মধ্যে কোনো কথাই হয় না।
মমতাজ বেগমের সাথে দেখা করতে এসে মৃত্তিকা পল্লবীকে পুরো ঘটনা জানায়। পল্লবী সবকিছু শুনে বলে,
“ইমতিয়াজকে আমার কখনোই খারাপ মনে হয়নি। তুমি যখন অসুস্থ ছিলে, তখন আমি দেখেছিলাম।”
“অপরূপা যে বলল, সে শাফিনের কাছের লোক। আর ইমতিয়াজ নিজে বলেছে শাফিনকে ও আগে থেকে চিনে।”
পল্লবী একটু ভেবে বলল,
“একটা কথা বলি, একটু স্বাভাবিক হও। শাফিন ছাড়া আর কেউ এর উত্তর দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে আগেই তুমি সংসার ভে°ঙে ফেলো না।”
হঠাৎ মৃত্তিকার শরীর খারাপ শুরু হলো। জ্ঞান হারিয়ে পল্লবীর উপর পড়ে গেল। পল্লবী ওকে বসিয়ে মুখে একটু পানি দেয়। পল্লবী ফ্যান ছেড়ে এসে মৃত্তিকার হিজাব খুলে ওকে একটু হালকা করে দেয়।
মৃত্তিকা একটু একটু করে চোখ খুলে। মৃদুস্বরে বলল,
“পানি খাবো।”
পল্লবী ওকে পানি দেয়। পানি পান করে মৃত্তিকা বলে,
“কয়েকদিন ধরেই শরীরের অবস্থা খারাপ।”
“প্রেশার লো হয় নাকি?”
“জানি না।”
মৃত্তিকা জানে আসলে কি, যে মি°থ্যা সে ছড়িয়েছিল তা এখন সত্য। ইমতিয়াজের সন্তান ওর গর্ভে একটু একটু করে বড় হচ্ছে।
______________________________________
সারাহ্ কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। সারাদিন বাসায় থেকে থেকে সে বি°র°ক্ত হয়ে গেছে। তবুও বের হওয়া নিষেধ। কোনো প্রকারে ওর বাইরে যাওয়া হবে না।
সারাদিন টিভি দেখে, বই পড়ে, রান্না করে, কোরআন পড়েই সে কা°টিয়ে দিচ্ছে। রান্নায় গিয়েও মাঝে মাঝে আহনাফের ব°কা খেতে হয়।
বিকাল পাঁচটা, আরাম করে বসে বসে সে বই পড়ছে। এর মধ্যে ফোন বেজে উঠে। আননোন নাম্বার দেখেও সারাহ্ রিসিভ করে,
“আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”
অপরপাশ থেকে জবাব আসে,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি মৃত্তিকা। (একটু থেমে) আ, ওই মিউকো। তানজিমের কাজিন।”
সারাহ্ মাথা নেড়ে বলল,
“ওহ, আপনি। কেমন আছেন?”
“জি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কি অবস্থা?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
মৃত্তিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“শাফিনকে আপনি দেখেছিলেন?”
“হুম, দেখেছিলাম।”
“আপনাকে কে বাঁচিয়েছিল সেদিন?”
“জানি না, সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার থাকায় চেহারা দেখিনি।”
“কন্ঠ শুনেছিলেন?”
“হুম।”
“একটা ভয়েস পাঠাচ্ছি, শুনে বলতে পারবেন উনি কিনা?”
“পারবো, ইনশাআল্লাহ।”
মৃত্তিকা কল কে°টে শরীফের একটা ভয়েস রেকর্ড পাঠায়। সারাহ্ কথা শুনে এক ঝ°ট°কায় চিনে ফেলে। কথার স্টাইল আর সুর একই।
সারাহ্ আবারো মৃত্তিকাকে কল দিয়ে বলল,
“আমার তো মনে হচ্ছে উনিই। কন্ঠ একদম সেম।”
মৃত্তিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে,
“আমি শিউর।”
“কে উনি?”
“আমার কাছের কেউ, যাকে আমি অনেক ভালোবাসি।”
এমনসময় মৃত্তিকার কাছে আসে ফাহাদ। বলে,
“এডভোকেট বিথীর স্বীকারোক্তি জানা গেছে। সে নিজের বিষয় ছাড়া, এখানে থাকা অপরূপার ব্যাপারে কিছুই বলেনি।”
মৃত্তিকা কল লাইনে রেখেই বলল,
“নিজের ব্যাপারে কি বলেছে?”
“বলেছে সে প্রাণের ভ°য়ে শাফিনের সাথে যুক্ত ছিল। এর আগেও নাকি একজন এডভোকেটকে শাফিন মে°রে ফেলেছিল, শুধুমাত্র তার বিরুদ্ধে কথা বলার অপ°রাধে। তাই বিথী এসব করেছে।”
“ওকে, তুমি যাও।”
ফোনের অপরপাশে থাকা সারাহ্ ওদের কথোপকথন সবই শুনে। বিথীকে সে চেনে না, তবে এটা তো বুঝেছে শাফিনকে যে এডভোকেট বারবার বাঁচিয়েছে সেও ধরা পড়েছে।
______________________________________
তিনমাস পেরিয়ে যায়, একে একে ফাঁ°সি হয়েছে রাব্বি, বিল্লাল, বিথীর। সম্পৃক্ততা থাকার প্রমাণে আরিফাসহ আরো চারপাঁচ জন অফিসারের যাবৎ জীবন কারাদন্ড হয়েছে। এমনকি শাফিনকে গোসল করানো সেই লোকদেরও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। শাফিনের অনেক লোকজনই এখন জেলে আছে।
তবে শাফিনের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। পিবিআই না পেলেও মৃত্তিকা পেয়েছে।
মমতাজ বেগমের মাধ্যমে জেনে নিয়েছে শাফিনের অবস্থান, সে সালদা নদী পেরিয়ে ভারতে চলে গেছিলো। শাফিনকে ফোনযোগে অনেকদিন না পেলেও, হঠাৎ-ই পরশু সে মমতাজ বেগমকে ফোন দেয়।
মমতাজ বেগম খুব স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলে সবটা জেনে নেয়। উনি শাফিনের খোঁজ জানতে নিজে থেকেই মৃত্তিকাকে সাহায্য করেছে। যদিও কারণটা মৃত্তিকার কাছে খুবই সহজ। মমতাজ বেগম চাচ্ছে মৃত্তিকা ম°রে যাক, তাও শাফিনেরই হাতে।
ভারতের ত্রিপুরায় সে এতোদিন অবস্থান করেছিল, এখন সে আবারো বর্ডার পেরিয়ে দেশে এসেছে। বিবির বাজার এলাকায় কোনো এক বাড়িতে সে আছে। সারাহ্-কে যেদিন অপ°হ°রণ করেছিল, সেদিনই শরীফের তাড়া খেয়ে সে পালিয়েছিল আর পরশুদিন ফিরে এসেছে।
সব খোঁজখবর যোগাড় করে মৃত্তিকা হাসপাতালে আসে, শরীফের সাথে দেখা করতে। শরীফ নিজের চেম্বারেই ছিল। মৃত্তিকা এসে কোনো অনুমতি ছাড়াই ভিতরে ঢুকে যায়।
শরীফ ওর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“পারমিশন ছাড়া ভিতরে আসলেন কেন?”
“বাবার চেম্বারে মেয়ের আসতে হলে পারমিশন লাগে না।”
শরীফ অবাক চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। উঠে ওর কাছে এসে বলে,
“মিউকো?”
“হুম, কথা আছে।”
“বসো।”
মৃত্তিকা এসে শরীফের চেয়ারেই বসে পড়ে। শরীফ হেসে পাশের সোফায় বসে। মৃত্তিকা বলে,
“আমি বিবির বাজার যাবো, শাফিন ওখানেই আছে।”
শরীফ ওর কাছে এসে বলে,
“একা?”
“একা হলে কি আর আপনার কাছে আসতাম? আপনিও যাবেন।”
“ইমতিয়াজ?”
“আপনি জানেন আমি ওকে সন্দেহ করছি, এখনো করি।”
শরীফ মাথা নেড়ে বলল,
“কবে যাবে?”
“আজই, বলা যায় না শাফিন কখন পালায়।”
“ঠিক আছে, বিকেলে রওনা দিবো। প্রস্তুতির প্রয়োজন।”
মৃত্তিকা তাতেই সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে আসার সময় বলে,
“শাফিনকে আমি জি°ন্দা ধরবো। অপরূপাকে আমি ওর সামনে মা°রতে চাই।”
______________________________________
সাড়ে সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা সারাহ্-র এখন সবকিছুতেই অস্বস্তি হচ্ছে। হাঁটা, বসা, শুয়ে থাকা, সবই যেন কষ্টের। কুরবানির ইদ গেল কয়েকদিন আগে, বেচারী তাতেও কোথাও বের হতে পারলো না।
ঢাকায় চলে এসেছে দুইমাস হলো। একদিন পর পর আহনাফ এসে দেখা করে। কিন্তু আহনাফকে দেখার তৃষ্ণা যে তাতে মেটে না, লজ্জায় তাকে বলতেও পারে না।
রুম থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে এসে টিভি ছাড়ে। মাঝে মাঝে কোমড়ের পিছনে হাত দিয়ে হাঁটে, ব্য°থা হয় বলে এই পদ্ধতি। এখনো সে এমন করেই হাঁটছে, পিছন ফিরে দেখে, সামিহা ওকে অনুকরণ করছে। ও তাকাতেই দৌড়ে পালিয়ে যায়।
সারাহ্ এসে সোফায় বসলে সামিহা আবারো ওকে অনুকরণ করতে থাকে। সারাহ্ রেগেমেগে নার্গিস পারভিনকে ডেকে বলে,
“আম্মু, দেখো তোমার মেয়ে কি করে?”
সামিহা হেসে কু°টিকু°টি। নার্গিস পারভিন এসে সামিহাকে বলে,
“আমি দেখছি কিন্তু এশা। নিজের সময় বুঝবি, এমন ফাজলামি কেউ করে?”
সারাহ্ হেসে উঠে বলে,
“দোয়া করো যেন ওর একসাথে চারটা বেবি হয়। মায়ের দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়।”
নার্গিস পারভিন মুচকি হেসে “আমিন” বলে চলে গেলেন। সামিহার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সারাহ্ এখনো হেসে যাচ্ছে।
______________________________________
বিকেল চারটায়, বিবির বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মৃত্তিকা ও শরীফ, সাথে আর কাউকে আনেনি ওরা। ইমতিয়াজও জানে না মৃত্তিকা কোথায়। কল দিতে পারে ভেবে মৃত্তিকা ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছে।
ঢাকা থেকে কুমিল্লা শহর, সেখান থেকে ব্রাহ্মণপাড়া থানা এবং সেখান থেকে প্রধান গন্তব্য বিবির বাজার চলে আসে। শরীফ নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছে। জিপিএস ব্যবহার করে জায়গা খুঁজতে সমস্যা না হলেও সময়টা কম লাগেনি, সব মিলিয়ে পাঁচ ঘন্টা লেগেছে ওদের।
রাত নয়টা বেজে গেছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা, অবশ্যই এখানে প্রতি পদক্ষেপে বি°পদ। মৃত্তিকাকে একহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে শরীফ।
“শাফিন, খোলামেলা জায়গায় অবশ্যই থাকবে না।”
শরীফের কথায় মৃত্তিকা জবাব দেয়,
“থাকতেও পারে, এমনও তো হতে পারে যে সে এলাকার কোনো প্রভাবশালীর বাসায় আছে।”
শরীফ চিন্তাভাবনা করে বলে,
“সামনে একটা জায়গা আছে। ওখানে প্রচুর ব্ল্যা°ক মার্কেটিং হয়, শাফিন কি ওখানে থাকতে পারে?”
মৃত্তিকা মাথা নাড়ে। তারপর বলে,
“একসাথে দুজন যাওয়া কি ঠিক হবে?”
“আমি তোমাকে একা ছাড়বো না।”
ধ°মক দিয়ে কথাটা বলে শরীফ।
শরীফের কথা মেনে নেয় মৃত্তিকা। দুজনে যায় সীমান্তের সেই স্থানে। রাতের আঁধারেও সেখানে লোকজন আছে। টর্চলাইট জ্বালিয়ে কাঁ°টা°তারের বেড়া কে°টে ওপার থেকে এপারে আর এপার থেকে ওপারে জিনিসপত্র আনা নেওয়া হচ্ছে।
এরমধ্যে একটা চেনা মুখ চোখে পড়ে। হ্যাঁ, এটা শাফিন। সম্ভবত এখানে সে শ্রমিকের কাজ করছে। কাজ শেষে টাকা নিয়ে সে হাঁটা লাগায়, যেন একপ্রকার অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
মৃত্তিকা-শরীফ একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে ওকে অনুসরণ করছে। শরীফ একটা লাঠি নিয়ে রাস্তা থেকে নেমে ঝোপের আড়ালে চলে যায়। মৃত্তিকা রাস্তার পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে শাফিনের সামনে দিয়ে চলে যায়।
বোরকা-নেকাব থাকায় শাফিন ওকে চিনতে পারে না। একটু দূরে গিয়ে মৃত্তিকা বসে যায়। শাফিন ওর কাছে আসলে মৃত্তিকা বলে,
“আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে, একটু সাহায্য করবেন। আমি প্রেগন্যান্ট।”
শাফিন যেন অদ্ভুত এক আনন্দ পায়, সে মৃত্তিকার বি°কৃত কন্ঠটা চিনে না। অনেকদিন হলো সেই চিৎকার সে শুনে না। নি°ষি°দ্ধ চাহিদা বেড়ে গেল তার, ঘোরে জড়িয়ে গেল সে।
শরীফ এখনো ঝোপের আড়ালে লুকানো। তার নজর শাফিনের পায়ের দিকে। এক আঘাতে ওকে কাবু করতে হবে।
মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে নেকাব খুলে স্বাভাবিকভাবে বলল,
“বলেছিলাম না মামা, সিংহী শি°কার করবে। দেখো শি°কার করতে চলে এসেছে।”
ওর মুখের দিকে টর্চ দিয়ে চেহারা দেখে শাফিন বলে,
“মিউকো।”
“ইয়া আল্লাহ্।”
বলে পেছন থেকে শাফিনের পায়ে আ°ঘা°ত করে ওকে ফেলে দেয় শরীফ।
শাফিনের হাত থেকে টর্চ নিয়ে শাফিনের মাথায় জোরে আ°ঘা°ত করে মৃত্তিকা। মাটিতে গ°ড়াগ°ড়ি খাওয়ার মূহুর্তটাই সুযোগ। ওর হাতপা, মুখ বেঁধে দেয়।
“এখন ওকে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে।”
মৃত্তিকা একটু হেসে বলে,
“আশা করি এটাও পারবো।”
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
সপ্তপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৭ পর্ব)
গাড়ির পিছনের সিটের নিচের অংশে শাফিনকে বেঁধে ফেলে রেখেছে। শরীফ ড্রাইভ করছে আর মৃত্তিকা পাশে বসা। শাফিনকে এমনভাবে রেখেছে যেন বাইরে থেকে না দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর পর শরীফ তার দিকে তাকাচ্ছে।
গাড়িতে উঠে মৃত্তিকার আবারো শরীর খারাপ হওয়া শুরু হলো। প্রচুর বমি হলো, আবার মাই°গ্রে°নের ব্য°থা। সিটে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম আসলেও, সে ঘুমাচ্ছে না। সারারাত জেগে থাকা মেয়েটা এই ভোররাতে আর কিভাবে চোখ খুলে রাখতে পারে? কিন্তু শাফিনের জন্য জেগে থাকতে হবে ওর।
শরীফ ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,
“একটু খাও, মুখেও দিয়ে নাও।”
মৃত্তিকা তাই করলো। শরীফ গাড়ির এসি বন্ধ করে মৃত্তিকাকে বলে,
“জানলা খুলে দাও।”
এরমধ্যে শরীফের ফোন বেজে উঠে। মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে ইমতিয়াজের নাম্বার দেখে বলে,
“ফোন অন রাখা জরুরি?”
“হাসপাতাল বা কোম্পানি থেকে কল আসতে পারে।”
বেজে বেজে কল কে°টে গেল। মৃত্তিকা ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দেয়। শরীফ এতে কিছুই বলে না। মেয়ে যে তার মতোই, কিছু বললেও শুনবে না।
রাস্তায় কোনো জ্যাম নেই। গাড়ি সাই সাই করে এসে পড়ে ঢাকায়। শাফিনকে শরীফের ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে নেয় না, ওকে মতিঝিলের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে।
জাহাঙ্গীর সাহেবের ফ্ল্যাটের একতলা উপরেই সেই ফ্ল্যাট, মানে পাঁচতলায়। এই মাসেই ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ায় ফাঁকা পড়ে আছে। বাসায় কোনো ফার্নিচার নেই, শুধু দুইরুমে লাইট লাগানো আছে।
বাসায় এসে শাফিনকে জানলার গ্রিলের সাথে শক্ত করে বেঁধে দেয়। মৃত্তিকা ফ্লোরে বসে পড়ে। হঠাৎ করে এতোটা লম্বা ভ্রমণ করায় সে ক্লান্ত।
শরীফ এসে ওকে বলল,
“ঠিক আছো?”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“যা আছি, ভালো আছি। অপরূপাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করুন।”
শরীফ চিন্তায় পড়ে যায়। মৃত্তিকা এখন আর ধানমন্ডি যেতে পারবে না, আবার ওকে এখানে একা রেখে শরীফের যেতেও ইচ্ছা করছে না। শাফিনকে একা রাখাও বি°প°জ্জনক।
মৃত্তিকা বুঝতে পারে শরীফের চিন্তা, আশ্বাস দিয়ে বলে,
“আপনি যেতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই।”
“তোমাকে একা রেখে?”
“আমি থাকতে পারবো।”
শরীফ যায় না। ফ্লোরে ওর পাশে বসে কল দেয় তানজিমকে। মতিঝিলের বাসার ঠিকানা আর ফ্ল্যাট নাম্বার দিয়ে, ওকে আসতে বলে। তানজিম দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে। সামিহার বাসায় শরীফ কেন যেতে বলছে?
তবুও সে বের হয়। বলা তো যায় না সামিহার কোনো বিপদ হলো কিনা। মাত্র কিছুক্ষণ আগে ফজরের আযান দিলো, এখনো সূর্য উঠেনি। নামাজ পড়েই বেরিয়ে যায় তানজিম।
এদিকে কাল থেকে মৃত্তিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ইমতিয়াজ। ফোনের পর ফোন দিচ্ছে, কিন্তু বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। মৃত্তিকার ছড়ানো মি°থ্যা যে সত্য হয়েছে, তা ইমতিয়াজ জানে। এখন শাফিন যদি কোনো ক্ষতি করে, এই ভ°য়ে ক্রমাগত তার ভী°তি বাড়ছে।
শরীফ নামাজ পড়ছে। ড্রইংরুমেই একপাশে সে নামাজে দাঁড়িয়েছে। মৃত্তিকা এখনো ফ্লোরে বসা। ফোন অন করে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারো ইমতিয়াজের কল আসে।
কল কা°টতে গিয়ে ভুলবশত রিসিভ করে ফেলে সে। এবারে আর কোনো উপায় না পেয়ে ফোন কানে দেয়।
“কোথায় তুমি, মিউকো?”
ইমতিয়াজের মুখ থেকে বারবার ‘মিউকো’ নাম শোনাটা মৃত্তিকার জন্য কষ্টেরই বটে। হতে পারে সে দোষী, খু°নি, অনেক কিছু। কিন্তু সে তো মৃত্তিকার ভালোবাসা নাম।
“মৃত্তিকা?”
এবারে ইমতিয়াজের কন্ঠে বেশ উৎ°ক°ন্ঠা বোঝা গেল। মৃত্তিকা মৃদুস্বরে বলে,
“হুম।”
“কোথায় আছো?”
“বাবার কাছে।”
মৃত্তিকার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে, কিন্তু সে একদম স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলছে।
“ফোন বন্ধ ছিল কেন?”
মৃত্তিকা নিশ্চুপ। ইমতিয়াজ আবারো বলে,
“বাসায় আসো।”
মৃত্তিকা কিছু না বলে কল কে°টে দেয়। ফোন দূরে ফেলে কাচুমাচু করে বলে থাকে। শরীফ নামাজ শেষে মৃত্তিকাকে দেখে বলে,
“নামাজ পড়ে নাও।”
শরীফের সাহায্য নিয়ে উঠে মৃত্তিকা ওয়াশরুমে যায়। অযু করে, নামাজ পড়ে নেয়।
শরীফ ওকে পাশের রুমে নিয়ে বলে,
“যা সহ্য করতে পারছো না, তা কেন করছো?”
“ইমতিয়াজ..”
কথা শেষ করতে পারে না মৃত্তিকা, কাঁদতে শুরু করে দেয়। শরীফ ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“মা আমার, এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না। ইমতিয়াজ শাফিনকে আগে থেকে চেনে, হতে পারে সে ওই পঞ্চম ব্যক্তি। তাই বলে নিজেকে শেষ করো না।”
মৃত্তিকা মাথা তুলে না। বাবার মিউকো বাবার বুকেই আশ্রয় নেয়। শরীফ ওর মাথায় হাত বুলায়। এমনসময় সদর দরজায় নক পড়ে। কলিং বেল নেই, তাই তানজিম এসে নক করেছে।
শরীফ গিয়ে দরজা খুলে বলল,
“আসো।”
তানজিম ভিতরে এসে শাফিনকে দেখে রেগে যায়। তেড়ে যেতে নিলে শরীফ ওকে থামিয়ে বলে,
“শান্ত হও। আগে পুরো কথা শুনো, তারপর ভেবে দেখো কি করবে।”
“কি কথা?”
“মিউকো।”
মৃত্তিকা বাইরে এসে দাঁড়ায়। তানজিম এখনো বি°ভ্রা°ন্তিতে আছে। শরীফ বলে,
“এখন তুমি তোমার বোনকে পাহারা দাও, আমি অপরূপাকে নিয়ে আসি।”
তানজিম আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায় না। শরীফ বেরিয়ে যায়। মৃত্তিকা শান্ত গলায় বলল,
“তানজিম, বসো।”
______________________________________
সকাল সকাল উঠে সারাহ্ ঘর গুছিয়ে ফেলছে। যেহেতু আজ বৃহস্পতিবার, তাই আহনাফ আজকে আসলে হয়তো দুইদিন থাকবে। সামিহা ভার্সিটিতে গেছে। এজন্য একা একাই সব কাজ সেরে ফেলছে সে।
মাত্রই ড্রইংরুম গুছিয়েছে সারাহ্। নার্গিস পারভিন নাস্তা এনে ওকে দিয়ে বলে,
“এশাটাও হয়েছে, নাস্তা না করেই দৌড় লাগিয়েছে।”
সারাহ্ মাথা নেড়ে বসে বলে,
“দিনে দিনে বয়স বাড়ার থেকে কমতেছে।”
“তাই তো দেখছি। (একটু থেমে) জামাই আজকে আসলে থাকবে তো।”
“জানি না, ওর তো আবার মত বদলাতে সময় লাগে না।”
নার্গিস পারভিন ওর পাশে বসে বলল,
“শাফিনের কোনো খোঁজ এখনো পায়নি। ভয় হচ্ছে আমার।”
“ভ°য় পেয়ে কি হবে মা? যা ভাগ্যে আছে, তা কি আর মুছে ফেলা যাবে।”
“তা ঠিক, কিন্তু…”
দরজার বাইরের একটা শব্দে দুজনের কথা হঠাৎ থেমে যায়।
“ছেড়ে দিন আমাকে।”
বলে জোরে কেউ চিৎকার করলো।
মায়ের বাধা উপেক্ষা করে গিয়ে সারাহ্ দরজা খুলে, লিফট বন্ধ হয়ে গেছে। মানে কেউ লিফটে করে কাউকে জোরপূর্বক নিয়ে যাচ্ছে।
লিফট পাঁচতলায় গিয়ে থেমেছে। শরীফ অপরূপাকে নিয়ে এসেছে। অপরূপা জোরাজুরি করে চারতলায় লিফট থামিয়ে চেঁচিয়েছে, নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা তার ব্যর্থ।
সারাহ্ও পাঁচতলায় যায়। সব ফ্ল্যাটই স্বাভাবিক লাগছে। সারাহ্ ঘুরে ঘুরে চারটা ফ্ল্যাট দেখে নেমে যেতে নিলে শরীফ বের হয়। আচমকা সামনে চলে আসায় সারাহ্ চমকে উঠে।
“সরি, সরি, ধা°ক্কা লেগেছে নাকি?”
শরীফের কথায় সারাহ্ মাথা নেড়ে বলল,
“না, আমি ঠিক আছে।”
শরীফ লিফট খুলে সারাহ্-র সাথেই নিজে উঠলো। বলে,
“গ্রাউন্ড ফ্লোর?”
“না, থার্ড ফ্লোর।”
“ওকে।”
কন্ঠটা সারাহ্-র চেনা লেগেও অচেনা। তবে ভেবেচিন্তে সে চিনে যায়। এই কয়েক মাসে মৃত্তিকার পাঠানো ওই ভয়েসটা সে এতোবার শুনেছে, এই কন্ঠ ভুলে যাওয়ার নয়।
সারাহ্ বাসায় চলে আসে। নার্গিস পারভিন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সারাহ্ ঠোঁট উলটে বলে,
“সব নরমাল, কিন্তু শব্দ একটা হয়েছে।”
“যাক, তোমার আর বাইরে যেতে হবে না। বাসায় থাকো।”
“হ্যাঁ, আমি তোমাদের একমাত্র বন্দিনী।”
অপরূপার পর এবারে মমতাজ বেগমকে আনতে গেছে শরীফ। তিনজনকে একসাথে করেই কথা বলবে ওরা। শরীফের যে রাগটা শাফিনের উপর জমে আছে তা সে যেকোনো মূল্যে বি°স্ফো°রণ ঘটাবে।
শাফিনের মুখোমুখি অপরূপাকে বেঁধে বসিয়েছে মৃত্তিকা। তানজিমকে এতোক্ষণ সে ভ°য়া°নক পারিবারিক অতীতটা বলেছে। তানজিম পুরো ঘটনা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। অতীতে একজনের চেয়ে অন্যজন নি°ষ্ঠুর। সেই নি°ষ্ঠুর°তার শাস্তি ওরা কেন পাচ্ছে? আর ওর বাবা? সন্তানের মুখ দেখেই কেন তার ভালোবাসার পরিবর্তন হলো? যদি তা না হতো তবে তার বোনেরা আজ বেঁচে থাকতো।
______________________________________
বিকালে আহনাফ বাসায় আসে। সামিহা দরজা খুলতেই ওর হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে সে নার্গিস পারভিন ও জাহাঙ্গীর সাহেবের সাথে কুশল বিনিময় করে। তারপর রুমে চলে যায়। কাঁধে ব্যাগ থাকায় বোঝা যাচ্ছে ও আজ রাতটুকু হলেও থাকবে।
সারাহ্ মাত্রই আসরের নামাজ পড়ে উঠেছে। জায়নামাজ রেখে ফিরতে গিয়েই আহনাফের সামনে পড়ে। আহনাফকে দেখে নিজের অজান্তেই হেসে দেয় সারাহ্।
“বাহ, ঘরে আসতেই বাবুর আম্মুর মিষ্টি হাসি৷”
সারাহ্ একটু লজ্জা পেয়ে বসে। আহনাফকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে সে হিজাব খুলে বলে,
“এরপরে শুধু কান্নাকাটি করবো।”
আহনাফ ব্যাগ রেখে শার্টের হাতার বোতাম সবে খুলতে শুরু করেছে, সারাহ্ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। একদম বুকে মাথা রেখে ওর সাথে মিশে গেছে। আহনাফ ওকে বেশ আলতো করে আগলে নেয়।
সারাহ্-র মাথায় চুম্বন করে বলল,
“বাবুটা লজ্জা পাবে মায়ের বেহায়াপনায়।”
সারাহ্ কিছু বলে না। সে নিজেই নিজের এই কাজে লজ্জায় ম°রছে। আহনাফের দিকে তাকানোর সাহসটুকু ওর অবশিষ্ট নেই। বুকের মধ্যিখানের স্থান দখল করেছে সে।
______________________________________
শরীফ হাসপাতালে গেছে, খুব জরুরি দরকার আছে বলেই যেতে হয়েছে। তানজিম এখনো বাসায় মৃত্তিকার কাছেই আছে।
মৃত্তিকা তানজিমকে বলে,
“আমি দশমিনিটের জন্য বাইরে যাবো। ওদের খেয়াল রেখো।”
“জি।”
বলে তানজিম মাথা হেলিয়ে সম্মতি দেয়।
মৃত্তিকা বাইরে গিয়ে কয়েকটা বড় বড় পে°রেক কিনে, সাথে একটা বড় হাতুড়ি নেয়। তারপর সে আবারো বাসায় ফিরে আসে। ড্রয়িং রুমে করা বিছানার উপর এগুলো রাখে। অপরূপা একটা শুকনো ঢোক গিলে।
অপরূপা জানে, এই মেয়ের দ্বারা অসম্ভব কোনো কাজ নেই। যেভাবে ওকে সি°গা°রেট দিয়ে পু°ড়িয়েছিল, গরম শি°কের ঘা দিয়েছিল, ওর মুখে সুই ঢু°কিয়েছিল, ঠোঁট সেলাই করার প্রস্তুতি নিয়েছিল, এমনকি ওর মুখে গরম পানি ঢে°লে ঝ°লছে দিয়েছিল। এই মেয়ে চাইলে, সমস্ত শরীরে পে°রেক ঢুকিয়ে দিতে খুব বেশি সময় নিবে না।
মৃত্তিকা শাফিনকে বলে,
“তুমি, জামিল, দুলাল- এই তিনজন ছাড়া খু°নের সাথে আর কে জড়িত?”
শাফিন একটু হেসে বলে,
“জামিল ম°রেছে, দুলাল ম°রেছে। আর ছিল কবির, যাকে তোমার মা সেদিন মে°রে ফেলেছে। আর আমি তোমার সামনে। কথা দিচ্ছি, তোমাকে না মে°রে এই শাফিন মরবে না।”
মৃত্তিকা বুঝতে পারে, মমতাজ বেগমের কথা সাথে শাফিনের কথার মিল আছে, চতুর্থ ব্যক্তি কবির।
“আর কে কে ছিল?”
শাফিন এবারে জোরে জোরে হেসে ওঠে। ওর হাসি শুনে মৃত্তিকার রাগ বাড়ে। ডান হাতের বাঁধন খুলে তা দেয়ালে চেপে ধরে তানজিমকে বলে,
“একটা পে°রেক দাও।”
মৃত্তিকার কথায় একটা ভ°য়া°নক রাগ আর ক্ষোভ আছে। তানজিম পে°রেক দিলে মৃত্তিকা শাফিনের হাতের উপর তা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“হাতুড়ি।”
হাতুড়ি পাওয়া মাত্রই পে°রেকে আ°ঘাত করা শুরু করে মৃত্তিকা। হাতের তালু এ°ফোড় ও°ফোড় হয়ে পে°রেক গিয়ে লাগে দেয়ালে। শাফিন চিৎকার করতে নিলে, তানজিম কিছুক্ষণ আগে পে°রেকের সাথে আসা বড় শপিং ব্যাগটা ওর মুখে ঢু°কিয়ে দেয়।
মৃত্তিকা কি°ড়মি°ড় করে বলল,
“মুখ বন্ধ করো না। আমি ওর চিৎকার শুনতে চাই।”
গড় গড় করে র°ক্ত বেয়ে পড়তে লাগলো। সাদা দেয়াল মুহূর্তেই র°ঞ্জিত হয়ে গেল। মৃত্তিকার অ°গ্নিকু°ণ্ডের ন্যায় চোখের দিকে তাকিয়ে শাফিন যেন নিজের মৃ°ত্যু দেখছে।
শপিং ব্যাগটা বের করে মৃত্তিকা জিজ্ঞাসা করে,
“দ্বিতীয়বার সুযোগ দিলাম এবার বলো আর কে কে ছিল?”
“পঞ্চম ব্যক্তি বেঁচে আছে, আমি ম°রে গেলেও সে তোমাকে মা°রবে। তবে আমি চাই তাহমিনার মতো করে তোমাকে মা°রতে।”
হাতে লাগানো পেরেকটা মৃত্তিকা ঘুরাতে শুরু করে। এবারে মুখ খোলা থাকায় শাফিন জোরে চেঁচিয়ে উঠে।
মৃত্তিকা বলে,
“এই হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না ওদের? খুব আনন্দ হতো ওদের চিৎকার শুনে? এখন আমি তোমার চিৎকার শুনে, খুব আনন্দ পাচ্ছি, খুব খুশি লাগছে আমার।”
মৃত্তিকা আরেকটা পে°রেক নিয়ে শাফিনের পায়ের পাতায় গেঁথে দেয়। শাফিনের ভ°য়ংকর এক মৃ°ত্যু চিৎকার বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। কিন্তু তবুও মৃত্তিকা থামে না, জোরে জোরে হাতুড়ি পি°টিয়ে পে°রেক আরও শক্ত করে দেয়। পায়ের পাতা ভেদ করে তা গিয়ে লাগে শক্ত টাইলসের গায়ে। মমতাজ বেগম পাশের রুমে থাকায়, এখানে ঘটনা উনি দেখেন না। তবে শব্দ উনি শুনেছেন।
“আপু, থামো। সে ম°রে যাবে, আর আমি চাই না এতো তাড়াতাড়ি সে ম°রে যাক।”
তানজিমের কথায় মৃত্তিকা সরে আসে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এর মধ্যেই মনে হয় ইমতিয়াজের কথা। ওকে তো বাসায় যেতে বলেছিল, ও শোনেনি। হয়তো ইমতিয়াজ এখনো ওকে খুঁজছে।
______________________________________
হঠাৎ করে উপরের ফ্ল্যাটে খুব জোরে শব্দ হওয়ায়, সারাহ্ চমকে সরে আসে। আহনাফ হেসে উঠে একটু জোরে বলে,
“বাবুটা আমার, তোমার আম্মাজানের নির্লজ্জতায় লজ্জা পেয়ো না। সে একটু এমনই।”
“আহনাফ।”
সারাহ্-র ডাকে আহনাফ ওর সামনে মুখ দিয়ে বলে,
“আহনাফ বলবে না। হুটহাট নাম ধরে ডাকা আমার পছন্দ না, কেন ভুলে যাও এটা?”
সারাহ্ কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
“ওকে, একটা গল্প বলি। একসময় মানুষ স্বামীর নাম ধরে ডাকাকে খুব বড় অপ°রাধ মনে করতো, গল্পটা ওই সময়ের। এক মহিলা নদী পার হবে, তো তার নৌকা লাগবে। কিন্তু মহিলার কাছে কোনো টাকা নেই, এখন সে তার স্বামীর নাম বলে নদী পার হয়ে যাবে। পরে স্বামী টাকা শোধ করে দিবে। কিন্তু স্বামীর নাম তো সে বলতে পারবে না তাই মাঝিকে বলেছে- চব্বিশ গুণ দুই আর তিন গুণ চার, যোগ করে পেয়ে যাবেন সোয়ামির নাম আমার। তাহলে তার স্বামীর নাম কি?”
আহনাফ হেসে উঠে বলে,
“কি হবে?”
“কি আবার? চব্বিশ গুণ দুই মানে আটচল্লিশ, তিন গুণ চার মানে বারো। যোগ করলে হয় ষাট। মানে তার স্বামীর নাম ষাটেশ্বর।”
আহনাফ দাঁত বের করে হাসে। সারাহ্ বলে,
“উহু, হাসলে হবে না। নিজের নামের এমন সূত্র বের করেন ফিজিক্স স্যার। নাইলে দেখবেন কি করি?”
আহনাফ ওর কাছে এসে বলে,
“কি করবা?”
সারাহ্ ওকে সরিয়ে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে নেন। তারপর বলবো।”
______________________________________
রাতে শরীফ বাসায় এসে শাফিনের এ অবস্থা দেখে ওর হাতে আর পায়ে ব্যা°ন্ডে°জ করে দেয়। মৃত্তিকাকে ধ°মকে বলে,
“নিজের এই অবস্থায় তুমি ওকে কেন এভাবে আ°ঘাত করেছো? তুমি জানো এই কাজের প্রভাব তোমার বেবির উপর পড়তে পারে? এত ভারী জিনিস তুমি কেন তুলছো?”
সত্যিই হাতুড়িটা অনেক ভারী ছিল। বড়সড় পে°রেক ঢুকানোর, বড়সড় হাতুড়ি এটা। স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি ভারী হবে।
মৃত্তিকা কিছু বলে না। নিরবে প্রস্থান করে। বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চোখের জল বি°স°র্জন করতে থাকে। রিপার জন্য শরীফের কান্না এক আল্লাহ আর শরীফ ছাড়া আর কেউ যেমন জানেনা, ঠিক তেমনি ইমতিয়াজের জন্য মৃত্তিকার কান্না আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।
শরীফ শাফিনকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মা°রতে শুরু করে। শাফিনের নাক মুখ দিয়ে র°ক্ত ঝরছে, গালে র°ক্ত জমাট বেঁধে কালো বর্ণ ধারণ করেছে।
আবারো একটা গরম শি°ক আনা হয়। তবে সেটা অপরূপার জন্য না, এটা শাফিনের জন্য। শাফিনের গায়ের শার্ট অনেকক্ষণ আগেই শরীফ খুলেছে, বুকে-পেটে বিরতিহীনভাবে আ°ঘাত করেছে সে।
শি°ক এনে শাফিনের বুকের বামপাশে ধরে শরীফ বলে,
“অতিরিক্ত গরমে শিলাও গলে যায়, এখন আমি দেখতে চাই তোমার হৃদপিণ্ড গ°লে কিনা। (একটু থেমে) আর কে কে ছিল? সত্যি করে বলো।”
মৃত্তিকা বেরিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়ায়, উঁকি মে°রে দেখতে থাকে শরীফের সেই পুরনো ভ°য়ংকর রূপ।
অবশেষে শাফিন চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“ইমতিয়াজ ছিল, ইমতিয়াজ।”
পেছনের দেয়ালের সাথে ধা°ক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় মৃত্তিকা। জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“সবকিছুকে গুছিয়ে দাও তুমি, আল্লাহ্। আমার ইমতিয়াজকে এতো নি°কৃষ্ট করো না। আমার এতো বড় পরীক্ষা তুমি নিও না, হে আল্লাহ্।”
চলবে……