#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দ্বিপঞ্চাশৎ পর্ব (৫২ পর্ব)
অপরূপা দরজা খুলে থেমে যায়। ইমতিয়াজ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অপরূপা একটু পিছিয়ে আসে। ইমতিয়াজ বাসায় ঢু°কেই দরজা লাগিয়ে দেয়। অপরূপার ডানগালের অবস্থা সে দেখে, সেখানেই একটা চ°ড় বসিয়ে দেয়৷
“আমি শুরুতেই সন্দেহ করেছিলাম মৃত্তিকা কিছু একটা করছে।”
ইমতিয়াজের সাথে অপরূপার পেরে উঠা সহজ কথা নয়। অপরূপার হাত উ°লটে পেছনে এনে টেনে ধরে ইমতিয়াজ। দুহাত দুইদিকে ধরে জোরে টা°ন দেয়।
অপরূপা চেঁ°চিয়ে উঠে, হয়তো হাত মচকে গেছে। প্রচুর ব্য°থা অনুভব হচ্ছে। ডাইনিং এর চেয়ারের সাথে ওকে বেঁধে রেখে ফাহাদকে টেনে তুলে বলে,
“কেমন পুরুষ তুমি? একটা মেয়ের সাথে পারো না?”
ফাহাদের নাকেমুখে পানি দেয় ইমতিয়াজ। কিছুটা ঠিক লাগলে সোফায় বসিয়ে দেয়৷ ফাহাদ নিচুস্বরে বলে,
“ম্যাডাম কিছুক্ষণ পরই চলে আসবে।”
“আসুক।”
ইমতিয়াজ অপরূপার সামনে চেয়ার টে°নে বসে। মৃত্তিকা নিষেধ করার পরেও ওর সকল তথ্য ইমতিয়াজকে দিয়েছে ফাহাদ। গতরাতেই দিয়েছে, তাইতো আজ সকাল সকাল এসে হাজির হয়েছে সে।
ইমতিয়াজ পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে অপরূপাকে বলে,
“শাফিনের সাথে যুক্ত আছো, তবে এটাও জানো শাফিন কোথায় আছে?”
অপরূপা চুপ থাকায় ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“দেখো, যে লোক জামিল আর দুলালকে মারতে পারে সে তোমাকেও মারতে পারবে। এটা ওর কাছে কোনো বিষয়ই না।”
কথা বলতে বলতে অপরূপার নাম্বার থেকে মৃত্তিকার নাম্বারে ডায়াল করে, রিং হচ্ছে।
ইমতিয়াজ অপরূপাকে বলে,
“ম্যাডামকে আসতে বলো। আমার কথা জানিও না।”
মৃত্তিকা রিসিভ করে, অপরূপা বলে,
“মৃত্তিকা, বাসায় কেউ একজন এসেছে।”
মৃত্তিকা চমকে উঠে। সে এই বাসায়ই আসছিল। চটপট করে বলে,
“কে এসেছে?”
কল কে°টে যায়। মৃত্তিকা আবারো কলব্যাক করলে ইমতিয়াজ কে°টে দেয়। মৃত্তিকা চিন্তিত হয়। এ আবার কোন নতুন সমস্যা?
______________________________________
“শাফিনকে আমি একসময় পছন্দ করতাম। অন্যরকম সম্পর্ক ছিল আমাদের। নার্গিস, রিপা ওরা জানতো আমাদের কথা। তবে ওই দুইটা খু°নের পর আমি সম্পর্ক শেষ করে দিই। শাফিন মেনে নিতে পারেনি এটা। অনেক ঝা°মেলা করেছে আমার সাথে। মানিনি, নিজের জে°দ নিয়ে বসেছিলাম। তখনও আমি ওর অতীত সম্পর্কে জানতাম না। আমি জানতাম না শাফিন রিপাকে পছন্দ করতো।”
একটু থামেন রোমি খন্দকার। তারপর আবারো বলেন,
“আমরা যখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি তখন রিপা জেনেছিল শাফিন বিভিন্ন অ°বৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত। সে শাফিনকে কয়েকবার সর্তক করলেও শাফিন তা মানে না। বরং রিপা যখন মিউকোকে নিয়ে প্রেগন্যান্ট ছিল, তখন…”
রোমি খন্দকার থেমে গেলে সারাহ্ বলে,
“আমি জানি বাকিটা কি?”
রোমি খন্দকার মাথা নেড়ে বলল,
“সেদিন খুব ভয়ংকরভাবে সে আমাদের উপর ক্ষে°পেছিল। তারপর যদিও নার্গিসের বিয়ে হয়ে যায় আর সে অন্য এলাকায় চলে যায়। তবে আমরা ওর এসব সামনে আনতে ম°রিয়া হয়ে ছিলাম। নার্গিস একটা পরিকল্পনা করে, আর সে অনুযায়ী আমি শাফিনের ব্যবসার একটা ভাগ নিয়ে ওর সাথে যুক্ত হই। খুব কাছ থেকে আমি ওর এসব দেখেছিলাম। যত জায়গায় ডিল করেছে সব কাগজ আমি হাতে পেয়েছিলাম। এই ফাইলে সেগুলোর নকল আছে।”
আহনাফ উনার কথাগুলো সব ভিডিও করছে। সে বলে,
“তা না হয় বুঝলাম, তবে এতো বছর পর কেন সে আপনাদের পিছু লেগেছে?”
“ও লাগেনি আমরা লাগিয়েছি, না চাইতেই লাগিয়েছি।”
সারাহ্ একটু অবাক হয়। বি°পদ কেউ ডেকে আনে নাকি?
“রিপার ডি°ভো°র্সের পরপর শাফিনের নামে একটা কে°ইস করেছিল সে। এতে শাফিনের কিছুই হয়নি, জে°লেও যায়নি, কেউ জানেও নি। শাফিনের নজর তখন রিপার উপর তীব্র, আমার বা নার্গিসের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানেনি তখন। তারপর রিপা ইতালি চলে যায়, প্রায়ই দেশে আসতো তবে শাফিনের গোপনে। একের পর এক কুকর্ম সে চালিয়ে যাচ্ছিল, অথচ পুরো সমাজে তার একটা ভদ্র চেহারা ছিল। কোনো কে°ইস তার কিছু করতে পারেনি, লিগ্যাল রাস্তাগুলো যেন তার জন্য বন্ধ। রিপা অনেকবার দেশে এসেছিল, রিপা আর নার্গিস মিলে অনেক চেষ্টা করেছে। তবে কাজ হয়নি। রিপা সমসময় আমাদেরকে লুকিয়ে রেখে নিজে সামনে থাকতো। (একটু থেমে) শেষবার রিপা দেশে আসে ওর বোনের মেয়ের বিয়েতে।”
আহনাফের দৃষ্টি স্থির হয়। রোমি খন্দকার থামে না,
“বিয়ের কয়েকদিন আগে নার্গিস শাফিনকে মে°রে ফেলার পরিকল্পনা করে, রিপা সম্মত হয়। এছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। কাজটা আমাকে করতে হতো। করতে পারিনি, উলটো নার্গিসের পরিকল্পনা সম্পর্কে সে জেনে যায়। নার্গিসকে সে ভ°য়া°নকভাবে টার্গেট করেছিল। তারপর যতটুকু শুনেছি রিপা…”
আহনাফ মাঝ থেকে বলে উঠে,
“তাহসিনার বিয়েতে রিপা বেগম মা°রা যায়।”
রোমি খন্দকার আহনাফের দিকে তাকায়, সারাহ্ও তাকায়। রোমি খন্দকার মাথা নেড়ে বলেন,
“হ্যাঁ, এর আগের রাতে রিপার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। রিপা বলেছিল ওর বোনের দুজন মেয়েই নাকি মামার কথা জেনে গেছে, তাই ছোট মেয়ে মানে যার বিয়ের কথা ছিল তাকেও নাকি পা°চারের হু°মকি দিয়েছিল। তোমাদেরকে এসবের সাথে আমরা জড়াতেই চাইনি সারাহ্।”
আহনাফ ভিডিও সেভ করে ফোন রেখে বলল,
“সবকিছুর জন্য তবে আপনারাই দায়ী, তবুও এতোদিন আপনারা চুপ ছিলেন। এতোটা বছর গু°ম°রে ছিলেন। আজও আমাদের জানাতে চাচ্ছেন না, আরো কয়জন মানুষ ম°রলে জানাতেন আপনারা?”
রোমি খন্দকার মাথানিচু করে ফেলে। সত্যিই তার নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। আহনাফ বেরিয়ে যায়। সারাহ্ বের হতে নিলে রোমি খন্দকার ওর হাতে ফাইলটা দিয়ে বলে,
“এটা মিউকোকে দিয়ে দিও। রিপার বড়বোন আরো অনেক কিছুই জানে, এখানে অনেক ষড়°যন্ত্র আছে সারাহ্।”
“আপনারাও সেই ষড়°যন্ত্রেরই অংশ হয়েছেন আন্টি। চাইলে আরো আগেই অনেক কিছু করা যেতো। এতোগুলো নিরীহ মানুষকে ম°রতে হতো না।”
সারাহ্ ফাইল নিয়ে বেরিয়ে যায়। মায়ের উপর প্রচন্ডভাবে রেগে আছে সে। সব জেনেও কেন বারবার গোপন করেছে উনি।
______________________________________
ঘন্টাখানেক পর মৃত্তিকা এসে বাসার দরজা খুলতে নিয়ে বুঝতে পারে দরজা ভেতর থেকে আটকানো। ব্যাগ থেকে পি°স্ত°ল বের করে বামহাতে রেখে বেল বাজায় সে৷
ফাহাদ এসে দরজা খুলে। মৃত্তিকা ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
“কে এসেছে বাসায়?”
মৃত্তিকা ভিতরে এসে ইমতিয়াজকে দেখে হাত থেকে পি°স্ত°ল পড়ে যায়। অপরূপাকে বাধা অবস্থায় চেয়ারে বসে থাকতে দেখে।
“ইমতিয়াজ।”
ইমতিয়াজ একটু মাথা নাড়ে। চেয়ার ইশারা করে বলে,
“বসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
মৃত্তিকা চেয়ারে বসে। ইমতিয়াজ ওর দিকে ঝুঁকে বলল,
“এতো লুকোচুরি কেন আমার সাথে? বিশ্বাস করতে পারো না?”
“ও তোমাকে মোটেও বিশ্বাস করে না, তুমি..”
অপরূপার কথার মাঝেই ইমতিয়াজ ওর গালে ঠা°টিয়ে একটা চ°ড় লাগায়। মৃত্তিকা চমকে উঠে।
ইমতিয়াজ বলে,
“ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে কোনো লাভ নেই।”
“ইমতিয়াজ, এটা আমার ফ্যামিলির সমস্যা, তাই আপনাকে জড়াতে চাইনি।”
ইমতিয়াজ রাগে চেঁ°চিয়ে উঠে,
“তোমার ফ্যামিলি কি আমার ফ্যামিলি নয়? তাহমিনা কি আমার কেউ নয়?”
মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“শান্ত হন। আপনার ভ°য়ং°কর চেহারা আমার ভালো লাগে না।”
ইমতিয়াজ শান্ত হয়। ওর রাগ ভ°য়াবহ রকম, সে জানে এটা। তাহমিনাও তার রাগকে ভ°য় পেতো।
সময় গড়ায়, দুপুর ছাড়িয়ে বিকাল আর বিকাল ছাড়িয়ে রাত হয়। এরমধ্যে একটা পরিকল্পনা সাজানো হয় ওদের। নিজেদের ছোট এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেই শাফিন ধরা পড়ে যাবে। তবে এতে কিছুটা সময় লাগবে।
ইমতিয়াজ আজ এ বাসায়ই থাকবে। অপরূপাকে আর যাই হোক, ফাহাদের কাছে ছাড়া মোটেও ঠিক হবে না। মৃত্তিকা চলে গেছে তানজিমের বাসায়। মমতাজ বেগমকে প্রতিদিন সে নিয়ম করে এককাপ চা খাওয়াচ্ছে, ঘুমের ওষুধ মেশানো চা।
______________________________________
একমাস পর,
কয়েকদিন ধরেই কাগজপত্র অদৃশ্য হচ্ছে এডভোকেট বিথীর। সব নয়, বেছে বেছে কিছু কাগজ পাচ্ছে না। এটা নিয়ে শাফিনের সাথে কথা বলতে বলতে বাসায় ফিরছে। রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে। নিজের গাড়িতে করেই ফিরছে সে। ড্রাইভার গাড়িটা বাসার দিকে না নিয়ে অন্যরাস্তায় নিচ্ছে দেখে বিথী ফোন রেখে বলে,
“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“তা তো আমি জানিনা।”
কন্ঠটা বিথীর ড্রাইভারের মতো লাগেনি। ধ°মক দিয়ে বলে,
“কে আপনি?”
“হয়তো কেউ, যে আপনার পরিচিত নয়। চিৎকার করবেন না, আপনি গান পয়েন্টে আছেন।”
গাড়ি থামে শরীফের বাসার সামনে। দরজা খুলে ড্রাইভারের আসন থেকে ইমতিয়াজ বের হয়। উনাকে হেঁচকা টা°নে বের করে বাসার ভিতরে নিয়ে যায়।
মৃত্তিকা বাসার ভিতরেই ছিল। বিথীকে এনে ড্রইংরুমে বসিয়ে ইমতিয়াজ দরজা লাগায়। তারপর ফাহাদকে কল দিয়ে বলে,
“এখন চালু করো।”
“ওকে।”
এতোক্ষণ বাসার সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। এখনই মাত্র চালু হলো। ইমতিয়াজ বিথীকে চেয়ারের সাথে বেঁধে দেয়। অপরূপা আর বিথী মুখোমুখি।
অপরূপার চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। একমাসে তার চেহারায় কোনো বিলাসিতার ছোঁয়া পড়েনি। উলটো সকাল-সন্ধ্যা মৃত্তিকার অ°ত্যা°চারে সে অ°তিষ্ঠ। দুহাত ভে°ঙে গেছে, ব্যান্ডেজ করা আছে সেখানে। সুন্দর চেহারাটা এখন আর সুন্দর লাগছে না, কেমন যেন অগোছালো হয়ে গেছে।
“একে চেনেন?”
খুব শান্তভাবে বিথীর কানের কাছে কথাটা জিজ্ঞাসা করে ইমতিয়াজ। বিথী চুপ করে আছে। ইমতিয়াজ সোজা হয়ে মৃত্তিকাকে বলে,
“শাফিন নি°র্ঘাত এদেরকে শাটআপ ডো°স দিয়েছে।”
মৃত্তিকা একটু হেসে বলে,
“বকবক ডো°স লাগবে বোধহয়।”
মৃত্তিকা এসে বিথীর গাল চেপে ধরে বলল,
“তোমার কাগজপত্র আমি গা°য়েব করেছি। তোমরা চুপ থেকে কয়দিন বাঁচবে আমিও দেখবো।”
বিথী গাল ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“আমি যা করেছি নিজের জন্য করেছি, আর কিছু না। আমি উকিল, আমি এমনটা করতেই পারি।”
“ন্যায়-অ°ন্যায় বোধটা তোমার নেই। অথচ তোমরাই মোটা মোটা আইনের বইপুস্তক পড়ো।”
মৃত্তিকা বিথীকে চেয়ার থেকে খুলে ওয়াশরুমে নিয়ে আসে। এক বালতি পানিতে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। হাত তার পেছনে বাধা, চাইলেও সে মৃত্তিকাকে সরাতে পারবে না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার।
বেশ কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা তার মাথা তুলে বলে,
“এখন তো বলবে?”
“উকিলের কথার প্যাঁ°চ নিতে পারবে না।”
“আর তুমি আমার প্যাঁ°চ নিতে পারবে?”
আবারো একই কাজ করে সে। বারবার করলেও বিথী মুখ খুলে না। রাগে মৃত্তিকার গা রিরি করতে শুরু করেছে। বিথী বুঝতেও পারছে না এতে তার উপর অ°ত্যা°চারের মাত্রা কেবলই বাড়বে।
______________________________________
সারাহ্ আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখছে সে। স্পষ্ট একটা মাতৃকালীন সৌন্দর্য এসেছে তার মধ্যে।
আহনাফ রুমে এসে ওকে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“নিজেকে এভাবে মুগ্ধ হয়ে দেখছো?”
সারাহ্ ফিক করে হেসে উঠে বলল,
“না তো।”
আহনাফ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তবে যে চেয়ে আছো?”
দুজনেই আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। সারাহ্-র হাসিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আহনাফের হাতের উপর হাত রেখে বলে,
“আমার ভ°য় করছে আহনাফ?”
“কেন? শাফিনের ভ°য় পাচ্ছো?”
আহনাফ ওকে ঠিক বুঝে। সারাহ্ আহনাফের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বলে,
“তাহমিনা আমার মতোই ছিল, তাই না?”
আহনাফ ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
“থামো ঐশী, আমার সহ্য হবে না।”
সারাহ্ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আহনাফ, এমনও তো হতে পারে আম্মু আর আন্টি আমাদের ভালোর জন্যই এসব লুকিয়েছে।”
“কোনো ভালো তো এতে হয়নি।”
“উনারা তো চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারে নি। আন্টি তার মেয়েকে হারিয়েছেন। তাহলে তো আম্মুও তার..”
সারাহ্ নিজে থেকেই থেমে যায়। আহনাফও চুপ থাকে। দুজনই কাঁদছে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখছে না।
______________________________________
সূর্য উঠে, সকাল হয়। আজ শরীফ অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসবে। মৃত্তিকাকে কথাটা জানায়নি ইমতিয়াজ। ভোরে ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। সকাল সাতটায় বাসায় চলে এসেছে শরীফ।
ইমতিয়াজ আজ অফিসে একটু দেরি করে যাবে। মৃত্তিকা এখনো ঘুমাচ্ছে, কালরাতটা এখানেই কা°টিয়েছে সে। এমনি মিউকোকেও সাথে এনেছে, ওকে নিয়েই আরামে ঘুমাচ্ছে সে। কলিং বেল শুনে তার ঘুম ভা°ঙে।
মিনমিনে স্বরে বলল,
“ইমতিয়াজ, কে এসেছে?”
ইমতিয়াজ পাশে বসে ফোন দেখছিল।
“দেখছি।”
বলে ফোন রেখে সে উঠে যায়।
দরজা খুলে শরীফকে দেখে কোলাকুলি করে সে। ইমতিয়াজ তো জানে শরীফ এখন আসবে। শরীফ ড্রইংরুমে বসে বলল,
“মিউকো কি ঘুমাচ্ছে?”
“হুম।”
ডাইনিং এ বাধা অবস্থায় আছে অপরূপা ও বিথী। দুজনেই মাথা হেলিয়ে রেখে ঘুমাচ্ছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ফাহাদ। ইমতিয়াজের থেকে প্রায় সকল কথাই শরীফ জেনেছে আর শরীফের কথামতোই কাল বিথীকে তুলে এনেছে ইমতিয়াজ।
শরীফ ওদেরকে ইশারা করে বলে,
“কান টা°নলে মাথা আসবে। তবে আসল কানটা এখনো বাকি।”
“আসল কান?”
মৃত্তিকা চোখ কচলে উঠে আসে। শরীফকে দেখে চমকে উঠে বলল,
“আজকে আপনার দেশে আসার কথা ছিল নাকি?”
শরীফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“না, সারপ্রাইজ।”
মৃত্তিকা রান্নাঘরে গিয়ে চা বসায়। ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“সারপ্রাইজ? ঢং যতসব।”
সারাদিন শরীফ বাসায় থাকলেও মৃত্তিকা তার সাথে একটা কথাও বলে না। সেই জে°দ, সেই রাগ মৃত্তিকার মধ্যে খুঁজে পায় শরীফ। মায়ের মেয়ে মায়ের মতোই, বাবার মতো হিং°স্র°তা ছাড়া আর কিছুই নেই।
সন্ধ্যার পর শরীফ হাসপাতালে যায়। পল্লবী সবটা সামলে নিলেও নিজেকে তো কিছুটা দেখতেই হবে।
মৃত্তিকা চুল আঁচড়াচ্ছে আর ভাবছে। গভীর ভাবনায় মগ্ন সে। শাফিনকে কিভাবে দ্রুত হাতে আনবে? চিন্তা এই একটাই। হঠাৎ মৃত্তিকার মাথায় সেই পুরোনো শর্টকাট বুদ্ধিটাই আবার খেলে গেল।
শাফিন যেহেতু প্রেগন্যান্ট মেয়েদের দিকে আ°কৃষ্ট হয়, তাই ওর প্রেগন্যান্সিই পারে শাফিনকে দ্রুত সম্মুখে আনতে। তবে কি সে মি°থ্যা খবর ছড়িয়ে দিবে? ইমতিয়াজ জানলে ওকে কি বলবে?
ইমতিয়াজ এমনসময় রুমে আসে।
“মৃত্তিকা, কলরব আজ অফিস জয়েন করেছে।”
মৃত্তিকা পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ে মাথানিচু করে ফেলে। ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে লজ্জা পাচ্ছে। ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকায়, ওর কথায় লজ্জার কি খুঁজে পেল মৃত্তিকা বুঝে না সে।
ইমতিয়াজ ওর সামনে এসে বলল,
“কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
মৃত্তিকা ওকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে মাথা রেখে দুহাতে পিঠের দিকের শার্টের অংশ মুঠোয় ধরে। ইমতিয়াজ ওর মুখটা দেখতে পারে না।
ইমতিয়াজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“মৃত্তিকা?”
চলবে…..
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ত্রিপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৩ পর্ব)
সকাল দশটা, কলেজে ক্লাস করাচ্ছে আহনাফ। বেশ কয়েকবার কল আসলেও ফোন সাইলেন্ট থাকায় সে দেখেনি। গালিব বারে বারে ওকে কল করছে।
রোমি খন্দকারের থেকে আনা ভিডিওটা গালিবকে পাঠিয়েছিল আহনাফ। আহনাফের সন্দেহের উপর ভিত্তি করে শাফিনের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ইন্সপেক্টর ফজলে রাব্বি, জেলার বিল্লাল হোসেনকে গ্রে°ফ°তার করা হয়েছে। ওরা অপ°রাধ স্বীকার করেছে, ওদের ভাষ্য অনুযায়ী শাফিন এখন কুমিল্লাতে আছে এবং সে নার্গিস পারভিন ও রোমি খন্দকারকে না মে°রে কিছুতেই শান্ত হবে না, আর সাথে মৃত্তিকা তো আছেই।
ক্লাস শেষে বেরিয়ে ফোনে এতোগুলো কল দেখে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে আহনাফ। আবার দুইটা ভয়েস ম্যাসেজও আছে।
আহনাফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ম্যাসেজ দুটি চালু করে,
“শাফিন কুমিল্লাতে আছে, জেলার বিল্লাল হোসেনকে আজকে ঠাকুরগাঁও থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। দুজন ক°ড়া নজরে আছে, পালানোর কোনো রাস্তা খোলা নেই। আজকে র্যাবের দুইটা টিম শাফিনকে খুঁজতে কুমিল্লা যাবে, তবে আপনি আর আপনার ফ্যামিলি একটু সাবধানে থাকবেন। নার্গিস পারভিন ও রোমি খন্দকারের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে আছে।”
ম্যাসেজগুলো শুনে আহনাফ একটু থম মে°রে যায়। শাফিন কুমিল্লায় আছে, এইটুকু ওর চিন্তার জন্য যথেষ্ট।
ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছে সারাহ্। বড় আবায়া পড়ে নিজের শরীর আবৃত করে রেখেছে। আহনাফ এসে ক্লাসরুমের দরজা বরাবর বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
সারাহ্ ওকে দেখেনি, সে মনোযোগ দিয়ে একটা গাণিতিক সমস্যা সমাধান করছে। ক্লাসের কয়েকজন ছাত্রী ওকে খেয়াল করে৷
একজন সারাহ্-কে ডেকে বলে,
“ম্যাম, স্যার এসেছেন।”
সারাহ্ কপাল কুঁচকে দরজার দিকে তাকালো। তারপর ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলে,
“এখন কি স্যারের ক্লাস?”
“নো ম্যাম।”
সারাহ্ ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
“এখানে আসার কি দরকার?”
“আমার সাথে বাসায় যাবে, আগে একদম কলেজ থেকে বের হবে না।”
আহনাফ চলে যেতে নিলে সারাহ্ ওকে ডেকে বলে,
“কেন?”
“যা বলেছি শুনো।”
সারাহ্ ক্লাসে ফিরে আসে। আহনাফের এসব আচরণ ওর একদম অদ্ভুত লাগে। হুট করে একটা কথা বলল আর ওকে তাই করতে হবে।
______________________________________
মমতাজ বেগমের সাথে দেখা করতে এসেছে মৃত্তিকা। মমতাজ বেগম বিছানায় শুয়ে আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি অসুস্থ।
“বড়মণি, কি হয়েছে?”
মমতাজ বেগম ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ঘুম হচ্ছে না, তাই মাথাব্য°থা করছে অনেক।”
মৃত্তিকা গিয়ে উনার পাশে বসে। একমাসের বেশি সময় ধরে উনাকে প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খাওয়াচ্ছে মৃত্তিকা। একটু একটু করে মাত্রা বাড়িয়েছে, আর এটা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে এখন তা ছাড়া উনার ঘুমই হয় না। দুইরাত না দেয়ার ফলে উনি ঘুমাতে পারেনি।
মৃত্তিকা সহানুভূতির সুরে বলে,
“চা করে দিবো?”
“হ্যাঁ, দাও।”
মৃত্তিকা গিয়ে চা করে আনে। তবে এবারে তাতে আর ঘুমের ওষুধ মেশায়নি। মমতাজ বেগম চা পান করা শুরু করে।
মৃত্তিকা উনার মুখোমুখি বসে বলল,
“বড়মণি, একটা কথা বলি?”
“কি?”
মৃত্তিকা শেষবারের মতো চিন্তা করে, তারপর বলে,
“আমার মনে হচ্ছিলো, তাই কি°ট দিয়ে টেস্ট করেছি। (একটু থেমে) আমি প্রেগন্যান্ট বড়মণি।”
মমতাজ বেগম চা খাওয়া বন্ধ করে দেন। দরজার ওপাশ থেকে তানজিমও কথাটা শুনে। তানজিমের অবাক লাগে বিষয়টা। মমতাজ বেগমকে নিয়ে এতো কথা জেনেও মৃত্তিকা কি করে তাকে এটা বলতে পারলো?
মমতাজ বেগম মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক যেন তার পড়ছে না। তারপর হেসে বলল,
“এ তো খুশির খবর, গো°মড়া মুখে বলছো কেন?”
“ভ°য় হচ্ছে।”
“কেন ভ°য় নেই? এটা স্বাভাবিক। (একটু থেমে) ইমতিয়াজ জানে?”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“না।”
“তবে এখন জানিও না, কিছুদিন পর জানাও।”
“জি।”
তানজিম দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুদিন পর জানাবে কেন? কি হবে এই কিছুদিনে? তানজিম জানে শাফিন আসবে, পশুর মতো আবারো আ°ক্র°মণ করবে মৃত্তিকার উপর।
______________________________________
তিনদিন পর, শাফিনকে পাওয়া যায়নি, খোঁজাখুঁজি করেও না। তবে দেশের এয়ারপোর্ট ও অন্যান্য পোর্টে ক°ড়া নজরদারি চলছে। গালিব আর কাউকে হাতছাড়া করতে দিবে না। এতে আ°ইনের উপর থেকে ভরসা মানুষের উঠে যাবে।
“মৃত্তিকা প্রেগন্যান্ট।”
“তাতে এখন আমার কিচ্ছু আসে যায় না। এই মেয়েটা আমার লাইফটা শেষ করে দিয়েছে। এই মেয়েটাকে মা°রতে গিয়েই প্রথম আমি সন্দেহের জালে পড়েছি।”
“যা হয়েছে, হয়ে গেছে। রোমির কোনো খবর?”
“না, রোমি বাসায় নেই। কোথায় গেছে তা জানা যায়নি। (একটু থেমে) নার্গিসের বাসার আশেপাশে পাহারা জোরালো করেছে আহনাফ।”
“তারমানে তোমাকে ধরার সকল কাজ করা হয়েছে?”
“হুম।”
মমতাজ বেগম ও শাফিন ফোনে কথা বলছে। শাফিন একপ্রকার ফেঁ°সে গেছে, নিজেকে বাঁচানোর এতোদিনের সকল চেষ্টা তার ব্যর্থ হওয়ার পথে।
“অপরূপা কোথায়?”
মমতাজের কথায় শাফিন জবাব দেয়।
“হয়তো ধরা পড়েছে, জানা নেই। রাব্বি, বিল্লাল সবাইকে ধরে ফেলেছে।”
“আমি এখনো বাইরে আছি। এক কাজ করি, আমরা দুজন বেনাপোল দিয়ে ভারতে চলে যাই। আপাতত এছাড়া কোনো উপায় নেই।”
“বেনাপোল দিয়ে যাওয়া যাবে না, টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার যাবো আমরা।”
“আচ্ছা, যেভাবেই যাই, আমাকে জানাও।”
“তুমি বাসা থেকে বের হওয়ার বন্দোবস্ত করো।”
খুব স্বাভাবিক স্বরে কথা বলে মমতাজ বেগম ফোন রাখে, উনার ভাব দেখলে মনে হতে পারে এসব কোনো অন্যায় নয় আর উনি যা করেছে সবই ঠিক।
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠে। দরজা খুলে দেখে, মৃত্তিকা এসেছে।
মৃত্তিকা সোফায় বসে বলল,
“বড়মণি, কোথাও যাচ্ছিলে নাকি?”
ওর কথায় বড়সড় রকমের ভনিতা দেখা যাচ্ছে। মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে বলল,
“না তো।”
মৃত্তিকা ব্যাগ থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে বলে,
“ভেবেছিলাম কা°টা দিয়ে কা°টা তুলবো। এখন দেখলাম কা°টা দিয়ে কখনো কা°টা তোলা যায় না, কা°টা তুলতে অন্য যন্ত্রের দরকার হয়।”
মমতাজ বেগম কপাল কুঁচকে বলল,
“মানে? কি বলছো তুমি এসব? আর এই সিরিঞ্জ দিয়ে কি হবে?”
আর কিছু বলতে পারে না, উনার হাতে মৃত্তিকা সিরিঞ্জ ঢু°কিয়ে দেয়। এখানে শরীর অবশ হওয়ার এনে°স্থি°সিয়া ছিল, মমতাজ বেগম আর নড়াচড়া করতে পারে না।
“ভিতরে এসো।”
মৃত্তিকার কথায় তিনজন মেয়ে ভিতরে আসে। ওরা মমতাজ বেগমকে তুলে নিয়ে যায়।
পল্লবীর বাসায় এনে ফেলে উনাকে। পল্লবী জানে এসব। সে মৃত্তিকাকে ঘুমের ওষুধের নাম বলেছিল এবং আজকের এনে°স্থি°সিয়াটুকু উনি দিয়েছে। তিনজন মেয়ে নার্স, পল্লবীর কথায় এইটুকু সাহায্য করেছে।
“অনেক সুযোগ দিয়েছি আর তুমি ক্রমাগত তার অপব্যবহার করেছো। যাক অবশেষে তো একটু কাজে লাগবে।”
এখন অপেক্ষা চলবে কখন মমতাজ বেগম স্বাভাবিক হয়। কারণ শাফিন আর পরিবারের পূর্ব রহস্য সম্পূর্ণটাই এই একজন জানে।
______________________________________
বিকালে সারাহ্-কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছে আহনাফ, টমছম ব্রিজের কাছে ডি. এইচ হসপিটালে।
ডাক্তারের কথা অনুযায়ী সারাহ্ শারিরীকভাবে একদম ঠিক আছে, তবে ওর মানসিক যত্ন আরও বেশি নিতে হবে।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে সারাহ্ মাস্ক পড়তে পড়তে বলে,
“উনি কিভাবে জানলো, আমার মানসিক যত্নেরও বেশি নিতে হবে?”
“আরে (একটু হাসে) ওনাদের এসবের আন্দাজ আছে।”
“না, আপনি কিছু বলেছেন।”
“আরে না, আমি কিছু বলিনি আমি তো চুপই ছিলাম।”
সারাহ্ আশেপাশে তাকাতে তাকাতে একটু দূরে ডাক্তার আরিফাকে দেখে আহনাফকে টে°নে বলে,
“ওই যে ডাক্তার আরিফা।”
আহনাফ ওদিকে তাকায় না। সারাহ্-কে বলে,
“তাকিয়ে থেকো না।”
আহনাফ সিএনজি আনার অজুহাতে রাস্তা পার হয়ে অপরদিকে যায়। ওকে আসতে দেখে আরিফা জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করে, তবে পালাতে পারে না। আহনাফ তাকে ধরে ফেলে।
র্যাবের তিনজন কর্মকর্তা সিভিল পোশাকে কাছেই ছিল। আহনাফ কাউকে ধরেছে দেখে উনারা এগিয়ে আসে।
“ডা. আরিফা? নজর রাখছেন আমাদের উপর?”
আরিফা হাত ছাড়িয়ে নিয়েও যেতে পারে না। র্যাব সদস্যরা সামনে চলে আসে। আহনাফ বলে,
“উনাকেও নিয়ে যান, শাফিনের আরেকজন যাসুস।”
এখান থেকে র্যাব সদস্যরা সোজা আরিফাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এই কে°ইসের অপ°রা°ধীর অভাব নেই, এতো মানুষ মিলে কি এমন দরকারে নিরীহ জীবনগুলো শেষ করেছে?
আহনাফ সিএনজি নিয়ে সারাহ্-র কাছে এসে বলে,
“এখানে আর কত কত মানুষ আছে, তা এক আল্লাহ্ই ভালো জানে।”
সারাহ্ আলতো করে মাথা নাড়ে। সিএনজিতে বসে সারাহ্ বলে,
“আপনার মনে হয় শাফিন ধরা পড়বে?”
“অবশ্যই ধরা পড়বে।”
“এসব তো আগেও ট্রাই করেছে।”
আহনাফ ওকে দিকে তাকিয়ে বলল,
“তখন ওই অফিসাররা বাইরে ছিল, আর এখন তাদেরকেই আগে ধরা হয়েছে। (একটু থেমে) আর শাফিনকে পাওয়া মাত্রই ক্র°স ফা°য়ার করা হবে।”
সারাহ্ পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারে না। রোমি খন্দকারের কথাগুলো মিলালে, শাফিনকে আর যাই হোক দেশের আ°ইন আদালত দিয়ে কিছুই করা যাবে না। উনারা চেষ্টা করে দেখেছে, ব্যর্থ হয়েছে এবং এই কারণেই এতোদিন লুকিয়ে রেখেছে।
______________________________________
“তুমি বুঝদার মানুষ, আমার মামের বয়সী। সত্যি বলতে মামের পর তোমাকে আমি তার স্থানই দিয়েছিলাম। তবে তুমি সেটা মর্যাদা রাখোনি বড়মণি।”
মমতাজ বেগম চোখ তুলে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। মৃত্তিকা হাতঘড়িতে দেখে রাত আটটা বেজেছে। কপালে চুলগুলো সরিয়ে হিজাব বাঁধতে বাঁধতে বলে,
“বড়জোর আজকের রাতটা সময় দিতে পারি। তুমি চিন্তা করে দেখো।”
একটু নিচু হয়ে মমতাজ বেগমের মুখের সামনে গিয়ে বলে,
“মৃত্তিকার হিং°স্র°তা তুমি দেখো না, প্লিজ। তুমি দশজনকে খু°ন করতে পারো, কিন্তু তোমার একজনকে মা°রতে আমার কলিজা ছিঁ°ড়°তে হবে। তোমাকে খুবই ভালোবাসতাম, এটা তোমার থেকে আশা করিনি আমি। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে তুমি এসবে ছিলে।”
মমতাজ বেগম এখন একটু ঢুলছে, বোঝা যাচ্ছে এনে°স্থি°সিয়ার প্রভাব এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। মৃত্তিকা বুঝতে পারে উনার বয়সের তুলনায় এনে°স্থি°সিয়া বেশি পড়েছে।
মৃত্তিকা খাবারের প্লেট এনে মমতাজ বেগমকে একটু একটু করে খাইয়ে দেয় আর বলে,
“বো°মের পরিবর্তে গ্রে°নেট যেমন মা°রতে পারি, তেমন ফুলও ছুঁ°ড়তে পারি। এতো কিছু না করলে বুঝি হতো না?”
“তাহসিনা-তাহমিনা, ওরা আমার সংসার নষ্ট করেছে।”
মৃত্তিকা প্লেটটা পাশে রেখে বলল,
“ওরা কিভাবে তোমার সংসার নষ্ট করেছে?”
“লুৎফরের সাথে আমি ভালোই ছিলাম। আমাদের সংসারের সব ছিল। একটা জিনিসের কম ছিল, তা হলো সন্তান। আমি অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম, চায়নি লুৎফরের মা। ওকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিলো।”
একটু ঢুলে পড়তে নিলে মৃত্তিকা মমতাজ বেগমকে ধরে সোজা করে বসিয়ে পানি খাওয়ায়। মুখে পানির ছি°টা দিয়ে বলে,
“তাহমিনা-তাহসিনা তোমার মেয়ে না?”
“সৎ মেয়ে, লুৎফরের দ্বিতীয় বউ শারমিলির ঘরে বছর না ঘুরতেই তাহমিনা আসে, তারপর আসে তাহসিনা। আমি বুঝতে পারছিলাম লুৎফর শারমিলিকে অন্যরকম চোখে দেখছিলো, যেন দুজনের জন্য দুরকম নিয়ত তার। শারমিলিকে চোখের হারাতো, তারপর আমি শারমিলিকেই হা°রিয়ে দেই।”
“মে°রে ফেলেছিলে?”
“হ্যাঁ, যেনোতেনো ভাবে না (দুহাত তুলে বলে) মুখে বালিশ চে°পে। সবাই ভেবেছিলো সে ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যা°টাক করেছে।”
মৃত্তিকার আর সহ্য হয়নি, আর কোনো খুনের কথা সে শুনতে পারছে না। মমতাজের গালে একটা চ°ড় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“মেয়েগুলোকে ঐদিনই মে°রে দিতে, এত কষ্ট তবে পেতো না।”
পল্লবী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সকল কথা শুনে। মৃত্তিকা উঠে আসার সময় পল্লবীকে দেখে বলে,
“ফুপ্পিজান, ইমতিয়াজকে বা তোমার ভাইকে এর কথা জানিও না।”
পল্লবী মাথা নাড়ায় বলে,
“ঠিক আছে জানালাম না। তবে লুকিয়ে কয়দিন লাগবে?”
“আগে আমি শাফিনকে চাইছি। সে শীঘ্রই আসবে আমাকে মা°রতে আর তার বোনকে বাঁচিয়ে নিয়ে যেতে।”
মমতাজ বেগম ফ্লোরে পড়ে গিয়ে বলে,
“তুমিও তাহমিনার মত কাঁদবে, চিৎকার করে কাঁদতে, আর এবার আমি সামনে থাকবো।” একই কথা কয়েকবার বলতে থাকে মমতাজ।
মৃত্তিকা বাইরে আসলে পল্লবী ওর পিছু পিছু এসে বলে,
“মিউকো, প্রেগন্যান্সির মি°থ্যা খবরটা ইমতিয়াজ জানলে কিন্তু…”
কথা শেষ না করেই একটু ইতস্তত বোধ করে হাত নাড়ায় পল্লবী।
“ও জানবে না, মমতাজ এখানে আর শাফিন নিশ্চয়ই ইমতিয়াজকে জানাবে না।”
“সব ভালো থাকলেই ভালো। আমি চাইনা তোমার সংসারে কোনো সমস্যা হোক।”
মৃত্তিকা মুচকি হাসে। “তোমার সংসার” কথাটা খুব সুন্দর লেগেছে।
মৃত্তিকা বাসায় আসার বেশ কিছুক্ষণ পর ইমতিয়াজ আসে। মৃত্তিকা অ্যাডভোকেট বিথীর সাথে কথা বলছে। তার এখন আর কিছু জানার নেই, শাফিন কোথায়, কি করছে, কিছু না। কারণ মৃত্তিকা জানে শাফিন ওর কাছেই আসবে। মৃত্তিকা শুধু জানছে, বিথীর কাছে শাফিনের বি°রুদ্ধে আর কোন কোন প্রমাণপত্র আছে।
ইমতিয়াজ মৃত্তিকার পিছন থেকে চোখ ধরে বলে,
“সারপ্রাইজ আছে।”
মৃত্তিকা হেসে ওঠে,
“কি সারপ্রাইজ শুনি?”
“বললে নষ্ট হয়ে যাবে। আমার সাথে এসো।”
চোখ ধরেই মৃত্তিকাকে রুমে নিয়ে আসে ইমতিয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের এসব দৃশ্য দেখে অপরূপা। ওর জীবনটাও তো মৃত্তিকার মতো সাজানো গোছানো হতে পারতো। তবে কেন হয়নি?
মৃত্তিকাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে ইমতিয়াজ বলে,
“আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।”
“ওকে।”
মৃত্তিকার মুখে এখনো সেই অমায়িক হাসি।
ব্যাগ থেকে একজোড়া স্বর্ণের বালা বের করে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার দুহাতে বালা দুটি পরিয়ে দিয়ে বলে,
“এবারে চোখ খোলো।”
মৃত্তিকা চোখ খুলে অবাক হয়। সাধারণত সে স্বর্ণ পড়ে না। দুইকানে ছোট ছোট ডায়মন্ডের দুটি রিং, এছাড়া তার সমস্ত শরীরে বাঙালি মেয়েদের মতো গয়না নেই। সে এসব পছন্দ করে না। তবে আজকে ইমতিয়াজের এই বালা দুটি তার খুব পছন্দ হয়েছে।
মৃত্তিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়েচেড়ে নিজেকে দেখছে। ইমতিয়াজ ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সুখ সংবাদ তুমি শোনালে বেশি খুশি হতাম। এমনিতেও খুশি আমি।”
মৃত্তিকাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“নিজের খেয়াল রেখো আর বেবিরও।”
মৃত্তিকার চুল সরিয়ে ঘাড়ে চুম্বন করে ইমতিয়াজ ফ্রেশ হতে চলে যায়। মৃত্তিকার পুরো পৃথিবী এক জায়গায় থেমে গেছে। ইমতিয়াজ যদি জানতে পারে এসব কিছু মিথ্যা, তখন সে কিভাবে সহ্য করবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, ইমতিয়াজ জানলো কি করে?
মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করে। ইমতিয়াজকে হারানোর ভ°য় তার শরীরের প্রত্যেকটা শি°রা উপশি°রায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চলবে…..
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
চতুঃপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৪ পর্ব)
(আজকের পর্বটি গতানুগতিক পর্ব থেকে একটু ভিন্ন)
“বড়মণি কেমন আছে?”
মৃত্তিকার কথায় পল্লবী ঘাড় নাড়িয়ে বলে,
“এখন ভালোই আছে। তবে কিছুই খায়নি।”
“হুম।”
মৃত্তিকা খাবারের প্লেট নিয়ে ভিতরে আসে। মমতাজ বেগম ওকে দেখে বলে,
“এতো দরদ উ°তলে পড়তেছে কেন?”
মৃত্তিকা সামনে বসে রুটি ছিঁ°ড়ে উনার মুখের সামনে ধরে বলে,
“খাও, কালরাতে অর্ধেক খাইয়ে চলে গেলাম আর তো খাওনি।”
“খাবো না, মেহেরিবার মতো দরদ দেখাচ্ছো।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে জোর করে উনার মুখে রুটি দিয়ে বলে,
“তোমাকে আমি মা°রতে পারতাম, অপরূপার মতো হাত ভে°ঙে দিতে পারতাম। কিন্তু পারিনি। আমার দুর্বলতা হয়তো এখানেই, যাকে ভালোবাসি তাকে আ°ঘাত করতে পারি না।”
মমতাজ বেগম আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ খেতে থাকেন। খাওয়া শেষে বলেন,
“তোমার মনে হয় আমি কোনো অপ°রাধ করেছি? আমার তো মনে হয় না। বাবাকে কথা দিয়েছিলাম এই বংশের প্রতিটা র°ক্ত°কণাকে শেষ করে দিবো, তাই রিপাকে মে°রে ফেলেছি। আর শাফিন তো তোমাকেও মা°রবে।”
শান্তভাবে চেয়ে থাকে মৃত্তিকা। এতোটা সহজে সে নিজেকে নির্দোষ বলছে কিভাবে?
“তোমরা কি এ বংশের নও?”
মমতাজ বেগম মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, কিন্তু রিপার বাবা আর আমার বাবা আলাদা।”
“সেটা শাফিন আমাকে বলেছে। তবে মা°রতে কেন চাও? আমার নানুমণির সাথেও তোমার বাবা নি°কৃষ্ট আচরণ করেছিল, কিন্তু এতো রাগ কিসের?”
মমতাজ বেগম বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলা শুরু করে,
“খুলনায় গিয়ে জমিদার বাড়ি দেখেছিলে না? অনেক আগের জমিদারি ছিল আমাদের। ইংরেজ আমলেরও আগের জমিদারি, বুঝতে পারছো? অনেক পুরনো জমিদারি এটা। খুলনার বিশাল অংশ জুড়ে এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশসহ এই জমিদারি ছিল।
আমার দাদিমা বলেছিলেন, উনি যখন বিয়ের পর প্রথম খুলনায় আসেন, তখন জমিদারি দেখে উনি অবাক হয়েছিলেন। হওয়ারই কথা, আটদশ জন দাসী সব সময় তাকে পাহারা দিয়ে রাখতো, কিছু করা লাগতো না। একটা রানী রানী ভাব থাকতো তার মধ্যে। উনার দুই ছেলে ছিল, ইউসুফ আর ইউনুস। পরহেজগার মানুষ ছিলেন, তাই নবীদের নামে ছেলেদের নাম রেখেছিলেন।
এরপর ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়, আমাদের জমিদারিও ভাগ হয়। তবে পাকিস্তান আমলেও জমিদারি শেষ হয়নি, কিছুটা ছোট পরিসরে তখনও চলছিল।
আমার দাদা, জমিদার আকবরের ভয়ে তখনও ওই এলাকার লোকজন কাঁপতো। উনি ছেলেদের অনেক যত্নে বড় করলেও ইউসুফ কোনো ভালোমানুষ হলেন না। সে হলো এক ব°খাটে, কু°ৎ°সিত স্বভাবের মানুষ।
ইউসুফ নবীর নামে নাম হলেও নামের মর্যাদা সে রাখেনি। তার কাছে এলাকার কোনো মেয়ে নিরাপদ ছিল না। আমার দাদি এসবের জন্য অনেক শা°সন করেও কোনো লাভ হয়নি।
তাই তাকে দ্রুত বিয়ে করানো হলো এলাকার এক দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে। মেয়ের নাম ছিল জোসনা। রূপে গুণে পরিপূর্ণ মেয়েটার জীবন জেনেবুঝে নষ্ট করা হয়েছিল।”
মমতাজ বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“প্রতিরাতে মেয়েটির চিৎকারে পৈ°শা°চিক আনন্দ পেতো ইউসুফ। পি°শা°চের সন্তান কি আর ভালো হবে? হলো না। দুই সন্তান মমতাজ আর শাফিন, কেউই ভালো মানুষ হলো না। দুজনই খারাপ, জঘন্য হলো।”
মৃত্তিকা হা করে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক তার পড়ছে না। কি শুনছে সে?
“তবে শাফিন, মমতাজ কিন্তু একদিনে খারাপ হয়নি। তাদেরকে খারাপ করা হয়েছে।”
মৃত্তিকা নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“মামের নাম কেন পরিবর্তন করেছিলে?”
মমতাজ বেগম হেসে বলল,
“সম্মান রক্ষার্থে, রিপা যাতে বুঝতে না পারে সে কে? কি তার পরিচয়? কে তার বাবা-মা?”
মৃত্তিকার মনে এখনো হাজার প্রশ্ন, কিন্তু করতে পারছে না সে। গুছিয়ে আনতে কষ্ট হচ্ছে, আবার না জানি কি শুনতে হয়?
মমতাজ বেগম থম মে°রে বসে থেকে বলল,
“রিপার বাবার কথা শুনবে না? কি করেছিল সে?”
“বলো।”
“উনার নাম ছিল ইউনুস। উনি ছিলেন বাবার বিপরীত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। লেখাপড়ায় ছিল তার প্রচুর আগ্রহ। সাথে সাথে অ°স্ত্র চালনাও শিখেছে। পড়াশোনার জন্য লাহোরে থেকেছে বহুদিন, সেখানেই পরিচয় হয় পাকিস্তানি কন্যা মেহরিবার সাথে।
প্রেম আদান প্রদান না হলেও বিয়ে ঠিকই হয়, সাথে হয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা সংসার। পর্দাশীল মেহরিবাকে হুর বলে ডাকতো ইউনুস। তার চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী, তার প্রাণে সখায় পরিণত হয়।
স্ত্রী নিয়ে দেশে ফিরলে পিতা আকবর নিজের জমিদারি দুইভাগ না করে পুরো জমিদারি দিয়ে দেয় ইউনুস চাচাকে। শ°ত্রু°তার শুরু হয় তখনই।
১৯৭০ সালে জমিদারি হস্তান্তরের কিছুদিন পরই মারা যায় দাদা আকবর ও দাদিমা। রহস্যজনক মৃ°ত্যু হয় তাদের। কে মে°রেছিল? ইউসুফ আর জোসনা মে°রেছিল, আমার মা-বাবা খু°ন করেছিল।”
মমতাজ বেগম চেঁচিয়ে উঠে,
“আমরা দুজন তখনই দেখেছিলাম দুই দুইটা খু°ন। নিজেদের দাদা-দাদির খু°ন। আমাদেরকে বোঝানো হয় এটাই ঠিক। আমাদের বয়স কত ছিল জানো? আমার বয়স ছিল নয় আর শাফিনের সাত।”
মৃত্তিকা কেঁপে উঠলো। নিজের হাতে নিজের বাবা-মাকে খু°ন করাও সম্ভব? তাও জমিদারির জন্য?
মমতাজ বেগম অনেকক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর শান্ত গলায় বলেন,
“দেশে যখন যু°দ্ধাবস্থা, তখন একরাতে জন্ম হয় রাহা সুলতানার। তোমার মা, রাহা। আমরা দেখেছিলাম কি অপরূপ সুন্দরী ছিলো সে। মেহরিবাও সুন্দরী ছিল, তুমিও তার মতোই হয়েছো। (একটু থেমে) তবে জানো তো ওই রাতটা আমাদের জন্য সুখের হয়নি। দাদা-দাদিকে খু°নের জন্য বাবাকে সন্দেহ করে চাচা।
সাক্ষী হিসেবে শাফিনকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিল, তখন শাফিন সব স্বীকার করেছিল। ওই রাতেই বাবা-মাকে কা°রা°গারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। অকথ্য নি°র্যাতন চলেছিল বাবার উপর। মা তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল, তাই মাকে মা°রেনি। তবে মায়ের সামনে বাবাকে পাশবিক নির্যাতন করেছিল চাচা। চাচার এমন ভ°য়ংকর রূপ আগে কখনো দেখিনি।”
মমতাজ বেগম থেকে গেলেও মৃত্তিকার শোনার পিপাসা থামে না। জিজ্ঞাসা করে,
“তোমাদের আর কোনো ভাইবোন আছে?”
মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে না বোঝানো। তারপর বলল,
“না, আমার মায়ের ওই সন্তান, পৃথিবীর মুখ দেখেনি। মেহেরিবা চাচি প্রতিদিন উনাকে খাবার দিতে যেতো, কিন্তু মা ঠিকমতো খেতো না। কারণ খাবার শুধু উনার জন্য বরাদ্দ ছিল, আমার বাবার জন্য না। আমার বাবাকে একদিন পর পর খাবার দেওয়া হতো, তাও শুকনো শক্ত রুটি। এটা ছিল আমার চাচার অভিনব শাস্তি। একেবারে না মে°রে, তিলে তিলে মা°রতে চেয়েছিল। এর চেয়ে শি°র°শ্ছেদ বা ফাঁ°সি অনেক ভালো।
মা কাঁদতো এসব দেখে, এসবের জন্যই একদিন মা অসুস্থ হয়ে যায়। আমি দেখেছিলাম সেদিন মাকে।
সেদিন একটা কথা ভালোমতো বুঝেছিলাম, যত স্বা°র্থপর হবে, তত ভালো থাকবে। আর সত্য যত কম বলবে, প্রিয়জন তত কম হারাবে। যার যত টাকা, তার তত ক্ষমতা আর ক্ষমতা বেশি মানেই, তুমি যা চাইবে তাই করবে।
বাবা এই খবরটা পেয়ে সেদিন আমাদের দুজনকে বলেছিল এই পরিবারের একটা সদস্যকেও বাঁচতে দিবেন না উনি। যদি উনি না থাকে তবেও যেন ওরা না বাঁচে। আমার মনে আছে, বাবার কথা।
অনেকদিন বাবা মা আমাদের থেকে দূরে থাকে। চাচি আমাদের খেয়াল রাখলেও, বাবা মায়ের অভাব কি আর উনি দূর করতে পারবে?
প্রায় ছয় সাত মাস পর একদিন বাবা পালিয়ে যায়। বাবাকে খুঁজতে আশেপাশে অনেক লোক লাগানো হয়, ঠিক যেমন এখন শাফিনকে সবাই খুঁজছে।
এরমধ্যে আমরা খবর পাই দেশ স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে রমরমা থাকলেও আমাদের জমিদার বাড়ি শুনশান ছিল। চাচা আর চাচি আনন্দ করলেও, আমরা দুই ভাইবোন কিছুই করতে পারিনি। আমার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না, মা কারাগারে, আমাদের অবস্থাটা কেউ বোঝেনি।”
মমতাজ বেগম চুপ হয়ে যায়। মৃত্তিকা এসে উনার পাশে বসে বলল,
“বড়মণি, তোমার বাবার খোঁজ কিভাবে পেয়েছিলে?”
“খোঁজ পাইনি উনি এসেছিলেন।”
মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“রাহার বয়স তখন কেবল নয়মাস। প্রতিরাতের মতো একরাতে চাচা ইউনুস ঘরে ফিরে মেহরিবার সাথে গল্পে মশগুল ছিল। মেহরিবা তখন তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিজেদের সুন্দর সময়টাকে কাটাতে ছাদে যায় ওরা। চাঁদনি রাত্র জ্যোৎস্নাবিলাস সুখকর হয় না।
বাবা এসে হাজির হয়, একা নয়। সাথে ছিল বাড়ির সব চাকরবাকর আর পাহারাদাররাও। চাচাকে সেইরাতেই মেহরিবার সামনেই কু°পিয়ে হত্যা করা হয়। আমরা তখন সামনে ছিলাম, রাহা ছিল। আমি নিজে দেখেছিলাম কিভাবে বাবা রাম°দা দিয়ে চাচাকে কু°পিয়েছিল। বড় হা°তুড়ি দিতে থেঁ°তলে দিয়েছিল উনার মাথা।
চাচির চিৎকার আজও আমার কানে বাজে। ইউনুস, ইউনুস করে আকুতিভরা চিৎকার করেছিল। বাবা শুনেনি।
চাচার পর অন্তঃসত্ত্বা মেহরিবার উপর চালানো হয় শারিরীক নি°র্যা°তন। সবসময় পর্দার আড়ালে থাকা মেহরিবাকে সকলের সামনে বস্ত্র°হ°রণ করে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। আমার জীবনের নি°কৃষ্টতম দৃশ্য সেদিন দেখেছিলাম। আমার বাবা আমারই চোখের সামনে আমারই চাচিকে রে°প করেছে। শাফিন ছিল সেখানে, চাচির চিৎ°কারে সে হেসেছিল।
বারবার শারিরীক নির্যাতনে র°ক্ত°ক্ষরণে মা°রা যায় চাচি মেহেরিবা। তার খোলা চোখদুটো দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে। একটা অধ্যায় যেন মুছে গিয়েছিল। জমিদারিতে একটা কালো দাগ পড়েছিল।”
“থামো, থামো।”
বলে মৃত্তিকা সরে গেল। চিৎকার করে কেঁদে উঠে সে। এতোটা নি°কৃষ্ট কেউ কিভাবে হতে পারে?
অনেকক্ষণ পর মৃত্তিকা শান্ত হয়। মমতাজ বেগম বলেন,
“ঘৃ°ণা হচ্ছে না আমাকে?”
মৃত্তিকা কান্নাভরা কন্ঠে জবাব দেয়,
“এই দৃশ্য দেখেও তুমি কি করে এতোটা নিচে নামতে পারলে?”
মমতাজ বেগম একটু নড়েচড়ে বসে বলল,
“আমার চেয়েও খারাপ শাফিন হয়েছে, সেদিন চাচির চি°ৎ°কারে যেখানে সবাই কাঁদছিলো, সেখানে সে হেসেছিল। সেদিন থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। মেয়েদের এই কষ্টের চিৎকারটা সে উপভোগ করতো।”
মৃত্তিকার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। মমতাজ বেগম বলেন,
“সেদিন এসব দৃশ্য দেখেছিল যেসব চাকররা, তাদেরকেও হ°ত্যা করেছিল বাবা। রাহাকে হ°ত্যা করতে দেয় না আমার মা, বেঁচে যায় রাহা। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রিপা। রাহা সুলতানা থেকে রিপা বেগম।
রাতারাতি জমিদারি দখল করে বসে বাবা ইউসুফ। তবে প্রকৃতি বাবাকে এর যোগ্য শা°স্তি দিয়েছিল। ট্রেনে কা°টা পড়ে কিছুদিন পরই মারা যায় সে। আমার মা জোসনা আমাদের সাথে রিপাকেও বড় করতে থাকে। রিপা জানতেও পারে না, তার মা বাবার সাথে কি হয়েছিল। সে জানতো তার বাবা ট্রেনে কা°টা পড়ে মা°রা গেছে।”
মৃত্তিকার চোখের সামনে ঘটনাগুলো ভাসছে। সে দেখছে আকবরের মৃ°ত্যু, ইউসুফের উপর হওয়া নি°র্যা°তন, জোসনার সন্তান হারানোর দুঃখ, ইউনুসের করুন মৃ°ত্যু, মেহেরিবার চি°ৎ°কার, জোসনার মাতৃসুলভ আচরণে রাহার বেঁচে যাওয়া।
সব যেন একই মালার একেকটি মুক্তা, সুতোটায় টা°ন পড়তেই সবগুলো টপটপ করে ঝরে পড়লো।
মমতাজ বেগমের কথায় মৃত্তিকার ঘোর কাটে,
“শাফিন তার বাবার মতোই হলো। তারও প্রতিরাতে মেয়ে চাই, নতুন নতুন মেয়ে। শাফিন মেয়েদের জীবন নিয়ে পুতুল খেলায় মেতে থাকে, সাথে চলে জুয়ার কারবারি। জমিদারি শেষ হতে থাকলো। একপর্যায়ে দেখা যায়, যাও কিছু আছে তা শাফিনের পেছনেই খরচ হচ্ছে।
১৯৮৮ সাল, রিপা তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। যৌবনের রূপ তখন তার সর্বাঙ্গে। মায়ের মতো রূপবতী তরুণী রিপার দিকে নজর যায় শাফিনের। প্রতিটা মুহূর্ত শাফিনের নোং°রা চিন্তায় রিপা।
সবার আগে বিষয়টা মায়ের নজরে পড়ে। মা কখনো চায়নি রিপার ক্ষতি হোক। তখন মায়ের সিদ্ধান্তে ম্যাট্রিকের পর পরই রিপাকে কুমিল্লা পাঠানো হয়।
এই ঘটনায় শাফিন রেগে যায়। রিপাকে নিজের করার বাসনা তার বাড়তে থাকে। এদিকে রিপা তখন ইন্টার পাশ করে অনার্সে পড়াশুনা করছে।
কিছুদিন পর শাফিনকে নিয়ে আমরা ঢাকায় চলে আসি। গ্রামে ওর এতোই বদ°নাম হয়েছিল যে ওখানে থাকাই দুষ্কর ছিল। শাফিন চাকরি নেয়, তারপর ওর বিয়ে হয় দেলোয়ারার সাথে।
তবে গোপনে সে অন্ধকার জগতের বিজনেসের সাথে যুক্ত হয়। হুমায়ুন নামের একজন তখন থেকেই ওর সঙ্গী ছিল, তবে বিজনেস দখলের জন্য সে হুমায়ুনকেও মে°রে ফেলেছিল।”
মমতাজ বেগম একটু বিরতি নিয়ে আবারো বলা শুরু করে,
“রিপা মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো। শাড়ির ভাঁজে তখনও তার ভরা যৌবনের ছোঁয়া। একবার বাড়িতে আসে তোমার বাবা শরীফের সাথে, দুজনে নাকি বিয়ে করে নিয়েছে। শরীফ তখন ঢাকা মেডিকেলে ইন্টারশীপ করছিল।
শাফিনের জন্য এটা কোনো ভালো খবর হলো না। শরীফ-রিপার সংসার ভা°ঙার জন্য উঠে পড়ে লাগে সে। তবে নিজের স্ত্রীর সামনে একটা মুখোশ পড়ে নেয় সে। ভালো মানুষের মুখোশ। সুরভি আর দেলোয়ারার জন্য যেন তার কত ভালোবাসা।
যখন তোমার জন্ম হয়, তখন রাগে শাফিন আমাদের মাকে মা°র°ধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, মাকে আর খুঁজে পাইনি। জানি না বেঁচে আছে নাকি ম°রে গেছে। সব ঘটনা জেনেও আমি চুপ ছিল। অ°ন্যায়কে শুরু থেকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম আমি।
শাফিন অবশেষে সফল হয়। শরীফের রাগকে কাজে লাগিয়ে রিপার ডি°ভো°র্স হয়। তবে রিপা এবারে আর দেশে থাকে না। তোমাকে নিয়ে পাড়ি দেয় ইতালিতে। আর দেশে শাফিন হয় ঢাকার এক বড় অফিসের কর্মকর্তা আর একজন সাধারণ ব্যবসায়ী।”
একটু নিচুস্বরে মমতাজ বেগম বলেন,
“শাফিন কিন্তু এই দিনগুলোতে থেমে থাকেনি, একের পর এক মেয়ের জীবন সে শেষ করেছে। তবে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর সে আর এসব করেনি, সে তখন…”
মমতাজ বেগমের কথার মাঝেই মৃত্তিকা বলে,
“অপরূপার মতো মেয়েদের কাছে যেতো, আর অপরূপাকে বিয়ে করে।”
“হুম।”
মৃত্তিকা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে। লাইটের আলোয় হাতের বালাদুটো চকচক করছে তার। তার বুক চি°ড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
মানুষের মধ্যে দুইটা সত্ত্বা থাকে, একটা ভালো আর অন্যটা খারাপ। কিন্তু যখন মানুষটা ভালো সত্ত্বাকে মে°রে ফেলে, তখন খারাপটা তার রক্তনালি দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। কেউ জন্ম থেকে খারাপ নয়, পরিস্থিতি তাকে খারাপ হতে বাধ্য করে। সে হতে পারে অপরূপা, হতে পারে মমতাজ বেগম কিংবা শাফিন।
চলবে…..